জ্বলদর্চি

বিশ্বশান্তির দূত হাঙ্গেরিয় পদার্থবিজ্ঞানী লিও ৎজেলার্ড/ পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ১১
বিশ্বশান্তির দূত হাঙ্গেরিয় পদার্থবিজ্ঞানী লিও ৎজেলার্ড 

পূর্ণ চন্দ্র ভূঞ্যা

লং-আইল্যান্ডের দক্ষিণতম প্রান্তের একটি ছোট্ট জনপদ 'প্যাচক' (Patchogue)। নিউইয়র্ক সিটির লোকজনের খুব জনপ্রিয় একটি ট্যুরিস্ট প্লেস। শহর থেকে দূরে উইক-এন্ডে নিরিবিলি সময় কাটানোর আদর্শ জায়গা। ঝিনুক, জাহাজের অট্টালিকা, মাছ-ধরা এবং গ্রীষ্মকালীন ট্যুরিজমের জন্য বিখ্যাত গ্রামটি। এমন জায়গায় জীবনের শেষ সময়টুকু নির্ঝঞ্ঝাটে অতিবাহিত করছেন এক প্রৌঢ় বিজ্ঞানী। অথচ বিংশ শতাব্দীর প্রথমে একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কারে বিশ্ব তোলপাড় করে দিয়েছেন তিনি। তাঁর আবিষ্কার পদার্থবিজ্ঞান শাখায় নতুন উদ্দিপনাময় সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বহু অজ্ঞাত রহস্যের স্থায়ী সমাধানের উপায় বাতলে দিয়েছে তাঁর আবিষ্কার। সেজন্য রাজনীতি এবং বিজ্ঞানের তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্ব সমীহ করে চলেন এ হেন প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিককে। তিনি আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯―১৯৫৫)। আর সে-কথা ভাল মতো জানেন হাঙ্গেরিয় নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী লিও ৎজেলার্ড। সেজন্যই নিরুপায় হয়ে ছুটে এসেছেন এতদূর প্যাচক গ্রামে। পারলে তিনিই পারবেন এতবড় অন্যায় রুখতে, নতুবা কেউ পারবেন না এতবড় ধ্বংসের হাত থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করতে। 

   ইতিমধ্যে বর্ষীয়ান বিজ্ঞানী নীলস বোর-এর পত্র, ফ্রাঙ্ক রিপোর্ট, ফিজিক্সের পোপ ফার্মি'র চিঠি― কোনকিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না মনুষ্যকৃত একটি দুর্ঘটনা। একটা চেষ্টা করলেন ৎজেলার্ড। সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায়। গাড়ি চালিয়ে একাই চললেন লং-আইল্যান্ডের দক্ষিণতম প্রান্তে। এবার বাড়িটা চিনতে অসুবিধা হল না তাঁর। এবং বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকও সহজে চিনতে পারলেন একদা তাঁর প্রিয় ছাত্রটিকে। শেষবার দেখেছিলেন ছয় বছর আগে। ১৯৩৯ সালে। এই প্যাচক-এ। এখন আবার ১৯৪৫-এ। বাড়ির বৈঠকখানায় প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিককে মনের সব কথা খুলে বললেন ৎজেলার্ড। সব শুনে আইনস্টাইন তক্ষুণি রাজি হয়ে গেলেন পুনরায় প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি লিখতে। চিঠি লেখা হল ২৫ মার্চ ১৯৪৫ তারিখে। এমন কী ঘটনা? যার জন্য তড়িঘড়ি প্যাচক-এ ছুটে গেলেন ৎজেলার্ড এবং মধ্যস্থতা করতে রাজি হয়ে গেলেন আইনস্টাইন!
         
   বিংশ শতাব্দীর মধ্য তিরিশ ভাগ সদ্য অতিক্রম করেছে তখন। হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে পরমাণু বোমা খেলাঘরের দিকে একঘর, দু'ঘর করে শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছেন বিশেষজ্ঞরা। বাকি শুধু অন্তিম ধাপ― 'নিউক্লিয়ার চেইন রিঅ্যাকশান'। নিউক্লিয় চক্রাবর্তন অবস্থা। এটা সম্পূর্ণ করতে পারলে অনিবার্য ফল অত্যন্ত শক্তিশালী এক বিস্ফোরক হাতের মুঠোয় এসে যাওয়া। যে কেউ তখন বানিয়ে ফেলতে পারবে পরমাণু বোমা। আর তাতে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে পৃথিবী! তখনও বিজ্ঞান গবেষণা তার স্বকীয়তা খুইয়ে কূটনীতির দাস বনে যায়নি। আর পণ্ডিতরা নিজেরাই সন্দিহান― এর পরের ধাপ অ্যাটম বোমা কি-না! এই যা রক্ষে! এমন সময় সিঁদুরে মেঘ দেখলেন হাঙ্গেরিয় পদার্থবিজ্ঞানী লিও ৎজেলার্ড। যেভাবে পরমাণুর হৃদয় বিদীর্ণ করে একের পর এক অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারে ইউরোপীয় ভূখণ্ডে উৎফুল্ল হচ্ছেন বিজ্ঞানীকূল, কী জানি অদূর ভবিষ্যতে হয়তো অ্যাটম বোমা তৈরির মিশনে নেমে পড়বে কিনা ইউরোপের কোনও দেশ; কে জানে? হলফ করে কেউ বলতে পারে না। ভয় বিশেষ করে জার্মানিকে। সেখানে তখন রাজত্ব কায়েম করেছেন একমেদ্বিতীয়ম স্বৈরাচারী শাসক হিটলার। নিত্য নতুন আদেশ জারি করে ইউরোপে ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছেন। তাঁর লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে মধ্য ইউরোপের ওপর। সে এক অস্থির সময়! কী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, কী পরমাণুর অন্তরে! 

   বিজ্ঞানী ৎজেলার্ড নিজে বিতাড়িত ভিয়েনা থেকে! ইংল্যান্ড হয়ে এখন তিনি আশ্রয় নিয়েছেন আমেরিকায়। তাঁর অপরাধ তিনি ইহুদি! এতসব করেও অ্যাটম বোমা ঠেকানো মুসকিল। তাঁর ধারণা; এখনও পরিস্থিতি নাগালের বাইরে বেরিয়ে যায়নি। চেষ্টা করলে রুখে দেওয়া যায় সভ্যতা ধ্বংসের সমস্ত ঘৃণ্য প্রচেষ্টা। তার জন্য একজোট বাঁধতে হবে সব বৈজ্ঞানিককে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে সবাইকে। যে-যার নিজ নিজ আবিষ্কার ল্যাব‍রেটরির চার দেওয়ালের ভেতরে সীমাবদ্ধ রাখবে। কাক-পক্ষীও যেন ঘুনাক্ষরেও টের না পায়; ল্যাব‍রেটরির ভেতর কী হচ্ছে না হচ্ছে! তাহলে ঠেকিয়ে রাখা যাবে ভয়ঙ্করতম মারণাস্ত্রটির উদ্ভাবন। এমন দাবি নিয়ে ৎজেলার্ড হাজির হলেন পোপের দরবারে― ফিজিক্সের পোপ, এনরিকো ফার্মি (১৯০১―১৯৫৪)। ফ্যাসিস্ট ইতালির জীবনযাত্রায় বীতশ্রদ্ধ ফার্মি ১৯৩৮-এ নোবেল পুরস্কার গ্রহণের অছিলায় দেশত্যাগী হলেন। এখন তিনিও আমেরিকায়। ফার্মিকে সব কথা খুলে বললেন ৎজেলার্ড। যেমন করে হোক এ দুর্দৈবকে রুখতে হবে।
        
   এর দিন কয়েক পরে ফার্মির বাড়িতে বসল বৈঠক। ফার্মি আর ৎজেলার্ড ছাড়া উপস্থিত আছেন উইগনার (১৯০২―১৯৯৫), টেলার (১৯০৮―২০০৩) ও গ্যামো (১৯০৪―১৯৬৮)। সবার সামনে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরলেন ৎজেলার্ড। বক্তব্যের শেষে ৎজেলার্ড একখানা জার্মান পত্রিকা মেলে ধরলেন টেবিলে। সবাই ঝুঁকে পড়ল তার উপর। তাতে জানা গেল গত তিরিশে এপ্রিল ১৯৩৮-এ ছ'জন জার্মান নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী সম্মিলিত হয়েছেন সরকারি উদ্যোগে। উদ্দেশ্য নিউক্লিয়ার শক্তির সন্ধান। হিটলারের এতটা বেপরোয়া ভাব কী তাহলে পরমাণু বোমার জন্য! সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা অবশ্য সে-ই ইঙ্গিতবাহী। ইতিমধ্যে জার্মান অধিকৃত চেকোশ্লোভাকিয়ার খনি থেকে হঠাৎ ইউরেনিয়াম বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম থেকে বানানো যাবে পরমাণু বোমা! আকাশে বাতাসে উড়ছে সে-খবর। সেজন্য এমন হুইপ জারি নয়তো? কেননা বেশ কিছু দিন ধরে জার্মান বিশেষজ্ঞদল আর কোনও আর্টিকেল ছাপতে পাঠাচ্ছেন না কোনও সায়েন্স ম্যাগাজিনে। নাৎসি জার্মানি যেন রহস্যাবৃত ঘন প্রহেলিকার জাল বিস্তার করে চলেছে নিজের চারদিকে। চরম গোপনীয়তা তার-ই অঙ্গ!

   এদিকে ফার্মির অ্যাপার্টমেন্টের ঘরোয়া বৈঠকে দুটো সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এক, বিজ্ঞানীরা স্বতঃপ্রণোদিত সেনসর বসাবেন তাদের ল্যাব‍রেটরির উপর। গোপনীয়তা বজায় রাখবেন। সে না-হয় হল। কিন্তু নাৎসি জার্মানরা যদি মারণাস্ত্রের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে থাকে তাহলে তাদের আটকানো মুসকিল হবে। সেক্ষেত্রে একান্ত জরুরী আরেকটি সমান্তরাল পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র। যে-রাষ্ট্র জার্মানির চোখে চোখ রেখে প্রত্যুত্তর দিতে পারবে। তাই দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যে-দেশ বাস্তুচ্যুত বৈজ্ঞানিকদের আশ্রয় দিয়েছে তার সরকারকে অবহিত করা আশু প্রয়োজন। একদিন ঘরোয়া বৈঠকের সেই পঞ্চপাণ্ডব সাক্ষাৎ করলেন আমেরিকার নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল হুপার-এর সঙ্গে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! কোনও লাভ হল না। হুপার এক কান দিয়ে শুনলেন, অন্য কান দিয়ে বের করে দিলেন। গুরুত্ব দিলেন না। ঘটনাচক্রে জার্মানির পরমাণু প্রকল্পের মাথা হাইজেনবার্গ (১৯০১―১৯৭৬) এসময় এসেছেন আমেরিকায়। তাঁকে আমেরিকায় আটকানোর অনেক চেষ্টা করলেন ফার্মি আর ৎজেলার্ড। সে সম্ভাবনাও ফলপ্রসূ হল না। সে-প্রচেষ্টাও ব্যর্থ। সান্ধ্য-আসরে এ নিয়ে প্রায়শই আলোচনা হচ্ছে পাঁচ বৈজ্ঞানিকের; কীভাবে মার্কিন বড়কর্তাদের সমস্যাটার বিষয়ে অবগত করানো যায়? শেষে ৎজেলার্ড বললেন, শ্রদ্ধেয় আইনস্টাইনকে বল্লে কেমন হয়! আইনস্টাইন যদি যুদ্ধসচিব হেনরি স্টিমসন বা প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি লিখতে সম্মত হন, তাহলে সমস্যাটার একটা হিল্লে হলেও হতে পারে! একবাক্যে মেনে নিলেন সবাই। 

   ১৯৩৯-এর জুলাই মাসের এক রৌদ্রতপ্ত দিনে উইগনার ও টেলারকে সঙ্গে করে ৎজেলার্ড পৌঁছে গেলেন লং-আইল্যান্ডের দক্ষিণতম প্রান্তে প্যাচক গ্রামে। প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিকের ডেরায়। সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যায় ব্যস্ত আইনস্টাইন তখন যেন অন্য জগতের। ইউরেনিয়ামের চেইন রিঅ্যাকসনের কথা তাঁর কখনও মনেই আসেনি। 'ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি' নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণায় বিভোর তিনি। জগতের বাকি বিষয়ে ধ্যান দেওয়ার মতো সময় তাঁর নেই। ৎজেলার্ড-এর কথায় তিনি রাজি হলেন মধ্যস্থতা করতে। আইনস্টাইনের দস্তখত করা সেই চিঠিটা আজ বিশ্ব-ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। প্রবীণ বিজ্ঞান-তপস্বীর কথা সেদিন ফেলতে পারেননি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। ডেকে পাঠালেন তাঁর মিলিটারি অ্যাটাশে জেনারেল 'পা' ওয়াটসনকে।
     
   আইনস্টাইন-প্রেরিত চিঠির গোছা তাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরে প্রেসিডেন্ট উচ্চারণ করলেন ঐতিহাসিক উক্তি, '―Pa! This requires action!' অর্থাৎ 'পা! এটার ব্যবস্থা হওয়া দরকার!' শুরু হয়ে গেল 'ম্যানহাটন-প্রোজেক্ট'। অ্যাটম বোমা তৈরির গোপন মিশন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আট থেকে নয়টি কেন্দ্রে একযোগে চলছে গবেষণা। সেই পঞ্চপাণ্ডবসহ কয়েক হাজার বৈজ্ঞানিক যুক্ত এ হেন প্রকল্পে। পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে সমাধানের চেষ্টা চলছে। তার ভিতরে তিনটি পথ ইউরেনিয়াম বোমা তৈরির প্রচেষ্টা আর দুটি প্লুটোনিয়াম বোমার। এই প্লুটোনিয়াম নিয়ে পরীক্ষা হচ্ছে শিকাগো কেন্দ্রে। সর্বময় কর্তা আর্থার কম্পটন (১৮৯২―১৯৬২)। ইটালিয়ান ফার্মি, জার্মান ফ্রাঙ্ক (১৮৮২―১৯৬৪) এবং স্বদেশীয় উইগনার-এর সঙ্গে শিকাগো ইউনিভার্সিটির মেটালর্জিক্যাল ইউনিটে অংশগ্রহণ করলেন ৎজেলার্ড। কিছু দিনের মধ্যেই জুটল চিফ ফিজিসিস্টের তকমা। ১৯৪২-এর ২রা ডিসেম্বর ইটালিয়ান ফার্মি'র সঙ্গে তৈরি করলেন Chicago Pile-1, বিশ্বের প্রথম নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকট‍র। এখানে নিস্তড়িৎ নিউট্রন কণা দিয়ে প্লুটোনিয়ামের চেইন বিক্রিয়া ঘটানো হচ্ছিল। তারপর বোমা তৈরি করতে ফার্মি চলে যান লস অ্যালামসের কারখানায়। ৎজেলার্ড রয়ে গেলেন শিকাগোতে। ইউনিভার্সিটি ল্যাবে ইউরেনিয়াম থেকে বেশি বেশি প্লুটোনিয়াম বের করবার জন্য। ১৯৪৩-এর মার্চে আমেরিকার 'নিরপেক্ষ নাগরিক' হলেন ৎজেলার্ড। এভাবে বিভিন্ন সেন্টারে হাজার হাজার বিজ্ঞানীর একটানা ছ'বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১২৫ বিলিয়ন ডলার (এক বিলিয়ন = ১০০ কোটি) ব্যয়ে প্রায় তৈরি হয়ে এল তিনটি অ্যাটম বোমা― ট্রিনিটি, লিটল-ম্যান ও ফ্যাট-বয়। ১৯৪৫-এর গ্রীষ্মে।
           

   এমন সময় বিশ্ব-রাজনীতিতে পাশার দান পুরো উল্টে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজিত; তার অবস্থা সঙ্গীন। বার্লিনের পতন এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা! জাপানও নতজানু; রাশিয়ার মধ্যস্থতায় সারেন্ডার করতে প্রস্তুত! এ সময় পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের আর যৌক্তিকতা কী? ইত্যাবসরে জার্মান অ্যাটম বোমা প্রকল্পের কাগুজে-বাঘের সংবাদও চাউর হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে; পরমাণু বোমা তৈরির ধারেকাছে কোনও দিন পৌঁছয়নি জার্মান বিশেষজ্ঞদল! তাহলে কী করা হবে বোমা তিনটি দিয়ে? রাষ্ট্র পরিচালকদের হাতে এমন অস্ত্র এসে যাওয়ার অর্থ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো। এবার তাহলে কী উপায়?

   আত্মগ্লানির আগুনে দগ্ধ হতে শুরু করেছেন উদ্বাস্তু বৈজ্ঞানিকের দল; বিশেষত ৎজেলার্ড। ১৯৪৫-এর বসন্তে তিনি রীতিমত বিচলিত হয়ে পড়েন। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছেন, কার ভয়ে তবে আগ বাড়িয়ে সেদিন পরমাণু বোমা বানানোর প্রস্তাব পেড়েছিলেন ৎজেলার্ড? এ তো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ! আত্মগ্লানি কুরে কুরে খাচ্ছে তাঁকে। তিনিই সর্বপ্রথম উপযাচক হয়ে আমেরিকার নিউক্লিয়ার শক্তির পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে তাঁর অসার বক্তব্য, অকাঠ্য যুক্তি শুনতে বাধ্য করিয়ে ছিলেন। তাঁর ধারণা যে কত ভ্রান্ত, কত ঠুনকো ছিল; এখন তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র মানসপটে চাক্ষুষ করে এখন আবার তিনি শিউরে উঠছেন। নিজের ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে সমগ্র সভ্যতার অস্তিত্ব সংকটের কারণ হয়েছেন তিনি। বর্তমান যুদ্ধে এ অস্ত্র ব্যবহৃত হলে লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যুর জন্য পরোক্ষে তিনি দায়ী হবেন। তাই সভ্যতার উপর বোমা বর্ষণ যাতে না হয়; তার জন্য প্রাণপাত আরম্ভ করলেন তিনি। 

   এর আগে, ১৯৪৪-এর ছাব্বিশে অগাস্ট প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিজ্ঞানী নীলস বোর। একটি সুলিখিত স্মারকলিপি তুলে দেন প্রেসিডেন্টের হাতে। স্মারকলিপির বিষয়বস্তু: নিউক্লিয় শক্তির শান্তিপূর্ণ প্রয়োগের অনুরোধ। বিবেচনার জন্য নিজের টেবিলের ড্রয়ারে সেটি সযত্নে গুছিয়ে রেখেছিলেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু কই! কোনও ব্যবস্থা তো চোখে পড়ছে না! এত করেও যখন আটকানো যাচ্ছে না দুর্ঘটনা; নিরুপায় ৎজেলার্ড একাই ছুটলেন লং-আইল্যান্ডের দক্ষিণতম প্রান্তে; আইনস্টাইনের বাসায়। প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করলেন। এবারও বর্ষীয়ান বৈজ্ঞানিক রাজি হলেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে পত্র লিখতে। মাননীয় প্রেসিডেন্টকে পরমাণু অস্ত্রের বিধ্বংসী বিপদের কথা সবিস্তারে বর্ণনা করে চিঠি পোষ্ট করলেন পঁচিশে মার্চ ১৯৪৫। কিন্তু দুর্ভাগ্য ৎজেলার্ড-এর! সে-চিঠি পৌঁছল হোয়াইট হাউসে, এপ্রিলের বারো তারিখে। নিয়তির কী পরিহাস! চিঠির প্রাপক মারা গেলেন তার আগের দিন, এগারো এপ্রিল। ফলে চিঠিখানা রাখা ছিল না-খোলা অবস্থায়, সদ্য প্রেসিডেন্ট স্থলাভিষিক্ত হ্যারি ট্রুম্যানের টেবিলে। অপাত্রের হাতে।

   এখন কী করবেন ৎজেলার্ড? দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাঁর। তাই প্রেসিডেন্ট হ্যারী ট্রুম্যানের সঙ্গে সাক্ষাতের শেষ চেষ্টা করলেন ৎজেলার্ড। অতিব্যস্ত প্রেসিডেন্টের সময় যে বাড়ন্ত! সাক্ষাৎপ্রার্থীকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন ক্ষমতাশালী ডেমোক্রেট সেনেটর জেমস বার্নেসের নিকট। ৎজেলার্ড-এর সাক্ষাতের এক সপ্তাহের মধ্যে সেক্রেটারি অব স্টেট পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন সেনেটর বার্নেস। ৎজেলার্ড মানবিকতার দোহাই পেড়েও কাবু করতে পারলেন না সেনেটরকে। ভগ্ন মনোরথে লস অ্যালামসে ফিরে এলেন ৎজেলার্ড। দেখলেন, সেখানে তাঁর সতীর্থরা দ্বিধাবিভক্ত। এক দল বোমা বিরোধী। এই দলের নেতা অভিজাত জার্মান নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট জেমস ফ্রাঙ্ক এবং সক্রিয় কর্তা ৎজেলার্ড। ১৯৪৫-এর জুনে ফ্রাঙ্ক একটি রিপোর্ট তৈরি করলেন। রিপোর্টে বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের ওপর যেন অ্যাটম বোমা নিক্ষেপ না করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এতে সই দিলেন ৎজেলার্ড, ফ্রাঙ্ক, রোবিনোভিচ এবং আরও চারজন। অন্য দল ওপেনহেইমার (১৯০৪―১৯৬৭)-এর নেতৃত্বে শত্রুকে সমুচিত জবাব দিতে প্রস্তুত। হিংসার বদলা আরও হিংসা! রক্তের বদলে চাই আরও রক্ত! স্বাভাবিক ভাবেই এই দ্বিতীয় দলের পাল্লা ভারী। ইন্টেরিম কমিটির বাকি তিন সদস্য ফার্মি, কম্পটন (১৮৯২―১৯৬২) আর লরেন্স (১৮৯০―১৯৭১) বোমা নিক্ষেপের পক্ষে। শেষদিকে যদিও ফার্মি তাঁর মত পরিবর্তন করেছিলেন। তিনি এবং মার্কিন বিজ্ঞানী ইসিডর রবি (১৮৯৮―১৯৮৮) একটি যৌথ পত্র লিখেছিলেন প্রেসিডেন্টকে। তাদের বক্তব্য, "এই অস্ত্রের বিধ্বংসী ক্ষমতার কথা মনে করে আমরা পরামর্শ দিচ্ছি নৈতিক কারণে এর প্রয়োগ আপনি বন্ধ করুন।"
       

   ইতিমধ্যে অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণের দামামা বেজে উঠেছে। বোমা নিক্ষেপের প্রশাসনিক ছাড়পত্র গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে গেছে। তারই অবশ্যম্ভাবী পরিনতি― ১৯৪৫-এর ৬ অগাস্ট তারিখে হিরোশিমায় আর ৯ অগাস্ট তারিখে নাগাসাকির ধ্বংসলীলা। তেজস্ক্রিয় আগুনের লেলিহান শিখায় মনুষ্যত্ব পুড়লেও সম্রাট নীরো (পড়ুন ট্রুম্যান) বোধহয় সেদিন সানন্দে বেহালা বাজিয়েছিল!

   পরমাণু বোমার সাফল্যে লস অ্যালামসে তখন অবিমিশ্র আনন্দ-হিল্লোল। তার মাঝে ৎজেলার্ড গভীর শোকে মূহ্যমান। তিনি বলেছিলেন, "৬ই অগাস্ট তারিখটা আমার জীবনে একটা কালো দিন।" যুদ্ধান্তে এ হেন মানুষটি স্ট্রিম বদল করে নিলেন। নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী থেকে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা আর সমাজ বিজ্ঞানের গবেষক-অধ্যাপক। সেটা ১৯৪৬ সাল। জীববিদ্যা শাখায় গবেষণা ক্ষেত্রেও তাঁর উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখলেন। 
       
   যুদ্ধ-বিরোধী শান্তিপ্রিয় এ হেন মানুষ লিও ৎজেলার্ড হাঙ্গেরির রাজধানী শহর বুদাপেস্টে এক মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ১৮৯৮ সালের এগারোই ফেব্রুয়ারি তারিখে। ছোটবেলা তাঁর নাম ছিল লিও স্পিৎজ। মাতা টেকলা ভিদোর এবং পিতা লুইস স্পিৎজ একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ১৯০০ সালের ৪-ঠা অক্টোবর তাঁর পরিবারের পদবি জার্মান 'স্পিৎজ' (Spitz) থেকে পরিবর্তন করে হাঙ্গেরিয়ান 'ৎজেলার্ড' (Szilard) রাখেন। হাঙ্গেরিয়ান 'ৎজেলার্ড' শব্দের অর্থ 'Solid' (কঠিন বা দৃঢ়)। ধর্মীয় পটভূমির ভেতর অজ্ঞানবাদী হিসাবে তিনি বড় হতে থাকেন। কৈশোরে তিনি চাক্ষুষ করেন মানুষের স্বজন হারানোর যন্ত্রণা, প্রথম মহাযুদ্ধের কুৎসিত রূপ। ১৯১৬ সালের ২২ জানুয়ারি পঞ্চম ফরট্রেস রেজিমেন্ট থেকে তিনি চিঠি পান। যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। কিন্তু তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান। স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা। হল না স্বপ্নপূরণ। অফিসার র‍্যাংকে সেনাবাহিনীতে যুক্ত হলেন। যুদ্ধ শেষে ১৯১৯-এর জানুয়ারি থেকে সুপ্ত ইচ্ছা অনুসারে পুনরায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করেন। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধোত্তর অস্থির সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে হাঙ্গেরিয়ান-রাশিয়ান কম্যুনিজম। বেলা কুন-এর নেতৃত্বে। এমন সময় হাঙ্গেরিতে নিজের ভবিষ্যৎ শূন্য বুঝতে পেরে ভায়া অস্ট্রিয়া হয়ে জার্মানির রাজধানী বার্লিন চলে গেলেন তিনি। ১৯১৯-এর পঁচিশে ডিসেম্বরে। এসময় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে তিনি ফিজিক্সে মনোনিবেশ করেন। ফ্রেডরিক উলহেল্ম ইউনিভার্সিটিতে আইনস্টাইন, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, ওয়াল্টার নার্নস্ট, জেমস ফ্রাঙ্ক ও ম্যাক্স ভন লাউ― শিক্ষকগণের সান্নিধ্য পান। বন্ধু হিসাবে পেলেন উইগনার, গ্যাবর ও জন ভন নিউম্যান-এর সঙ্গ। ১৯২৪-এ ইনস্টিটিউট ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সে তিনি ভন লাউ-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট রূপে নিযুক্ত হন। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে কাটালেন। ১৯৩৩-এর তিরিশে জানুয়ারি জার্মানিতে হিটলারের অভ্যুত্থান ঘটলে তিনি ইংল্যান্ড চলে যান। সেখান থেকে ১৯৩৮ সালের ২-রা জানুয়ারি পাড়ি দিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাকাপোক্ত বসবাস শুরু করেন সেখানে। 

   দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯-এ তিনি লিখলেন এক ছোট গল্প। 'My Trial as a War Criminal' (যুদ্ধ বন্দী হিসাবে আমার বিচার)। এ গল্পে সোভিয়েত রাশিয়ার বিপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের পর মানবতাবিরোধী অন্যায় ষড়যন্ত্রের ট্রায়ালের চিত্রনাট্যে নিজেকে কাল্পনিক চরিত্র হিসাবে তুলে ধরেছেন তিনি। ১৯৫৯-এ তিনি 'Atoms for Peace Award' পেয়েছেন। ১৯৬১-তে প্রকাশিত হল একগুচ্ছ গল্প সমেত 'ঠাণ্ডা যুদ্ধ' (Cold War) বিষয়ে তাঁর পুস্তক 'The Voice of the  Dolphins' (ডলফিনের কণ্ঠস্বর)। এভাবে মানবতাহীন মেদিনীর বিপক্ষে তাঁর লেখনী বারবার গর্জে উঠেছে। কখনও নিজেকে নিজে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। ক্রুশবিদ্ধ হয়ে অদৃশ্য যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। আবার কখনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দীপ্ত কণ্ঠে ব্যক্ত করার সাহস দেখিয়েছেন, 'রাজা, তোর কাপড় কোথায়?' 
       
   
শেষে, ১৯৬০-এ তাঁর শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ল। নিউইয়র্কের হাসপাতালে তেজস্ক্রিয় 'কোবাল্ট থেরাপি' সহযোগে তাঁর চিকিৎসা চলতে থাকে। ১৯৬২-তে রোগাক্রান্ত দেহে প্রতিষ্ঠিত করলেন 'Council for a Livable World'; যেখানে নিউক্লিয়ার অস্ত্র নিয়ে মার্কিন কংগ্রেস, হোয়াইট হাউস আর আমেরিকার জনগনের উদ্দেশ্যে The Sweet Voices of Reasons তুলে ধরা হয়। ১৯৬৩-এর জুলাই মাসে উক্ত সংগঠনের অস্থায়ী ফেলো এবং পরে ১-লা এপ্রিল ১৯৬৪-তে স্থায়ী ফেলো মনোনীত হন। তারপর ১৯৬৪ সালের তিরিশে মে তারিখে ঘুমের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী। না-ফেরার দেশে চির-শান্তিতে বিরাজ করুন বিশ্ব-মানবতার পূজারী প্রিয় লিও ৎজেলার্ড।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments