জ্বলদর্চি

বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক- ১৫/অসীম ভুঁইয়া

Bengali grammar and debate
বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক
পর্ব ১৫

অসীম ভুঁইয়া

বাংলা দল( syllable) ও তার বিশ্লেষণ 

  বাংলা দল মূলত  ইংরেজি syllable এর প্রতিশব্দ। একে অনেকে অক্ষর বলে থাকেন। তবে বাংলায় বর্ণকেও অক্ষর বলা হয়। তাই আমরা syllable কথাটির উল্লেখ করলাম। অর্থাৎ বাংলা অক্ষর বা দল =  ইংরেজি syllable।

 এবার জেনে নিই, দল বা syllable  আসলে কী? দল বা অক্ষর বিষয়টি আপাতভাবে খুবই সরল একটি ধারণা বলে মনে হলেও আদতে কিন্তু তা নয়। এটি একটি বিতর্কিত ও পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার প্রেক্ষিতে জটিল বিষয়। তবে এই ব্যাকরণ ধারাবাহিকের  উদ্দেশ্য অনুযায়ী আমরা অত জটিলতায় না গিয়ে শুধু "বাংলা দল" নিয়েই সহজ আলোচনা করব।

    আমাদের কথা বলার সময় আমরা যে সমস্ত শব্দ উচ্চারণ করি তা আপাতভাবে নিরবচ্ছিন্ন মনে হলেও তাদের মধ্যে অবশ্যই সূক্ষ্ম ফাঁক  থাকে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলে বুঝতে পারব যে, এক একটি ঝোঁকে বা বাগ্ যন্ত্রের ন্যূনতম চেষ্টায় আমরা শব্দের এক একটি অংশ উচ্চারণ করি। কথা বলার সময় তা এমনভাবে জুড়ে যায় যে আমরা বুঝতেই পারি না তাদের মাঝের ব্যবধানটুকু। মোটকথা যেকোনো শব্দের যে অল্প অংশটুকু আমাদের বাগ্ যন্ত্র  স্বল্পতম প্রয়াসে এক ধাক্কায় উচ্চারণ করতে পারে, তাই দল বা অক্ষর।
 যেমন-  বিমল: এই শব্দটি বাকযন্ত্র দুটি ঝোঁকে বা দু ধাক্কায় উচ্চারণ করে। প্রথম ঝোঁক : বি,  এবং দ্বিতীয় ঝোঁক : মল। অর্থাৎ বিমল শব্দে দুটি দল বা syllable: বি এবং মল। 
    
   এখানে আরেকটি লক্ষ করার বিষয়: প্রতিটি দলে অন্তত একটি স্বরধ্বনি রয়েছে। বি: ব+ ই। মল: ম + অ + ল। তার মানে স্বরধ্বনি ছাড়া কোনো দল গঠিত হতে পারে না। অন্যদিকে একটি স্বরধ্বনিও দল হতে পারে। যেমন: অনুরিমার "অ", এবং এর "এ।"  কিন্তু একটিমাত্র ব্যঞ্জন বা একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনিতে দল গঠিত হতে পারে না। কারণ স্বরধ্বনি ছাড়া তো এককভাবে কোনো ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণই করা যায় না। অর্থাৎ বাগ্ যন্ত্রের স্বল্পতম চেষ্টায়, এক ঝোঁকে  ভাষা ও শব্দের স্বরধ্বনি সমন্বিত যে ন্যূনতম অংশটুকু  উচ্চারিত হয়, তাকেই দল বা অক্ষর বলে।

   Syllable বা দলের বৈশিষ্ট্য:

i. বাকযন্ত্রের ন্যূনতম চেষ্টায় উচ্চারিত হয়।
ii এক ঝোঁকে বা এক ধাক্কায় উচ্চারিত হয় 
iii. স্বরধ্বনি ছাড়া কোনো দল গঠিত হতে পারে না।
iv. একটি স্বরধ্বনিও একটি দল হতে পারে। কিন্তু একক ব্যঞ্জনধ্বনি বা স্বরধ্বনি ছাড়া একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনি দল গঠন করতে পারে না।
v. দল উচ্চারণ ও ঝোঁক কেন্দ্রিক। অর্থ গুরুত্বপূর্ণ নয়।
vi. উচ্চারণ - কেন্দ্রিক হওয়ায়, দল বিশ্লেষণের সময় বর্ণ নয়, ধ্বনি উল্লেখ করতে হয়।
 কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
যুক্তাক্ষর= যুক্ -তাক্ -খর: তিনটি দল।
 অঞ্জনা= অন - জ্ - না: তিনটি দল।
 বিজ্ঞান= বিগ্-  গ্যা৺ন: দুটি দল।

   উল্লেখ্য, দল বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ উচ্চারণ কেন্দ্রিক। তাই বিশ্লেষণের সময় বর্ণ নয় ধ্বনিকেই গুরুত্ব দিতে হবে।

 দলের শ্রেণিভাগ:
 
উচ্চারণ ও শব্দান্তের ধ্বনি অনুযায়ী দলকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
 এক, মুক্ত দল বা স্বরান্ত দল। এবং দুই, রুদ্ধ দল বা ব্যঞ্জনান্ত দল।
 
   এক, মুক্ত দল( open syllable):  যে দল উচ্চারণের সময় স্বরতন্ত্রী কিছুটা মুক্ত থাকে, এবং শেষে স্বরধ্বনি থাকে তাকে মুক্ত দল বা স্বরান্ত দল বলে।
যেমন: বিপাশা= বি -পা -শা। তিনটি দলের শেষে স্বরধ্বনি।
 অদিতি= অ- দি -তি। 

   দুই, রুদ্ধ দল ( close syllable) : যে দল উচ্চারণের সময় স্বরতন্ত্রী দুটি রুদ্ধ থাকে এবং শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকে তাকে রুদ্ধ দল বলে। একে বদ্ধদল বা হলন্ত / হসন্ত অক্ষরও বলা হয়।

যেমন: আজ= আ + জ্  একটি দল , শেষে ব্যঞ্জন ধ্বনি।
উল্লেখ্য, 
এক, যৌগিক স্বরধ্বনিগুলিকে রুদ্ধদল হিসেবেই ধরা হয়। কারণ যৌগিক স্বরের শেষ স্বরটি  অর্ধস্বর আর অর্ধস্বর উচ্চারিত হয় কিছুটা ব্যঞ্জনের মতোই, শেষে হস্ চিহ্নযুক্ত।
 যেমন মৌ = ম + ঔ ( ও + উ) এখানে শেষে উ্  অর্ধস্বর।
 
   বাংলা ছন্দের আলোচনাতেও একে রুদ্ধদল হিসেবেই গণ্য করা হয়। তাই যৌগিক স্বরকে স্বরান্ত বলা হয় না।

    মুক্ত দল ও রুদ্ধ দলের কিছু উদাহরণ।

শতদল: শ -ত- দল: শ, ত মুক্তদল, আর "দল" রুদ্ধ দল, দল সংখ্যা ৩।
 সম্পূর্ণ: সম্- পূর্- ণ।
 নিরপরাধ: নি -র- প -রাধ।

   একাধিক দল বিশিষ্ট কিছু শব্দ:

এক, একটি দল নিয়ে তৈরি শব্দ: এ, ও । বাক্য :এ জীবন। "ও আকাশ সোনা সোনা।" 
 দুই, দুই দল নিয়ে শব্দ:
 কথা: ক- থা। লব্ধ: লব্- ধ
 তিন, তিন দলের শব্দ
 অদিতি: অ- দি- তি।
 প্রিয়াঙ্কা: প্রি- য়াঙ্- কা।
চার, চার দলের শব্দ:
 অযাচিত: অ- যা- চি -ত। 
 পাঁচ, পাঁচ দলের শব্দ: অভাবনীয়: অ -ভা -বো- নি -য়
ছয়, ছয় দলের শব্দ:
 জাতীয়তাবাদী: জা- তি -য়ো- তা -বা -দি।
 সাত, সাত দলের শব্দ:
 আন্তর্জাতিকতাবাদ: আন্- তর্- জা- তি- ক -তা -বাদ।

দল( syllable) ও অর্ধস্বর:

    আগেই বলেছি অর্ধস্বরগুলো syllable গঠন করতে পারে না।
 এরা কোনো স্বরধ্বনির সঙ্গে কিছুটা ব্যঞ্জনধ্বনির মতো হস্  যুক্ত হয়ে অবস্থান করে। আমাদের মতে বাংলায়  যে ২৬ টি  যৌগিক স্বর রয়েছে( তার মধ্যে ৫/৬ টির প্রয়োগ বিরল) তার শেষ অর্ধস্বরটি নিয়ে কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।
অয়=জয়: একটি দল এবং তা অবশ্যই রুদ্ধ দল।
আও= যাও। এই= নেই।
অর্ধস্বরগুলি অন্য শব্দে পূর্ণ স্বরধ্বনির মর্যাদা পেতে পারে। যেমন:  ওদের, উনি, ইমন, এবং: এখানে ও, উ, ই,এ : এগুলো পূর্ণস্বর এবং স্বতন্ত্র দল।
 
   অর্থাৎ একই স্বরধ্বনি পূর্ণ ও অর্ধস্বর দুইই  হতে পারে। অর্ধস্বর হিসেবে ব্যবহৃত হলে দল গঠন করতে পারে না, আর পূর্ণ স্বর হিসেবে ব্যবহৃত হলে দল গঠন করতে পারে।

    একই স্বরধ্বনির অর্ধস্বর ও পূর্ণস্বর হিসেবে প্রয়োগ:

বলাই= ব + লাই : ই অর্ধস্বর
বলি= ব + লি: ই পূর্ণস্বর।

 পাশাপাশি দুটো স্বর থাকলেই যে শেষ স্বরটি অর্ধস্বর হবে হবে এমন কোনো কথা নেই। 

যেমন: খাও= খ্ -আ -ও্ : এখানে "ও্" অর্ধস্বর।
কিন্তু  খেয়ো= খ্- এ -ও: এখানে "ও" পূর্ণস্বর। কারণ পূর্ণরূপেই উচ্চারিত। তাই আলাদা দলও গঠন করতে পেরেছে। 
খাও: একটি দল।
খেয়ো: খে+ ও: দুটি দল।

   এভাবে খাও থেকে খাওয়া: খাও্+ আ, যাও থেকে যাওয়া: যাও্+ আ, চাও থেকে  চাওয়া: চাও্+ আ:  
 দুটি করেই দল, তিনটি নয়। 

   দলের সংগঠন:
সংগঠনের দিক থেকে দল বা syllable কে এই ভাবে ভাগ করতে পারি:

দল: ১. Onset বা আদি/ শুরু।
২. Core/ rhyme বা দলকেন্দ্র/ মিত্রক।
৩. Coda  বা শেষ/ অন্ত
দলশীর্ষ বা peak যা
 দলকেন্দ্রের স্বরধ্বনি।(এখানে ছকটি এঁকে দেখানো সম্ভব হল না। একটু কষ্ট করে বুঝে নিতে হবে।)
 
   ১. আদি/ শুরু: কোনো দলের দলকেন্দ্র সেই দলের স্বরধ্বনি। কারণ দল হতে গেলে অন্তত একটি স্বরধ্বনি প্রয়োজন। তাই এই দলকেন্দ্ররূপী স্বরধ্বনির আগের অর্থাৎ বামদিকের ব্যঞ্জনধ্বনিগুলিকে আদি বা onset বলে।
যেমন: জল: জ্ -অ -ল: এখানে আদি হল জ্।আর "অ" দলকেন্দ্র। "ল" অন্ত।

 দলশীর্ষ: দলকেন্দ্রের স্বরধ্বনিকেই দলশীর্ষ বলে।
 যেমন: দল: দ -অ- ল।এখানে "অ" দলশীর্ষ।
 উল্লেখ্য ,দলশীর্ষ একটিই স্বরধ্বনি নিয়ে গঠিত, তবে  পূর্ণস্বরধ্বনি বা দলশীর্ষর সঙ্গে অর্ধস্বর জুড়ে থাকতেই পারে। এটি কেবল যৌগিক স্বরের ক্ষেত্রেই ঘটে। তবে সেই অর্ধস্বরটি ব্যঞ্জনধ্বনির মতো হস্ যুক্ত হওয়ায় তাকে অন্ত বা coda হিসেবে ধরা হয়।
 যেমন: যাও: এখানে একটি দল।
"আ" এর পর "ও্" অর্ধস্বরটি coda বা অন্ত।আর "আ"হল দলশীর্ষ।

  অনেকে অবশ্য অর্ধস্বরটিকে নিয়েই দলশীর্ষ বলে থাকেন।  তবে আমাদের মত প্রথমটির দিকে। আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে: দলশীর্ষর  আগে বা পরে আদি বা অন্ত হিসেবে কোনো ব্যঞ্জন নাও থাকতে পারে। অর্থাৎ শুধু দলশীর্ষ একাও দল গঠন করতে পারে।
 যেমন এ, ও।
 দলশীর্ষ গঠনের চারটি সম্ভাবনা:
১. আদি- দলশীর্ষ -অন্ত: এই তিনটি উপাদান নিয়ে দল তৈরি।
যেমন: ফল: ফ- অ- ল।
২. আদি বাদ দিয়ে শুধু শীর্ষ ও অন্ত নিয়েও দল গঠন হয়।
 যেমন : আম: আ + ম। 
৩. অন্ত বাদে শুধু আদি ও দলশীর্ষ  নিয়েও দল গঠন হতে পারে।
 যেমন:  না: ন্ + আ । পা: প্ + আ।
 ৪. আদি ও অন্ত বাদে শুধু দলশীর্ষ নিয়েও দল তৈরি হয়। যেমন:  এ, ও। বাক্য: এ তো আচ্ছা লোক!  "ও আমার দেশের মাটি।"
 এছাড়াও আমার : "আ" দলশীর্ষ তথা একটি দল।

   যেকোনো ভাষায় দল গঠনের বৈচিত্র্যের উপর অনেকাংশেই তার স্বাতন্ত্র্য নির্ভর করে। অক্ষরের বিন্যাসই কোনো ভাষার শব্দকে মাধুর্যময়, শৈল্পিক তথা সমৃদ্ধশালী করে তোলে। বাংলা শব্দ, অক্ষর বিন্যাসের নানা বৈচিত্র্য নিয়ে অনন্তের দিকে ধাবিত।

 বাংলায় পূর্ণস্বর ও যৌগিক স্বররের অর্ধস্বর নিয়ে আমরা ১৭  টি দলের সংগঠন  পেয়েছি। 

  কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে:
১। শ্রুতিস্বর দিয়ে দল গঠিত হয় না। যেমন: খা+ আ= খাওয়া। খা ও আ এর মাঝের শূন্যস্থান ভরাট করেছে "ও্" অর্ধস্বরটি।তাই "খাও" একটিই দল। আলাদাভাবে অর্ধস্বর "ও্" কে দল বলা যাবে না।
 ২। অনেকে "শ"কে একক ব্যঞ্জনধ্বনি দল বলে থাকেন। এটিকে অবশ্য ব্যতিক্রম হিসেবেই নেওয়া হয়।
৩। ব্যঞ্জনধ্বনি, স্বরধ্বনি ব্যতীত এককভাবে উচ্চারিত হতে পারে না, তবে ব্যঞ্জনান্ত- দলে বা রুদ্ধদলে স্বরছাড়া ব্যঞ্জন উচ্চারিত হয়। 

   আর হ্যাঁ, দলের যে ১৭ প্রকার সংগঠনের খোঁজ পেয়েছি, তার লিস্ট পরে একদিন দিয়ে দেব।
মতামত জানাতে পারেন।
Whatsaap নম্বর: 7001888143
Mail id: ashim.bhunia1982@gmail.com
West Bengal, India।
   সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি: লেখকের গ্রন্থ-সমূহ:  
প্রকাশিত কবিতা-গ্রন্থ:
১। মৃত্যু ও রক্তের আলাপন। ২। কান্নাতে ভাসে মৃগতৃষ্ণিকা। ৩। আঙুলে জড়ানো ঘুম। ৪। হলুদ পাতার মেয়েরা। ৫। হলদে গোধূলির বাইপাস। ৬। যৌথ কবিতা-গ্রন্থ: বিন্দাস আগুনে আধপোড়া নাভি।৭।গল্প-সংকলন: রূপসার সন্ধ্যার ফ্ল্যাটে।
** "সবৃত্তত্রিরেখা" সাহিত্য আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা।
৯। ব্যাকরণ গ্রন্থ: আধুনিক ভাষা প্রবাহ। ১০ প্রকাশিতব্য ব্যাকরণ গ্রন্থ: "আধুনিক বাংলা ব্যাকরণ সমগ্র, বিতর্ক ও ভাষাতত্ত্ব"।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

3 Comments