জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের বৈষ্ণব কবি( দ্বিতীয় পর্ব)/বিভাস মণ্ডল

মেদিনীপুরের বৈষ্ণব কবি( দ্বিতীয় পর্ব)

ড. বিভাস মণ্ডল

শ্রী শ্যামানন্দ প্রভু

১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দের চৈত্র পূর্ণিমায় ধারেন্দা বাহাদুরপুর গ্রামে আবির্ভুত হন শ্যামানন্দ। বাল্যকালে তাঁর ডাকনাম ছিল দুঃখী।বাল্যকাল থেকে কৃষ্ণ ভক্তির চরম প্রকাশ পরিলক্ষিত হয় দুঃখীর অন্তরে। অম্বিকা কালনায় ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দে গৌরিদাস পণ্ডিতের প্রিয় শিষ্য হৃদয় চৈতন্য অধিকারী ঠাকুরের নিকট শ্রীকৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে তিনি দুঃখী কৃষ্ণদাস নামে পরিচিত হন। পরে শ্রীধাম বৃন্দাবনে শ্রীজীব গোস্বামীর সাহচর্যে আসেন। শ্রীনিবাস আচার্য ও নরোওম ঠাকুরের সঙ্গে কৃষ্ণদাস বৈষ্ণব ধর্ম শাস্ত্র পাঠ করে বিদগ্ধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হন। পরে গুরুর আদেশে উৎকল ও দক্ষিণ পশ্চিমবাংলায় চৈতন্য মহাপ্রভুর অহিংস প্রেমধর্ম প্রচারে অগ্রসর হন। প্রধান শিষ্য শ্রীরসিকানন্দকে সঙ্গে নিয়ে উৎকলের সর্বত্রই কৃষ্ণ নামে জনসাধারণকে মাতোয়ারা করে তোলেন। অগণিত ভূস্বামী- রাজা সহ মুসলিম শাসকদের তিনি হরিপ্রেমে আকৃষ্ট করে সমাজে সুস্থিত পরিবেশ সৃষ্টি করেন। 

  অরণ্যসংকুল ও মালভূমি বেষ্টিত ভৌগোলিক অঞ্চলের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষ বিশেষ করে কোল- ভীল- সাঁওতাল- ভূমিজ প্রভৃতিদের মধ্যে অহিংসার বার্তা প্রেরণ করে শ্যামানন্দ মধ্যযুগে যে অভাবনীয় কর্ম করেছিলেন তা সত্যই আমাদের বিস্মিত করে।মহাপ্রভুর অহিংস প্রেমধর্ম প্রচারের পাশাপাশি বৈষ্ণব সাহিত্য সৃষ্টিতেও তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দের জ্যেষ্ঠ শুক্লা পঞ্চমীতে তাঁর তিরোধান ঘটে।

  শ্যামানন্দের বিখ্যাত গ্রন্থ ' অদ্বৈত তও্ব'। এই গ্রন্থে শ্যামানন্দ অদ্বৈত প্রভুর প্রতি শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরীর নানান উপদেশ বৃওান্ত লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর অপর গ্রন্থ ' একাদশী ব্রতকথা'। এতে ২৮০টি শ্লোক রয়েছে। এছাড়া বৃন্দাবনের স্থান মাহাত্ম্য বিষয় নিয়ে তিনি রচনা করেন' বৃন্দাবন পরিক্রমা'। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের ' বৃহৎ বঙ্গ' গ্রন্থে শ্যামানন্দ রচিত 'অদ্বৈত তও্ব', ' উপাসনাসার সংগ্রহ', একাদশী ব্রতকথা' ও' বৃন্দাবনপরিক্রমা' র কথা উল্লেখ করেছেন।এছাড়া ও তিনি ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্ধের একখানি পদ্যানুবাদ ও রচনা করেছেন।

  এই গ্রন্থগুলি ছাড়াও শ্যামানন্দ বাংলা- ওড়িয়া ও ব্রজবুলি ভাষা মিশ্রিত পদ রচনা করে বৈষ্ণব পদ সাহিত্যকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর পদগুলি বহু বিচিত্রধর্মী। যার মধ্যে অন্যতম হল- গৌরাঙ্গ বিষয়ক, নিত্যানন্দ বিষয়ক, কৃষ্ণের রূপ, রাধার রূপ, রাসনৃত্য, গোষ্ঠলীলা, ফুলদোল, বসন্ত বিহার, হিন্দোল বা ঝুলন বিষয়ক, বাল গোপালের নৃত্য বিষয়ক, অনুরাগ বিষয়ক, রূপানুরাগ বিষয়ক, মিলন বিষয়ক, প্রভাতী ও প্রার্থনা বিষয়ক পদ। শ্যামানন্দের পদে চিত্ররূপময়তা, ভক্তিময়তার পাশাপাশি ছন্দ- অলংকারের রূপবৈচিত্র্য পদসাহিত্যকে উজ্জ্বল করে তুলেছে।

শ্রীরসিকানন্দ প্রভুঃ

শ্যামানন্দের অগণিত শিষ্যের মধ্যে সর্বোওম ও সমধিক প্রসিদ্ধ শিষ্য হলেন রসিকানন্দ। তিনি ঝাড়গ্রাম মহকুমার সাঁকরাইল থানার ডোলং নদীর তীকে রোহিনী গ্রামে ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে কার্তিক মাসে জমিদার অচ্যুতানন্দ পট্টনায়কের পুত্ররূপে আবির্ভুত হন। ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিরোহিত হন।শ্যামানন্দ তাঁকে১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে দীক্ষা দেন। তারপর যৌথভাবে কখন ও বা এককভাবে শ্রীচৈতন্যের অহিংস প্রেমধর্ম বাংলা- বিহার- ওড়িশায় প্রচার করতে থাকেন।সে সময়কার অস্থির সমাজ জীবনকে সুস্থ পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে তাঁর অবদানকে স্বীকার করে নিতে হয়। 

   রসিকানন্দ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের নিকট ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্য পুরাণাদিতে প্রগাঢ় ব্যুৎপওিলাভ করেন। স্বাভাবিকভাবে তিনি সংস্কৃত ভাষায় বেশ কয়েকটি গ্রন্থ ও স্তাত্রাবলি রচনা করেন। যা বৈষ্ণব সাহিত্য সম্ভারকে সমৃদ্ধ করে তোলে।
রসিকানন্দের " শ্রীভাগবতাষ্টকম্" রচনাটিতে ভক্ত ভাগবতের মহিমা বর্ণিত হয়েছে। এর প্রতিটি শ্লোকেই তিনি ভক্ত ভাগবতের চরণে ভূলুণ্ঠিত হয়ে প্রণিপাত জানিয়েছেন। একশত একটি শ্লোকে রসিকানন্দ সংস্কৃত ভাষায় রচনা করেছেন " শ্রী শ্রী শ্যামানন্দ শতকম্" ।এই গ্রন্থে গ্রন্থকার তাঁর গুরু শ্রীশ্যামানন্দের মহিমা অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন। গ্রন্থটিত্ গুরুতও্ব বিষয়টি অত্যন্ত সুচারুভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। এই গ্রন্থের প্রথম থেকে ২৪ সংখ্যক শ্লোক পর্যন্ত গ্রন্থকার গুরু শ্যামানন্দের গুণরাজি পরিবেশন করেছেন। ২৫ সংখ্যক শ্লোকে গোপীজনবল্লভকে সূচিত করেছে। ২৬- ৫৪ সংখ্যক শ্লোকে ভগবানের নিত্য প্রেয়সীরূপে শ্রীশ্যামানন্দরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন, তা বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে।৫৫- ৬৪ সংখ্যক শ্লোকে শ্রীবৃন্দাবনের প্রতিটি বস্তুর মাধুর্য মহিমা প্রকাশ পেয়েছে। ৬৫- ৭৭ সংখ্যক শ্লোকে গুরুদেবের নিকট কৃষ্ণ ভক্তি ভিক্ষা প্রার্থনা করা হয়েছে।৭৮- ৯৩ সংখ্যক শ্লোকে শ্যামানন্দের ধ্যানাবস্থা স্বরূপের পরিচয় দিয়েছেন। গ্রন্থটি বস্তুবৈভবে, ভাবগৌরবে, ভাষার লালিত্যে সকলের মন আকর্ষণ করে।

  এছাড়া রসিকানন্দের " শাখাবর্ণন" , " রতি বিলাস", " শ্যামানন্দ রসনিধি" প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। বারোটি শ্লোক সমন্বিত রাধাকৃষ্ণের লীলাবিলাস নিয়ে তিনি " কুঞ্জ কেলি দ্বাদশ" নামে স্তোত্র রচনা করেন। বৈষ্ণবীয় ভক্তিরসের ধারায় এই সংস্কৃত স্তোত্র বা কাব্যগুলো বৈষ্ণব ভক্তদের নিকট অত্যন্ত আদরণীয়।
পদাবলি সাহিত্যে শ্রীরসিকানন্দের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা- ওড়িয়া- ব্রজবুলিতে তাঁর সর্বমোট ৩৫টি পদ রয়েছে। গুরু শ্যামানন্দের মতো বহু বিচিত্র ধরণের তিনি পদ রচনা করেছেন। তাঁর পদগুলো গৌরাঙ্গ বিষয়ক, দধিমঙ্গল বিষয়ক, কৃষ্ণের রূপ বর্ণনা বিষয়ক, মিলন বিষয়ক, দোলযাত্রা বিষয়ক, নিবেদন বিষয়ক ,  মান বিষয়ক, রাস বিষয়ক ও অভিসার বিষয়ক। পদগুলো পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে লিখিত। '" পদকল্পতরু" তে তাঁর পদ রয়েছে।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments