জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের বৈষ্ণব কবি-৩/ বিভাস মণ্ডল

মেদিনীপুরের বৈষ্ণব কবি
পর্ব-৩
বিভাস মণ্ডল 

শ্রী গোপীজনবল্লভ দাস

 শ্রীরসিকানন্দের প্রিয় শিষ্য ও সাধক শ্রীগোপীজনবল্লভ দাস ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রসময় দাস শ্যামানন্দের শিষ্য ছিলেন। গোপীজনবল্লভ দাস নারায়ণ গড় থানার অধীনে ধারেন্দা গ্রামে সদগোপ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর গুরু শ্রীরসিকানন্দের জীবনীমূলক কাব্য " শ্রী শ্রীরসিকমঙ্গল কাব্য" রচনা করেন।  গ্রন্থটি শুধু বৈষ্ণব সাধক রসিকানন্দের জীবনাল্লেখ্য নয় , এটি সপ্তদশ শতকের ওড়িশা সন্নিহিত দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গের এক ঐতিহাসিক দলিল। চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাবে ওড়িশায় বৈষ্ণব ধর্মের প্লাবন ঘটলেও বালেশ্বর, মেদিনীপুর, সিংভূম, ময়ূরভঞ্জ ও কেওঞ্ঝর প্রভৃতি অঞ্চল তা থেকে বঞ্চিত ছিল। এ সকল স্থানের মানুষের মধ্যে জীবহিংসা, মদ্যপান, নরহত্যা প্রভৃতি কুকর্ম ক্রমে বেড়ে চলছিল। যা শ্যামানন্দ ও রসিকানন্দের প্রভাবে সেই সকল অঞ্চলের মানুষজন সুস্থিত পরিবেশে ফিরে আসে।  গ্রন্থটিতে মোট চারটি বিভাগ বা খণ্ড রয়েছে। যথা- পূর্ব বিভাগ, দক্ষিণ বিভাগ , পশ্চিম বিভাগ ও উত্তর বিভাগ। প্রত্যেকটি বিভাগে ১৬ টি করে লহরী বা অধ্যায় রয়েছে। মঙ্গল কাব্যের রীতিতে গ্রন্থটি রচিত। যা পাঁচালি আকারে গীত হয়ে পরিবেশিত হত। বিভিন্ন সুর ও ছন্দের উল্লেখ রয়েছে।

গোবর্দ্ধন দাস 

 শ্যামানন্দের দ্বিতীয় প্রধান শিষ্য হলেন দামোদর যোগী। তিনি মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত দামোদরের উল্লেখযোগ্য শিষ্য হলেন গোবর্দ্ধন দাস ও কানুরাম দাস। এঁরা দুজনেই মেদিনীপুর জেলার অধিবাসী। পদাবলি সাহিত্যে গোবর্দ্ধন দাসের বিশেষ অবদান রয়েছে।তাঁর নামে সতেরোটি পদ পাওয়া গেছে। 

কানুরাম দাস 

দামোদর যোগীর শিষ্য কানুরাম দাস ধারেন্দাতে জন্মগ্রহণ করেন। পদাবলি সাহিত্যে এঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। তাঁর নামে চৌদ্দটি পদ পাওয়া গেছে। 

দুঃখী শ্যামদাস 

 দুঃখী শ্যামদাস ছিলেন শ্যামানন্দ প্রভুর অন্যতম শিষ্য ও সুকবি। ইনি মেদিনীপুর শহর থেকে ২৫ কি. মি পূর্বে কেদারকুণ্ডু পরগণার হরিহরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন শ্রীমুখ দে ও মাতা ভবানী।এঁরা ছিলেন ভরদ্বাজ গোত্রীয় কায়স্থ। শ্যামানন্দের ন্যায় ইনি ' দুঃখী শ্যামদাস' নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর লেখা বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে যা বৈষ্ণব সমাজে ও সাহিত্যে বিশেষ গৌরবের পরিচয় রাখে। দুঃখী শ্যামদাস " গোবিন্দ মঙ্গল" , " একাদশী ব্রত" ও শ্রীধর স্বামীর টীকা অবলম্বনে মূল ভাগবতের পদ্যানুবাদ করেন। গোবিন্দ মঙ্গলের জন্য দুঃখী শ্যামদাস বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। এই গ্রন্থটি ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে বা শেষদিকে রচিত হয়।
দুঃখী শ্যামদাসের " গোবিন্দ মঙ্গল" গ্রন্থটি ভাগবতের ১ম, ২য়, ১০ম, ১১শ ও ১২ শ স্কন্ধ অবলম্বনে ও সূত্র বিশেষে ব্রহ্মবৈবর্তাদি পুরাণের সাহায্য নিয়ে রচিত। তবে এই গ্রন্থে ভাগবতের দশম স্কন্ধের কৃষ্ণের মধুর লীলাময় কাহিনীটি ছন্দবৈচিত্রে বর্ণিত।কবি তাঁর গোবিন্দমঙ্গলকে ভক্ত সাধারণের নিকট পাঠ করে বা কীর্তনের মাধ্যমে শোনাতেন। করুণ রস বর্ণনায় শ্যামদাসের " বারোমাস্যা" অতি সুন্দর। এছাড়া তিনি শ্রীধর স্বামীর ভাগবতের টীকার পদ্যানুবাদ করেছিলেন। যা থেকে স্বাভাবিকভাবে শ্যামদাসের সংস্কৃতভাষা জ্ঞানের সম্যক পরিচয় মেলে।

সনাতন চক্রবর্তী

সপ্তদশ শতকের শুরুতে তমলুকের সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ বংশে আবির্ভুত হন কবি সনাতন চক্রবর্তী। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে ভাগবতের পদ্যানুবাদ করেন। বঙ্গবাসী কার্যালয় থেকে তাঁর গ্রন্থের কতকাংশ মুদ্রিত হয়। ভাগবত অনুবাদের ধারায় কবি সনাতন চক্রবর্তীকেও পেয়ে মেদিনীপুরবাসী গৌরবান্বিত হয়েছেন।

শ্রী কৃষ্ণচরণ দাস

প্রভু শ্যামানন্দের শিষ্য রসিকানন্দ। তাঁর শিষ্য নয়নানন্দ, নয়নানন্দের শিষ্য শ্রীরাধামোহন। রাধামোহন ঠাকুরের শিষ্য শ্রীকৃষ্ণচরণ দাস। শ্রীগোপীজনবল্লভ দাস যেমন শ্রী শ্রীরসিকমঙ্গল গ্রন্থ রচনা করে চরিত সাহিত্যে বিশেষ অবদান রেখেছেন, তেমনি শ্রীকৃষ্ণচরণ দাস " শ্রী শ্রীশ্যামানন্দ প্রকাশ" নামে একখানি গ্রন্থ লিখে চরিত সাহিত্যের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর এই গ্রন্থে শ্যামানন্দ ও রসিকানন্দের নাম- প্রেম প্রচারের কথা বর্ণনা করেছেন।
   গ্রন্থটি চারটি দশা বা ষোলটি লহরীতে পয়ার ছন্দে রচিত। শ্রীকৃষ্ণচরণ ব্রজধামে স্বপ্নে শ্যামানন্দ প্রভুর কৃপাদেশ পেয়ে তাঁর মহিমা বর্ণনে প্রবৃত্ত হন। বাংলা ভাষায় লেখা এই শ্যামানন্দ প্রকাশ গ্রন্থটি বৈষ্ণব সাহিত্যের ইতিহাসে একটি অমূল্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থে গ্রন্থকার শ্যামানন্দ ও তাঁর প্রিয় শিষ্য রসিকানন্দের মহিমা বর্ণনের পাশাপাশি ওড়িশায় চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেমধর্ম প্রচারের কাহিনী বিশেষভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের ২৫ চৈত্র পানিহাটি থেকে শ্রীঅমূল্যধন রায় ভট্ট মহাশয় এই গ্রন্থখানি প্রকাশ করেন। ইতিপূর্বে শ্রীপাট গোপীবল্লভপুর থেকে গ্রন্থটি প্রকাশ পেয়েছে এছাড়া বৈষ্ণব রিসার্চ ইনস্টিটিউট( হালিশহর)
 থেকে শ্রীকিশোরী দাস বাবাজী মহাশয় প্রকাশ করেন।
এছাড়া " শ্রী শ্রীশ্যামানন্দ রসার্ণব" নামে শ্রীকৃষ্ণচরণ দাসের আর একটি গ্রন্থ রয়েছে। এই গ্রন্থে শ্যামানন্দ প্রভুর দ্বাদশ শাখার পরিচয় পাওয়া যায়। যাঁদের নিয়ে তিনি বাংলা- বিহার- ওড়িশায় বৈষ্ণব ধর্মের প্লাবন ঘটান।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments