জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩৩/ শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩৩

শ্যামল জানা

লে দ্যামোয়াজেলস দ’ অ্যাঁভো 

ছবিতে ওই যে পাঁচজন গণিকা((ছবি-১) [“লে দ্যামোয়াজেলস দ’ অ্যাঁভো” ছবিতে পাঁচজন গণিকা ও আরও অন্যান্য অংশগুলিকে আলাদা আয়তক্ষেত্র দিয়ে চিহ্নিত করা আছে “তুলনা-১” “তুলনা-২”... এইভাবে৷ কারণ, এইগুলির তুলনায় পরে আরও ছবি দেখানো হবে৷]), তাদের একদম বাঁ-প্রান্তে যে দাঁড়িয়ে আছে তার মুখের অভিব্যক্তি থেকে শুরু করে সারা শরীরটাই একেবারে নিরাসক্ত৷ 
যেন আমি যন্ত্রের মতো রোজ এখানে দাঁড়াই, খদ্দের এলে তার মনোরঞ্জন করি, চলে গেলে আবার এখানে এসে দাঁড়াই৷ এই গতানুগতিকতা বছরের পর বছর ধরে চলছে তো চলছেই!

  গাঢ় সবুজ ধরনের, লম্বাটে অ্যাবস্ট্রাক্ট আইবেরিয়ান স্কাল্পচারের মতো নিরাসক্ত মুখ৷ এই ছবিটি আঁকার কিছুদিন আগে পিকাসো আদিম প্রাক্-ধ্রুপদী মূর্তির একটি প্রদর্শনী দেখেছিলেন৷ এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়েই হুবহু ওই রকমই এই মহিলার মু্খটি তিনি আঁকলেন (ছবি-২)৷
  একেবারে মাঝখানে যে মহিলাটি আছে (দর্শকের বাঁ-দিক থেকে তৃতীয়), সে দু-হাত মাথার পিছন দিকে দিয়ে দু-কনুই মাথার ওপরে তুলে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যেন খরিদ্দারদের শরীর দেখিয়ে প্রলুব্ধ করছে! চোখ-মুখের ভাষা এমন, যেন আমন্ত্রণ করছে৷ বলছে— এই লাস্যময়ী শরীর দেখে তোমার ইচ্ছে জাগছে না? এসো, আমি তোমার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি৷ মহিলার এই দাঁড়ানোর সম্পূর্ণ ভঙ্গিটাই হুবহু তিনি নিলেন আঁরি মাতিস-এর ১৯০৫ সালে আঁকা “লে বনহেয়ার দে ভিভরে”(Le Bonheur de Vivre) ছবিটি থেকে (ছবি-৩)৷ 


শুধু তাইই নয়, এর আগের যে মহিলার ছবিটি (দর্শকের বাঁ-দিক থেকে দ্বিতীয়), সেটিও কিন্তু এই মাঝখানের মহিলাটির অনুকরণেই আঁকা৷ তবে, তাদের দাঁড়াবার ভঙ্গিটি মাতিস-এর আঁকা ছবির থেকে হুবহু নিলেও মুখের ছবিটি কিন্তু একটু অদল-বদল করে আফ্রিকার কাঠের মুখোশ থেকে নেওয়া(ছবি-৪)৷

তার পরের মহিলা, অর্থাৎ ক্যানভাসের ডানদিকে একেবারে ওপরের ছবিটির মুখটা দেখলেই বোঝা যায়, সর্ব অর্থে বাকি অন্য চারজন মহিলার মুখের থেকে আলাদা৷ কেন? আসলে, এই ছবির নিচের দিকে, মাঝখানে, একজন নাবিকের ছবি ছিল৷ যে, ওই মহিলার কাছে এসেছিল তার যৌনক্ষুধা মেটাতে৷ কিন্তু এই মহিলা একটু দোনামোনার মধ্যে ছিল৷ খদ্দের লক্ষ্মী, কক্ষোনো তাকে ফেরানো উচিত নয়৷ আবার সে নাবিক, যদি যৌনরোগ থাকে? তাই, আহ্বানের সাথে সন্দেহ মিশে যে জটিল অভিব্যক্তি, যে স্টিফনেস, সেটাই, এই মহিলার চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছিল(ছবি-১, তুলনা-৪)৷

  পরে, পিকাসো ওই নাবিকের ছবিটি ক্যানভাস থেকে মুছে, ওখানে কিছু ফলের ছবি এঁকে দেন৷ ছবিটি ভালো করে লক্ষ করলেই পাঠক বুঝতে পারবেন, ওই ফলগুলির মধ্যে একটি কাটা তরমুজের টুকরো এমনভাবে তিনি এঁকেছেন, যেন তা উত্থিত লিঙ্গস্বরূপ, যা সামগ্রিকভাবে পুরুষ যৌনচিহ্নের প্রতীক(ছবি-১, তুলনা-৬)! ছবিতে যদি নাবিকটি থাকত, তাহলে, বিষয়টি ১:১ হয়ে যেত৷ অর্থাৎ একজন মহিলার সন্দেহদৃষ্টি একজন পুরুষের প্রতি বর্তাত৷ কিন্তু নাবিকটি না থাকায়, ক্যানভাসের সব মহিলাদের দৃষ্টি-যন্ত্রণা-সন্দেহ, এবং সেই অভিব্যক্তির অড়ালে নিঃশব্দে থেকে যাওয়া পুরুষদের প্রতি ঘৃণা সবটাই বর্তাল যতজন পুরুষ এই ছবিটা দেখেছে, দেখছে, এবং দেখবে, তাদের ওপর!

  শুধু তাইই নয়, ক্যানভাসের ডানদিকে নিচে, একজন পুরুষ ডাক্তার তিনি এঁকেছিলেন, যে ওখানে এসেছিল নগ্ন নারীর অ্যানাটমি প্র্যাকটিস করতে, কিন্তু তারও চোখেমুখে ছিল কামের লোলুপ দৃষ্টি৷ তাকেও একই কারণে পিকাসো মুছে দিয়েছিলেন৷ আর, ওই জায়গায় বসিয়ে দিয়েছিলেন এমন একজন নারীকে(ছবি-১, তুলনা-৫), যে অন্য চারজনের মতো নয়৷ যে, স্বেচ্ছায় এই পথ বেছে নিয়েছে, এবং যত রকমের পাপকাজ আছে, সে নির্দ্ধিধায় করতে পারে এমনই ভয়ঙ্কর! যেন, শুধু পুরুষ কেন, এ রকম মহিলাও অল্প হলেও পৃথিবীতে থাকে!

  মুশকিলটা ঠিক এখানেই হয়েছিল পিকাসোর! এই দুই নারীর(ছবি-১, তুলনা-৪ ও তুলনা-৫) এই যে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা-বর্ণনা দেওয়া হল যত সহজে, পিকাসো কিন্তু তত সহজে এদের মুখদুটি প্রথমে এঁকে উঠতে পারেননি! অগুনতি খসড়ার পর খসড়া এঁকেছিলেন পিকাসো, কিন্তু কিছুতেই যা চাই তাই হচ্ছিল না! এবং এই কারণেই বেশ কিছুদিন আটকে ছিল এই ছবিটা!

  আমাদের কফি হাউসের মতো প্যারিসের তৎকালীন এক বিখ্যাত বার-এ বেশকিছু উল্লেখযোগ্য লেখক-শিল্পী, যেমন— পাবলো পিকাসো, জর্জেস ব্রাক্, আঁদ্রে দের‍্যাঁ, ‘আভাঁ গার্দ’ মুভমেন্টের কিছু শিল্পী, গীয়োম অ্যাপোলোনীয়ার প্রমুখরা প্রায় নিয়ম করে আড্ডা দিতেন৷

  ওই সময়েই, ওই বার-এর এককোণে ডাঁই হয়ে পড়ে থাকা ধুলোর আবর্জনার স্তুপের ভেতর থেকে একটি আদিম যুগের আফ্রিকান কাঠের মুখোশ(ছবি-৫) পাওয়া যায়৷ 
ওটা দেখে পিকাসোর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল প্রায় আর্কিমিডিস-এর মতো! ওই মুখোশটি যিনি পান, পিকাসো তাঁর থেকে আবার কিনে নেন৷ এখানে দুটি মত চালু আছে৷ কেউ বলে আঁদ্রে দের‍্যাঁ-র কাছ থেকে, আবার কেউ বলে ডিলার রু দে রেনের-এর কাছ থেকে পিকাসো ওটা কিনেছিলেন৷

  যার থেকেই কিনুক, ওই আদিম আফ্রিকান কাঠের মুখোশটিই তখন ছিল পিকাসোর মুশকিল আসান! এতদিন মনে মনে ধারণার মধ্যে বাকি যে দুই মহিলার মুখের অভিব্যক্তিটি তিনি লালন করেছিলেন, যা তিনি কিছুতেই এঁকে উঠতে পারছিলেন না, ওই মুখোশটি সেই সময় হাতে এসেছিল বলেই, তা থেকে ওই আটকে যাওয়া বাকি দুই মহিলার একটি মুখের অভিব্যক্তি মনঃপূতভাবে আঁকতে পেরেছিলেন পিকাসো৷

  ক্যানভাসের ডানদিকের ওপরের মহিলার(ছবি-১, তুলনা-৪) মুখের যে জটিল অভিব্যক্তিটি— রোজগারের আশায়, যে খরিদ্দারকে বাইরে আহ্বান করছি, সেই খরিদ্দারকেই আবার মনে মনে একেবারেই গ্রহণ করতে পারছি না যদি তার যৌন রোগ থাকে, সেই ভয়ে৷ এই অভিব্যক্তিটি, এই মুখোশটি দেখে, অবশেষে মনঃপূতভাবে এঁকে ফেলতে সক্ষম হলেন পিকাসো(ছবি-৬)৷
  শুধু তাইই নয়, ওই ধরনেরই আর একটু অন্যরকম দেখতে আর একটি আফ্রিকান কাঠের মুখোশ তিনি সংগ্রহ করলেন৷ যেটির থেকে ক্যানভাসের ডানদিকের নিচে বসা মহিলার(ছবি-১, তুলনা-৫) পাপে পরিপূর্ণ মুখের অভিব্যক্তিটিকে মনের মতো ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হলেন পিকাসো(ছবি-৭)৷ 
এইভাবে দীর্ঘ নাটকীয় পরিক্রমাশেষে পোঁতা হল প্রথম কিউবিজম্-এর বীজটি— লে দ্যামোয়াজেলস দ’ অ্যাঁভো৷  (ক্রমশ)

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments