জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -১/ সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম- ১

"নিরপেক্ষতা বলতে সাদা চোখে যা বুঝি তা হচ্ছে, কোনো নির্দিষ্ট পক্ষ অবলম্বন না করে সঠিক বেঠিক বিবেচনা করা।আবার কারও কারও মতে নিরপেক্ষতা হচ্ছে সত্যের পক্ষ নেওয়া। তবে 'সত্য' শব্দটির নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই।"
        সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নিরপেক্ষতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা

অ্যারিস্টটল বলেছেন, "মানুষ 
রাষ্ট্রনৈতিক প্রাণী। যুক্তি তার পথ নির্ণায়ক। যুক্তির বাইরে কিছু অনুসরণ করলে, তার অবনতি হবে। যুক্তি বিরোধী বড় শক্তি যাহা মানুষের মনকে পরিচালিত করে, তাহা ধর্ম বিশ্বাস।" 

  একথা বললে বোধ হয় ভুল বলা হবে না, রাষ্ট্রনীতি অপেক্ষা ধর্মনীতিই আজ পর্যন্ত মানুষের মনে অধিকতর প্রভাব বিস্তার করেছে। মধ্যযুগে ইউরোপে ধর্মগুরুর শিক্ষার মাধ্যমে, জীবনের যা কিছু সমস্যা, তার মাধ্যমে সমাধান হতো। কিন্তু যুক্তিবাদীরা তা মানতে পারেনি, তাই নবজাগরণের আন্দোলন এবং নতুন সমাজব্যবস্থার সূত্রপাত। তখন ধর্ম ছিল রাজনীতির অভিভাবক। এখন যুক্তি ও বিজ্ঞান, ধর্মকে সেই অভিভাবকত্ব থেকে বিতাড়ন করছে। তাছাড়া এই অবস্থান বর্তমান বহু ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ শুধু নয়, বহু জাতির ও অবস্থান। তাই রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য ধর্ম সম্বন্ধে নীরব থাকাই শ্রেয়। কারণ ধর্মের কথা তুললেই, তা সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে পরিণত হবে। আর কোনো ধর্মমতকেই অভ্রান্ত বা সত্য বলে গ্রহণ করা যায় না। অতএব রাষ্ট্রের কর্তব্য ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন থাকা। আর সব ধর্মকে সমানভাবে মান্যতা দেওয়া। সেই থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটির উদ্ভব।

  ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বা Secularism বর্তমান বিশ্বে বহুল প্রচলিত একটি দর্শন। সেক্যুলার রাষ্ট্রদর্শনেরই অপর নাম হলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। এই দর্শনের মূল কথা হলো- পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলো হবে ধর্মের বিধিবিধান মুক্ত। ধর্মের ব্যবহার শুধু ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ থাকবে৷ সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মের ব্যবহার করা হবে না। ইউরোপীয় গির্জার ধর্মযাজকদের অবাঞ্ছিত জুলুমের হাত থেকেও তাদের ধর্মের নামে অধার্মিক শোষণের খড়গহস্তকে নিষ্ক্রিয় করার উদ্দেশ্যে এই মতবাদের উদ্ভব ঘটেছিল।

  ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ আসলে কি? ধর্মনিরপেক্ষতার ইংরেজি শব্দ Secularism, যার উদ্ভব ঘটেছে secularise হতে। যার অর্থ হলো বৈষয়িক, অস্থায়ী, প্রাচীন ইত্যাদি। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হলো ইহলৌকিক, ইহজাগতিক, পার্থিব বিমুখতা। আভিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে বৈষয়িকতাবাদ ইহলৌকিকতাবাদ এবং জাগতিকতাবাদ। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হলো- যা ধর্ম বা আধ্যাত্মিক পবিত্র বলে বিবেচিত নয়; যা ধর্মের সাথে সম্পর্কিত নয়; না কোন ধর্ম বিশ্বাসের অন্তর্গত। আর ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- Rejects all forms of religious faith অর্থাৎ এটি হলো এমন দর্শন যা সকল প্রকার ধর্মবিশ্বাসকে নাকচ করে দেয়। Encyclopedia of Britanica তে বলা হয়েছে যে, যারা কোন ধর্মের অন্তর্গত নয়, কোন ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত নয়, কোন ধর্মে বিশ্বাসী নয় তাদেরকেই বলা হয় ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে- The belief that the state morals, education should be independent of religion. অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ এমন একটি মতবাদ, চিন্তাধারা, বিশ্বাস বা পারলৌকিক ধ্যান-ধারণা ও ধর্মের সাথে সম্পর্কহীনভাবে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে। 

  এখন আসা যাক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উৎপত্তি ও বিকাশের আলোচনায়। সর্বপ্রথম খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রিকরা দর্শন চর্চা করতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উন্মেষ ঘটায়। যারা এসময় গ্রিসে দর্শনচর্চা করত তাদের বলা হতো সোফিস্ট। এই সোফিস্টদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিলেন সক্রেটিস। সক্রেটিসের চিন্তাধারাতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করলেও তিনি নৈতিক শিক্ষার কথা বলেননি। পরবর্তীতে রোমান সাম্রাজ্যে ও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এরপর ধর্মনিরপেক্ষতার আধুনিক ভাবধারার বিকাশ ঘটে মধ্যযুগের শেষের দিকে। পশ্চিম ইউরোপে স্কলাস্টিক ও লসিনলিস্ট দার্শনিকদের ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারা হতে এর ক্ষেত্র তৈরি হয়। লুথার কিং এর খৃষ্টান প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলন যা ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করে। তবে মুখ্যত পঞ্চদশ শতকে ইউরোপীয় নবজাগরণের মধ্যদিয়ে এই মতবাদের বিকাশ ও ব্যপ্তি ঘটেছিল। নবজাগরণের সঙ্গে এই শব্দটি গভীর ভাবে সম্পর্কিত। ইতালীয় ম্যাকিয়াভেলির নৈতিকতামুক্ত থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার মতবাদ এবং ফরাসি বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক করার আন্দোলন প্রভৃতি পরবর্তীতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। এই সময় থেকে ইউরোপ সহ সারা বিশ্বে মধ্যযুগীয় চিন্তা চেতনার, সামাজিক কাঠামোর সম্পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই মতবাদ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে ওতোপ্রোতো যুক্ত হয়ে পড়ে। 
  এদিকে উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে এসে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষ মতবাদ হিসেবে আর্বিভূত হয়। এ সময় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মূল প্রবক্তা ছিলেন জ্যাকব হলিয়ক (১৮১৭-১৯০৮) তিনি ধর্মীয় পরিবেশে লালিত-পালিত হলেও যাজকদের দুর্নীতি, ধর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার এবং তাদের মধ্যে সহানুভূতির অভাব দেখে তিনি চার্চের প্রতি বিমুখ হয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত ১৮৪১ সালে সম্পূর্ণভাবে চার্চ ত্যাগ করেন। তিনি আজীবন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে যান। এর প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হলিয়কের যারা সহযোগী ছিলেন তারা হলেন- ব্রেডলাফ, চার্লস সাউথওয়েল, থোমাস কপার, চার্লস ওয়ার, ডি ডব্লিউ ফুট প্রমুখ। হলিয়ক ও তার সঙ্গীরা নাস্তিকতাবাদী আন্দোলনের বিকল্প অথচ সহধর্মী একটি আন্দোলন ১৮৪৬ সালে শুরু করেন৷ জনগণ যাতে তাদের আন্দোলনকে নাস্তিক্যবাদী আন্দোলন মনে না করে সে জন্য ১৮৫১ সালে তারা সুকৌশলে সেক্যুলারজিম পরিভাষাটি প্রয়োগ করে। কেননা এই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী হলিয়কের সবাই ছিলেন কট্টর নাস্তিক, এমনকি ব্রেডলাফ এবং তার সহযোগীরা এই আন্দোলনকে নাস্তিক্যবাদী আন্দোলন বলে প্রচার করতেও দ্বিধা করতেন না। ব্রেডলাফ বলেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের আন্দোলনকে সফল করতে হলে অবশ্যই নাস্তিকতার ধারণাও প্রচার করতে হবে। তার মতে, নাস্তিকতাবাদ ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ টিকে থাকতে পারে না। তারা একসময় প্রচার করতে থাকে যে, তাদের আন্দোলন আস্তিকতাও নয়, নাস্তিকতাও নয়। যদিও তারা বুঝতেন যে, আস্তিকতাও নয়, নাস্তিকতা ও নয়, এমন ধরনের অবস্থার কোন বাস্তবতা নেই। উনিশ শতকের সত্তরের দিকে যখন ব্রেডলাফ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে তখন পুরো আন্দোলনটি নাস্তিকতাবাদী ও গোড়া ধর্মবিরোধী আন্দোলনের রুপ লাভ করে। এরপর বিশ শতকের দিকে এসে ধর্মনিরপেক্ষতা আন্দোলন স্বতন্ত্র আন্দোলনের মর্যাদা লাভ করে। যার মূল্য উদ্দেশ্য হল সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে ধর্মকে আলাদা করা। এটাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের চূড়ান্ত বিকাশ ও সফলতা।
আবার নিরপেক্ষ শব্দটিকে যদি সন্ধি বিচ্ছেদ করি তবে, নিঃ+ অপেক্ষ। 'নি' মনে নাই।অপেক্ষ বলতে বুঝি শর্তাধীন। অর্থাৎ নিরপেক্ষ মানে শর্তাধীন নয়। আবার নিরপেক্ষ শব্দটি 'নির' প্রত্যয় যোগে উদ্ভূত। যার অর্থ নেই। আর অপেক্ষা শব্দের যে অর্থ বাংলা অভিধান এ আছে, তন্মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে ভরসা বা নির্ভরতা। তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ হবে সেই ব্যক্তি, যে ধর্মের কোন শর্তে আবদ্ধ নয়, কিংবা কোন ধর্মের প্রতি তার কোন ভরসা বা নির্ভরতা নেই। 

  যুক্তিবিদ্যায়, যে পদ অপর কোন পদের উপর নির্ভরশীল নয়, তাকে নিরপেক্ষ পদ বলে। যেমন- মানুষ, মাটি,জল। আবার যে পদের অর্থ অপর কোন পদের উপর নির্ভরশীল তাকে আপেক্ষিক পদ বলে। যেমন, শিক্ষক - ছাত্র। নিরপেক্ষ সত্তা অপর সত্তার উপর নির্ভরশীল নয়। আপেক্ষিক সত্তা অপর সত্তার সঙ্গে সংযুক্ত। পারস্পরিক নির্ভরতা এবং সম্পর্কের ভিত্তিতেই সামগ্রিক সত্তা অপর সত্তার সঙ্গে যুক্ত। পারস্পরিক নির্ভরতা এবং সম্পর্কের ভিত্তিতেই সামগ্রিক সত্তার উদ্ভব। সামগ্রিক সত্তার প্রতি অংশ, অপর অংশের সঙ্গে সংযুক্ত। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ- এর মতে অনন্য নির্ভর স্বাধীন এবং অপরিবর্তনীয় চরম বলে কিছু নাই। তাছাড়া তেমন কোনো অস্তিত্বের কল্পনা করাও চলে না। তাই যে কোনো অস্তিত্ব মাত্রই আপেক্ষিক। কখনো নিরপেক্ষ হয় না। 

আবার অর্থনীতিতে নিরপেক্ষ রেখা (Indifference Curve) হল এমন এক বক্ররেখা যার বিভিন্ন বিন্দু নির্দেশিত দুই বা ততোধিক দ্রব্যের বিভিন্ন সমন্বয়, ভোগকারীর নিকট সমভাবে পছন্দসই হয়। নিরপেক্ষ রেখা বরাবর ভোক্তা প্রতিটি দ্রব্যের ক্ষেত্রেই সমান সন্তুষ্ট থাকে। অর্থাৎ ওই বক্ররেখার কোন বিন্দুতে ভোক্তার কোন নির্দিষ্ট দ্রব্যের প্রতি বিশেষ আকর্ষন থাকে না। ওই বক্ররেখার প্রত্যেকটি বিন্দুতে ভোক্তার সন্তুষ্টি সমান। যদি ঐ রেখার একদিকে হিন্দু এবং অন্যদিকে মুসলিম ধর্ম রাখি, তাহলে ভোক্তা কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি আগ্রহী নয়। বলা যেতে পারে তিনি ধর্ম বিশ্বাসী নয়। (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments