জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩৬/ শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩৬

শ্যামল জানা

দাদাইজম্

আমরা জেনেছি— আগে সবটাই ছিল গ্রাম৷ ধনবান উঁচু তলার মানুষ বলতে বোঝাতো একমাত্র সামন্তপ্রভুদের৷ আর, সম্পত্তি মানে একমাত্র জমি বা ল্যান্ড৷ শিল্প-বিপ্লব বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশনের পর এই সমস্ত ধারণা আমূল বদলে গেল৷ গ্রামের পাশাপাশি গড়ে উঠল শহর৷ ইন্ডাস্ট্রির মালিকেরাও হয়ে উঠল অত্যন্ত ধনবান৷ কারখানায় হাজিরার সূত্রে সময়ও হয়ে উঠল অত্যন্ত মূল্যবান! শুরু হল— ঘড়ি ধরে চলা৷ সমাজজীবনে এল গতি৷ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকল দৈনিক অপরিহার্য বস্তু বা এসেনসিয়াল কমোডিটি৷ পুঁজির ধারণাও একেবারে পাল্টে গেল! এই হল আধুনিকতার প্রথম ধাপ৷
তারপর স্বাভাবিকভাবেই সূত্রপাত হল দখলদারির৷ আর তা থেকে অনিবার্যভাবে তৈরি হল যুদ্ধ-পরিস্থিতি৷ এবং অবশ্যম্ভাবী হল যুদ্ধ! এতৎসত্ত্বেও শুধুমাত্র বাস্তবের কঠিন মুঠোর ভেতরেই ছিল পৃথিবী৷
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওই বাস্তবের কঠিন মুঠো একেবারে আলগা হয়ে গেল৷ বিশ্বযুদ্ধ শুধুমাত্র ঘরবাড়ি-রাস্তাঘাট-সেতু ইত্যাদি ভেঙে তছনছ করে দিল তা নয়, সমাজনীতি-অর্থনীতি-রাজনীতিও ভেঙে তছনছ করে দিল৷ একেবারে আমূল পাল্টে গেল সবকিছু৷ মানুষের চিন্তাভাবনা-মননও৷ সূত্রপাত হল দ্বিতীয় ধাপের আধুনিকতা৷ বিশেষ করে ইয়োরোপে৷
এতদিন যে বাস্তবের বোধ থেকে নীতি তৈরি হত, ঠিক-ভুলের বিচার হত, তা পাল্টে গেল৷ যা কখনো ঘটেনি, বা ধারণাতেই ছিল না, বিস্ময়করভাবে তা ঘটতে শুরু করল৷ আইনস্টাইন-এর থিওরি অফ রিলেটিভিটি বা E=mc2 বা অন্যান্য আবিষ্কার থেকে সায়েন্স ফিকশন-এর সূত্রপাত ঘটল সাহিত্যে৷ সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর থিওরি অফ আনকনসাস-সাবকনসাস মাইন্ড থেকে মানুষের অবচেতনের যে রহস্য জানা গেল, তাও শিল্প-সাহিত্যে প্রবেশ করল৷ কার্ল মার্কস-এর কমিউনিজম্-এর ধারণা, তা থেকে মানুষ বুঝতে পারল— উচ্চ ধনী যেসব কারখানার মালিক বা সামন্তপ্রভুরা যেরকম মানুষ, সেরকম সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েতরাও সমানভাবে মানুষ৷ তারা কীভাবে শোষণ করছে, তার বিজ্ঞান জানল মানুষ৷ এবং সে সবও সরাসরি ঢুকে পড়ল শিল্প-সাহিত্যে৷ শুধু তাইই নয়, শিল্প-সাহিত্য সবার জন্য, সবাই সৃষ্টি করতে পারে, সবাই উপভোগ করতে পারে, সবার সমান অধিকার৷ এই ধারণা থেকে শিল্প-সাহিত্য নানা বিধি-নিষেধের বেড়া ভেঙে প্রকাশ্যে চলে এল৷ সংগীতে নির্দিষ্ট করে দেওয়া যে পর্দার ব্যবহার তাকেও ভেঙে তছনছ করে দিলেন শ্চোয়েনবার্গ! সুচারুভাবে নির্দিষ্ট নিয়মে পংক্তি নির্মাণ না করে, কোনো পদ্ধতির ধার না ধেরে, কোথাও প্রচুর অক্ষর এক জায়গায়, তো কোথাও ছড়ানো ছিটানো কিছু অক্ষর দিয়ে পাতা জুড়ে কবিতা লিখলেন ম্যালার্মে৷ আশা করি মনে আছে, আয়নার কাঁচ ভেঙে যাওয়ার পর তাতে যে কাটা কাটা প্রতিবিম্ব পড়ে, ঠিক সেইভাবে ভাঙাচোরা মানুষের ছবি এঁকে কিউবিজম্-এর সূত্রপাত করলেন পিকাসো৷

শুধু তাইই নয়, সময়টা এমনই এক শূন্য অবস্থানে দাঁড়িয়েছিল যে, ক্রমাগত আরও আরও ভাঙচুরের, মৌলিক সব চিন্তা বা ধারণার জন্ম হচ্ছিল৷ নৈরাজ্যবাদী ও ধ্বংসবাদী অধ্যুষিত হয়ে উঠল রাজনৈতিক বাতাবরণ এবং শিল্প সম্পর্কে যে বাস্তব ধারণা, তাকে ভীষণভাবে আক্রমণ করতে শুরু করলেন নতুন যে সব শিল্পীদের উত্থান হয়েছিল তাঁরা নিজেরাই! প্যারিসে, শিল্পী মার্শেল দুশাম্প নিজহাতে যে সব ইম্প্রেশনিজম্ ও কিউবিজম্ পদ্ধতিতে ছবি এঁকেছিলেন, সেগুলি তিনি সম্পূর্ণ বাতিল করে দিলেন৷ কারণ, তাঁর মনে হয়েছিল ওই ছবিগুলো শুধু চোখে দেখার জন্য! মগজ অবধি পৌঁছায় না! পিকাসোর “লে দ্যামোয়াজেল দ’ অ্যাঁভো” ছবিটি থেকে যেমন কিউবিজম্-এর সূত্রপাত হয়েছিল, তেমনি মার্শেল দুশাম্প-এর একটি কাজ থেকে দাদাইজম্-এর সূত্রপাত ঘটল৷ এ প্রসঙ্গে আমরা “৩০তম” লেখায় খানিকটা আলোচনা করেছিলাম, আশা করি পাঠকদের মনে আছে৷ এখন পুনরায় তা উল্লেখ করা প্রয়োজন—
“ধরা যাক একটি সাইকেল৷ তার কার্যকারিতা, ও তার ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল৷ ধরা যাক একটি ভাস্কর্য(Sculpture)৷ সেটি তৈরির আগে একজন শিল্পী কীভাবে বিষয় ভাবে, তারপর সেই বিষয় অনুযায়ী ভাস্কর্যটি কী রূপ নেবে, কীভাবে তৈরি হবে, তার পরিকল্পনা করে৷ কিন্তু এগুলো যদি কিচ্ছু করতে না হয়? আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকা রেডিমেড যদি কিছু পাওয়া যায়? তাহলে পরিশ্রম করতে হয় না, অভিনবও হয়৷ দুশাম্প ঠিক তাইই করলেন৷
১৯১৩ সালে তিনি ফেলে দেওয়া বাতিল ফ্রক সমেত একটি সাইকেলের চাকাকে একটি কিচেন টুলের ওপর এমনভাবে প্রতিস্থাপন করলেন, যেন কিচেন টুলটি পেডেস্টাল, ও সাইকেলের চাকাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য(Sculpture)(ছবি-১)৷ 

এই যে একটি সচল বস্তু, বাতিল হওয়ার পর তার ব্যবহারিক দিককে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে বিস্ময়করভাবে তাকে একটি নতুন কনসেপ্টে ব্যবহার করা, তাকে শিল্প হিসেবে প্রতিপন্ন করা, রিকনসেপ্ট করা— এটাই হল “রেডিমেড” গ্রুপের প্রধান দর্শন৷ তিনি এভাবে পরের বছরেও(১৯১৪) একটি বোতল শুকোবার গোলাকার তাককে ভাস্কর্যে পাল্টে দিলেন! এইভাবে কিউবিজম্-এর দ্বারা অনুপ্রণিত হয়েও কিউবিজম্-এর ধারণা থেকে অনেকটা সরে গেল৷ একই সাথে দাদাইজম্-এর বীজও বপন করে ফেলল৷” অর্থাৎ কিউবিজম্ অনুপ্রণিত ‘রেডিমেড’ গ্রুপের যে ভিত্তিগত চিন্তা, তাইই রূপান্তরিত হয়ে দাদাইজম্-এর সূত্রপাত ঘটালো৷
আসলে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যে সাংঘাতিক আতঙ্ক, তা একটুও মেনে নিতে না পেরে, তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াস্বরূপ দাদাইজম্-এর জন্ম হয়েছিল৷ বিশেষ করে, সেইসব মানুষদের বিরুদ্ধে, যাদের চেতনায় যুদ্ধ কোনোভাবে দাগ কাটেনি! যেন যুদ্ধ তাদের প্রসন্নতা দিয়েছে! তাঁদের বিরুদ্ধে! দাদাইস্টরা প্রতিবাদস্বরূপ তাঁদের শিল্প থেকে যে তিনটি বিষয় বাদ দিলেন, সেই তিনটিই কিন্তু শিল্পের মূল উপাদান৷ সেই তিনটি হল— Logic, Reason ও Aesthetics ৷ আর, তাঁদের মূল হাতিয়ার হল— ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, তীব্র ননসেন্স-এর খোঁচা, অযুক্তি ও অনুমান৷

“দাদা” কথাটির উৎপত্তি নিয়ে বেশ মতবিরোধ আছে৷ ‘দা’ কথটির অর্থ ‘হ্যাঁ’৷ তাঁবেদাররা যে রকম কথায় কথায় ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ করে, সেরকম ব্যাঙ্গার্থে ‘দা দা’ করা হয়েছে৷ আর একটি মত হচ্ছে— দাদা মানে অনুমানযোগ্য নয়, অস্বচ্ছ, ধোঁয়াশাপূর্ণ৷ যে মতটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, সেটি হল— সুইজারল্যান্ডের জুরিখ প্রদেশে ক্যাবারে ভোলতেয়ার(Cabaret Voltaire)নামে একটি মিউজিক ব্যান্ড-এর দল ছিল৷ যেটি চালাতেন হুগো বল৷ সেই সময়ের বহু গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী, বিশেষ করে যাঁরা যুদ্ধ প্রতিরোধকারী, তাঁরা এর সদস্য ছিলেন৷ ১৯১৬ সালে হুগো বল ওখানে একটি মিটিং করলেন৷ যেখানে ঠিক হল— যুদ্ধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তাঁদের শিল্পের দলটি শূন্যতাবাদী(Nihilistic) ও সৌন্দর্যবিরোধী(Antiaesthetic) আন্দোলন গড়ে তুলবে৷ ওই মিটিং-এ উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ সব শিল্পীরা যেমন— জাঁ আর্প, রিচার্ড হুলসেনবেক, ত্রিস্তান জারা , মার্শেল জাঙ্কো , ও এমি হেনিংস৷ দলটির নাম ঠিক করার জন্য তাঁরা একটি ফ্রেঞ্চ-জার্মান অভিধান নিয়ে বসলেন৷ পাতা খোলা অবস্থায় তার ওপরে একটি কাগজকাটা ছুরিকে বিদ্ধ করা হল৷ তখন ‘দাদা’ নামটি পাওয়া গেল, যেন এটাই সবচেয়ে সঠিক নাম, এটাই আমরা চাইছিলাম৷ ফ্রেঞ্চ ভাষায় ‘দাদা’ মানে ‘hobby-horse’ ৷ বাংলায় যাকে বলে ছোটো অথচ শক্তিশালী পাহাড়ি ঘোড়া(মতান্তরে গাধা)৷ যে পাহাড়ে চড়াই-উৎরাইয়ের সময় কোনো নিদিষ্ট নিয়ম মেনে চলে না৷ চলনে কোনো সৌন্দর্য নেই৷ গলার স্বর কর্কশ৷ অথচ কখনো পা ফস্কায় না, পড়ে যায় না৷ যেখানে পৌঁছোতে চায়, সেখানে ঠিক পৌঁছে যায়, কখনো ভুল হয় না৷ এইভাবে দলের নামকরণ হল— দাদা৷

১৯১৬ সালে সুইজারল্যান্ড-এর জুরিখ প্রদেশ থেকে শুরু হলেও তা দ্রুত ছড়িয়ে গেল পৃথিবী জুড়ে৷ জার্মানির বার্লিন-এ কোলন-এ, হ্যানোভার-এ, নিউ ইয়র্ক সিটিতে, প্যারিস-এ৷                                                 (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরিস্থিতিতে তা একটু স্তিমিত হয়ে গেছিল৷ এই যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর, অর্থাৎ ১৯১৮ সালের পর আর্ট ডিলার লিওন্স রোজেনবার্গ-এর পৃষ্ঠপোষকতায় আবার স্বমহিমায় ফিরে এসেছিল কিউবিজম্৷ আবার শিল্পীদের প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিল কিউবিজম্৷ 
🎨

Post a Comment

0 Comments