জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস - ৩৭/শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩৭

শ্যামল জানা

দাদাইজম্ (দ্বিতীয় অংশ)

ছবি আঁকার প্রেক্ষিতে এযাবৎ যত দল বা মতবাদের(Ism) জন্ম হয়েছে, তাদের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবনা, বিপরীত অবস্থান, ও বিপরীত দর্শন থেকে দাদাইজম্-এর জন্ম হয়েছিল! অতি বিস্ময়ের এই, যে, একটি শিল্প সংক্রান্ত ইজম্-এর জন্ম হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে শিল্পকে বাদ রেখে! প্রথমত এই দাদাইজম্ কোনো শিল্পের সংকট বা কোনো শিল্পের কন্ডিশন থেকে জন্মাচ্ছে না! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে যে মনুষ্যত্বের বা মানবিকতার সংকট, তার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর প্রতিবাদস্বরূপ এই দাদাইজম্ জন্মাচ্ছে৷
এঁরা মনে করছেন— এই যে মানুষ ক্রমশ সভ্য হচ্ছে, ক্রমশ আধুনিক হচ্ছে, তার পরিণাম যদি যুদ্ধ হয়, তাহলে সেই সমাজের সংরক্ষণ করার মতো এমন কোনো ঐতিহ্য থাকতে পারে না! কারণ এ তো পুঁজিবাদের ঐতিহ্য! আমরা মানি না! আমরা সমস্ত রকমের সংরক্ষণশীলতাকে অস্বীকার করছি৷ যুদ্ধ কোনো সৌন্দর্যও বহন করে না! যুদ্ধের পক্ষে কোনো রকমের কোনো যুক্তি থাকতে পারে না! তাই, তাঁরা কোনো আর্টিস্টিক স্টাইলকেই গ্রহণ করলেন না! ঠিকমতো ভাবলে চরম বিস্ময়ে মাথা ঘুরতে শুরু করে! যে, সৃষ্টিশীল শিল্পের যে তিনটি মূল উপাদান, যেটা ছাড়া কোনো শিল্পই সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়— Logic, Reason ও Aesthetics — এই তিনটি উপাদানকেই তাঁরা শিল্প থেকে বাদ দিচ্ছেন! কীভাবে?
ধরা যাক আমি একটি প্রেমকে বিষয় করে ছবি আঁকব, তাই ছবিতে ফুল ব্যবহার করলাম— না, এটি Logic  হয়ে গেল, করা যাবে না! যেহেতু ফুল প্রেম-ভালোবাসার প্রতীক৷ কোনো ছবিতে আমি বৃষ্টি পড়ছে আঁকলাম৷ তার সাথে রাস্তায় একজন ছাতা মাথায় মহিলাও যাচ্ছে আঁকলাম, কারণ বৃষ্টি পড়ছে বলে সে ছাতা মাথায় দিয়েছে— না, এটি করা যাবে না, যেহেতু বৃষ্টি পড়ার কারণেই মহিলাটি ছাতা মাথায় দিয়েছে৷ এটি Reason হয়ে গেল৷ আর, এমন কোনো শিল্পকর্ম, যা দেখে মানুষ অভিনব অর্থে বিস্মিত হবে, অথচ, “বাঃ! কী সুন্দর”— এই বোধে কেউই আক্রান্ত হবে না(ছবি-২)৷ 

যদি হয়, তাহলে সেটি Aesthetics হয়ে গেল, করা যাবে না৷

পাঠক, একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন— এই সমস্ত শর্ত মাথায় রেখে সাধারণভাবে কোনো মৌলিক ছবি আঁকা যায় না, বা মৌলিক ভাস্কর্যও করা যায় না! তবে, পুরোনো কোনো ছবিকে বিকৃত করা যেতে পারে(ছবি-১৷একদম ওপরের ছবি)৷ বা, প্রথাগত শিল্প-পদ্ধতিকে বাইপাস করে অন্য আর একটি বা একাধিক বিকল্প পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে৷ এবং এই দাদাইস্টরা তাইই করেছিলেন৷ তাঁরা যে বিকল্প পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করেছিলেন, সেগুলির অধিকাংশ হল— কোলাজ, ফোটোমন্তাজ, ‘ফাউন্ড অবজেক্ট কনস্ট্রাকশন’ বা ইনস্টলেশন ইত্যাদি৷
 কারণ, তাঁরা মনে করছেন— ওই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই তিনটি উপাদান (Logic, Reason ও Aesthetics) শিল্পে যেভাবেই আসুক না কেন, তাতে তৎকালীন আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজেরই(Modern capitalist society) প্রতিফলন ঘটবে৷ তাই, তার বদলে প্রতিবাদস্বরূপ তাঁদের শিল্পের উপাদান হচ্ছে— Nonsense (অর্থহীনতা), Irrationality (অযুক্তিকতা), ও Anti-bourgeois (সংরক্ষণশীলতার বিরোধিতা) স্রেফ ভাবা যায় না(ছবি-১৷একদম ওপরের ছবি)! 

শুধু তাইই নয়, আশ্চর্যের বিষয় এই, যে, এই দাদা আন্দোলন শুধুমাত্র দৃশ্যশিল্পের মধ্যে আটকে থাকল না! একই সাথে সাহিত্যে এবং শব্দমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ল! এবং সে ক্ষেত্রেও তাঁরা প্রথাগত ব্যাপার-স্যাপার এড়িয়ে গিয়েছিলেন৷ দৃশ্য-শিল্পের ক্ষেত্রে রং-তুলি নয়, কোলাজকে; শব্দ-শিল্পের মধ্যে সংগীত নয়, ‘সাউন্ড পোয়েট্রি’-কে; আর, সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাধারণ গদ্য নয়, ‘কাট-আপ রাইটিংস’-কে তাঁরা হাতিয়ার করেছিলেন৷ এক্ষেত্রে ‘সাউন্ড পোয়েট্রি’ বলতে বোঝাচ্ছে— "verse without words"৷ যা কিনা সাহিত্য আর মিউজিক্যাল কম্পোজিশনের মাঝখানে সেতু হিসেবে কাজ করে৷ যেখানে আভিধানিক শব্দার্থ বা বাক্য গঠনের বদলে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকেই ধ্বনি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যেহেতু লেখার ব্যাপার থাকে না, তাই এটি পারফর্মেন্স৷ আর, কাট-আপ রাইটিংস হচ্ছে— একটি সাধারণ বাক্যকে কেটে কেটে ছোটো করে ফেলা৷ যেমন— “এখন সকাল হয়েছে৷ কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে চারদিক৷ সবকিছু ঝাপসা লাগছে৷” এই বাক্যটি কাট-আপ রাইটিংস-এ হয়ে যাবে— “সকাল৷ কুয়াশাচ্ছন্ন৷ ঝাপসা”৷

এই যে দাদাইস্টরা এতকিছু করছে, সেগুলি যত না শিল্পের জন্য, তার চেয়ে বেশি যুদ্ধ, যুদ্ধকালীন হিংস্রতা, ও তৎকালীন জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অসন্তোষের কারণে! এবং এ জন্য তাঁরা তৎকালীন “radical left-wing” পার্টির সঙ্গে যুক্তও হয়েছিলেন৷
এই যে, দাদাইস্টরা এতকিছু করলেন, তৎকালীন শিল্পী বা শিল্প-সমালোচকরা তা কীভাবে গ্রহণ করলেন? তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ! আমরা আলোচনায় না গিয়ে যদি সেই সময়ের চার রকমের চারজনের মতামত তুলে ধরি তাহলে অনেকটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে৷

এক শিল্প ইতিহাসবিদ বলছেন— "reaction to what many of these artists saw as nothing more than an insane spectacle of collective homicide".
সেই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা— ‘American Art News’-এ তাঁদের একজন আর্ট ক্রিটিক দাদা প্রসঙ্গে রিভিউ লিখছেন— "Dada philosophy is the sickest, most paralyzing and most destructive thing that has ever originated from the brain of man".
তৎকালীন জার্মানীর সবচেয়ে আধুনিক চিত্রশিল্পী ‘হানস্ রিখটার’-এর মতে— Dada was not art: it was "anti-art." Dada represented the opposite of everything which art stood for. Where art was concerned with traditional aesthetics, Dada ignored aesthetics. If art was to appeal to sensibilities, Dada was intended to offend.
    যাঁর হাত ধরে দাদাইজম্-এর সূত্রপাত হল, সেই ‘হুগো বল’ অনেকটা কৈফিয়ৎ-এর মতো করে জানাচ্ছেন— "For us, art is not an end in itself ... but it is an opportunity for the true perception and criticism of the times we live in."                                (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

1 Comments