জ্বলদর্চি

পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা - ২৯/বিমল মণ্ডল

Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
পর্ব- ২৯
চতুর্থ অধ্যায় || বাক্যতত্ত্ব (Syntax) 

৮.বাক্যঃ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ 

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় সাধারণত মান্য চলিত বাংলার ন্যায় বাক্যের উক্তিগত দিক থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ — এই দুই প্রকার রীতির ব্যবহার  দেখা  যায়। প্রায়শই  এই সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় প্রত্যক্ষ বাক্যের প্রয়োগ  বেশি দেখা  যায়। তবে কোন কিছুর বর্ণনা বা বিবৃতির সময় বা বিশেষ করে লোককথা বা গল্প কাহিনীতে পরোক্ষ বাক্যের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।যেমন-

৮.১.প্রত্যক্ষ বাক্য(Direct Narration):

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় প্রত্যক্ষ  বাক্যের ব্যবহার  দেখা  যায়।  তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বাক্যের ব্যবহার চলিত বাংলার মতো  এই জেলার মৎস্যজীবীদের  কথ্যভাষায় প্রয়োগ  হতে দেখা যায়।যেমন—

ক. মাজিয়া দা কইথলা,"আমি আইজ মাচ ধত্তে যাবানি।"(মেজো দাদা  বলেছিল,"আমি আজ মাছ ধরতে যাব না।")
খ.হায় আল্লা,"আমি নোউকায়  কতবানু দেড়ি আছি।"
( হায় আল্লা," আমি নৌকায় কত সময় ধরে দাঁড়িয়ে  আছি।")
গ.সোউ কইথলো,"মোরমোনে  জাল মাত্তে যাবো।"( সে বলেছিল,"আমরা জাল মারতে যাব।")
ঘ.নজু মাঝি ডাকিয়া কটে," আমি অখুঁই পান্তা খাইতে যাইটি।"
( নজু মাঝি  ডেকে বলেছিল,"আমি এখুনি পান্তা খেতে যাচ্ছি।"
ঙ.লোকটা  কউছি,"মুই কুনঠি যিবা?"( লোকটা  বলেছিল, "আমি কোথায় যাব?")

৮.২.পরোক্ষ বাক্য( Indirect Narration) :

 এই জেলার  মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায়  ব্যবহৃত পরোক্ষ বাক্যে অতীত ও ভবিষ্যৎ কালের বক্তা শুধুমাত্র উদ্দিষ্ট  ব্যক্তিটির সর্বনাম পদের পরিবর্তন  করে থাকে এবং মান্যচলিত  ভাষার মতোই সেই পরিবর্তিত পদানুসারে ক্রিয়াপদের বিভক্তিগত দিক থেকে  পরিবর্তন  হয়।যেমন—

ক.মা কহিল্লা তার শরীর খেরাপ।( মা বলেছিল যে তার শরীর  খারাপ।) 
খ.বাপরে অউ ভলা মাচ অতো দর দিয়া লুবানি।( বাবাগো এই ভোলা মাছ এতো দাম দিয়ে নেবো না।)
গ.ওনে কইথলো অতগামাচ কাই রাখবে? ( ওরা বলেছিল যে এতো মাছ কোথায় রাখবে?)
ঘ.তান্নে কঠে মাচ একলা একলা লিয়াবে।( তারা বলেছিল যে তারা মাছ একা একা নিয়ে যাবে।)
ঙ.তন্নে কইথলু ওউঠি মাচ ধরবু।( তোরা বলেছিলি যে এখানে মাছ ধরবি।)

৯. বাচ্য (Voice) :

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় সাধারণত  মান্যচলিত  বাংলা ভাষার মতোই এখানেও কর্তৃবাচ্য, কর্মবাচ্য ও ভাববাচ্য— এই তিন রকমের বাচ্যের প্রয়োগ দেখা যায়।তবে এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় প্রায়শই  কর্তৃবাচ্যের ব্যবহার বেশি দেখা  যায়। 

৯.১. কর্তৃবাচ্য(Active Voice):

আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে যেখানে ক্রিয়ার কাজ কর্তা-ই করে,কর্তাই বাক্যের মধ্য প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়,তাই কর্তৃবাচ্য।এই বাচ্যে কর্তা প্রথমা বিভক্তি হয় এবং ক্রিয়া সকর্মক হলে কর্ম দ্বিতীয়া বিভক্তি  হয়।কর্তাকে অনুসরণ করে ক্রিয়ার রূপ উত্তম,মধ্যম অথবা প্রথম পুরুষের হয়।সুতরাং   পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের  কথ্যভাষায় এই চলিত বাংলার মতো এখানেও কর্তৃবাচ্যে ক্রমানুসারে কর্তা,কর্ম এবং ক্রিয়াপদ বসে।যেমন-

ক.মুই দুফুরবেলায় নউকা তুই লিয়াসবো।(আমি দুপুরবেলায়  নৌকা তুলে নিয়ে আসবো।)
খ.তুমি দুটা ভাত খাই লও।( তুমি দুটো ভাত খেয়ে নাও।)
গ.মন্টুয়া মাচ ধরেটে।( মন্টু মাছ ধরছে।)
ঘ.তন্নে দেঁড়িয়া র।( তোরা দাঁড়িয়ে  থাক।)
ঙ.মোনে জাল টাইথলি।( আমরা জাল টেনে ছিলাম।)

৯.২.কর্মবাচ্য (Passive Voice) :

যেখানে কর্মই মুখ্য- রূপে দেখা দেয়,কর্তা অপেক্ষা কর্মের সঙ্গে ক্রিয়ার ঘটনার প্রধান যোগ কল্পিত হলে কর্মবাচ্য হয়। চলিত বাংলার মতো পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় কর্মবাচ্যে কর্মপদ প্রথমে ব্যবহার হয় এবং কর্তার উত্তরে দিয়া, থেকিয়া  প্রভৃতি অনুসর্গ এবং রে, তে ,এর,এ প্রভৃতি  বিভক্তির প্রয়োগ  লক্ষ্য করা  যায়। যেমন—

ক.তনকের দিয়া মাচ ধরা হবেনি।( তোদের দ্বারা মাছ ধরা হবে না।)
খ মাইটকাটার মাচ কুটা শেষ  হইচে।( মেয়েটির  মাছ কাটা শেষ  হয়েছে।) 
গ.তারুনকের  কথা শুঁতে হবে।( তাদের কথা শুনতে হবে।)
ঘ.বাগ তানকের খায়ালিছে।( বাঘ তাদের খেয়ে নিয়েছে।)
ঙ.মোর গাঙ দেখা হউচি। ( আমার সমুদ্র দেখা হচ্ছিল।) 

৯.৩.ভাববাচ্য(Impersonal Voice):

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় সাধারণত  ভাববাচ্যের ব্যবহার  দেখা যায় সামাজিকতা,ভদ্রতা রক্ষার প্রয়োজনে।বিশেষত অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত কিংবা বয়সে বড়ো বা ছোটো অথচ অচেনা মানুষদের সাথে কথা বলবার সময় ভাববাচ্যের প্রয়োগ  দেখা  যায়  তবে এখানে প্রশ্নাত্মক বাক্যেও ভাববাচ্যের ব্যবহার  হয়। অর্থাৎ  ক্রিয়াপদই যেন কর্তার স্থানটি অধিকার  করে। সাধারণত  এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় ভাববাচ্য প্রায়শই  লক্ষ্য করা যায়। যেমন—

ক.তনকের কতবা আসা হইচে?( তোদের কখন আসা হল?)
খ.নউকার ভিতরমা বুসা হউ।( নৌকার ভেতরে বসা হোক।)
গ.মোর খুপ যন্ত্ররনা হউছি।(আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।) 
ঘ.শুয়া হইচে?( শোওয়া  হয়েছে?)
ঙ.মাচ ধত্তে যাওয়া হইথলো।( মাছ ধরতে যাওয়া  হয়েছিল।)
চ.কতবানু আসা হইচে?( কখন  থেকে আসা হয়েছে?)
ছ.তারুনকের  আসা হল্লা।( তাদের আসা হল।)
জ.কতবা আসা হতলা?( কখন  আসা হল?)
ঝ.ওউঠিটা খাড়া হবা।( এখানে দাঁড়ানো হবে।)
ঞ.মোর একি হেইলা?(আমার কি হল?)

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় মান্যচলিত ভাষার মতো বাক্যতত্ত্বের বিভিন্ন দিক আলোচনা করলাম। এই জেলার কথ্যভাষায় যে শব্দভাণ্ডার সমীক্ষায় উঠে এসেছে তা পরবর্তী পর্বে তা বিভিন্ন শ্রেণী বিভাগ করে আলোচিত হবে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments