জ্বলদর্চি

'নববর্ষ উদ্ভাসিত হোক নতুন আলোকে'/পার্থ সারথি চক্রবর্তী

'নববর্ষ উদ্ভাসিত হোক নতুন আলোকে'

পার্থ সারথি চক্রবর্তী 

বাংলা নববর্ষ শুরুর দিনটি আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের কাছেই আনন্দের ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রত্যেকের কিছু না কিছু  সুন্দর স্মৃতি অবশ্যই জড়িয়ে আছে এই দিনটির সঙ্গে। ইতিহাস ঘাঁটলে এই বঙ্গাব্দ বা নববর্ষের শুরু 'পহেলা বৈশাখ' সম্পর্কে কিছু বিষয় জানতে পারা যায়।
 কেউ কেউ বাংলা নববর্ষের উদ্ভবের কৃতিত্ব ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্ককে দিয়ে থাকেন। পরবর্তীতে মুঘল বাদশাহ আকবর এটিকে পরিবর্তন করেন 'কর বা রাজস্ব' আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা পাওয়ার জন্য। এর আগে মুঘল সাম্রাজ্যের সব বাণিজ্য ইসলামিক হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী করা হোত। তিনি একে পরিবর্তন করেন যাতে সরকারি খাজনা আদায় সহজ ও সরল হয়। চৈত্রের শেষে চাষীর গোলা শস্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত। ফলে তারা ফসল বিক্রি করে সহজেই খাজনা বা কর প্রদান করতে সমর্থ হতেন। জানা যায়,  ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে তা কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসনে আরোহণ কাল(১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এর নাম ছিল ফসলি সন, পরে 'বঙ্গাব্দ' বা বাংলা সন হিসেবে পরিচিত হয়। মুল তত্ত্ব কিন্তু একটা জায়গায়, বকেয়া সব কর বা খাজনা ৩১ শে চৈত্রের মধ্যে চুকিয়ে দেওয়া। সেই থেকে আসে 'হালখাতা' র ধারণা। তবে এখন পহেলা বৈশাখের গুরুত্ব শুধুমাত্র বাণিজ্য বা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয়। অনেক বৃহত্তর প্রেক্ষাপট নিয়ে আজ পহেলা বৈশাখের ব্যাপ্তি বা বিস্তৃতি। সামাজিক, সাহিত্য ও সংস্কৃতি মূলক ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে বাঙ্গালী জীবনে আজ পহেলা বৈশাখের গুরুত্ব অসীম। শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ নয়, গোটা পৃথিবীর সমস্ত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এই দিনটি এক আনন্দের দিন। উৎসব ও উদ্দীপনার দিন। পুরনো বছরের সমস্ত দুঃখ,জরা, ক্লেশ, গ্লানি ভুলে গিয়ে মানুষ মেতে ওঠে নব আনন্দে, নতুন আশায়। এগিয়ে চলে এক নতুন দিনের স্বপ্নে, নতুন প্রভাতে।

আজো বাংলাদেশে মহা ধুমধাম করে নববর্ষ পালিত হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা, নৌকা বাইচ,  বৈশাখী মেলা ইত্যাদি আয়োজিত হয় সর্বত্র। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গে সর্বত্র মানুষ যার যার সামর্থ্য মোতাবেক নতুন জামা পরিধান করেন। মেলা, উৎসব ইত্যাদিতে অংশ নেন। অনেক সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজিত হয়। নতুন পত্রিকা প্রকাশিত হয়। নতুন লেখায় সুসজ্জিত নতুন বই বা ম্যাগাজিন সাহিত্য পাগল বাঙালীকে উদ্বেলিত করে তোলে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে শিবের পুজো করা হয়। গাজন পুজো বা চড়ক পুজো করা হয়। বছরের শেষ দিন চড়ক মেলা সংগঠিত হয়। সেই উপলক্ষ্যে বিরাট মেলা আয়োজিত হয়। প্রচুর লোকের সমাগম হয়। চড়কের মেলা বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।
নিজের অভিজ্ঞতার ভান্ডারে উঁকি দিলে দেখা যায়, বাবা মায়ের সাথে দোকানে দোকানে হালখাতা সারতে যাওয়ার স্মৃতি আজো উজ্জ্বল। সময়ের সাথে সাথে হয়ত পরিস্থিতিতে বদল এসেছে। আর গত এক বছরের বেশি সময় ধরে গোটা বিশ্ব যে অতিমারির বিরুদ্ধে লড়ছে, তার ফলে যে কোন উৎসব পালনের ক্ষেত্রে বাধা আসা বা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে ' নিউ নর্মাল ' পরিস্থিতি তেও মানুষ সীমিত অবসরে মেতে উঠেছে। আসলে মানুষ তো বেশি দিন কালের দাস হয়ে থাকতে চায় নি বা থাকেও নি। বরং সে কালকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। তাই তো আজ কিছু প্রতিষেধক উঠে এসেছে গবেষণা থেকে। যদিও সেগুলো কতটা কালোত্তীর্ণ, তার উত্তর কালের গহ্বরেই প্রোথিত আছে। তবে মানুষ হাল ছাড়েনি। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতাটাই আসল।

নববর্ষ বয়ে নিয়ে আসে নতুন ভাবনা, নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা ধারণা। নতুন প্রজন্মকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। চারিত্রিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অপ্রতুলতা সমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে। কখনো বা নাড়িয়ে দিচ্ছে সামাজিক ভিত্তি। সত্যের অপলাপ ও মিথ্যার জয়জয়কার গোয়েবলসের তত্ত্বকে সত্য প্রমাণিত করে চলেছে।  রাজনীতির আঙ্গিনায় এক অভূতপূর্ব দৈন্য দিনদিন প্রকট হয়ে উঠছে। যে দেশের রাজনীতিতে পথ দেখিয়ে গিয়েছেন গান্ধীজী, নেতাজী, আবুল কালাম আজাদের মতো ব্যাক্তিত্বেরা; সেখানে রাজনীতির নামে কেবলমাত্র মিথ্যাচার, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন এবং পরিশেষে নিজের আখের গোছানোই মূল লক্ষ্য হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে হবে। যুবসমাজকে দেশপ্রেম ও সত্যের পথে নিয়ে আসতে হবে। অলস ও ভোগসর্বস্ব জীবন পরিত্যাগ করে পরিশ্রম, সাধনা ও চরিত্র গঠনের মাধ্যমে এক সুস্থ, প্রগতিশীল,পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব সমাজ গড়ে তুলতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও স্বনির্ভরতার পথে। গোটা বিশ্বকে পথ দেখাবে আমাদের দেশ। আর এক্ষেত্রে সমস্ত জড়তা ত্যাগ করে প্রথম সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেবে বাঙালী।
নব নব ধারণায় সাজিয়ে তুলবে রাজ্য, দেশ তথা সমাজকে। তবেই না নববর্ষ উদযাপন তথা ' পহেলা বৈশাখ' পালন সার্থক হবে!
নববর্ষ আলোকিত হয়ে উঠবে নতুন সূর্যালোকে, নতুন প্রভাতে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments