জ্বলদর্চি

পয়লা বৈশাখের সেকাল একাল/শ্রাবণী গুপ্ত

পয়লা বৈশাখের সেকাল একাল

শ্রাবণী গুপ্ত

কাটোয়ার মতো নিতান্ত ছোট শহরে বেড়ে ওঠার কারণেই আমার মূল্যবোধ, আমার ধ্যান ধারণা হয়তো অনেকটা সাবেকি। আজকাল তো কত কথাই শুনি, 'সাবেকি পোশাক' 'সাবেকি গয়না' ইত্যাদি ইত্যাদি কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমরা আমাদের জীবনচর্যা যেন ভুলতেই বসেছি। ভুলে গেছি কত পরম্পরায় জড়িয়ে ছিলাম আমরা, ভুলে গেছি আদব-কায়দা নিয়ম-কানুন। 

    চৈতন্য মহাপ্রভুর স্মৃতি বিজড়িত শহর কাটোয়ায় কেটেছে আমার মেয়েবেলা। তখনও বাড়িতে বাড়িতে তিন দিন ধরে চলতে থাকা কীর্তন, আমাদের রাতের ঘুমকে তাড়া করে বেড়ায় নি, তখনও সদ্য কেনা সাটার লাগানো "সোনোডাইন" টেলিভিশনে 'মহাভারত' নামক মেগাসিরিয়াল দেখতে আসতে সংকোচ করত না পাড়ার বয়স্ক মানুষজন থেকে কচিকাঁচার দল। খুব মনে পড়ে, সমর মামার কথা, যার সোনার দোকানে তখন থেকেই মা আমার জন্য অল্প অল্প করে সোনার গয়না গড়তে দিতেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের মায়েদের কাছে এ যেন এক প্রথার মতোই ছিল। পয়লা বৈশাখে সেই সব সোনার দোকানে কী ভিড় কী ভিড়! মায়ের হাত ধরে গেছি এ দোকান থেকে দোকান। হাতে ক্রমশঃ বাড়তে থেকেছে মিষ্টির প্যাকেট আর লক্ষ্মী-গনেশের ছবি দেওয়া পঞ্জিকা ক্যালেন্ডার। কখনো কখনো সিনারি দেওয়া ক্যালেন্ডার যে জুটত না এমনও নয়। আর মিষ্টির প্যাকেট মানেই লাড্ডুতে হাবুডুবু। অন্য মিষ্টিও থাকত বৈকি। খাতির একটু বেশি থাকলে কাঁচের বোতলে লিমকা কিংবা সিট্রাও পাওয়া যেত এক আধটা। গ্রীষ্মের তীব্র গরমে ঘাম মুছতে মুছতে মা আমার মুখে ধরতেন কোল্ড ড্রিংকস-এর বোতল। তখনও ঘরে ঘরে রেফ্রিজারেটরে আইসক্রিম রাখা এমন বাধ্যতামূলক ছিল না। অতিথি এলে লেবু চিনির সরবতই সহবত দেখানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। আর একটা কথা বেশ মনে পড়ে, আমার স্বাধীনতা সংগ্রামী দাদুর পেনসনভোগী বিধবা দিদা আমার জন্য কিনে দিতেন ছিটকাপড়, যা দিয়ে মা বানিয়ে দিতেন সুন্দর সুন্দর জামা। তখনতো নতুন জামা পেতাম বছরে দু'বার, এক পুজোর সময় আরেক পয়লা বৈশাখে। লাল রঙের কাপড়ে সাদা ফুলের ছাপ কিংবা সাদা রঙে নীল ডোরাকাটা জামায় ঝলমলিয়ে উঠত আমার মত সদ্য কিশোরী হয়ে ওঠা মেয়েরা। তখনকার পয়লা বৈশাখ ছিল সহজ সরল স্বাভাবিক, এখনকার মতন ডিজাইনার পোশাকে দম্পতির সেজে ওঠার তাগিদ বা সুযোগ কিছুই হয়তো ছিল না। মায়ের জন্য বাবা নিয়ে আসতেন গোটা চারেক সুতির ছাপা শাড়ি, যেগুলি ছিল মায়ের সেই বছরের জন্য বরাদ্দ ঘরে পড়ার শাড়ি। সেলের বাজারের রমরমা তখনও ছিল তবে তা ভিন্ন ধরণের। যেহেতু পয়লা বৈশাখ মানে পুরোনো বছরের সমস্ত দুঃখ-গ্লানি-অবসাদ মুছে ফেলার উৎসব, তাই দোকানগুলিও সেজে উঠত নতুন রঙে নতুন ঢঙে। আর তাই পুরোনো অবিক্রিত পোশাক স্বল্পদামে বিক্রি করে দেওয়া হতো। সারা বছর ধরে চলতে থাকা বিকিকিনির কারণে ক্রেতা বিক্রেতাদের তৈরি হত এক সুন্দর সম্পর্ক। পয়লা বৈশাখের দিন তাই হালখাতা নিয়ে বসতেন দোকানের মালিকেরা, আর ক্রেতারা বিগত বছরের সমস্ত ধার দেনা মিটিয়ে দিতেন ঐ দিনে। তখন হয়তো মানুষের হাতে অর্থের প্রাচুর্য ছিল না, তখন হয়তো এত বড় বড় শপিং মল তৈরি হয়নি কিন্তু তখন যা ছিল এখন আর তা বোধহয় নেই। ক্রমশঃ হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস, বাড়তে থাকা লোভ, সংযমের অভাবে যেন ক্রেতা বিক্রেতার পারস্পরিক সেই সুন্দর সম্পর্ক হারিয়ে গেছে। "মানুষ বড়ো একা, তুমি মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াও" বলার লোক এখন কমে গেছে। 

   তখনও এখনকার মতো ছোট ছোট শহরে পয়লা বৈশাখের দিনে মন্দিরে মন্দিরে সকাল সকাল ভিড় জমত হালখাতার পুজো করবার জন্য। ভিড় করত গৃহিণীরা পরিবারের মঙ্গল কামনায়। নতুন ছাপা কিংবা তাঁতের শাড়িতে আর শাঁখা-পলা-সিঁদুরে যেন রমণীরা সাবেকি বাঙালিয়ানা ফিরিয়ে আনত। বাড়িতে বাড়িতে রান্না হত কতরকম পদ। এখনও যে হয় না সে কথা বলব না। তবে কর্মব্যস্ত জীবনে এসব অনেকখানিই কমে গেছে। 

   শ্রী শ্রী গনেশ হল সমৃদ্ধির দেবতা আর মা লক্ষ্মী ঐশ্বর্যের দেবী। আর তাই পয়লা বৈশাখের দিনে সমস্ত বাঙালি ঐ দুই ইশ্বরের কাছে পরিবারের সুখ সমৃদ্ধি-এর কামনা করেন। এখন হয়তো ধুতির চল নেই তবে পাঞ্জাবি পড়ে বাঙালিয়ানা দেখানোর এ এক সুন্দর দিন। সারাবছর নাইবা পড়লাম শাড়ি কিংবা পাঞ্জাবি, সারাবছর নাইবা জুটলো মায়ের হাতের পঞ্চব্যন্জ্ঞন  কিন্তু ঐ একটি দিন বাঙালির যেন পুরোপুরি বাঙালি হয়ে ওঠার দিন। 

    পয়লা বৈশাখ পালনের শুরু হয়তো হয়েছে অনেক আগেই, শোনা যায় সম্রাট আকবরের আমলে বাঙালি ক্যালেন্ডারের সূচনা হয়। তৎকালীন সময়ে মূলত খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে এই নতুন ধরনের সনের ব্যবস্থা করা হয়। সমস্ত খাজনা মিটিয়ে পুরোনো খাতার পাট চুকিয়ে নতুন হালখাতা করার রেওয়াজ সেই তখন থেকেই। আর খাজনা পরিশোধ করার পর মিষ্টি খাওয়ানো হত সকলকে। এখনও গ্রামগঞ্জে পয়লা বৈশাখে ক্রেতাদের মিষ্টি খাওয়ান অনেক দোকানের মালিকেরা। সময়ের সাথে সাথে পয়লা বৈশাখ নামক উৎসবের আঙ্গিক কিছুটা বদলে গেলেও বাঙালির মননে এই দিনটির যে বিশেষ তাৎপর্য আছে তা ঐদিন পশ্চিমবঙ্গের রাস্তায় মানুষদের দেখলেই বোঝা যায়। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে তাই পয়লা বৈশাখ এখনও এগিয়ে আছে এ কথা নির্দ্বিধায় বলাই যায়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments