জ্বলদর্চি

নববর্ষের প্রাসঙ্গিকতা-তার চিরন্তনতায়,শুভময়তায়/আবীর ভট্টাচার্য্য

নববর্ষের প্রাসঙ্গিকতা-তার চিরন্তনতায়,শুভময়তায়

আবীর ভট্টাচার্য্য

উৎসবপ্রিয় বাঙালিজীবনে যত সমস্যাই থাক না কেন, শুধু দিনযাপনের, শুধু প্রাণধারনের গ্লানি তার সয় না, তাই সুযোগ পেলেই সাধারণ প্রাত্যহিকতায় নব-আনন্দে উদযাপনের ঘট সাজায়,ক্ষণিক সুখের আশায়। তা সে পারিবারিক ক্ষেত্র হোক বা সামাজিক। নববর্ষ বাঙালী সমাজজীবনে তেমনই এক আনন্দঘন দিন, স্মৃতিমেদুর আত্মোপলব্ধির,অথবা আত্মজাগরণের।
কালচক্রের সাধারণ নিয়মেই চৈত্রশেষে আসে বৈশাখের প্রথম দিন, বছরের আর সব দিনগুলির মতই গতানুগতিকতায়। তবু সেই স্মরনাতীত কাল থেকেই মূলত প্রধান ফসল তােলার সময়কে সাধারণভাবে উৎসবের জন্যে নির্ধারিত করা হয় সমস্ত দেশে,কালে। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। শোনা যায়,মুর্শিদকুলী খান এক নতুন রীতি প্রচলন করেন; চৈত্র মাসে ফসল তােলার পর খাজনা আদায়ের সাথেই 'পুণ্যাহ' উৎসব পালন করা হবে এবং উৎসব শেষে সংগৃহীত রাজস্ব ভারতের তৎকালীন রাজধানী দিল্লিতে প্রেরণ করা হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মারী প্রভৃতি কারণে ফসল উৎপাদন হ্রাস পেলে পুণ্যাহ উৎসবেই রাজস্বমুক্তির সিদ্ধান্তও গৃহীত হতাে।তাই 'পুণ্যাহ' নামের অনুষ্ঠানটির সাথে  শুধু রাজস্ব-আদায় নয় ; অনাদায়কৃত রাজস্বহ্রাস বা মুক্তি কিংবা ভবিষ্যতের জন্য স্থগিত করার ব্যবস্থাও  করা হতাে। সেই ধারা ক্রমান্বয়ে আজ হালখাতায় এসে পৌঁছেছে।
এতো গেল ইতিহাসের কচকচানি গল্প, বাঙালি জীবনে নববর্ষ আসে স্মৃতিমেদুরতায়,অনুভবে, আনন্দ উদযাপনে। আমরা যারা মফস্বলে বড়ো হয়েছি, আজও চৈত্র হাওয়ার মর্মরে ভেসে আসে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভক্তদলের স্বস্তিবাচন....."মহাদেবের চরণে সেবা লাগে..." সমস্ত চৈত্রমাস জুড়ে গ্রামগঞ্জে শিবের পূজা হয়, একদল 'ভক্তা' সারা মাস কঠোর কৃচ্ছসাধনে ব্রতপালন করেন, আগুনের ওপর হেঁটে যাওয়া, মন্ত্রপূতঃ লোহার শিক বা 'বান' নিজের জিভের মধ্যে ঢুকিয়ে শীতলামন্দির থেকে দূরবর্তী শিবমন্দির পর্যন্ত্য যাওয়া........ 
ছিলো একসময় সেসব দিন, চৈত্র গাজনের মেলা , চড়ক, বান-নেওয়া, আগুনঝাঁপ, হিদোলা... আরও কতো কি! এছাড়া শীতলাপূজা,দেশপূজা,অষ্টম বা চব্বিশ প্রহর জুড়ে অখন্ড হরিনাম সংকীর্তন তো আছেই। বস্তুতপক্ষে, প্রকৃতির সঙ্গে ছিলো অঙ্গাঙ্গী বসবাস, প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে ভালোবেসে পূজার্ঘ্য দিয়েই চলতো জীবন নির্বাহ।অকাল বৈশাখী ঝড়ের প্রাদুর্ভাব, চড়া দাবদাহ থেকে মুক্তির জন্য ঘেটু সংক্রান্তি পালন, সকালেই বাসী মুখে আঁশবটি ছুঁয়ে সমস্ত অশুভ শক্তিজয়ের নিয়ম প্রকারান্তরে সেই প্যাগানিজ্ম্ কেই সমর্থন করে। আজও হয়তো নিয়মরক্ষায় সেসব অনুষ্ঠান হয়, আমাদের আর সময় হয় না ব্যস্তজীবন ছেড়ে সে উৎসবের আঙিনায় পা ফেলতে। তবু স্মৃতিকাতর মন ভেসে যায় কোন এক অনাক্রম্য গানে, দ্বিপ্রহরের দাবদাহের আগে সকালের সেই স্নিগ্ধ আলোয় ফুল্লমাধবীর সুগন্ধ মনে পড়িয়ে দেয় ঠাকুমার শিখিয়ে দেওয়া পূণ্যিপুকুর ব্রতকথা,আদর-সিংহাসন ব্রত বা বসুন্ধরা ব্রতপালনের কথা.......
চৈত্রের শেষদিন থেকে শুরু হয়ে সারা বৈশাখ মাস ধরে কুমারী মেয়েরা বাড়ির পাশে ছোট্ট নকল পুকুর কেটে, তার মধ্যিখানে বেলের ডাল পুঁতে, পুকুরে নিজের হাতে ঘটিভরা জল ঢেলে পূর্ণ করে,সাদাফুলে সাজিয়ে মন্ত্র পড়তাম...
"পূণ্যিপুকুর পুষ্পমালা
কে পূজে রে দুপুরবেলা?
আমি সতী লীলাবতী ভাইয়ের বােন পুত্রবতী,
হবে পুত্র মরবে না
পৃথিবীতে ধন ধরবে না"......প্রিয় পরিজনের জন্য নারীমনের এই অন্তর্লীন আকুতি তো চিরন্তন,পরিনত জীবনেও তা যে গভীরতর ছায়া বিস্তারে,তা বেশ বোঝা যায়।এ প্রসঙ্গে
 বৃষ্টির কামনায় 'বসুধারা ব্রত', তুলসী গাছে ছোট্ট ভারা বেঁধে, আলপনায় সাজিয়ে মাটির ঘটের তলায় ছোট্ট ছিদ্রে টুপটাপ জলদান যেন মানুষ-প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধনেরই দ্যোতক।
আজ আমাদের ব্যস্তজীবনে আমরা হয়তো এসব ভুলতে বসেছি,তবু মনের কোনে কি আজও ছায়া দোলায় না নীলষষ্টীর ব্রতপালন করে ফিরে পুত্রের মাথায় হাত রেখে মায়ের কল্যাণবচন, 'নীলের ঘরে দিয়ে বাতি,জল খায় গো পুত্রবতী'.. অথবা আদর-সিংহাসন ব্রতে বাড়ির শিশু কন্যাটির ভবিষ্যত সুখী সমৃদ্ধ জীবনকামনায় পাঁচ-এয়োতীর সম্মিলিত স্তবপাঠ!.... আসলে,এগুলি সবই কিন্তু এক যৌথজীবনের পাঠদানের প্রস্তুতি,তা সে জীবন সামাজিক অথবা প্রকৃতি সম্পৃক্ত যাই হোক না কেন! আর তাই হয়তো আজও দেখি একেবারে আধুনিকা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তরুনীও অনভ্যস্ত হাতে নববর্ষের সকালে তরুনস্বামীর প্রশংসা পাওয়ার ইচ্ছেয় পিৎজা-ম্যাগী ছেড়ে সাবেকী বাংলা রান্নায় মন দেয়, সাদা খোলের লালপাড় শাড়ি, সিঁদুর-উজ্জ্বল সেই চিরায়ত কল্যাণমুর্তির লজ্জারুন আভায় প্রেমিক হৃদয় অকারণে উদ্বেল হয়ে ওঠে,বহুযুগের মিলনমালা প্রিয়কন্ঠে দোদুল দোলে,'কোন পূরাতণ প্রাণের টানে'….প্রাত্যহিকতার একঘেয়েমির অভ্যস্ততার মাঝে এই সব ছোট্ট ছোট্ট সুখযাপন সম্পর্কে মাধুর্য্য ছড়িয়ে যায়.....'আসিবে ফাল্গুন পুনঃ; তখন সবাই শুন নব পথিকেরই গানে নূতনের বাণী……' 
এক চিরকল্যাণময় আনন্দ দ্যোতনা নিয়ে সমস্ত বিভেদ গ্লানি উজিয়ে আমাদের প্রাণের ঠাকুর নিদান দেন, 'পুরাতনের হৃদয় হতে,আপনি নূতন উঠবে ফুটে'... আমরা অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় থাকি, চিকন অশথপাতায়,নবদূর্বাদলে,কুর্চি-মহুয়ার গন্ধবিধুর বৈশাখী ভোরে এক অভিনব-আনন্দ-ধ্বনি জেগে উঠে, শুভ হোক, শুভ হোক..আলোয় ভালোয় বেঁচে থাকে অন্তহীন জীবন ও তার সংস্কৃতি।
এখানেই উৎসব-উদযাপনের সার্থকতা। শুভমস্তু। 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments