জ্বলদর্চি

প্রথম পাতায় পুরানো খাতার জের টেনে/অনিমেষ দত্ত

প্রথম পাতায় পুরানো খাতার জের টেনে আনি

অনিমেষ দত্ত


বছরের শুরু সারা বছরের গতিপ্রকৃতি নির্দেশ করে।
বাংলা-বাঙালীর কাছে এই শুরুটা তৈরি হয় পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষ দিয়ে।আসল কথা বছরের শুরু।একটি নতুন সূর্য।একটি নতুন ভোর।সারা বছরের নানা কাজের সূচনা এটাই।

যদিও শুরুটা কিভাবে হয়েছিল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত।কেও বলেন বিক্রমাদিত্যের নাম অনুসারে আবার কেও বলেন সপ্তম শতকে রাজা শশাঙ্ক-এর আমলেই এর শুরু।যদিও আরও অনেক মতের মাঝে বলা হয় মূলত হুসেন শাহ কিমবা মোঘল সম্রাট আকবর কৃষিকাজের সুবিধার্থে বাংলা সন প্রবর্তন করেন।হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়।প্রথমে ফসলি ও পরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত মোঘলরা পহেলা বৈশাখ পালন করতেন।
লাল রঙের কাপড়ে বাঁধানো হালখাতা নববর্ষের অনেক আগেই বাজারে এবং তা পরে ব্যবসায়ীর দোকান হতে সরাসরি পূজার থালাতে চলে আসে।সকাল সকাল মন্দিরে মন্দিরে যেমন ভিড় তেমনি অনেক ব্যবসায়ীর দোকানেই চলে পূজাদি।মূলত লক্ষী ও গনেশ কে সামনেই রেখেই পূজাকর্ম চলে।ঘট,পঞ্চপল্লব,ফল,মিষ্টি,নৈবেদ্য,দীপ-ধূপ,সিন্দুর,গামছা প্রভৃতি দিয়ে শুভ আয়োজন।হালখাতার প্রথম পাতায় লেখা থাকে শুভ নববর্ষ ও সালসংখ্যা আর নীচে সিন্দুরে আঁঙুল ডুবিয়ে তৈরি হয় মঙ্গলচিহ্ন স্বস্তিক।চারিপাশে রূপা কিমবা বাজার চলতি নিকেলের মোহর করবার টাকার সিন্দুরছাপ।আর কিছু সিঁদুরের ফোঁটা সাথে বিল্বপত্র ও ধান-দূর্বা। 
ব্যবসায়ীদের কাছে নববর্ষ মানে পুরানো খাতা থেকে নতুন খাতাতে জের টেনে আনা।কথাটা কানে লাগলেও এটাই ধ্রুব সত্য।চির বাস্তব।প্রমথ চৌধুরীর-র কথায়,

 "নূতন বৎসরের প্রথম দিন অপরদেশের অপর জাতের পক্ষে আনন্দ-উৎসবের দিন।কিন্তু আমরা সেদিন চিনি শুধু হালখাতায়।বছরকার দিনে আমরা গতবৎসরের দেনাপাওনা লাভলোকসানের হিসেব নিকেশ করি,নূতন খাতা খুলি,এবং তার প্রথম পাতায় পুরানো খাতার জের টেনে আনি।"

 যদিও সারা চৈত্র মাস জুড়েই চলতে থাকে বর্ষবরণ প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষে চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুব সংক্রান্তি পালিত হয়।গাজন উপলক্ষ্যে চড়ক অথবা শিব পূজা।এদিন সূর্য মীন রাশি ত্যাগ করে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে।
কথায় বলে-

"চৈত্র মাসে চড়ক পূজা,গাজনে বাঁধে ভারা/বৈশাখ মাসে তুলসী গাছে,দেয় বসুধারা।"

গ্রামবাংলায় আজও নববর্ষের সকালে স্নান সেরে নতুনজামা পরে মন্দিরে পুজাে দেওয়ার চল রয়েছে।অনেকের বাড়িতে দুর্গাপূজাতে নতুন জামা না হলেও পয়লা বৈশাখ তা হয়ে থাকে।নূতন হোক বা পুরানো শহর কিমবা গ্রাম সব জায়গায় দোকান ফুল দিয়ে সাজানোর ব্যস্ততা সকাল থেকেই চোখে পড়ে।বছরভর পাওনাগন্ডার হিসাব মেটবার আশায় দোকানির মুখেও লেগে থাকে হাসি।কিছুকিছু স্থানে এখনও মেলা বসে নববর্ষ কে কেন্দ্র করে।আবার কোথাও নাচ-গান-কবিতায় চলে নববর্ষ উৎসব পালন।

একটা সময় বাড়ি বাড়ি আমন্ত্রণ পত্র দিয়ে দোকানে যাবার নিমন্ত্রণ থাকত।এখন তার পরিমাণ কমলেও একবারে মুছে যায়নি।চিঠির ওপরে গনেশবন্দনা আর মাঝে নতুন খাতার শুভ মহরৎ এ যোগ দেবার বার্তা।
নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলে হাতে হাতে মেলে আদর আপ্যায়ন,মিষ্টান্ন,ক্যালেন্ডার প্রভৃতি।একসময় আপ্যায়নের বহর থাকত বেশ ভারীক্কি।প্রথমেই হাতে আসত গোলাপ জল মেশানো ঠান্ডা সরবত।নরম সাদা মখমলের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে সরবত খেতে খেতে চলত পুরানো হিসেব।বাতাসে থাকত ধূপ -আতরের গন্ধ আর সামনে থাকত মিঠা পান,চুরুট সিগারেট।সবার শেষে হাতে মিস্টির প্যাকেট হাতে বাড়ি ফেরা।অনেকগুলো দোকান হলে আরামপ্রিয় বাঙালী আরও আরামে ডুবে থাকে।বাড়ি ফেরার সময় প্যাকেটের পরিমাণ বাড়ে।বাড়ির কচি কাচাদের অপেক্ষা থাকে মিস্টির প্যাকেটে মন দেবার।

বছরের এই একটা সময়ই অনেক শুভেচ্ছাবার্তা বাড়ি আসে।প্রিয় আত্মীয় কিমবা কাছের লোকজনেরা এই শুভবার্তা।শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তার ব্যোমকেশ গল্প 'খুঁজি খুঁজি নারি' তে লিখছেন,

"পয়লা বৈশাখ তিনি তার ঘনিষ্ট ব্যক্তিদের শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি লিখতেন।এবার নববর্ষ সমাগত দেখে তিনি চিঠি লিখতে আরম্ভ করলেন।আমাকে প্রতিবছর চিঠি লেখেন,এবারও লিখলেন।"

গল্পটি লেখা হয় ১৩৬৮ বঙ্গাব্দের কোন এক সময়ে।অর্থাৎ বেশীদিন না হলেও চিঠি লেখার চল যে বেশ ছিল তা বোঝা যায়।কিছুবছর আগেও পোস্টঅফিসে চিঠির জন্য ভিড় জমত যদিও এখন তা ফিকে।মোবাইলে টুকটাক কিছু মেসেজেই সব শেষ।হয়তো পরে এটাও থাকবে না।

বছরের প্রথম দিন অতিপবিত্র দিন ভেবেই যেমন ব্যবসায় ঝড় তোলার একটা আহ্বান থাকে তেমনি চৈত্র সেল দিয়ে বছরের শেষটায় দোকানে একটা ভিড় জমানোর চেষ্টাও থাকে।হালখাতার হিসাব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,

"আদি অতি পুরাতন,এখাতা হালের/হিসাব রাখিতে চাহে নূতন কালের।/তবু ভরসা পাই আছে কোন গুন/ভিতরে নবীন থাকে অমর ফাগুন।/পুরাতন ফাঁপা গাছে নূতনের আশা/নবীন কুসুমে আনে অমৃতের ভাষা।।"

আদি পুরাতন হালখাতা নবীন নূতনের বাহক চিরকাল।একসময় কেবল দোকানে দোকানে শুভ মহরত অনুষ্ঠিত হত তাই নয় তার সাথে
সিনেমা পাড়ায় চলত নতুন ছবির সূচনা।খেলার মাঠে ফুটবলের বার পুজো ও বইপাড়াতে নতুন বই,পাঁজি -পঞ্জিকা প্রকাশ সব এইসময়।নব নব পত্র-পত্রিকাও প্রকাশ পায় এই সময়।বঙ্কিমচন্দ্রের 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকা-ও  প্রকাশ পেয়েছিল পয়লা বৈশাখ। এই সারিতে রয়েছে যেমন কৃষ্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের 'সাহিত্য-রত্ন -ভান্ডার',রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের 'প্রবাসী' পত্রিকা কিমবা উপেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী-র 'সন্দেশ' তেমন হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ এর 'মাসিক বসুমতি',নৃসিংহচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত 'সাহিত্য-সংহিতা' প্রভৃতি।এমনও শোনা যায় বিদ্যাসাগরের 'বর্ণপরিচয়' ও কোন এক পয়লা বৈশাখ নববর্ষের দিন প্রকাশিত।
এইচল এখনও অনেকটাই বজায় রয়েছে।

অাড়ম্বর কম হলেও যোগান রয়েছে।বাঙালী বলেই হয়তো বাংলা নববর্ষের সেই টান আজও সমানভাবে বর্তমান। সময় বদলেছে, মন বদলেছে, আমেজ কমেছে তবে মেজাজ এখনও সমানভাবে বাঙালীকে অদৃশ্য শিকড়ের সাথে টেনে রেখেছে আর টেনে রেখেছে বাংলা বছর শুরুর দিন,মানে পয়লা বৈশাখ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments