জ্বলদর্চি

হে নূতন/ শ্যামাশ্রী চৌধুরী মজুমদার

হে নূতন

শ্যামাশ্রী চৌধুরী মজুমদার

কয়েকবছর ধরেই মোবাইলের সৌজন্যে নববর্ষের নানা শুভেচ্ছা বার্তায় ভরে যায় ইনবক্স। জীর্ণ পুরাতনকে সরিয়ে নতুনের আবাহন বার্তার কত সুচারু সৃজনশীলতার ছবি, ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ার নানা দিগন্তে। অথচ আমরা যারা ইতিমধ্যেই কাটিয়ে ফেলেছি জীবনের প্রায় চল্লিশটা বসন্ত তাদের মেমরি কার্ডের কয়েক জিবি দখল করে থাকা নববর্ষ কেবলমাত্র একটা দিনের উদযাপন নয় বরং গোটা একটা সমাজ প্রতিবেশের সামগ্রিক উৎসব মুখরতা যার ব্যাপ্তি পুরো চৈত্র আর বৈশাখ মাস জুড়ে। বাঙালির একেবারে নিজস্বতার সুঘ্রাণে ম ম করে যে শ্যাওলা মাখা ঘাটের সিঁড়ি যার পাশে পড়ে থাকে চৈত্র শেষের ঝরা পাতার দল আমের মুকুল বাতাবিলেবু ফুলের সুবাস মেখে তার একটু দূরে ডাবগাছের তলায় বিছিয়ে আছে বেশ কয়েকটি শূন্য ডাবের খোলা। নব কিশোর সন্ন্যাসীদের সারাদিনের সংযম শেষে ভোররাতের পেট ঠান্ডার আয়োজনের চিহ্ন... আরো খানিকদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের ছেলেবেলা লাজুক মুখে, নিঃশব্দে...।

 মন্দিরময় ভারতবর্ষের ছোট্ট কোণায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মন্দিরবাজার মহকুমার দু'চারটি বর্ধিষ্ণু গ্রামে বিরাজমান বেশ কয়েকটি শিবমন্দির তার মধ্যে কেশবেশ্বরের মহিমা দূর দূরান্তে ব্যাপৃত। চৈত্র সংক্রান্তির আগে হাজার হাজার মানুষ মনস্কামনা পূরণের জন্য কিংবা ভক্তির কারণেই সন্ন্যাসী হয়।  আশপাশের চেনা মানুষগুলো হঠাৎই কোন মন্ত্রবলে গলায় উত্তরীয় নতুন পোশাক, ভোররাতের হবিষ্যি আহারের দৈবী ছোঁয়ায় জেগে উঠত অন্যরূপে। নীলপুজোয় উপোসরাখা মায়ের সঙ্গে যেতাম নীলের ঘরে বাতি দিতে। তবে চোখ মেলে চড়ক গাছ থেকে মাটিতে বঁটি, ছুরি,কাঁটার ওপর সন্ন্যাসীদের 'ঝাঁপ' দৃশ্য দেখার সাহস কিছু কম পড়েছিল চিরকাল। মন্দিরের পিছনে বসতো চড়ক মেলা। আসলে তখন চোখ বন্ধ করেই পৌঁছে যেতাম পরের দিনের বাবার দোকানের হালখাতার বিপুল আয়োজনের উন্মাদনায়...সন্ন্যাস যাপন সেরে আসা দু'একজন পরদিন ভোর ভোর এসেই তুলসীতলায় ঝারা বেঁধে দেবে আর মায়েরা জল ঢেলে পুজো দেওয়ার শেষেই ধানমাঠে ছুটব আমরা। সেখানে শুকনো পাতা,খড়,নাড়া জ্বালিয়ে ধোঁয়ার আঁচ নিয়েই পরবর্তী গন্তব্য কলকাতা দূরদর্শনের 'নববর্ষের বৈঠক'।

  এখন এপ্রিল মানেই শেষ আর্থিক বছরের কর মিটিয়ে প্রায় শূন্য হিসাববইয়ের পাতায় নতুন সংযোজনের অপেক্ষা তবুও ক্যালেন্ডারের পাতায় পরপর কয়েকটা লাল রঙের সংখ্যা ক্যালাইডোস্কোপের জাদু নলের মধ্যে টেনে নিয়ে যায় অজান্তেই। খুলে যায় অগুনতি দৃশ্য পট...শহর কিংবা মফস্বলের মতো কেবল পয়লা বৈশাখই নয় চৈত্র মাস পড়লেই হালখাতার নিমন্ত্রণ আসতে শুরু করত আর কাল বৈশাখীর সাময়িক বাধা বিপত্তি কাটিয়ে প্রতিটা সান্ধ্য জলযোগে তাই হাজির হত ডালডায় ভাজা শক্ত, সুস্বাদু লুচি, পান্তুয়া, বোঁদে । এখন ভাবলেই টকে যায় মুখ অ্যাসিডিটির অবর্থ্য সম্ভাবনায়। অথচ তখন দিব্যি মাছের ডিমের বড়া কিংবা ম্যাথার (সদ্য ডিম ফোটা কুচো চিংড়ি) বড়া দিয়ে একথালা গরম ভাত কিংবা খুব গরম পড়লে জলঢালা ভাত নিমেষে শেষ হয়ে যেত ঘন্টা তিনেক পরেই। এসব দিন কি সত্যিই ছিল ! নিজেই সন্দিহান হয়ে পড়ি মাঝে মাঝে। আর ধুলো ঝেড়ে পাতা উল্টাতে থাকি রূপকথার গল্পের মতো... যাইহোক এখনকার মতো যখন তখন মিন্ত্রা,অ্যামাজন খুলে টপাটপ জামা কাপড় কেনার 'আক্কুটে' ( জিনিসপত্র নষ্ট করলে সেকালে যে অভিধা পেতাম) দিন তো আসেনি তখন, নতুন জামা হত বছরে দু'বার। দুর্গাপুজোয় আর পয়লা বৈশাখে। খুব ছোটবেলায় 'চৈত্র সেল' কথাটা কানে আসেনি তবে মার হাতধরে 'মহামায়া বস্ত্রালয়' কিংবা 'নীতা স্টোর্সে ' কেনাকাটা করতে যেতাম বিকেলবেলায়। ছোটদের বরাদ্দ ছিল দুটো জামা একটা আটপৌড়ে যেটা নববর্ষের প্রথমদিন নিম হলুদ মেখে স্নানের পর পরতে হবে আর দ্বিতীয়টা  বিকেলবেলায় গোষ্টমেলায় যাওয়ার জন্য। পয়লা বৈশাখ থেকেই সূচনা হত গোষ্ট মেলার। প্রতিটা গ্রামের জন্য বৈশাখের এক একটি দিন নির্ধারিত ছিল। প্রথমদিনটিতে মেলা হত আমার জন্মস্থান ঘাটেশ্বর গ্রামে যদিও ততদিনে আমার বর্ধিত শৈশবের ঠাঁই হয়েছে লক্ষ্মীকান্তপুর স্টেশন সন্নিহিত বিজয়গঞ্জের নতুন বাড়িতে। গোটা চৈত্র মাস জুড়ে শিবের আরাধনার পর এবার বংশীধারীর পালা। গাঁ ঘরের নিত্য পুজোর রাধা, কৃষ্ণ,গোপালের নিমন্ত্রণ হত সেই মেলার মাঠে । মাঠের মাঝে বসত পুজোর আসর। সবশেষে আসতেন 'শ্যামরায়' । তিনি পৌঁছে গেলেই শুরু হত পুজো। সেই উপলক্ষ্যে পুতুল নাচ,যাত্রা, পালাগানের আসর বসত শীতলা  মন্দির চত্বরে। অনেক বছর পর সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় গোষ্ট মেলার কথা পেয়েছি যদিও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই মেলাটির কথা খুব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে বলে মনে হয় না আজও। এগুলো একেবারে মাটির উৎসব। আর ছিল ঘোড়া ছুটের আসর। ঘোড়াদলের এক মাঠে পয়লা বৈশাখ লোক ভিড় জমাত এই ঘোড়াছুট দেখার আশায়। আমাদের যদিও সে সৌভাগ্য হয়নি শৈশবে। তবে আফশোস ছিল না একেবারে। ঐ দিনগুলো ছিল যেন খাঁটি সোনায় বাঁধানো তাই দু'একটা ফাঁকফোঁকরে বিশেষ কিছু যেত আসত না। বৈশাখের প্রথম সকালে বড়দের প্রণাম করতেই হাতে হাতে এসে যেত কড়কড়ে পাব্বুনি পাঁচ, দশটাকার নোট যা প্রায় গুপ্তধনের সামিল তা দিয়ে তখন সংগ্রহ করা যায় বিশ্বের সব মহার্ঘ সম্পদ...কাঠি বরফ, কুলফি মালাই, দাঁতের লড়াই, টিকটিকির ডিম লজেন্স, কারেন্ট নুন,আলুকাবলি... একটু বড় হওয়ার পর গল্পের বই কেনার জন্য জমিয়ে রাখতাম তিনভাইবোনের পাব্বুনির টাকা। আজও তেমন সঞ্চিত হয়ে আছে বুকের নির্জন কোটরে ! সময়ে অসময়ে বের করে দেখি....
 এখন পয়লা বৈশাখের হালখাতার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেই ইচ্ছে হয় না প্রবল ভিড়ের ঠেলায়। তাছাড়া এই লাড্ডু কিংবা পান্তুয়া বাড়িতে বেশি সংখ্যক উপস্থিতি মনে অকারণ অশান্তি সৃষ্টি করে অথচ একটা সময় নিজেরা বাড়িতে মিষ্টির বাক্স তৈরি করতাম দল বেঁধে। আর ইচ্ছে মতো খাওয়াও চলত সেই  সঙ্গে । সংক্রান্তির আগে থেকেই চলত দোকান ঝারা মোছার কাজ, গোছা গোছা কার্ড লেখা চলত সকাল বিকেল। সংক্রান্তির দুপুরে বিরাট বড় মাটির উনুন তৈরি হত। পরের দিন ভোর থেকে  বড় বড় কড়ায় নামবে আলুরদম  আর ঝুড়ি ঝুড়ি ফুলকো লুচি। বস্তা বস্তা আলু ছাড়ানো চলত আগেরদিন থেকে। সাহায্যের লোক থাকলেও আলুরদম বানাতে হবে মা'কেই নয়ত ঐ স্বাদ, গন্ধ আসবে না কিছুতেই। আমরা নববর্ষের বৈঠকে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গান শুনতে শুনতেই লুচি, আলুর দম, মিষ্টি গলাধঃকরণ করেই শুরু করতাম লুচি আলুর দম আর রসগোল্লা,পান্তুয়া, বোঁদের বাক্স বানাতে । কেবল স্থানীয় দোকানদার পাড়া প্রতিবেশী নয় সারা বছর দূর দূরান্ত থেকে আসা নিমন্ত্রিত খরিদ্দাররা নিয়ে যাবেন বাড়িতে। সেদিন দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত কত মানুষ যে আতিথ্য গ্রহণ করতেন...শুক্তো,মুড়োর ডাল,পাঁচ রকম ভাজা, মাছের ঝাল, মাছের কালিয়া, চিংড়ির মালাইকারি, চাটনি, দই, মিষ্টি আর ঠান্ডা পানীয়। মা,দিদা,মাসিমণিরা অ্যাপায়ন করে খাওয়াত কত যে চেনা অচেনা মানুষকে.... রাত গভীর হলেই শান্ত হয়ে আসত চারপাশ।মেলার দোকানিরা কেউ কেউ বাড়ির পথ ধরত কেউ আবার চট বস্তা পেতে ঘুমিয়ে পড়ত মেলার মাঠেই... একে একে সকলকে বিদায় জানিয়ে হিসেব নিয়ে বসত বাবা। রান্নাঘর ধুয়ে মুছে মা আর দিদা স্নান সেরে আসত। বিছানা করতে করতে মা জানতে চাইত
 -টাকা এল ঠিকমত? এত যে খরচ করলে!
 - ওই হয়েছে কিছুটা
এখন বুঝি নববর্ষের এই হালখাতার আয়োজন শুধুমাত্র পাওনা টাকা আদায়ের জন্য ছিল না কখনই। আমার খাদ্যরসিক বাবা চিরকাল মানুষকে খাওয়াতে ভালোবাসত আর মা ভালোবাসত স্বামী, সন্তান,স্বজন, পরিজন নিয়ে পরিপূর্ণ নিটোল সংসার যেখানে অতিথি আর নিমন্ত্রিত মাত্রই ছিল নারায়ণ...আর ছিল পরিশ্রমী উদ্যমী মানুষটার পাশে দাঁড়ানোর আপ্রাণ প্রয়াস।  ভ্যালেন্টাইন দিবসহীন আমাদের পূর্বজদের এইই ছিল ভালোবাসার আরেক নাম...পূব দক্ষিণ খোলা দোতলার ঘরে ততক্ষণে গা এলিয়ে দিয়েছি আমরা ভাইবোনেরা। সারারাত যাত্রাপালা চললে মাইকে ভেসে আসত কথা,সুরের ঢেউ... জানলার পাশের আম গাছের পাতা চুঁইয়ে নামত জ্যোৎস্না আর টপটপিয়ে ছড়িয়ে যেত নিস্তরঙ্গ পুকুরের প্রশস্ত পটে...ধু ধু ধানমাঠে ফিটফিটে আলোর পর্দা ঢেকে দিচ্ছে সারাদিনের ক্লান্তি এমনই কোনো নির্জন পথ বেয়ে মন্দিরে ফিরছেন শ্যামরায় ভক্তদের সমবেত খঞ্জনি আর খোলের  সঙ্গতে... শব্দ মিলিয়ে যেতেই  চরাচরের গভীর প্রশান্তি জানান দেয় নতুন এক সম্ভাবনার। দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে সে আমায় বলে 
-এবার ফিরে যা...এখন যে বিদায়ের পালা।
সেই থেকে দূরেই দাঁড়িয়ে আছি। আনন্দ সাগরে ডুব দেওয়ার পথে জমেছে অপব্যবহারের, অপচয়ের, বিস্মরণের পলি। তবু সেই পথেই আছে অনন্ত অপেক্ষা। জানি যা ভেসে যায় স্রোতে  তা ফিরেও আসে, কেবল জিয়ন কাঠিটুকু সময়ের শক্ত মুঠিতেই চির বন্দি...

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments