জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-২১/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-২১

শুভদীপ বসু

বিষয় -সঞ্চালনা

শিল্পী তার শিল্প উপস্থাপন করে। উল্টো দিকে থাকে দর্শক বা শ্রোতা,যারা সেই শিল্পমাধ্যমটিকে অন্তর থেকে অনুধাবন করেন।এই দুই এর মাঝে বন্ধন এর কাজ করেন সঞ্চালক।সঞ্চালক হোল সেই সুতো যে নানা রঙের ফুলকে একসাথে একত্রিত করে একটি সুন্দর মালা তৈরি করেন অথচ নিজে প্রকাশিত হন না,অন্যদের প্রকাশ করেন। আমরা জানি-"Anchoring,programme anchoring is nothing but talking to self by placing self in between the pulse of audience psychology and make that self happy and satisfied by entertaining and/or enriching with information and words of presentation."

সফল সঞ্চালক: সঞ্চালনায় সফল শিল্পীদের প্রতি আমাদের আকর্ষণ কম নয়।অনেক অনুষ্ঠানে তারাই আবার মূল আকর্ষণ।টিভিতে কিছু কিছু অনুষ্ঠান ওই সঞ্চালকের জন্যই মানুষের মনে ও মননে সুপারহিট।কোন বানেগা ক্রোড়পতি তে অমিতাভ বচ্চন, দাদাগিরিতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, মীরাক্কেলে মীর,দিদি নাম্বার ওয়ানে রচনা ব্যানার্জি,কাপিল শর্মা শোতে কাপিল ছাড়া অন্য দ্বিতীয় আমরা কাউকে ভাবতেই পারিনা। রেডিওতে পার্থ ঘোষ,গৌরি ঘোষ, ইন্দিরা দেবী বর্তমান সময়ে কৌশিক সেন,শৈলেন চক্রবর্তী,শুচিষ্মিতা গুপ্ত,নিবেদিতা নাগ তহবিলদার,সুতপা চট্টপাধ্যায়,মানস প্রতীম দাস প্রমুখ শিল্পীরা সঞ্চালক হিসেবে মানুষের মনে আলাদাভাবে জায়গা করে নিয়েছেন।দূরদর্শন এর পর্দায় অতীতে চৈতালি দাশগুপ্ত,ছন্দা সেন প্রমুখরা যেমন পথ দেখিয়েছিলেন ঠিক তেমনি বর্তমান সময়ে সমস্ত নিউজ প্রেজেন্টাররা যেমন-ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়,মধুবন্তি মৈত্র,সুমন দে এক এক জন সফল সঞ্চালক।হাসির রাজা উত্তম দাস এক সময়ে মঞ্চের সঞ্চালক হিসেবে নাম করেছিলেন।
আমি সঞ্চালনা শিল্পের বিরাট বড় কোন বোদ্ধা নই।দীর্ঘদিন কিছু রাজ্যস্তরে ও আন্তর্জাতিক স্তরে সঞ্চালনা করার সুযোগ পেয়ে নিজের কিছু অভিমত নতুন আগত এই শিল্পের শিল্পীদের শোনাতে চাই।দীর্ঘদিন ব্রততী বন্দোপাধ্যায়, চৈতালি দাশগুপ্ত,তরুণ চক্রবর্তীর মত বিশিষ্ট মানুষদের সান্নিধ্যে এসে সঞ্চালনা শিল্পের সাথে পরিচিত হতে পেরে নিজে যেটুকু শিখেছি তাই আপনাদের কিছু শোনাতে চাই।
একজন নবাগত সঞ্চালকের নিম্নোক্ত কিছু বিষয় গুলির উপর নজর থাকলে সে আগামী দিন আরো বড় জায়গায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করতে পারবে।

সঞ্চালকের যে যে বিষয়গুলোর ওপর নজর রাখা উচিত--
১)প্রথমেই বলি একজন সঞ্চালকের উক্ত ভাষার প্রতি সম্যক ধারণা থাকা একান্ত জরুরী।যে ভাষায় সে সঞ্চালনা করছে সেই ভাষাটির প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকলে সেই ভাষাটি যদি সঞ্চালক হৃদয় থেকে আত্মস্থ না করে তাহলে সঞ্চালনায় গতি আসেনা।তাই যে ভাষায় দখল নেই সেই ভাষাতে সঞ্চালনা করতে যাওয়া মুর্খামি।
২)সঞ্চালকের কণ্ঠস্বর সুন্দর হতে হবে এটা ঠিক।তবে তার কন্ঠ যে একেবারে ব্যারিটোন ভয়েস বা কোকিলকণ্ঠী হবে এরকম কোন মানে নেই।
৩)উচ্চারণের দিকে অবশ্যই একজন সঞ্চালক খেয়াল রাখবেন।আঞ্চলিক দোষ ত্রুটি থেকে তিনি মুক্ত হবেন।বাংলায় শিস ধ্বনি,তাড়িত ধ্বনি,অল্পপ্রাণ ধ্বনি,মহাপ্রাণ ধ্বনি,ঘোষ ও অঘোষ ধ্বনি উচ্চারণের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকবেন সঞ্চালক।বাক্যের শেষে টেল ড্রপ যাতে না হয় সেই বিষয়ে ও ওষ্ঠ বর্ণ উচ্চারণ এর ক্ষেত্রে সতর্ক হবেন সঞ্চালক।
৪)কোন মঞ্চে বা স্টুডিওতে যাওয়ার আগে উক্ত অনুষ্ঠান সম্পর্কে সম্যক ধারণা সঞ্চালককে অবশ্যই রাখতে হবে।অনুষ্ঠানের বিষয়,ভাবনা,উদ্যোক্তা বা সংস্থার উদ্দেশ্য,ইতিহাস,মঞ্চে আসীন সম্ভাব্য সকল ব্যক্তি নাম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সঞ্চালককে অবশ্যই কাছে রাখতে হবে।
৫)যেদিন এ অনুষ্ঠানটি হবে সেই দিনের ইতিহাস বা বিষয় ভিত্তিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও সাধারণ দৈনন্দিন জীবন থেকে উদাহরণ তুলে এনে দর্শকের সামনে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে।
৬)সঞ্চালকের রসবোধ থাকা অত্যন্ত জরুরী।অনুষ্ঠানের একঘেয়েমি কাটিয়ে তাতে প্রাণসঞ্চার করতে পারেন একমাত্র সঞ্চালক।
৭)একটি দীর্ঘসময়ের অনুষ্ঠানের মূল কান্ডারী কিন্তু সঞ্চালক তাই তাকে বিভিন্ন সময়ে প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় দিতে হয়।চোখ,কান খোলা রাখতে হয়। অনুষ্ঠানের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে তার একটা বিরাট ভূমিকা থাকে।কোন অনুষ্ঠানের পর কোন অনুষ্ঠান হওয়া উচিত,প্রয়োজনে পূর্বনির্দিষ্ট সূচি বদল করা ও দীর্ঘ অনুষ্ঠানকে হ্রাস করা তা সঞ্চালকের গুনের মধ্যেই পড়ে।
৮) মঞ্চ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সঞ্চালক কে সব সময় মনে রাখতে হয় সামনে উপস্থিত দর্শকরা তার মূল উদ্দেশ্য।তাই কথায় কথায় দর্শকদের গুনগান করতে পারেন সঞ্চালক ও দর্শক কি চাইছে তাদের মানসিকতা বুঝে কথা বলতে পারেন সঞ্চালক।দর্শকদের শ্রদ্ধা ভালোবাসা দিলে সঞ্চালক বহুগুণে এসব ফেরত পেতে পারেন দর্শকদের কাছ থেকে।
৯)একজন সঞ্চালকের দায়িত্ব বোধ অনেক বেশি।অনুষ্ঠানের শুরু থেকে অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য উদ্যোক্তারা তাকে নিয়ে এসেছেন সেই সময়টা অবশ্যই সঞ্চালক উদ্যোক্তাদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেন।
১০)হিন্দিতে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে-'আগে দর্শনধারী,ফির গুণবিচারী।'তাই সঞ্চালক নিজের পোশাক ও আচার আচরণ সম্পর্কে অবশ্যই গুরুত্ব দেবেন। কোন শ্রাদ্ধ বা স্মরণ অনুষ্ঠানে ঝকমকে পোশাক যেরকম দৃষ্টিকটু ঠিক তেমনি আনন্দ অনুষ্ঠানে জীর্ণ মলিন পোশাক বেমানান। তাই অনুষ্ঠানটি দিনের আলোয় নাকি সান্ধ্য রংবাহারি আলোয় হচ্ছে, অনুষ্ঠানটি টিভির পর্দায় নাকি কর্পোরেট অনুষ্ঠান হচ্ছে সেই বিষয়ে সম্যক ধারণা সঞ্চালককে রাখতে হবে ও প্রয়োজনে বিষয়ভিত্তিক,স্থান ও কাল ভিত্তিক পোশাক তাকে পড়তে হবে।
সবশেষে বলি একজন সঞ্চালককে অবশ্যই পরিমিতিবোধ সম্পর্কে ধারণা রাখাতে হবে।আমি ভালো গান পারি বা ভালো আবৃত্তি পারি তাহলেই একজন ভাল সঞ্চালক হতে পারব এরকম ধারণাটা ঠিক নয়।আমি আবৃত্তি জানি বলে অনুষ্ঠানের মাঝে বিভিন্ন সময়ে অযথা কবিতা বলবো তা ঠিক নয়। বহু সঞ্চালককে দেখি কোন আবৃত্তির অনুষ্ঠানের আগে সেই শিল্পী কে মঞ্চে তোলার পূর্বে নিজেই একটি গোটা দীর্ঘ কবিতা আবৃত্তি করে দিলেন। কেন করলেন? এটা কি প্রকাশ পেল না নিজের আত্ম দম্ভের কথা? আমি ওই উক্ত শিল্পীর থেকেও বেশি কিছু জানি সেটি প্রকাশ করা কি সঞ্চালকের প্রয়োজন ছিল? সঞ্চালক অন্যদের প্রকাশিত করে নিজে অপ্রকাশিত থাকবে,সে তো ওই সুন্দর মালার সুতো।স্ক্রিপ্ট দেখে দেখে সঞ্চালনা করা কোন দক্ষ সঞ্চালকের বৈশিষ্ট্য হতে পারেনা।এই শিল্প দীর্ঘদিনের চর্চার ও সাধনার বিষয়।দুদিন চর্চা করে তিন দিনে মাঠে মেরে দেবো এই ভাবনা না থাকাই শ্রেয়।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments