জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা /পর্ব ১০৭ /প্রীতম সেনগুপ্ত

সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম, সেবাব্রতের সূচনা কেন্দ্র

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
পর্ব ১০৭
প্রীতম সেনগুপ্ত


দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি --২

স্বামী অখণ্ডানন্দজী তখন মুর্শিদাবাদে। সর্বত্যাগী পরিব্রাজক এক সন্ন্যাসী। স্বামী কৃষ্ণনাথানন্দজী লিখছেন --- “ পরিব্রাজক সন্ন্যাসী তাঁর পথের দুই ধারে দেখতে পেলেন দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া। পথে ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্র দেখে তিনি এসে পৌঁছলেন দাউদপুরে। রাত্রি যাপন করলেন একটি দোকানে। সকালে বাজারের দিকে যেতে পথে দেখতে পেলেন একটি শীর্ণকায় মুসলমান মেয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছে --- তার পাশে পড়ে রয়েছে একটি মাটির কলসি, খানিকটা মাটি জলে ভিজে গেছে। পরিব্রাজক খোঁজ করে জানলেন দেশে আকাল, মানুষ খেতে পায় না। ঘরে জল আনবার একটি কলসিই ছিল। তার মা মারবে, সেই ভয়ে কাঁদছে। প্রেমিক সন্ন্যাসী বাজার থেকে একটি কলসি ও দু পয়সার কিছু চিঁড়ে-মুড়ি কিনে দেন, মেয়েটি খুশিমনে বাড়ি চলে যায়। মেয়েটি যেতে না যেতেই ১২-১৪ জন বুভুক্ষু ছেলেমেয়ে এসে সন্ন্যাসীকে ঘিরে দাঁড়ায়। তিনি তাঁর বাকী পয়সায় চিঁড়ে-মুড়কি কিনে তাদের মধ্যে বিতরণ করে দেন। তারা যেতে না যেতেই আর একদল এসে উপস্থিত। তখন তিনি কপর্দকশূন্য, খয়রাতি করার মতো কিছুই নেই। পরিব্রাজক সন্ন্যাসী অনুসন্ধান করে জানতে পারলেন যে নিকটেই জনৈক সরকারী কর্মচারী দুর্ভিক্ষপীড়িত অক্ষমদের এলোমেলোভাবে কিছু চাল বিতরণ করছেন। দাউদপুরে পরিব্রাজক সন্ন্যাসী একজন মরণাপন্ন নব্বই বছরের বুড়িকে কয়েকদিন সেবা শুশ্রূষা করে বাঁচিয়ে তুললেন। সন্ন্যাসীর হাতে ঝোল-ভাত খেতে খেতে বৃদ্ধা চোখের জল ফেলে বলেন,‘বাবা, তুমি আমার জন্ম জন্মান্তরের ছেলে।’ সন্ন্যাসী তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘আমি তোমার এই জন্মেরও ছেলে।’
সন্ন্যাসী এগিয়ে চলেন। নপুকুর গ্রামে একরাত্রি বাস করে বেলডাঙা ছাড়িয়ে ভাবতা পৌঁছান। সেখানে দেখেন কার্যক্ষম দুর্ভিক্ষপীড়িত কিছু লোক রাস্তায় মাটি কাটছে। গরীব মানুষগুলি তাদের ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না। সন্ন্যাসী ওভারসিয়রদের সঙ্গে কথা বলে তাদের প্রাপ্য মিটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এই সকল ঘটনার মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে সন্ন্যাসী- ঠাকুরের গরিব-গুর্বোর জন্য দরদ, উদ্বেগ ও সহানুভূতি। এদিকে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মন বিদ্রোহ করে ওঠে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে। তাঁর হৃদয়-যাতনা ফুটে উঠেছে তাঁর লেখাতে -- ‘যাত্রাপথে নপুকুর, বেলডাঙা প্রভৃতি গ্রামে অন্নকষ্ট ও জলকষ্ট দেখিয়া আমার হৃদয় অতিশয় বিচলিত হইল এবং উঠিতে বসিতে পথে চলিতে চলিতে ভগবানকে দয়াময় বলিতে  কুন্ঠাবোধ করিতে লাগিলাম। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা  কি পাপে যে অনাহারে দয়াময় ভগবানের রাজ্যে মারা যায়, তাহা আমার বোধ হইল না। এখন দয়াময়ের রাজ্য ছাড়িয়া পলাইতে ইচ্ছে হইল।’
🍂

কিন্তু তাঁর আর পালান হল না। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ভাবতার বাজারে একটি দোকানে রাত কাটানোর পরদিন সকালে বহরমপুর যেতে উদ্যত হয়েছেন, সে-সময়ে তিনি শুনলেন ---  স্পষ্ট শুনলেন কে যেন বলছে:‘কোথায় যাবি? এখানে তোর ঢের কাজ আছে।’ একবার নয়, দুবার নয়, তিনবার অশরীরী বাণী শুনতে পেলেন। শুধু তাই নয়। যতবার তিনি উঠতে যান, কে যেন তোর কোমর টেনে বসিয়ে দেয়। সন্ন্যাসী-ঠাকুর বহরমপুর যাওয়ার সংকল্প ত্যাগ করলেন।” (স্বামী অখণ্ডানন্দ মননে, সম্পাদনা -- মৃণাল গুপ্ত, রামকৃষ্ণ মিশন সারগাছি, মুর্শিদাবাদ ) বস্তুতপক্ষে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সেবা কার্যের বীজ প্রথম বপন করেছিলেন অখণ্ডানন্দজীই। তবে এর পিছনে ছিল স্বামীজীর অমোঘ অনুপ্রেরণা।
এই বিষয়ে স্বামী প্রভানন্দজী লিখছেন ---“ রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবাদর্শ যে প্রণালীর মধ্য দিয়ে সারা ভারতের পরিচিত হয়ে উঠেছে সেটি হচ্ছে সেবাযোগ -- শিবজ্ঞানে জীব সেবার ব্রত। স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় নরনারায়ণ সেবাই সর্বজনীন মহাব্রত যা ‘আবালবৃদ্ধবনিতা, আচণ্ডাল, আপশু,’ সকলেই বুঝতে পারে। মুর্শিদাবাদের মহুলা অঞ্চলে স্বামী অখণ্ডানন্দ সর্বপ্রথম সেবাযোগ অনুষ্ঠান করেছিলেন একনাগাড়ে প্রায় তিন মাস। তার প্রভাব সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে স্বামীজী একটি চিঠিতে লিখেছেন:‘ঐ যে কাজ, অতি অল্প হলেও ওতে বহরমপুর একেবারে কেনা হয়ে গেল -- এখন যা বলবে, লোকে তাই শুনবে। এখন ‘রামকৃষ্ণ ভগবান’ লোককে আর বুঝাতে হবে না। তা নইলে কি লেকচারের কর্ম -- কথায় কি চিঁড়ে ভেজে?’ স্বামী অখণ্ডানন্দের কৃতিত্ব, তিনি রামকৃষ্ণ- বিবেকানন্দ ভাবাদর্শের একটি দিক সার্থকভাবে রূপায়িত করতে পেরেছিলেন এবং বারংবার স্বামীজীর কাছ থেকে  স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। রূপকার স্বামী অখণ্ডানন্দ সেবাযোগ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মহুলা গ্রামকে তীর্থিকৃত করেছেন। মহুলা রামকৃষ্ণ সংঘের সেবাতীর্থ।”(স্বামী অখণ্ডানন্দ মননে, সম্পাদনা -- মৃণাল গুপ্ত, রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম, সারগাছি )
বিবেকানন্দ

আর স্বামীজীর সঙ্গে অখণ্ডানন্দজীর সম্পর্কের ভিত্তিটি এই সেবাযোগের সঙ্গে কীভাবে যোগসূত্র রচনা করেছে সেই বিষয়ে কৃষ্ণনাথানন্দজী যথার্থই লিখছেন --“তথ্যই নির্ধারণ করে যে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা পর্ব থেকে শিবজ্ঞানে জীবসেবার এই যে ধারাবাহিকতা তার ব্যবহারিক প্রয়োগের সূচনাটি হয়েছিল স্বামী অখণ্ডানন্দের হাত ধরেই। স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর মানসিক যোগসূত্রের এক অসামান্য বন্ধন যে সম্ভব তা উপলব্ধি করেই কিশোর গঙ্গাধরের প্রতি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশ ছিল ‘... নরেনের এত বড় বড় চোখ ... সব নারায়ণময় দেখে। তুই তার কাছে যা ...।’ এই যোগসূত্রেই ক্রমশ গড়ে উঠেছিল স্বামী অখণ্ডানন্দের মননে এক অসামান্য মানবপ্রেম। তারই ফলশ্রুতি ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’র ব্যবহারিক প্রয়োগ -- যা পরবর্তী সেবাব্রতীদের কাছে উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্তস্বরূপ।“

Post a Comment

0 Comments