জ্বলদর্চি

সত্যজিৎ-এর টেলিফিল্ম যেন এক প্রত্যাশাহীনভাবে বেঁচে থাকার লড়াই/ অনিমেষ দত্ত

সত্যজিৎ-এর টেলিফিল্ম যেন এক প্রত্যাশাহীনভাবে বেঁচে থাকার লড়াই 

অনিমেষ দত্ত

বাংলা সাহিত্য,চলচ্চিত্র,চিত্রকলা কিমবা সঙ্গীত রচনা সবেতেই সত্যজিৎ এর অবাধ বিচরণ।একের পর এক সাহিত্যরচনা যেমন সাহিত্যেকে আরও পরিপূর্ণ করে তেমনি সিনেমার নতুন দৃষ্টিভঙ্গী পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন জানালা খুলে দেয়।সিনেমার দিক দিয়ে যেমন তিনি সফল তেমনি টেলিফিল্মের দিক দিয়েও যেন এক মাইলফলক।সর্বসাকুল্যে তিনি মোট তিনটি টেলিফিল্ম করেন।

 শুরুটা হয় ১৯৬৪ সালে।আমেরিকান টেলিভিশন ওয়াল্ড থিয়েটার একটি সিরিজের মাধ্যমে।তারা ভারত থেকে তিন অংশের তিনটি ছবি নিয়ে এক ঘন্টার একটি ফিল্ম তৈরি করতে চাইছিলেন।প্রথম ছবিটি ছিল 'বম্বে লিটল ব্যালে ট্রুপ'-র ব্যালে।তৃতীয়টি ছিল রবিন হার্ডি পরিচালিত পন্ডিত রবিশংকরের কয়েকটি রাগ নিয়ে তৈরি ছবি।মাঝের ছবির ভার ছিল সত্যজিৎ রায়ের ওপর এবং তৈরি হয় সংলাপহীন ১৫ মিনিটের 'টু' ছবিটি।প্রযোজনায় এসো ওয়ার্ল্ড থিয়েটার।

  এটাই মূলত টেলিভিশন এ প্রথম কাজ।এই ছবি শৈশবের কথা বলে।ছবিতে ফুটে ওঠে ধনী দরিদ্রের শৈশবের খেলনা।যদিও দরিদ্রের খেলনার অনাবিল আনন্দ ঝড়ে উড়ে যায় ধনীর খেলনা।১৯৯২ সালে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পাবার পর 'টু'(প্যারাবেল অফ টু)সহ সত্যজিৎ-এর আরও ১৮ টি ছবিকে সংরক্ষণ করা হয়।

  এক সাক্ষাৎকারে  তিনি নিজেই বলেছেন,

'ভারতীয় সিনেমায় আজ চমকদারী দরকার নেই।যা দরকার তা হল আরও কল্পনা,আরও সংহতি,যে মাধ্যমে কাজটি হচ্ছে সেই মাধ্যমের সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখে আরও বুদ্ধিদীপ্তভাবে তাকে বুঝতে পারা এবং বিষয়বস্তু ও শৈলীকে চূড়ান্ত রকমের সরল করে ফেলা।'
 সত্যি তার সিনেমা কিংবা টেলিফিল্ম সবই ছিল সরলতার একটি বৃত্ত।

  'টু' -র প্রায় ষোল বছর পর তৈরি হয় ২৬ মিনিটের টেলিফিল্ম 'পিকু' যা সত্যজিৎ-এর লেখা গল্প 'পিকুর ডায়েরি' থেকে তৈরি।ফরাসী টেলিভিশনে ফ্রি লান্সের প্রযোজক আঁরি ফ্রেইজির উদ্যোগে ছবিটি তৈরি হয়।'পিকু'র চরিত্রে অর্জুন গুহঠাকুরতা সবার নজর কাড়ে।তাছাড়া ছবিতে হীতেশের ভূমিকায় ভিক্টর ব্যানার্জি ও সীমার ভূমিকায় অপর্ণা সেন সহ অন্যান্যরা ছিলেন।ছবিটির সঙ্গীত পরিচালকও সত্যজিৎ।'পিকু' -ই তার একমাত্র ছবি যেখানে নায়ক এক বছর দশেকের শিশু।আধুনিক পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের প্রেমহীনতা ও স্ত্রীর অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্কই এই ছবির একটি দিক।
  বার্গম্যান সহ অনেক পরিচালকই প্রেমের গোপনীয়তা আটকে ও তা প্রকাশের পর তার আবেগময় ঝড় কে সামনে রেখে ছবি করেছেন।এদিকে পিকু-ই প্রথম এবং একমাত্র ছবি যা এই দুটি উপাদান কে সম্পূর্ণ উল্টে দেয়।
'পিকু'-তে অবৈধ প্রেম আছে ঠিকই তবে তা গোপন প্রেম নয়।অবৈধ প্রেমের স্বপ্নময়তা এতে সেভাবে নেই।এখানে গোপন প্রেম প্রকাশিত যেন এক প্রত্যাশাহীনভাবে বেঁচে থাকার লড়াই।নিজের ছোটবেলার অনেক টুকরো স্মৃতিকে এই ছবির মাধ্যমে মিলিয়ে দিয়েছেন।

  সবার শেষে বলতে হয় ইতিহাস সৃষ্টিকারী দূরদর্শনের জন্য নির্মিতি প্রথম রঙিন টেলিফিল্ম 'সদগতি।' ওম পুরী(দুখী চামার),স্মিতা পাতিল(ঝুরিয়া),মোহন আগাসে(ঘাসিরাম) অভিনিত।প্রথমে ঠিক হয় বিভূতিভূষনের 'দ্রবময়ীর কাশীবাস',শিবরাম চক্রবর্তী কিমবা শরৎচন্দ্রের 'সতী' সহ আরও মোট ছটি গল্প নিয়ে ছবি হবে।পরে ইউনেসকো প্রকাশিত ভারতীয় গল্পের একটি ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থ সত্যজিৎ এর হাতে আসে আর তাতেই ছিল প্রেমচন্দের 'সদগতি'।লেখাটি পড়া মাত্রই গল্পটি ছবির জন্য পছন্দ হয়ে যায়।যদিও এটিকে ছবিতে রূপায়িত করা খুব চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে যায়।কারণ গল্পটি
১৯৩১ -এ ছবি শুরুর ৫০ বছর আগের লেখা।অথচ মূল ভাবনার সঙ্গে ভীষণ রকম মিল পাওয়া সমসাময়িক অনেক ঘটনাকে মেলানো কম ঝক্কির ব্যাপার না।হিন্দিতে ৫২ মিনিটের এ ছবিটি তৈরি হয়।রায়পুরকে কেন্দ্র করে পলারি ও কেশবা গ্রামে শুটিং হয়।গল্পের মতো একটি গ্রাম ব্রাহ্মণ ও অপরটি চামারদের গ্রাম হিসেবে শুটিং হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে সেখানকার হিন্দু দৈনিক মধ্যপ্রদেশে জাতপাত নিয়ে আপত্তি তোলে।

  এসবের মাঝেই ১৯৮১ এর ডিসেম্বরের শেষে 'পিকু' ও 'সদগতি'-র কলকাতায় প্রথম প্রদর্শন হয়।পরে প্রথম ভারতীয় দূরদর্শন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে একযোগে ভারতের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে একই অনুষ্ঠান দেখানো হয়।রায়পুরে এই জাতপাতের আপত্তির কারণে ছবিটি দেখানো হয়নি।তখন সেই কেন্দ্রে দেখানো হয় হেমা মালিনী ও ধর্মেন্দ্র অভিনিত 'মা' নামে হিন্দি ছবি।একমাত্র দিল্লী তে রঙিন ও বাকি জায়গা থেকে সাদা কালোতে 'সদগতি' দেখানো হয়।এখানে বলে রাখা ভালো যে 'সদ্গতি' নিয়ে একটি মনস্তাত্ত্বিক সমীক্ষা হয় কলকাতার বুকে।কলকাতার সেন্টার ফর সাইকোলজিক্যাল টেস্টিং অ্যান্ড রিসার্চ এর উদ্যোগে এই সমীক্ষা চালানো হয়।
'সদগতি' সম্পর্কে সত্যজিৎ বলেছেন,

  " 'সদগতি' গল্পটি আমার মতে ক্লাসিক।শেক্সপীয়র বা কালিদাসের ক্লাসিকস নিয়ে যদি আজ নাটক বা ফিল্ম তৈরি হয় তাহলে প্রেমচন্দের লেখা নিয়ে হবে না কেন!.....'সদগতি' ছবিটা করে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম এবং এ পর্যন্ত আমার যে কটা ছবি উতরেছে তার মধ্যে আমি অবশ্যই 'সদগতি'র নাম উল্লেখ করতে চাই।"

  ছবিটি ১৯৮১ তে এনে দেয় ভারতের জাতীয় পুরস্কারের বিশেষ জুরি পুরস্কার।
এই ছবিটি সহ অন্যান্য টেলিফিল্মগুলির আলোকচিত্র নির্মানে ছিলেন সৌমেন্দু রায় ও সম্পাদনায় ছিলেন দুলাল দত্ত।

  বর্তমানে ইন্টারনেটের দৌলতে সত্যজিৎ রায়ের তিনটি টেলিফিল্ম-ই খুব সহজেই দেখা যায়।
১৯৬৩-৯৯ সাল অবদি বিবিসি টেলিভিশন,লন্ডন উইক অ্যান্ড টেলিভিশন,ভারত সরকার সহ বিভিন্ন প্রযোজনায় সত্যজিৎ বিষয়ক তথ্যচিত্র ও টিভি চিত্র তৈরি করেছে।পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায়-এর পুত্র সন্দীপ রায় ১৯৮৫-৮৭ সাল পর্যন্ত সত্যজিৎ-এর গল্পগুলিকে নিয়ে দূরদর্শনের জন্য কুড়ি টিরও বেশী টেলিভিশন চিত্র তৈরি করেছেন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments