জ্বলদর্চি

ইউরোপ (যুগোশ্লাভিয়া)-র লোকগল্প (শুভ কামনা) /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প-- ইউরোপ (যুগোশ্লাভিয়া)
চিন্ময় দাশ   

শুভ কামনা 

একটি পরিবারে বাস করে তিন ভাই। থাকবার মধ্যে তাদের আছে একটি ফলন্ত নাসপাতি গাছ-- এই মাত্র। গাছটাকে পালা করে পাহারা দেয় তিন ভাই। দুজন যখন বাইরে যায়, তৃতীয় জন পাহারায় থাকে। 
একদিন এক পরী নেমে এল আকাশ থেকে। কেমন মানুষ ছেলে তিনটি-- পরীক্ষা করে দেখবে বলে। ভিখারির বেশ ধরে গাছের তলায় এসে হাজির হল পরী। করুণ গলায় বলল-- ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে একটি নাসপাতি দেবে, বাছা?
তখন পাহারায় আছে বড় ভাইটি। সে বলল-- বাকি দুই ভাইয়ের থেকে দিতে পারব না, বাপু। আমার ভাগ থেকে একটা দিতে পারি। 
ধন্যবাদ জানিয়ে, নাসপাতি নিয়ে চলে গেল ভিখারি।
পরদিন মেজভাইটি আছে পাহারায়।  ভিখারি হাজির হয়ে বলল-- ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে একটি নাসপাতি দেবে, বাছা?
ছেলেটি বলল-- আমার ভাগ থেকে একটা দিতে পারি। বাকি দুই ভাইয়ের থেকে কিন্তু দিতে পারব না। 
তৃতীয় দিন আবার এল ভিখারি। পাহারায় আছে ছোট ছেলেটি। একই কথা তাকে বলল-- ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে একটি নাসপাতি দেবে, বাছা?
ছেলেটিরও একই জবাব-- গাছটি আমাদের তিনজনের। অন্যদের ভাগ থেকে দেব কী করে? আমার ভাগ থেকেই একটা দিতে পারি। তা-ই নিতে হবে তোমাকে।
পরদিন একেবারে ভোরবেলা, তিনজনেই তখন বাড়িতেই। আবার এল পরী। তবে সেদিন এসেছে এক সাধুর বেশে। বলল-- শোন, বাছারা। থাকবার মধ্যে আছে তো তোমাদের একটা মাত্র নাসপাতি গাছ। তা, যাবে আমার সাথে? বোধহয়, তাতে কিছু উপকারই হবে তোমাদের।
তিন ভাই চলল সাধুর সাথে। কতটা পথ গিয়ে, বড়সড় এক নদীর পাড়ে হাজির হল সবাই। সাধু বড় ছেলেটিকে বলল-- যদি তোমার কোন চাহিদা থাকে তো বলো। পূরণ করে দেব আমি। তবে বাছা, একটাই কিন্তু। 
ছেলেটা তাকিয়ে তাকিয়ে নদীটাকে দেখছিল। এমন কথা শুনে, বলল-- তাহলে, জলের বদলে মদে ভর্তি করে, এই নদীটা আমাকে দাও। (ভয়ানক শীতের দেশ সেটা। বেঁচে থাকবার জন্য মদের খুব জরুরি প্রয়োজন।)
নিজের পরনের আলখাল্লা সরিয়ে, বুকে ক্রশ চিহ্ন আঁকল সাধু। অমনি পলক না ফেলতে, কোথায় গেল নদী। একেবারে ভোজবাজির মত, সেখানে গজিয়ে উঠল একটা আঙুর মাড়াই কল। লোকজনের ছোটাছুটি। কেউ পিপে ভর্তি করছে। কেউ এসে গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে পিপেগুলো। বিশাল এক কারখানা, গুদামঘর, কর্মীদের ছাউনি-- কত কিছু। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়, বড় ছেলেকে ' গুড মর্নিং, মালিক! ' বলে মাথা নোয়াচ্ছে কর্মীরা।
ঈশ্বর তোমার বাসনা পূর্ণ করেছেন। সাধু বলল-- সব অভাবী মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তুমিও কখনো অভাবীদের অবহেলা কোর না।
দুই ছেলেকে নিয়ে এগিয়ে চলল সাধু। কিছুদূর গিয়ে একটা খোলা মাঠে এসে পড়ল তিনজনে। এক ঝাঁক পায়রা দানা খাচ্ছে খুঁটে খুঁটে।
সাধু মেজো ছেলেটিকে বলল-- যদি তোমার কোন চাহিদা পূরণ করে দেব বলি, কী চাইবে তুমি? তবে বাছা, একটাই কিন্তু। 
মেজো বলল-- এই পায়রার ঝাঁকটাকে যদি ভেড়া বানিয়ে আমাকে দাও, খুব ভালো হয়।
নিজের পরনের আলখাল্লা সরিয়ে, বুক ক্রশ চিহ্ন আঁকল সাধু। অমনি পলক পড়ল না চোখের। সামনে একটা খামার বাড়ি। তার মাঠে চরে বেড়াচ্ছে ভেড়ার পাল। ঘরদোর, লোকজন। একদল মেয়ে কাজ করছে। কেউ ভেড়ী দুইছে। কেউ চীজ বানাচ্ছে দুধ ফেটিয়ে সর তুলে। কেউ মাংস গোছাচ্ছে। উল পরিস্কার করছে কেউ বা। যারাই পাশ দিয়ে যাচ্ছে, 'হুজুর, মালিক! ' বলে মাথা নুইয়ে যাচ্ছে মেজোকে।  
-- ঈশ্বর তোমার বাসনা পূর্ণ করেছেন। সব অভাবী মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তুমিও কখনো তাদের অবহেলা কোর না.-- এই বলে, ছোটকে নিয়ে এগিয়ে চলল সাধু।
একটা বনের মধ্যে পৌঁছল তারা কিছু দূর গিয়ে। সাধু বলল-- এবার তুমি বলো বাছা, তুমি কী চাও। তবে একটাই কিন্তু।
ছোট বলল-- হ্যাঁ, বাবা। একটাই চাহিদা আমার-- ঈশ্বর যেন একজন ধার্মিক বউ দেন আমাকে। 
-- ধার্মিক বউ? বড় কঠিন প্রার্থনা করে বসলে হে। সাধু বলল-- মাত্র তিনজন ধার্মিক মেয়ে আছে এই দুনিয়ায়। তাদের দুজনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। একজনই আছে এক রাজার ঘরে। এই মূহুর্তে বিয়ের আয়োজন চলছে সেটিরও। দুই রাজকুমার এসে হাজিরও হয়ে গিয়েছে বিয়ের জন্য। যাইহোক, তোমার দুই ভাইয়ের বাসনাই ঈশ্বর পূর্ণ করছেন। তোমাকেও নিশ্চয়ই বিমুখ করবেন না। এখন চলো তাড়াতাড়ি। রাজার কাছে পেশ করো তোমার আবেদন। 
যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থাতেই দুজনে এসে হাজির হল দরবারে। পোশাক আশাক জীর্ণ। দূর পথ ভেঙে আসায়, নিজেদেরও মলিন চেহারা। ছেলেটির চাহিদা শুনে, রাজা একবার তাকিয়ে দেখল তাকে। বলল-- তাহলে দেখছি তিন জন হল, যারা আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। কী ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় এখন?
সাধু বলল-- মেয়ের বিয়ে বলে কথা! রাজা, আমি বলি কী, ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো।  
রাজা বলল-- সেটা কিরকম? 
-- আঙুরের মাচা আছে নিশ্চয় রাজবাড়ীর বাগানে। একটা লতা কেটে এনে, তিন টুকরো করা হোক। রাজকুমারী নিজের হাতে তিনটে টুকরো পুঁতুক তিন জনের নামে। আজ রাতেই কুঁড়ি ধরে, সকালে পাকা আঙুর পাওয়া যাবে যার থেকে, তার সাথেই বিয়ে হবে রাজার মেয়ের। 
সবাই মাথা নেড়ে দিল এই প্রস্তাবে। রাজকুমারীও তিনজনের নামে তিনটে লতা পুঁতে দিল। সকালে দেখা গেল প্রথম দুটো লতা যেমনকে তেমনি আছে। ছোট ছেলেটার লতায় মকমকে সবুজ পাতা। আর, আহা, কী টুসটুসে রসালো আঙুরের থোকা।
-- এটা নিশ্চয় ঈশ্বরের করুণা। আমার বিশ্বাস, এতে আমার মেয়ের মঙ্গলই হবে। রাজা বলল খুশি হয়ে। বাকি দুজন-- দুই রাজকুমার। তারা অবাক হল বটে, তাদেরও তা-ই মনে হল। সকলেই খুশি হল এমন ঘটনায়। বিয়ে হল ভারী ধুমধাম করে। রাজার মেয়ের যেমনটি হয়। 
রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে, চলতে চলতে সাধু তাদের নিয়ে এল একটা বনের ভিতর। ছোটকে বলল-- তোমার মনের বাসনা ঈশ্বর পূরণ করেছেন। আশাকরি, তুমিও ঈশ্বরের সন্তানদের কখনো নিরাশ করবে না। বলে, সাধু চলে গেল নিজের পথে।
ঠিক এক বছর পরে, আবার নেমে এল পরী। মনের ইচ্ছা, ছেলে তিনটি কেমন আছে এখন, একবার নিজের চোখে দেখে নেবে। এবার পরী এসেছে বুড়ো থুত্থুড়ে এক ভিখারি হিসাবে।
বড় ছেলেটি তখন মদের কারখানায় কাজে ব্যস্ত। ভিখারি এসে বলল-- এক কাপ মদ দেবে, বাছা? একটু দয়া করো এই গরিব বুড়োটাকে। দাও এক কাপ মদ।
ছেলেটা ভয়াণক রেগে গিয়ে বলল-- এইভাবে সব ভিখারিকে এক কাপ করে মদ বিলোতে থাকলে, দু'দিন যাবে না, আমাকেই ভিখারি হয়ে যেতে হবে। ভাগো এখান থেকে।
আলখাল্লা সরিয়ে বুকে হাত রেখে, ক্রশ আঁকলো ভিখারি। সাথেসাথেই যেন ভোজবাজি। কোথায় সরগরম হয়ে থাকা এত বড় একটা কারখানা? কোথায় লোক-লস্কর?  সব কোথায় উধাও। বড় আকারের একটা নদীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা।
সাধু বলল-- যাও বাছা, নাসপাতি গাছই তোমার ভবিষ্যৎ। ঘরে ফিরে যাও।
ভিখারি তারপর গিয়ে হাজির হোল মেজো ছেলের কাছে। সে তখন নিজের ডেয়ারি ফার্ম নিয়ে ব্যস্ত। ভিখারি বলল-- দয়া করে একটু চীজ দেবে বাছা আমাকে? 
ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠল-- খেটে খেতে পারো না? যত আলসের দল এসে জোটে আমার এখানে। ভালোয় ভালোয় বিদেয় হও এখান থেকে। নইলে ভেতর থেকে কুকুর ডাকতে হবে আমাকে।
ভিখারি আলখাল্লা সরিয়ে ক্রশ আঁকলো বুকে। অমনি কোথায় গেল সেই পোলট্রি ফার্ম, কোথায় লোকজনের ব্যস্ততা। সব উধাও চোখের নিমেষে। ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে একটা খোলা মাঠের সামনে। যেখানে দানা খুঁটে খাচ্ছে একদল পায়রা। 
ভিখারি বলল-- নিজের অতীত ভুলে গিয়েছিলে তুমি। যাও এবার, নাসপাতি গাছই তোমার ভবিষ্যৎ।  ঘরে ফিরে যাও।
বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। এবার বুড়ো এসে বনে হাজির হল, যেখানে বউ সহ ছোট ছেলেটিকে ছেড়ে গিয়েছিল। দেখল, ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে থাকে দুটিতে। অভাবের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে চারদিকে। 
ভিখারি বলল-- ভগবানের দোহাই, আজ রাতের মত বুড়োটাকে দু'মুঠো খেতে, আর একটু মাথা গুঁজতে দেবে, বাছা?
-- দেখতেই পাচ্ছ, আমরাই গরিব। এখানে কি তোমার মন ভরবে, বাবা? ছেলেটি বলল-- তবুও, এসো। যা আমাদের আছে, তাই নেব ভাগাভাগি করে।
আগুনের কাছটিতে বিছানা ছিল দুজনের। সেখানেই বিছানা পেতে দিল তারা অতিথিকে। ভিখারি দেখল, পাঁউরুটি বানানো হচ্ছে, আটা বা ময়দা থেকে নয়। বন থেকে আনা গাছের বাকল গুঁড়ানো। উনুনের কাছে বসে, বিড়বিড় করছে বউটি--  কী দুর্ভাগ্য! ঘরে অতিথি, তাকে কিনা আসল পাঁউরুটি দিতে পারছি না। নিজেরই লজ্জা করছে আমার।
কিন্তু যখন ঢাকনা খুলল, কী আশ্চর্য, আসল ময়দার বাদামি রংয়ের আস্ত একখানা পাঁউরুটি বেরিয়ে এল ওভেন থেকে। আর, কী তার মিষ্টি সুবাস। ঘর ভরে উঠলো মিষ্টি সুবাসে। আজ এক বছর এমন খাবার মুখে ওঠেনি দুজনের।
কেবল ' ভগবান ' কথাটুকুই বলতে পারল, অন্য কথা মুখে সরল না মেয়েটির। কলসি থেকে জল গড়াতে গিয়ে আনন্দে বুক ভরে গেল তার। কোথায় জল? এ যে কলসি ভরা মদ! 
-- অবাক হয়ো না, বাছারা। সাধু বলল-- তোমরা অভাবী মানুষের কথা ভুলে যাওনি। ঈশ্বরও ভোলেননি তোমাদের কথা।
নিজের আলখাল্লা সরিয়ে বুকে ক্রশ চিহ্ন আঁকল ভিখারি। সাথে সাথে  মিলিয়ে গেল তাদের বনের কাঠ-পাতায় ছাওয়া জীর্ণ কুঁড়েঘরখানি। আলোয় ঝলমল বিশালএকখানা প্রাসাদ গজিয়ে উঠল চোখের পলক না ফেলতে। লোকলস্কর, দাসদাসী। গমগম করছে বাড়িটা। রাজার বাড়িও অত বড় নয়। আসা-যাওয়ার পথে, লোকজন মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে যাচ্ছে দুজনকে-- প্রণাম মালিক। প্রণাম মা জননী।
-- সুখে থাকো, বাছারা। দীন-দুঃখীর কথা ভুলে যেও না কোনদিন। ঈশ্বর চিরদিন তোমাদের সাথে থাকবেন।  মুখ ভরা হাসি সাধুর।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments