সত্যজিৎ রায়: একটি বিস্ময়ের নাম
সূর্যকান্ত মাহাতো
অত্যন্ত ছোটবেলা থেকেই পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের প্রতি একটা নিদারুন অনুরাগ ছিল তাঁর। একরকম নেশার মতো বলা যেতে পারে। এতটাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো মনোযোগ সহকারে সেই সুরের মূর্ছনায় মূর্ছিত হতেন যে পরবর্তীকালে সেই সুরের একটু টুং-টাং ধ্বনি শোনামাত্রই বলে দিতে পারতেন এটার কম্পোজার কে, এবং কোন সিম্ফনী, তার নাম। আর এভাবেই সুরটা শুনে সেটার কম্পোজার কে এবং কোন সিম্ফনী সেটা কে কত তাড়াতাড়ি বলতে পারে তা নিয়ে একটা বেশ মজার খেলাও খেলতেন। কখনও বন্ধুদের সঙ্গে কখনও বা পরিবারের সঙ্গে। আর পাশ্চাত্য সংগীতে অসাধারণ পান্ডিত্যের কারণে বেশিরভাগ সময় তিনিই বিজয়ী হতেন। আরও একটি খেলা খেলতে তিনি ভীষণ পছন্দ করতেন। সেটা হল ওয়ার্ড গেম। স্ক্র্যাবল, প্রোব, বগল এসব খেলায় ক্ষুরধার বুদ্ধির কারণে তার সঙ্গে কেউ সহজে পেরে উঠত না। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। এতক্ষন যার কথা বলছিলাম তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন বিরল প্রতিভার অধিকারী স্বনামধন্য সত্যজিৎ রায়(জন্ম ২মে১৯২১-মৃত্যু ২৩এপ্রিল১৯৯২)। ঠাকুর পরিবারের পরই বিখ্যাত যে রায় বংশ সেখানেই তার জন্ম। ঠাকুরদা ছিলেন বিখ্যাত মানুষ,লেখক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী(১৮৬৩-১৯১৫)। এবং পিতা ছিলেন বিশিষ্ট কবি ও লেখক সুকুমার রায়(১৮৮৭-১৯২৩)।
শিস দেওয়া ছিল তার অন্যতম একটি প্রধান শখ। কিশোরকাল থেকেই উচ্চস্বরে শিস দিতে ভালোবাসতেন। একটা গোটা সিম্ফনী কনসার্ট অনায়াসে তিনি শিস দিয়ে গাইতে পারতেন। পাশ্চাত্য সংগীতের প্রতি তার যে তীব্র অনুরাগ এটা তারই বহিঃপ্রকাশ। এই সংগীতানুরাগ একটা সময় তার হৃদয়কেও রাঙিয়ে তুলেছিল। বয়সে বড় এক নিকটাত্মীয়া দিদির(বিজয়া রায়) সঙ্গে বসে বসে একান্তে পাশ্চাত্য সংগীতের মাধুর্য উপভোগ করতেন। আর এভাবেই কখন যেন সিম্ফনীর সেই সুরগুলো অজান্তেই তাদের দুজনকে প্রেমের বাঁধনে বেঁধে ফেলেছিল। সত্যজিৎ পরবর্তী কালে তাকেই বিয়ে করেন এবং শেষদিন পর্যন্ত দুজনে সময় পেলেই একান্তে বসে পাশ্চাত্য সংগীতের চিরকালীন সেই সুরগুলোতে ডুবে যেতেন।
প্রবল পাশ্চাত্য সংগীতানুরাগ ও পাশ্চাত্য সংগীতে অগাধ পান্ডিত্যের কারণে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে তার প্রথম দিকের কয়েকটি সিনেমায় সংগীতগুলো সেভাবে তার নিজের মনকেই পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাই "তিনকন্যা" থেকে তিনি নিজেই সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই যে সেগুলো তিনি সম্পাদনা করেছেন তা তার সিনেমাগুলোকে একবার দেখলেই বোঝা যায়। পাশ্চাত্য সংগীতের প্রতি গভীর অনুরাগ হয়তো তাকে সেই দক্ষতাটা দিয়েছে। কেননা তিনি বলতেন---"ভাল ছবি করতে গেলে মিউজিক বিশেষ করে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিক জানা একান্তই দরকার।"
মিউজিক নিয়ে এতটাই মগ্ন থাকতেন যে সারাক্ষণ গুনগুন করে সুর তৈরি করতেন। খেতে বসে হঠাৎ হঠাৎ উঠে পড়তেন খাতায় নোটেশন গুলো তুলে রাখার জন্য। পাছে পরে ভুলে না যায়। আর এভাবেই তিনি সেরা সুরটা তুলে আনতেন। সিনেমাতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের যে একটা রিদম থাকে সেটাতে তিনি ভীষণ জোর দিতেন। অপূর্ব দক্ষতায় সেটা ফুটিয়েও তুলতেন। সিনেমার মুহূর্তগুলো কোন রিদমে আরও বেশি শৈলীময় হয়ে উঠবে এটা বোঝার দারুন ক্ষমতা ছিল তার। একটা হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গিমাকেও ব্যাকগ্রাউন্ড সুরের দ্বারা অপূর্ব রূপে গড়ে তুলতে পারতেন।
মাত্র ৮০ টাকা বেতনে এক ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থায় 'জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার' হিসাবে কাজ শুরু করেন। সেখান থেকেই ডি কে গুপ্তর (দিলীপ গুপ্ত)প্রকাশনা সংস্থা সিগনেট প্রেসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। তাদের ছাপা বইয়ের প্রচ্ছদ ও ভিতরের ছবি আঁকার কাজ করতেন। যার মধ্যে জহরলাল নেহরুর "দ্য ডিসকভার অব ইন্ডিয়া" ছিল বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এভাবেই "পথের পাঁচালী"-র একটি শিশু সংস্করণ "আম আঁটির ভেঁপু"-র প্রচ্ছদ তৈরি ও ভিতরের ছবি আঁকার দায়িত্ব পড়ল তার ওপর।
তারপর "আম আঁটির ভেঁপু"-র প্রচ্ছদ ও ভিতরের ছবি আঁকার কাজ করতে গিয়ে মূল"পথের পাঁচালী"-তে তিনি এতটাই আকৃষ্ট ও মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে, নানান কর্মব্যস্ততার মধ্যেও সর্বক্ষণ তার শরীর ও মন জুড়ে পথের পাঁচালীর একটা রেশ যেন জিইয়ে থাকত। ভাবলেন একে সিনেমায় রূপ দিলে কেমন হয়। যেমন ভাবা তেমনি নিলেন উদ্যোগ। স্থায়ী চাকরি ছেড়ে ঝুঁকি নিয়ে পা রাখলেন অনিশ্চিত সিনেমা জগতে। কিন্তু কিভাবে সংলাপ লিখতে হয় সেটাও জানতেন না। তাহলে উপায়? অবশেষে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংলাপ গুলোই গ্রহণ করলেন। তৈরি করা হল চিত্রনাট্য। অনেক খুঁজে খুঁজে যদিও বা শিল্পী নির্বাচন করা গেল তো প্রযোজক পাওয়া গেল না। প্রযোজকদেরকে চিত্রনাট্য শুনিয়ে, নানান অনুরোধ করেও কাজ হল না। সিনেমাটা সম্পর্কে সত্যজিৎ তাদেরকে বোঝালেন সেটা কতটা ভালো হতে পারে এবং কত বৈচিত্র আছে এর মধ্যে । তবুও প্রযোজকরা নীরব । কারণ তাতে নাকি নাচ-গান, প্রেমিক-প্রেমিকা বলে কিছু ছিল না।
সত্যজিৎ রায় ছিলেন প্রচন্ড আশাবাদী একজন মানুষ। স্ত্রী বিজয়াদেবীও সেকথা বলতেন। তাই তিনি হার মানলেন না। নিজের যেটুকু সঞ্চিত অর্থ আছে তাই দিয়েই ছবিটা বানানোর সংকল্প নিলেন। কিন্তু কত টাকা খরচ হতে পারে সে সম্পর্কে ততটা ধারণাও ছিল না। তাই শুটিংয়ের মাঝপথেই সমস্ত জমা টাকা শেষ হয়ে গেল। এবার কী হবে? অবশেষে স্ত্রীর সোনার গয়না বন্ধকী রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। বন্ধুদেরও সহযোগিতা নিতে হল। কোনোক্রমে শেষ হয়েছিল শুটিং। আর এভাবেই সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে তৈরি হল বাংলা চলচিত্র জগতের ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক। গ্রাম-বাংলা ও প্রকৃতিকে যেন চরিত্র রূপে ছবিতে ফুটিয়ে তুললেন। যা কিছু সত্যজিৎ রায়ের গৌরব অর্জন এখান থেকেই। তার বিশ্ব পরিচিতিও এখান থেকেই শুরু। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তারপর সেই যাত্রাপথ 'অপরাজিত', 'অপুর সংসার', 'পরশপাথর', 'জলসাঘর, 'গুপি গাইন বাঘা বাইন'' হয়ে আরও একাধিক ছবির মধ্য দিয়ে "আগন্তুক" এ এসে শেষ হল। এছাড়াও ছিল বিষয় অনুযায়ী নানান ধরনের তথ্যচিত্র নির্মাণ। কখনও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তো আবার কখনও বাবা সুকুমার রায়কে নিয়ে, কখনও বালা দেবীকে নিয়ে তো কখনও বিনোদবিহারীকে নিয়ে। তথ্যের সঙ্গে সঙ্গে তথ্যচিত্র গুলোতে একটা কাহিনীর ছোঁয়াও থাকত।
একটা সিনেমার সম্পূর্ণ নির্মাণ প্রক্রিয়াটি সত্যজিৎ রায় নিজের হাতে যত্ন নিয়ে গড়তেন। সমস্ত বিভাগে কতটা পান্ডিত্য থাকলে এমনটা করা সম্ভব তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কী নেই সেখানে! গল্প বা কাহিনী নির্মাণ, শিল্পী নির্বাচন, তাদের পোশাক পরিচ্ছদ কেমন হবে তার ছবি এঁকে দেখানো, স্ক্রীন প্ল্যান, স্ক্রিপ্ট, ডায়ালগ, ক্যামেরার এঙ্গেল, লাইট সোর্স, মেকআপ টেস্ট সবশেষে পরিচালনা করা। সেখানেই শেষ নয় তারপরেও আছে এডিটিং, সংগীত পরিচালনা সেখানে আবার প্রয়োজনে নিজেই গান লেখা ও তাতে সুর দেওয়া। সবশেষে বিজ্ঞাপনের জন্য আবার পোস্টার তৈরি করা। স্ত্রী বিজয়া দেবীর কথায়, "শুরু থেকে শেষ অবধি উনিই সর্বেসর্বা। আলস্য কাকে বলে জানতেন না। কখনও ওর মুখে শুনিনি 'টায়ার্ড' কথাটা।"
কিভাবে সম্ভব? আসলে তার দর্শনটাই ছিল---"জীবনটা একটা ডিভাইন গিফট, এটাকে অপচয় করার মতো বোকামি আর নেই।" কোনও কিছু নতুনত্ব নির্মাণে তার ছিল ভীষণ আগ্রহ। আর তাই হয়তো এত এনার্জি।
সিনেমা তাকে প্রবল খ্যাতি ও সুনাম এনে দিয়েছে একথা সত্য। তবে সংসারের আর্থিক খরচ মেটাতে পারেনি। যেটা মিটিয়ে ছিল তার সাহিত্য চর্চা। শখের লেখালেখিই ছিল তার যাবতীয় আয়ের মূল উৎস। তবে তার সাহিত্য চর্চা একেবারেই উপার্জনের জন্য ছিল না। আবার সাহিত্যিক হওয়ার বাসনা থেকেও নয়। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়কে এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, "নিজেকে সাহিত্যিক বলে ভাবিনি কখনো। এটাই দেখতাম যে আমার মাথায় নানারকম গল্পের প্লট আসে, এবং সেগুলো লেখার সময় গল্পে বেশ একটা বাঁধুনি আসে। এর বেশি কিছু নয়।" সর্বক্ষণ তার মাথায় কোনও না কোনও গল্পের প্লট যে ঘুরে বেড়ায় তার তাড়না থেকেই মূলত তার সাহিত্য চর্চা। অমর সব সৃষ্টি ফেলুদা সিরিজ, প্রফেসর শঙ্কুর ডায়েরি, ছোট গল্প এছাড়াও সিনেমা নিয়ে, আওয়ার ফিলম দেয়ার ফিলম(১৯৭৬), বিষয় চলচিত্র(১৯৮২), একেই বলে শুটিং(১৯৭৯), বাচ্চাদের ছড়ার বই-তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম ইত্যাদি আরও অনেক। "সন্দেশ" পত্রিকা সম্পাদনা ছিল তার অসামান্য সাহিত্য কীর্তি।
পুরস্কারের কথা লিখতে বসলে লিখে শেষ করা যাবে না। কী নেই সেখানে! পদ্মশ্রী(১৯৫৮) পদ্মভূষণ(১৯৬৫), পদ্মবিভূষণ(১৯৭৬),দাদাসাহেব ফালকে(১৯৮৫), ভারতরত্ন(১৯৯২), অক্সফোর্ড থেকে ডি লিট উপাধি। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর কথা তো ছেড়েই দিলাম। সবশেষে সিনেমা জগতের নোবেল বলে মানা হয় যে পুরস্কার সেই "অস্কার" সম্মানও অর্জন করেন ১৯৯২ সালে। 'অস্কার' ঘোষণার পরপরই যখন 'ভারতরত্ন' ঘোষণা করা হল তখন সত্যজিতের প্রতিক্রিয়া ছিল--- "প্রাইজ দেওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে।"
আমেরিকা থেকে কয়েকজন অস্কার পুরস্কারটি দিতে এসে দেখলেন যে সত্যজিৎ রায় অসুস্থ।নার্সিংহোমে ভর্তি আছেন। তাই ভাবলেন তার ছেলের হাতেই পুরস্কারটা তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু একথা জানতে পেরেই
সত্যজিৎ রায় বাধা দিলেন। তিনি বলেছিলেন, "তা হয় না। নার্সিংহোমের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমিই এঘরে ওটা রিসিভ করব। যে জিনিসটা পাবার জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করেছি কিন্তু পাব বলে ভাবিনি, সেটা পাব আর আমি নিজে তা নেব না, এ হয় না।"
একটা সময় পর হার্টের অসুখ এবং তার ওপর একটার পর একটা হার্ট অ্যটাক ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চির এই সুউচ্চ সৃজনশীল মানুষটিকেও কাবু করে ফেলেছিল। তার একমাত্র গর্বের ও একমাত্র শখের বিষয় ছিল যে শিস দিতে পারাটা সেটাও কেড়ে নিল এই অসুখ। এ নিয়ে স্ত্রীর কাছে দুঃখ প্রকাশও করতেন। "আগন্তুক" যে তার শেষ সিনেমা হতে চলেছে এটা বোধহয় তিনি বুঝতেও পেরেছিলেন। তাই শেষ শটটা নিয়ে হাততালি মেরে বলেছিলেন---
"যাঃ আমার যা কিছু বলার ছিল সব ফুরিয়ে গেল আর কিছু বলার নেই।"
তবুও অনেক কিছু বলা বাকি রেখে ২৩শে এপ্রিল ১৯৯২ সালে ইহলোক ছেড়ে বিরল প্রতিভার এই মানুষটি লোকান্তরিত হয়েছিলেন। চলচ্চিত্র ও সাহিত্য জগতে যে বিরাট শূন্যস্থান তিনি তৈরি করে গেছেন তা আজ একশ বছর পরেও আর পূর্ণ হলনা।
(তথ্যসূত্র ও ঋণ স্বীকার: আমাদের কথা/বিজয়া রায়- ধারাবাহিক দেশ পত্রিকা)
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
2 Comments
Khub sundar laglo lekha gulo pore 😌
ReplyDeleteKhub khub valo hoye6e
ReplyDeletePore valo legeche....👌👌👌