জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৪৩

শ্যামল জানা

সাররিয়েলিজম্ (দ্বিতীয় অংশ)

আমরা জেনেছি— "Surrealism" কথাটির বাংলা মানে “পরাবাস্তবতা”৷ শুধুমাত্র এই একটি শব্দ থেকে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারা যায় না৷ তাই প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা আমরা আগের কিস্তিতে করেছি৷ আর, যদি আমরা সংজ্ঞার মতো করে জানতে চাই, তাহলে, "Surrealism" কথাটি ১৯৬৭ সালে প্রথম যে অভিধানে(Merriam-Webster dictionary) যুক্ত হয়েছিল, সেটিই সংজ্ঞা হিসেবে যথার্থ— “marked by the intense irrational reality of a dream.”৷ আর, যদি ব্যাখ্যা হিসেবে দেখি, তাহলে,  ফরাসি কবি আন্দ্রে ব্রেতোঁ-র “সাররিয়েলিস্ট ম্যানিফেস্টো”-তে লেখা একটি-দুটি অংশ ইংরাজিতে তুলে ধরলে বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধা হবে৷ সেটি হল— “Surrealism is based on the belief ... in the omnipotence of dreams, in the undirected play of thought ... pure psychic automatism, by which it is intended to express … the real process of thought. It is the dictation of thought, free from any control by the reason and of any aesthetic or moral preoccupation.”
১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ফরাসি কবি, নাট্যকার, ছোটোগল্প লেখক, ঔপন্যাসিক, চিত্র সমালোচক ‘গীয়োম অ্যাপোলোনিয়ার’ তাঁর বেলজিয়ান কবিবন্ধু ‘পল দেরমি’-কে চিঠিতে লিখছেন— “আমরা শিল্পের ক্ষেত্রে নতুন যে বিষয়টিকে চালু করতে চাইছি, তাকে যথার্থ অর্থে বলতে গেলে, সেটি Supernaturalism-এর থেকেও সঠিক হবে surrealism বললে৷ আর, আমি এই শব্দটিকে ইতিমধ্যে ব্যবহারও করে ফেলালম একটি ব্যালে নাচের ক্ষেত্রে৷” এই প্রথম ফরাসি শব্দ ‘সাররিয়েলিজম’ কথাটি লিখিতভাবে ব্যবহার হল৷
সের্গেই দিয়াঘিলেভ-এর ‘ব্যালে রাসেস’ নামে একটি বিখ্যাত চলমান ব্যালে নাচের কোম্পানি ছিল৷ তাদের ‘প্যারেড(Parade)’ নামে একটি একাঙ্ক ব্যালে দৃশ্যকল্প ছিল৷ যেটি আর এক বিখ্যাত ফরাসি কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ডিজাইনার, চলচ্চিত্র-নির্মাতা, ‘জাঁ ককতো’ তৈরি করেছিলেন৷ তিনি প্রোগ্রাম নোট-এ ওই প্যারেড ব্যালেকে "realistic" হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন৷ কিন্তু অ্যাপোলোনিয়ার পরে তাকে বদলে, "surrealistic" করলেন৷ এবং ওই ‘প্যারেড’ নামের ব্যালেটি প্রথম দর্শকদের সামনে প্রদর্শিত(Premier show)হয়েছিল— ১৮ মে ১৯১৭ সালে৷ অর্থাৎ, ওই দিনেই ‘surrealistic’ কথাটি প্রথম জনসমক্ষে প্রকাশ পেল৷ কিন্তু অফিসিয়ালি প্রতিষ্ঠা পেতে সময় লাগল আরও সাত বছর!
১৯২৪ সালের ১৫ অক্টোবর ফরাসি কবি, সমালোচক ও মনের ডাক্তার আন্দ্রে ব্রেতোঁ ফ্রান্স-এর প্যারিস শহর থেকে ‘পরাবাস্তব ইস্তাহার(Surrealist Manifesto)’ প্রকাশ করলেন৷ সেই থেকে পরবর্তীকালেও সাররিয়েলিজম্ আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে প্যারিস শহরকে বিবেচনা করা হয়েছে৷ সেই ১৯১৭ সালের পর থেকে মূলত ১৯২০ সাল থেকে এই সাররিয়েলিজম্ আন্দোলন সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পডল৷ দেশে দেশে যেমন ছড়াল, তেমনি বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমেও ছড়াল— চিত্রশিল্পে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, সংগীতে৷ ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন ভাষাতেও৷ এখানেও থামল না, পাশাপাশি ছড়িয়ে পডল রাজনৈতিক চিন্তায়, চর্চায় দর্শনে এবং সমাজ-তত্ত্বে৷  
    আমরা এক কথায় বলতে পারি— সাররিয়েলিজম্ একটি সর্বৈব সাংস্কৃতিক আন্দোলন৷ যে আন্দোলন ইয়োরোপ-এ গড়ে উঠেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলস্বরূপ৷ এবং দাদাইজম্-এর দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়ে৷ তবে, প্রায় সব শিল্প-মাধ্যম এই ইজমকে ব্যবহার করলেও সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল দৃশ্যশিল্প এবং সাহিত্য৷ এর কারণ হচ্ছে, সাররিয়েলিজম্-এর যে মূল হাতিয়ার— জাক্সটাপোজিশন(Juxtaposition), অর্থাৎ আমাদের অচেতন মন থেকে যে সব কল্পনা বা দৃশ্যকল্প তৈরি হয়, তাদের অধিকাংশই বাস্তবের সঙ্গে মেলে না, বা অযৌক্তিক৷ একটা বস্তু বা প্রাণীর সঙ্গে একই রকম দেখতে আর একটি বস্তু বা প্রাণীর পাল্টাপাল্টি হয়ে যায় অচেতন অবস্থায়৷ এই বিষয়টিকে সবচেয়ে ভালোভাবে ধরা যায় দৃশ্যশিল্পে (ছবি-১)৷ সাহিত্যেও অনেকটা ধরা যায়৷

    আমরা প্রথমে আসব দৃশ্যশিল্পে৷ আমরা লক্ষ করে দেখেছি, আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, বা অবচেতনে আমাদের মনে কোনো ছবি তৈরি হয়, সেই ছবি কিন্তু বাস্তবেরই প্রতিফলন৷ অর্থাৎ বাস্তবে যে রকম দেখতে হয়, হুবহু সেরকমই৷ ফোটোগ্রাফিক৷ একেবারেই বিমূর্ত(Abstract)নয়৷ একটা আর একটার ঘাড়ে চেপে যায়, বা একটার সাথে আর একটা পাল্টাপাল্টি হয়ে গেলেও তারা বাস্তবে যেরকম দেখতে সেরকমই থাকে৷ যেমন— রাক্ষসের কুলোর মতো কান৷ অর্থাৎ কুলোটা বাস্তবে যে রকম দেখতে, সেরকমই থাকে৷ কানটা বাস্তবে যেরকম দেখতে সেরকমই থাকে৷ শুধু পাল্টাপাল্টি হয়ে যায়৷ আর, যেই পাল্টাপাল্টি হয়ে গেল, ওমনি বাস্তবের থেকে আলাদা হয়ে পরাবাস্তব হয়ে গেল৷ অর্থাৎ, সাররিয়েলিস্টিক ছবি হুবহু বাস্তবেরই প্রতিফলন৷ ফোটোগ্রাফিক৷ কিন্তু একটা আর একটার ঘাড়ে চেপে গেলে, বা পাল্টাপাল্টি হয়ে গেলে সে আর বাস্তব থাকে না, পরাবাস্তব বা সাররিয়েল হয়ে যায়৷
আর, দ্বিতীয় ব্যাপার হল— আমাদের স্বপ্নে বা অবচেতনে যে সব ছবি তৈরি হয়, সেগুলি কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে রোজ যে সব জিনিস দেখি(Everyday object) সেখান থেকেই তৈরি হয়৷ অচেনা অদেখা এমন কোনো বস্তু থাকে না৷ কারণ আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষ-চাহিদা ইত্যাদিগুলি দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা থেকেই তৈরি হয়৷ এখানে আন্দ্রে ব্রেতোঁ-র লেখা “সাররিয়েলিস্ট ম্যানিফেস্টো”-র একটি অংশ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক— "Resolve the previously contradictory conditions of dream and reality into an absolute reality, a super-reality", or surreality.৷ এখানে একটি ছবি দেখিয়ে আলোচনা করলে সবচেয়ে ভালো হয়৷ একটু আগে আমরা যে ছবিটি দেখেছি, ‘মেটামরফোসিস অফ নার্সিসাস’(ছবি-১), সেই ছবিটিকেই আমরা আলোচনায় আনব, যেটি সাররিয়েলিজম্-এর ক্ষেত্রে এবং সালভাদোর দালি-র ক্ষেত্রেও অন্যতম বিশ্বশ্রেষ্ঠ ছবি৷ বোঝানোর সুবিধার জন্য আমরা একটু পরিমার্জন করে নিয়েছি(ছবি-২)৷ 

    ছবি-২-তে পাশাপাশি দুটি ছবি আছে৷ ছবি-২/১ ও ছবি-২/২৷ দুটি ছবি প্রায় হুবহু এক রকম দেখতে(Juxtaposition)৷ অথচ বিষয়গতভাবে একেবারে আলাদা৷ নীল বর্ডার দেওয়া ছবি-২/১-এ আছে মানুষের হাতের পাঁচটা আঙুল৷ তিনটি খোলা৷ বুড়ো আঙুল, তর্জনি আর মধ্যমা৷ এই তিনটি আঙুল একটা ডিম ধরে আছে৷ যে ডিমের ওপরের অংশটি ফেটে ডাঁটি সমেত একটি ফুল বেরিয়েছে৷ বাকি অনামিকা ও কড়ে আঙুলদুটি ভাঁজ করা৷ মেঝেতে পেতে রাখা৷
পাশে, লাল বর্ডার দেওয়া ছবি-২/২ ভালো করে লক্ষ করলে স্পষ্টই বোঝা যাবে— এটি একজন নারীর ছবি৷ ক্লান্ত বা ঘুমন্ত৷ মাথা ঝুঁকিয়ে ভাঁজ করা বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপর রাখা৷ মাথায় লম্বা চুল৷ বাঁ হাতটা সামান্য ভাঁজ করা ও হাতের মুঠোটি মেঝের সাথে মেশানো৷ ডান দিকের হাত দেখা যাচ্ছে না৷ শুধু কাঁধটুকু দেখা যাচ্ছে৷ ডান পা-টা ভাঁজ করা, শুধু হাঁটুটা দেখা যাচ্ছে৷ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে দুটো ছবি বিষয়গতভাবে সম্পূর্ণ আলাদা৷ অথচ দৃশ্যত প্রায় হুবহু এক৷ ছবি-২/১ এর যেটা তর্জনী, ছবি-২/২ এর সেটি পুরো বাঁ হাত৷ ছবি-২/১ এর যেটা বুড়ো আঙুল সেটা ছবি-২/২ এর বাঁ হাঁটুর নিচের অংশ৷ ছবি-২/১ এর যেটা মধ্যমা, সেটা ছবি-২/২ এর যথাক্রমে বাঁ পায়ের থাই ও ডান কাঁধ৷ ছবি-২/১ এর যেটা ভাঁজ করা অনামিকা ও কড়ে আঙুল, সেটা ছবি-২/২ এর ডান পায়ের ভাঁজ করা হাঁটু৷ ছবি-২/১ এর আঙুলে ধরা ফাটা ডিম ও সেখান থেকে বেরোনো ডাঁটি সমেত ফুলটি ছবি-২/২-তে হয়ে গেছে নারীর মাথা ও মাথার চুল৷ অথচ এই দুটি ছবি পাশাপাশি মিলিয়ে দেখলে দৃশ্যত প্রায় হুবহু এক৷ দুটো সামান্য তফাৎ— ছবি-২/১ হলুদ রঙের নয়, কিন্তু ছবি-২/২ হলুদ রঙের৷ আর, ছবি-২/১ এর আঙুলের মাঝখানটা ফাঁকা৷ পিছনের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে৷ কিন্তু ছবি-২/২ এর মাঝখানটা ভরাট৷
রীতিমতো চমকে ওঠার মতো ছবি! যেন অবিশ্বাস্য! আশ্চর্যজনক! অপ্রত্যশিত! আর, এই চমকটা লাগল শুধুমাত্র পাল্টাপাল্টির জন্য৷ তর্জনি হয়ে যাচ্ছে পুরো হাত৷ ডিম হয়ে যাচ্ছে মাথা... ইত্যাদি ইত্যাদি৷ ফলে, ছবিটা আর বাস্তব থাকছে না৷ হয়ে যাচ্ছে পরাবাস্তব(Super-real বা Surreal)৷ আর, ব্যাখ্যাযোগ্যও থাকছে না, হয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ অনুভুতির বিষয়! আমরা এখানে “সাররিয়েলিস্ট ম্যানিফেস্টো”-র আর একটি অংশ অবশ্যই উল্লেখ করতে পারি— Works of Surrealism feature the element of surprise, unexpected juxtapositions and non  sequitur.৷                                           (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments