জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৩৫

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৩৫

সম্পাদকীয়
আমরা যখন ছোটো ছিলাম, বাড়িতে মা ঠাকুমারা জন্মদিন নয়, জন্মমাস পালন করতেন মনে আছে। অর্থাৎ বৈশাখে কারো জন্মদিন হলে তাকে বৈশাখের একটি ছুটির দিন দেখে পায়েস আর পঞ্চব্যঞ্জন সহযোগে খাওয়াতেন। একমাসে দুই ভাই বোনের জন্মদিন থাকলে একসাথে দুজনকে খাওয়াতেন। আজ এ কথার অবতারণা করছি কারণ আজ আমরা বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের জন্মমাস স্মরণ করব। হ্যাঁ, তোমরা এতদিনে সকলে জেনে গেছ, গত ২ রা মে ছিল সত্যজিৎ রায়ের শততম জন্মবার্ষিকি। এই দিনটিকে মাসটিকে এমনকি বছরটিকেও স্মরণীয় করে রাখতে আমরা আমাদের ছোটোবেলার পাতায় প্রণম্য প্রবন্ধকার দেবাশিস মুখোপাধ্যায় (দে মু) এর কলমে সত্যজিৎএর লেখাগুলির জন্মদিনের গল্প শুনে নেব।  তাছাড়া বেথুন কলেজের আচার্য্যা কৃষ্ণা রায়ের কলমেও সত্যজিৎএর জন্মদিনকে কেন্দ্র করে  একটি গল্প পড়ে নেব। জন্মদিনের এই আয়োজনকে সম্পূর্ণ করতে বীরভূমের কবি সন্দীপন রায় আর কালনার কবি মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা দুটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। না না মুখ গোমড়া করার কোনো কারণ নেই। তোমাদের পছন্দের মন পসন্দ কেকও আছে। সেগুলো অক্ষর দিয়ে বানিয়েছে তোমাদের দুই বন্ধু শ্রীপর্ণা আর প্রবাহনীল, গল্পে ও ছড়ায়। আর এবারের শততম জন্মদিন রঙীন হয়েছে যাদের জন্য তারা হল সৌতি, হিয়া, তুলি, পৃথা আর সায়ন্তনীর রঙ তুলির ছোঁয়ায়।   কিন্তু এত মজার পরও ভুলে যেও না পরিচালক সত্যজিৎ রায় শুধু রঙীন নয় সাদা কালো সিনেমা পরিচালনা করেও সারা বিশ্বে সমাদর পেয়েছিলেন। তাই এটা বলতেই হচ্ছে কেক কেটে যেমন রঙীন জন্মদিনের মজা পাওয়া যায় , পায়েস খেয়েও তেমন অনাবিল আনন্দের জন্মদিন পালন করা যায় বইকি। ঐ দেখ প্রচ্ছদের ছবিতে ঋপণ আর্য যে বাচ্চাগুলোর কোভিডের আগের সময়ের খেলার ছবি তুলেছেন, সেটা সাদা কালো হলেও বাচ্চাদের খেলার আনন্দ তাতে কি কিছু কম মনে হচ্ছে? না। এবার আসি পঞ্চব্যঞ্জনের কথায়। রতনতনু জেঠুর গল্পের ফুলকুসুমপুর গ্রামের তিন্নি বুম্বারা বন্ধুদের তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছে। কেন? সেটা জানতে পড়তে হবে এবারের সংখ্যা।  তবে এবার তোমাদের জন্য শেষ পাতে রয়েছে সেরা সন্দেশ। সেটা হল ঘোষ স্যারের 'গল্পে গল্পে ক্যুইজ'। ছোটো বন্ধুরা, তাহলে হল কিনা সন্দেশ সহযোগে পরমান্ন ভোজন! এর স্বাদ কেমন লাগল জানাতে ভুলো না কিন্তু।  --মৌসুমী ঘোষ।

লেখক সত্যজিৎ

দেবাশিস মুখোপাধ্যায় ( দে মু )

সাহিত্যিক হিসেবে সাক্ষাৎকার নিতে এলে তিনি বলতেন, “আমি মোটেই সাহিত্যিক নই। ‘সন্দেশ’কে ‘ফিড’ করাতেই, সন্দেশের পাতা ভরাতেই, আমার লেখা। লিখি ছোটোদের জন্যে।”

         অথচ ১৯৯২ তে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, চিত্রনাট্য মিলে তাঁর বইয়ের সংখ্যা ছিল ৪৬। আবার তাঁকেই বলতে শোনা গিয়েছিল, “আমার সংসার চলে প্রধানত বই লেখার টাকায়।”

         এটা ঠিকই, কয়েকটি সিনেমা বিষয়ক ইংরেজি প্রবন্ধ বা ছাত্রাবস্থায় দু’টি ইংরেজি গল্প বাদ দিলে, ১৯৬১ তে নবপর্যায়ে ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রকাশ করার পর এই ‘সন্দেশ’এর জন্যেই তিনি প্রথম বাংলা লিখতে শুরু করেন। দাদু উপেন্দ্রকিশোর, বাবা সুকুমার একং কাকা সুবিনয় রায়ের সম্পাদনায় যে পত্রিকার বয়স হয়েছিল প্রায় ২০ বছর, প্রধানত টাকার অভাবেই পত্রিকাটির হয়েছিল অকালপ্রয়াণ। বন্ধ হয়ে যাবার ২০ বছর পর সত্যজিৎ আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন ‘সন্দেশ’কে। এর পিছনে তাঁর মায়েরও খুব ইচ্ছা ছিল। তবে এ কথা সত্যি, তিনি লেখক হবার আশায় কখনই কলম তুলে নেন নি হাতে। কোনও মৌলিক রচনা নয়, ‘সন্দেশ’এ প্রথম লিখলেন প্রিয় কিছু ইংরেজি ছড়ার অনুবাদ। ‘অনুবাদ’ শব্দটি তিনি নিজেই ব্যবহার করেছিলেন বলেই উল্লেখ করলাম, আসলে সেটি ছিল সহজাত প্রতিভা ও শিক্ষায়, সহজ স্বচ্ছ অন্তঃমিলে বাংলায় রূপান্তরিত বা অনুকৃতি। নতুন সন্দেশের প্রথম সংখ্যাতেই ছিল এডোয়ার্ড লিয়ারের ‘দ্য জাম্বলিস’, বাংলায় সত্যজিতের কলমে হল, ‘নীল মাথাতে সবুজ রঙের চুল’ ‘পাপাঙ্গুল’। একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হয়ত, নন্সেন্স রাইম বা উৎকল্পনা - ছড়ায় ব্যবহৃত বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়াপদে বা উল্লেখিত প্রাণী বা ব্যক্তির নাম এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করতে গেলে রসহানি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সত্যজিৎ অসাধারণ উদ্ভট-অভিনবত্বে নতুন সব বাংলা শব্দ ব্যবহার করে সেগুলিকে মৌলিক ছড়ায় পরিণত করলেন। লিয়রের পঞ্চচরণ লিমেরিকের অনুবাদ দেখে মনে হয়, এগুলো ঠিক অনুবাদ নয়, বলা যেতে পারে লিয়রের আঁকা ছবির আর এক প্রস্থ বিবরণ। যেমন স্বতস্ফূর্ত, তেমনি সহজ ছন্দ। পরপর পাঁচটি সংখ্যায় এইসব ছড়ার অনুবাদের পর ষষ্ঠ সংখ্যায় অর্থাৎ ছ’মাস পর লিখলেন প্রথম মৌলিক গদ্য রচনা ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’। ধারাবাহিক। তিন কিস্তিতে শেষ। গল্পটা পড়ে মনে হয়, যেন হঠাৎই লিখে ফেলেছেন। মনে হয়, লিখতে নয়, চেয়েছেন গল্প বলতে। ফলে লেখাটায় দেখা গিয়েছিল স্বতস্ফূর্ত ভাব। গল্পের প্রধান চরিত্র প্রফেসর শঙ্কু। চরিত্রটির মধ্যে সুকুমার রায়ের সৃষ্টি পেফেসর হেঁসোরামের ছারা রয়েছে আর রয়েছে সুকুমারেরই আর একটি চরিত্র প্রফ্রসর নিধিরাম পাটকেল। কল্পবিজ্ঞানের থেকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন হাস্যরসকে। শঙ্কু নিয়ে তিনি কখনই সিরিজ করতে চাননি, ভাবেনও নি। শঙ্কুর ডায়েরিটি গল্পের শেষে ডেঁইয়ো পিঁপড়ের দল খেয়ে শেষ করে ফেলে। পরের সংখ্যায় সেই প্রথম মৌলিক ছড়া ‘মেছো গান’। দশম সংখ্যায় আবার একটি গল্প ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’, পরের সংখ্যায় ‘টেরাড্যাকটিলের ডিম’ গল্প। এই গল্পদু’টি কিন্তু লিখেছিলেন ‘সন্দেশ’এর কিশোর পাঠকদের অনুরোধে, বলা যেতে পারে চাপে। পরপর দু’টি অসাধারণ গল্প। তিন বছর বাদে ‘ফেলুদা’।

         শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ তখন অবসর নেওয়ার মুখে। অ্যাডভেঞ্চার, বিশেষ করে ছোটোদের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী হেমেন্দ্রকুমার রায়ের পর যখন শেষ হয়ে যাচ্ছিল। বাংলা গোয়েন্দা কাহিনীর অন্তিম পর্ব চলছিল নীহাররঞ্জন গুপ্তের মতো সামান্য কয়েকজনের কলমে। ঠিক তখনই আগমণ ঘটে সত্যজিৎএর ফেলুদার। প্রথমদিকে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরিটা ছিল শখের। দু’একটি গল্পের পর ফেলুদা এবং তাঁর স্রষ্টা দুজনেই ‘সিরিয়াস’। প্রথমে ফেলুদা আর তোপসে, পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন জনপ্রিয় রহস্য-কাহিনীর লেখক লাল্মোহন গাঙ্গুলী, ওরফে জটায়ু। তিন বয়সের, তিন ভিন্ন চরিত্র মিলে ফেলুদা অ্যান্ড কোং-এর মতো ত্রিরত্ন ভূভারতে তো নয়ই, গোটা বিশ্বে মেলে কদাচিৎ। ফেলুদা প্রকাশের পরই তিনি চলে এলেন জনপ্রিয়তার প্রথম সারিতে। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গল্প লেখার জন্যে আলাদা সময় দিতে হবে, এ ভাবনা কোনদিনই তাঁর মাথায় ছিল না। ‘সন্দেশ’ এবং তার পাঠক-পাঠিকারা তাঁকে বাধ্য করেছিল লিখতে। নিজেই সাক্ষাৎকারে কবুল করেছিলেন, “‘সন্দেশ’ না এলে হয়তো আমার লেখাই হতো না!”

         আসলে সত্যজিৎ-এর লেখার পিছনে ছিল তাঁর বংশগত সূত্রে পাওয়া উত্তরাধিকার। উপেন্দ্রকিশোর, কুলদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, সুকুমার, সুখলতা, সুবিনয়, লীলা মজুমদার তারপর এই আমাদের প্রিয়, সবার প্রিয় সত্যজিৎ, সত্যজিৎ রায়।


ফুলকুসুমপুর খুব কাছে ৮
রতনতনু ঘাটী
নৈবেদ্য প্রাথমিক বিদ্যালয় ত্রিপাঠি বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে। ঠিকমতো হাঁটলে পনেরো মিনিট। এই এট্টুখানি পথ যেতে তিন ভাইবোনের কম সে কম আধঘণ্টা তো লাগবেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুবল দিন্দাদের বড় পুকুরটা পেরোলে মিত্তিরদের মস্ত আমবাগান। তার মাঝখান দিয়ে মেঠো পথ ধরে স্কুলের দিকে এগেতে গেলে তিন্নি আর বুম্বার গা ছমছম করবেই করবে। তবে ওদের মধ্যে বিন্নি খানিকটা সাহসী। বিন্নি বলল, ‘চল চল। এখন আম খেতে ভূতও আসেনি আর মিত্তিরদের দরোয়ান বিরজুদাদুও এসে পৌঁছয়নি। তোদের অত ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। তা ছাড়া আমরা তো কেউ আম পাড়িনি গাছ থেকে?’ 
   বিন্নির সাহস জোগাতে-জোগাতে ওরা যেই মিত্তিরদের আমবাগানটা পেরিয়েছে, অমনি দেখল ঝিমলি যাচ্ছে আগে-আগে। তিন্নি ডাকল, ‘অ্যাই ঝিমলি, দাঁড়া। একটা জরুরি খবর আছে।’
   ঝিমলি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঝিমলি তিন্নির সঙ্গে ক্লাস ফোরে পড়ে। ওর স্কুলের ভাল নাম দেবাংশী। ঝিমলি জিজ্ঞাসু মুখে বলল, ‘বল, কী হয়েছে?’
   বিন্নি হাত তুলে তিন্নিকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আরে ঝিমলি, আমাদের বাড়িতে নানা কাণ্ড ঘটছে কাল থেকে।’
   ‘কী আবার ঘটল রে?’ ঝিমলি মুচকা হাসল।
   ওদের কাউকে কথা বলতে না দিয়ে বুম্বা বলল, ‘ঝিমলিদি, আমাদের বাড়িতে মোট চারটে খাঁচা কিনে আনা হয়েছে। তার মধ্যে একটা খাঁচায় ইচ্ছেঠাকুরমার রাধাগোবিন্দ এখন দাঁড়ে বসে দোদুল-দুল!’ বলে বুম্বা দু’ হাত দু’ দিকে দোলাতে লাগল।
   ‘মানে কী? ঝিমলি জিজ্ঞেস করল।
   বুম্বা হেসে বলল, ‘মানে বুঝতে পারলে না? দোল খাচ্ছে!’
   বিন্নি বাঁ হাত দিয়ে বুম্বাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আর-একটা খাঁচায় রাখা হয়েছে মিঁউকে।’
   ঝিমলি জিজ্ঞেস করল, ‘মিঁউটা আবার কে?’
   তিন্নি বলল, ‘আরে মিঁউ হল আমার বাবা বাড়িতে পুষবে বলে নিয়ে আসা বিড়ালছানা। আজই তার চোখ দুটো খানিকটা ফুটেছে। না হলে কাল থেকে সে তো দেখতেই পাচ্ছিল না। সে কাল দুপুরে খাওয়ার টেবিলের নীচ থেকে মিঁয়াও বলে ডেকেওছিল। ইচ্ছেদাদুর বকুনিতে বাবা তাকে খাঁচায় ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।’
     বুম্বা চোখ বড়-বড় করে বলল, ‘জানো তো ঝিমলিদি, আমাদের বাড়িতে আরও দুটো খাঁচা এসেছে? যদ্দুর শুনেছি, একটায় রাখা হবে গল্পকাকার কুকুর বিংগো। সে এখনও আমাদের বাড়িতে আসেনি। নিধিদাদুদের বাড়িতে আছে এখন। তবে এতক্ষণে সে আমাদের বাড়িতে এসে হয়তো খাঁচায় ঢুকে বসে আছে।’
   ঝিমলি হাঁ করে জিজ্ঞেস করল, ‘আর একটা খাঁচায়?’
   ‘ওই খাঁচাটায় থাকবে আমার বাবার খরগোশ। আমাদের বাড়িতে তার আসতে এখনও দিন দুয়েক তো লাগবেই।’ বলে থামল বুম্বা।  
   ঝিমলি হেসে বলল, ‘তোদার বাড়িটা তো একটা চিড়িয়াখানা হয়ে উঠেছে রে। দাঁড়া, শনিবার তো হাফ স্কুল। তোদের বাড়িতে যাব স্কুল ছুটির পর ওসব দেখতে। বাড়িতে মাকে বলে আসব, ছুটির পর তোদের বাড়িতে যাব!’
   বাঁ দিকে চণ্ডীমন্দিরের বকুলতলার দিক থেকে ওদের সঙ্গে এসে যোগ দিল চিকলু আর নীলূফার। চিকলু পড়ে বিন্নির ক্লাসে। ওর ভাল নাম চিন্ময়। নীলূফার পড়ে বুম্বার ক্লাসে, বুম্বার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু সে!
   বুম্বা আগ বাড়িয়ে বলল, ‘চিকলুদা, তুমি শনিবার আমাদের বাড়িতে ঝিমলিদির সঙ্গে এসো। আমাদের বাড়িতে গেলে একটা আস্ত চিড়িয়াখানা দেখতে পাবে!’ তারপর নীলূফারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুইও আসিস নীলূফার।’
   ওরা নৈবেদ্য স্কুলের কাছে এসেই গেছে। দয়ালদের ফুলের বাগানটা পেরোলে মনসাপোতার খালের উপর কংক্রিটের ছোট্ট ব্রিজ। তার পরেই ওদের স্কুল। একতলা, মাথায় অ্যাসবেস্টসের ছাউনি। 
   চিকলু হঠাৎ দয়ালদের ফুলের বাগানের বেড়ার ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা গন্ধরাজ ফুল তুলল। তাই দেখে চোখ পাকিয়ে বিন্নি বলল, ‘চিকলু, তুই ফুল তুললি কেন? তুই কি জানিস না, গাছ থেকে ফুল পাড়তে নেই? অনসূয়া ক্লাসমিস সেদিন ক্লাসে বলেছিলেন না, গাছ কত কষ্ট করে ডালে-ডালে ফুল ফোটায়। সে ফুল তুললে গাছের খুব কষ্ট হয়? ক্লাসে চল, আমি অনসূয়ামিসকে গিয়ে বলছি।’ 
   তক্ষুনি মিসের কাছ থেকে বকুনি খাওয়ার ভয়ে চিকলুর মুখটা এইটুকুনি হয়ে গেল। তবে স্কুলে গিয়ে প্রেয়ারের পর মিসকে নালিশ জানানোর কথা বিন্নির একদম মনেই নেই।
(এর পর আগামী রোববার)

সাই-ফাই গ্রহে কিছুক্ষণ 
কৃষ্ণা রায়

রোজি-ঠাম্মা আমাদের পাশেরবাড়ি অনেক কাল ভাড়া আছেন। এক সময়ে নাকি ইস্কুলের  হেডমিস্ট্রেস ছিলেন। সে আমরা দেখিনি। তবে দারুণ অংক করাতেন শুনেছি।  এখনো খুব ইংরেজি বই পড়েন। ক’দিন আগে  কোভিড থেকে সেরে উঠেছেন।  সারাদিন বারান্দায় বসে  আপন মনে কথা বলেন। আমায় দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে ডাকলেন, এই টুম্পা, তোমাদের বাড়ি জবা ফুল ফুটেছে? ওপরের ডালে দেখলাম দুটো কুঁড়ি। 
আমি বিড়বিড় করি,  এক্ষুনি ফুল আনতে বলবে। আমাদের বাগানের জবা, টগর ফুল ওর রোজ চাই।  মা বলে, বুড়ো-মানুষ চাইলে গোটা কয়েক দিয়ে আসবি।   ঠাম্মার বয়স এখন উনআশি। একটা  বেড়াল, একটা  কুকুর  আর একটা কাজের মানুষ নিয়ে তার সংসার। তিনকূলে কে আছে পাড়ার লোকেরা জানেনা। জিগ্যেস করলে মিটিমিটি হাসেন, হাবিজাবি লোকের ফর্দ দিয়ে কি হবে? আমার কি আপন মানু- মামার কথা তোমাদের বলি নি?
-কে সে?
-ওমা!    কী কান্ড। মানু -মামা মানে আমার মায়ের মানিকদা,  তোমাদের সত্যজিত রায়। বলেছি, ঠিক ভুলে গেছ। 
দাদা আমায় চিমটি কাটে, ওই  গুল-দস্তার গল্প শুরু হল।
নিরীহ মুখ করে বলি, ওমা তাই?   তাহলে ওদের বাড়িতে তোমার যাতায়াত আছে বলো। 
-সে সব পুরোন কালের কথা। আমার মায়ের পাড়াতুতো দাদা, ছোটবেলায় এক সাথে খেলাধুলো, আমায় নিজের হাতে ছবি -আঁকা শিখিয়েছেন। তা মা-ও চলে গেল-----  যোগাযোগ ফুরিয়ে গেল।  আসলে মানুমামার তারিণী খুড়ো সিরিসের গল্প গুলো তো আমার কাছেই শুনে লেখা।
মা ডাকল, কি রে সারা সকাল গল্প করলেই চলবে?
রোজি-ঠাম্মা বল্ল যাও ভাই, পড়তে যাও।  পরে অনেক গল্প বলব।  সে সব কেউ জানেনা।

দিন তিনেক পর সন্ধ্যেবেলায়  রোজি- ঠাম্মা বল্ল, টুম্পি,  খবর বল।  আমার টিভিটা খারাপ হয়ে বড্ড মুশকিল হয়েছে।
ঠাম্মা,  তোমার শরীর এখন ভাল তো?- পাশ কাটানোর চেষ্টা  করি।
কথা শোনো, কদিন বাদেই তো মানু -মামার জন্মদিন, একশ বছরের। তোমরা পাড়ায় কিছু করছনা?
দাদা  মুচকি হেসে বল্ল, ঠাম্মি, সেদিন রায় দিবস, কাগজে লিখেছে। কত রকম রায় ঘোষণা হবে।
রোজি -ঠাম্মা মুচকি হেসে বল্ল, তাই বুঝি? 

“জান টুম্পি,   ২রা মে  মামার জন্মস্থানে যাব, বকুলবাগানে। চিফ গেস্ট হয়ে।   বিরাট গাড়ি বারান্দাওয়ালা বাড়ি।  ছোটবেলায় ওখানে মায়ের সঙ্গে  থাকতাম। আমি   হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে ঠাম্মা হাসে,  কী বলব দিদু, কাল রাতে প্ল্যাঞ্চেটে মামা বল্ল, রোজি- রে আমার জন্মভিটেয় গিয়ে  আমায় একটু স্মরণ করিস। আমি  এখন সাই- ফাই  প্ল্যানেটে আছি। তোদের পৃথিবীর মত আরো চারটে পৃথিবী পেরিয়ে।  এখানে জল, হাওয়া,  গাছের ফল সব খুব টাটকা, কারুর কোন অসুখ নেই।কিন্তু  তোদের ওখানে নাকি দুষ্টু  একটা পুঁচকে ভাইরাস খুব জ্বালাচ্ছে?  আমি তো  এখানকার হাই টেনশন মেল সিস্টেম থেকে তোদের ওই নীল গ্রহের সব খবর পাই। কিন্তু আমার খবর জানাতে পারিনা, সে জন্য সেই আদ্যিকালের প্ল্যাঞ্চেট ভরসা।    বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি কোভিডের পর তোর   চোখ কান বেশ ভাল হয়ে গেছে।  তুই  কিন্তু আমায় প্লট দিবি, যাতে আমি এই সাইফাই গ্রহে বসে  সায়েন্স -ফিকশান লিখতে পারি।  আর হ্যাঁ ওই পাজি ভাইরাস-টা  আমাদের এখান থেকেই গেছে।  মানুষ তো  দিনদিন খুব   স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে্, নীল্গ্রহটাকে  নোঙরা করে ধ্বংস করে দিচ্ছে।  তাই  আমাদের এই গ্রহের বাসিন্দারা এই পাওয়ারফুল জীবাণুটা ওখানে পাঠিয়েছে।  তোদের সচেতন করতে।   চুপিচুপি জানিয়ে দিই, ওই লকডাউন না কি সব যেন তোরা করছিস, ওসব না করে খোলা জায়গায় , নদীর ধারে , বনের ভেতর , পাহাড়ের কোলে গিয়ে গলা ছেড়ে গান কর, আমার  সিনেমায় গুপি যেমন করত, এতে  ফুস্ফুসের জোর বাড়বে ,  শরীরের ইমিউনিটি চড়চড় করে বেড়ে যাবে-----“ 

 দাদা ডাকছে , কীরে ! আর  কত-বেলা অব্দি ঘুমোবি? আজ কি তারিখ?   তোর না  সকালে  পাড়ার ওয়েব–প্রোগ্রামে গুপি-বাঘা সিরিসের গান করার কথা? বাবা কম্পিউটার সেট করছে---
 জানলা দিয়ে টাটকা হাওয়া আর সোনা রঙের রোদ্দুর বিছানায় আছড়ে পড়েছে,-- কী সব ছাইপাঁশ স্বপ্ন দেখছিলাম এতক্ষণ--- 
- দাদা, রোজিঠাম্মা আজ  সকালে ফুল চায়নি?  
-নারে – মা বল্ল , আজ সকালে রোজি-ঠাম্মাকে গাড়ি  করে যেতে দেখেছে—  দক্ষিণ  কলকাতার বকুল-বাগান থেকে নাকি  নেমন্তন্ন এসেছে---সত্যজিত রায়ের জন্মস্থান -- , ওখানে উনি নাকি----। 
 আমি  চোখ রগড়ে বললাম , দাদা সাইফাই গ্রহ থেকে আমাদের এখানকার সব  প্রোগ্রাম দেখা যাবে?

মুগ্ধ থাকি সত্যজিতে
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস

সত্যজিতের লেখা পড়েই ছেলেবেলায় মুগ্ধ হতাম,
সম্পাদনার সন্দেশটাও কি গোগ্রাসে পড়ে নিতাম!
কিন্তু তখন বুঝিনি তো বহুমুখী তাঁর প্রতিভা,
কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি? সৃষ্টি সবই মনলোভা৷
খেল দেখালেন বিজ্ঞাপনে কর্মজীবন শুরু করেই,
মলাট লেখার নতুন দিশা দেখিয়ে দিলেন বইবাজারে৷
সুরের প্রতি টান কি দারুণ, কল্পনাতে অনন্যতার
ছোঁয়া পেল ফিল্ম দুনিয়া, আবহে তাঁর নিজস্বতা৷
প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য মিলিয়েছিলেন সৃষ্টি জুড়ে,
তবুও খাঁটি বঙ্গবাসী মনন মেধায় হৃদয়পুরে৷
শত শত বছর আরো বিশ্বজয়ী থাকুক এ নাম,
মৃত্যুজয়ী সত্যজিতের চরণ ছুঁয়ে শতেক প্রণাম৷


সেলাম মহারাজা
সন্দীপন রায়

তবুও তুমি থাকবে জানি, যতই হারি তোমার জিত। বাংলা আমি ভুলছি রোজই তবুও জেগে সত্যজিৎ। 

দীর্ঘদেহী বঙ্গপুরুষ চিন্তনে তো তুমিই মিথ। রবির পরে সর্বগুণী বিশ্বাকাশে সত্যজিৎ। 

সেলাম ঠুকি তোমার চরণ বাঙালিয়ানা শক্ত ভিত। রোজ সকালে সূর্য উদয় বাঁচার বাতাস সত্যজিৎ। 

মৃত্যু নাকি পোড়ায় সবই, মৃত্যু নাকি প্রবল শীত। জীবন জয়ী উষ্ণতাতে ছায়াছবি সত্যজিৎ।


সেই সন্দেশ 
শ্রীপর্ণা ঘোষ
সপ্তম শ্রেণী, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়,পশ্চিম মেদিনীপুর

বাড়িতে অনেক লোকজন। সবাই খুব গম্ভীর মুখে ঘুরছে। তারা কেন এসেছে তা আমি জানিনা। সবঘর লোকজনভর্তি, কোথাও লুকানোর জায়গা নেই। এদিকে কেউ যদি দেখতে পায় তখন কত কত প্রশ্নের উত্তর দাও। মা সকাল থেকে ব্যস্ত মিষ্টি ,জল, লুচি দিতে। আমার যে খিদে পেয়েছে তা মায়ের মনেই নেই। মায়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগই পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ আমার কানে এল ধনদাদু কাকে যেন বলছে, “সন্দেশের প্যাকেটটা এখানে রাখলাম।” গিয়ে দেখলাম, ধনদাদু নেই, মনে হয় মামার কাছে গেছে। 
সন্দেশের নাম শুনে আমার আরো খিদে পেয়ে গেল। কোথায় রাখতে পারে ধনদাদু! পুরো রান্নাঘর ঢুঁড়ে ফেললাম। কোত্থাও নেই। সব ঘরের এখানে ওখানে খুঁজে দেখলাম, নেই। তাহলে নিশ্চয়ই কেউ নিয়েছে। ছোটঘরে গিয়ে দেখলাম সুবিনয় কাকা ও লীলাপিসি কথা বলছে। ছোটঘরের পিছনের গ্রিল ছাড়া জানলাটা দিয়ে অনেক কষ্টে ঝুঁকে আড়াল থেকে শুনতে পেলাম, কাকা বলছে, “সত্যি লীলা, তোর ‘লক্ষ্মী ছেলে’ গল্পটা খুব ভালো লেগেছিল।” 
পিসি বলল, “বড়দাই তো একটা গল্প চেয়েছিল, ছাপবে বলে। আমি গল্পটার নাম রেখেছিলাম ‘লক্ষ্মীছাড়া’। ছাপার সময় বড়দাই নাম পালটে ‘লক্ষ্মী ছেলে’ রাখেন। মণিদা, আজ যদি বড়দা থাকতেন ! আজকের দিনটা বড় দুঃখের দিন।”
বুঝতে পারছি না, কাকা আর পিসি কোন দুঃখের কথা বলছে? 
সে কথা আমার এখন ভাবলে চলবে না। কাকাও নিতে পারে কারণ কাকার ডায়াবেটিস আছে। হয়তো লুকিয়ে রেখেছে। লীলাপিসিও লুচির সঙ্গে চার পাঁচবার মায়ের কাছ থেকে সন্দেশ চেয়ে খেয়েছে। আচ্ছা, লীলাপিসির পাশে রাখা ব্যাগটায় ওটা কি? যার জন্য ব্যাগের চেনটাও লাগানো যায়নি। একটা প্যাকেট উঁকি মারছে ভিতর থেকে। আরো ঝুঁকে দেখতে গিয়ে জানলা টপকে ওদের ঘরে গিয়ে পড়লাম ধুম করে। 
লীলা পিসি আমাকে দেখে বলল, “কিরে মানিক, আমি তোকেই খুঁজছিলাম।” 
আমি কাছে যেতেই আমাকে আদর করে ব্যাগ থেকে সেই উঁকি দেওয়া প্যাকেটটা বার করে আমার হাতে দিল। প্যাকেটের মধ্যের জিনিষটা বার করে দেখি, একটা দম লাগানো ব্যাঙ। লীলাপিসি বলল, “এটা তোর ছোটবেলার খেলনা।” খেলনাটা হাতে নিয়েই আমার ছোটোবেলার দু’একটা কথা মনে পড়তে লাগলো। 
আমি বড়ো ঘরে গিয়ে দেখলাম, সুখলতাপিসি, পূণ্যলতাপিসি আর মা গল্প করছে। এরা যে কেউ সন্দেশের প্যাকেটটা নেয়নি এটা ঠিক তবে পূণ্যলতাপিসি আগোছালো করে রাখা একদম পছন্দ করে না। কোনো জিনিষ পরে আছে দেখলেই সরিয়ে যে কোনো জায়গায় রেখে দেয়। একবার আমার আঁকার খাতাটা সরিয়ে কোথায় যে গুছিয়ে রেখে চলে গেছিলো আর খুঁজেই পাওয়া যায় নি। 
কিন্তু সবার সামনে আমি কি করে জিজ্ঞেস করবো! তাই আমি আশা ছেড়ে দিলাম। খিদেতে মাথা ঘুরছিলো। কিচ্ছু শুনতেও পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ কল্যাণীদি আমাকে ডেকে বলল, “কী হয়েছে তোর?” নলিনীদিও এল পিছু পিছু। কল্যাণীদি আর নলিনীদি হল পূণ্যলতাপিসির মেয়ে। আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, “আমার খিদে পেয়েছে আর ধনদাদু একটা সন্দেশের প্যাকেট রেখে গেছে সেটা খুঁজে পাচ্ছিনা।” তা শুনে ওদের গম্ভীর মুখেও হাসি দেখলাম। 
নলিনীদি বলল, “আমরা জানি, ওটা কোথায় আছে। আমরাই তো লুকিয়ে রেখেছি। যদি পারিস খুঁজে বের কর।” 
আমি মনে মনে ভাবলাম, একটা জায়গাই খালি খোঁজা বাকি আছে। সেটা মামার ঘর। 
শেষে মামার ঘর খুঁজেও কোথাও পেলাম না। এবার আমার চোখ থেকে টপ টপ করে জল পরতে লাগলো। ধনদাদু আমাকে কোলে নিয়ে বলল, “কী হলো?” কল্যাণীদি আর নলিনীদিও কাছে এসে বলল, “আমরা তো তোর সাথে মজা করছিলাম। আমরা সত্যি জানিনা কোথায় আছে।”
ধনদাদু আমাকে বাইরের ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে সবাই একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ছবির সাদা-কালো মুখটা আমার খুব চেনা লাগছে। ছবিতে রজনীগন্ধার মালা দেওয়া। সামনে ধূপ জ্বালানো। মা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে। সবাই দুঃখ দুঃখ মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। মা আমাকে কাছে টেনে নিয়ে ছবিটা দেখিয়ে বলল, তোমার বাবার কম বয়সের ছবি। আজ তাঁর মৃত্যুদিন। সঙ্গে সঙ্গে আমার অনেক কথা মনে পড়ে গেল। আমার হাতের সেই খেলনা ব্যাঙটা — বাবা বারান্দায় চেয়ারে বসে বিশ্রাম করছেন। আমি ব্যাঙটা দম লাগিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি। সেটা এখান থেকে ওখানে চলে যাচ্ছে। 
বাইরে থেকে পোস্টম্যান, রেজিস্ট্রি চিঠি বলে চেঁচালো। কেউ একটা গিয়ে চিঠিটা আনল। সই করতে হবে। মা চিঠিটা নিয়ে আমাকে বলল, মানিক টেবিল থেকে কলমটা এনে দাও তো। টেবিলে কলম নিতে গিয়ে দেখি, সেই সন্দেশের প্যাকেট! মাকে কলমটা দিয়ে আবার টেবিলে গিয়ে সন্দেশের প্যাকেটটা নিলাম। 
দেখলাম এটা আসলে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার প্যাকেট। আর প্যাকেটের ওপরে লেখা, ‘মানিককে। অনেক অনেক বড় হও — এই আশীর্বাদ করি, বাবা।’ 
আমি প্যাকেটের সন্দেশ আর তার ওপর লেখা সন্দেশ — এই দুই সন্দেশকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।

সব বাঙ্গালির বুকে
প্রবাহনীল দাস
সপ্তম শ্রেণী, একমি একাডেমী,কালনা, পূর্ব বর্ধমান

নতুন করে বলার কিছু রেখে গেছেন তিনি?
অপূর্ব তার কাজের সাথে সবাই পরিচিত।
এমনই সন্তান পেয়ে বাংলা মা গর্বিত —
ফেলুদা বা অপু-দুর্গা বানিয়েছিলেন যিনি।
তারিণী খুড়ো, শঙ্কু এবং আরও নানান মুখে,
আনন্দ খুব দিয়েছিলেন, মাতিয়ে ছিলেন মন।
পরিপূর্ণ থাকবে ঠিকই ভাবনার এক কোণ।
থাকেন যেন সত্যজিৎ সব বাঙ্গালির বুকে।


পাঠ প্রতিক্রিয়া ১
(অষ্টম শ্রেণীর শতভিষা মিশ্র জ্বলদর্চির ৩৪ তম ছোটোবেলা সংখ্যা পড়ে যা লিখল) 

বর্তমান কোভিড পরিস্থিতি খুবই সংকটজনক এবং আমরা ছোটরা এই সময়ে গৃহবন্দী।এই  অবস্থায় "ছোটোবেলা" পত্রিকাটির প্রত্যেকটি কবিতা, গল্প আমায় আনন্দ দিয়েছে এবং ছবিগুলিও খুব ভাল লেগেছে
সবার প্রথমে রতন জেঠুর "ফুলকুসুমপুর খুব কাছে" ধারাবাহিকটি আমি‌‌‍ প্রতি সংখ্যায় পড়ি।আমার খুব ভালো লাগে।
এবং গল্প কাকুর পোষ্যদের প্রতি স্নেহ ভরা যত্নকে আমি সমর্থন করি।
           এছাড়া শুভশ্রী আন্টির লেখাটিও আমার বেশ ভালো লেগেছে। একজন মা যেমন করে তার সন্তানকে আগলে রাখেন তেমন করে আলেক্সানাও জারিন কে দুষ্টু জুহাল এর হাত থেকে আগলে রেখেছিল।
              নন্দিতা আন্টির লেখা "হারাধনের দশটি ছেলে" কবিতাটিও বেশ ভালো। তিনি তার কবিতার দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন যে হারাধনের দশটি ছেলে কোথাও হারিয়ে যায়নি তারা বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হয়ে সবার মাঝে থেকে দেশের সেবা করে চলেছে ।
             শ্রীকান্ত আঙ্কেলের লেখা রাঙ্গা পিসির এবারের গল্প "গঙ্গাবক্ষে পাঁচ রাজকন্যে" গল্পটিও দুর্দান্ত। ভ্রমণ কাহিনী আমার এমনিতেই ভালো লাগে বিশেষ করে মুর্শিদাবাদের প্রতি একটা বিশেষ কৌতুহল আছে আমার। এছাড়াও গল্পটিতে প্রতিটি ভ্রমণ স্থানের যে নিখুঁত বিবরণ রয়েছে তা আমায় খুবই আকৃষ্ট করে। 
          স্বপ্ননীল রুদ্র তার লেখা কবিতা "ভানু ভায়ার ভাবচক্কর"- এ ভানু ভায়ার এক  অদ্ভুত প্রতিদিনের রুটিন তুলে ধরেছেন যা খুবই মজাদার।
               উর্মি দিদির লেখাটিও খুব সুন্দর। সত্যি আমরা সভ্য মানুষেরা এ ধরনের মানুষদের আজও না মানুষের দলে ফেলে রেখেছি। কিন্তু আমরা ভুলে গেছি যে তাদের মধ্যেও এক সৎ  মানসিকতা রয়েছে। আমাদের উচিত এসকল মানুষদের পাশে দাঁড়ানো।
         সবশেষে বলি সূর্যানিদিদির গল্পটির কথা। এই গল্পটি ও আমার খুব সুন্দর লেগেছে বিশেষ করে ভূতের ইউনিট টেস্ট আর দাদুর অদ্ভুত কান্ডকারখানার জন্য গল্পটি আরো বেশী মজাদার হয়ে উঠেছে। এছাড়া সমৃদ্ধি,রাজদীপ, সহেলী,অদিতি ও সম্প্রীতির আঁকা ছবিগুলিও খুব সুন্দর হয়েছে।
 মৌসুমী আন্টিকে অনেক ধন্যবাদ এই "ছোটবেলা" পত্রিকাটি আমাদের সামনে এনে দেওয়ার জন্য। আগামী সংখ্যার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।সবাই ভালো থেকো ও সুস্থ থেকো।


পাঠ প্রতিক্রিয়া ২
(জ্বলদর্চির ৩৪ তম ছোটোবেলা সংখ্যা পড়ে বন্দনা সেনগুপ্ত যা লিখলেন) 

ছোট্ট বন্ধুরা ভালো আছ নিশ্চয়ই। অমিয় বাবুর ছবির বুলবুলির মত একা একা লাগে নাকি? না কি, তার মত সব কাজ একা একা করতে মন চায়? এখন তো মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার সব নিজে নিজেই ব্যবহার করতে শিখে গেছ। বরং মাকে মাঝে মাঝেই সাহায্য কর, নয় কি? কত বড় হয়ে গেছ এই এক বছরে!

ছোটবেলা বিশেষ সংখ্যা ৩৪ পড়েছ? কি সুন্দর! প্রতিটি সংখ্যা আগেরটির থেকে আরও ভালো লাগছে।

রতনতনু ঘাটী মহাশয়ের "ফুলকুসুমপুর খুব কাছে" বরাবরের মতই অবর্নণীয়। সবচেয়ে মজা লাগে ওঁর নামকরণ। অননুকরনীয়। আর, এই নিউক্লিয়ার পরিবারের যুগে এই গল্পটি মানুষ পশু পাখি সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে থাকার প্রেরণা দেয়।   

শুভশ্রী সাহার "আলেক্সানা" খুব ভালো লাগল। নীল পরী তার বন্ধুকে কত ভালবাসে, তার কোন কষ্ট সে সইতে পারে না! আবার, জারিনও তাকে সানগ্লাস পরিয়ে রেখেছে যাতে অন্যের ক্ষতি না হয়!

শ্রীকান্ত অধিকারী ও রাঙা পিসির সাথে দারুণ এক খানা বেড়ান হল। সেই মুঘল আমলের দৃশ্য যেন চোখের সামনে ভেসে এল, আর সবের মাঝেই বিশাল সায়রে ঘাই দিয়ে গেল পাঁচ রাজকন্যে। অসাধারণ পেন পিকচার।

উর্মি শর্মার "না মানুষের কথাকলি" যেন জীবনের জয়গান। মনুষ্যত্ব বোধ, সততা ইত্যাদি মূল্যবোধগুলি বয়স, সামাজিক অবস্থান বা আর্থিক সামর্থের উপর নির্ভর করে না। তারা হৃদয় হতে স্বতই উত্সারিত হয়। এরকম লেখা পড়লে মনে আশা জাগে।

সূর্যানী নাগ, তোমার ভূতের পোর পড়াশুনা আর দুষ্টুমির গল্প বাড়ির সবার সাথে ভাগ করে নিলাম ভাই। খুব ভালো লিখেছ। 

স্বপ্ননীল রুদ্রের লেখা "ভানু ভায়ার ভাবচক্কর" পড়ে ভির্মি খাওয়ার জোগাড়। যাই হোক, ভানু ভায়ার খাওয়ার জোগাড় যেন অক্ষুন্ন থাকে! আর, নকল দাঁত রগড়ানোতে যেন ব্যাঘাত না ঘটে!

নন্দিতা দাসবসুর "হারাধনের দশটি ছেলে" কবিতাটি ছোটদের মনে আশা জাগায়। আর, আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। সবার মধ্যেই আশা আছে আর ক্ষমতা আছে। নিজের আশা আকাঙ্ক্ষা ছোটদের উপর চাপিয়ে না দিয়ে, তাদের নিজেদের মতো করে বেড়ে উঠতে দিয়ে দেখাই যাক না। 

সমৃদ্ধি চট্টোপাধ্যায়, রাজদীপ দাস, সম্প্রীতি বিশ্বাস, অদিতি বিশ্বাস, সহেলী মন্ডল, খুব সুন্দর এঁকেছ ভাই তোমরা। তোমাদের ছবিগুলি ছাড়া সংখ্যাটি এত অপূর্ব হয়ে উঠতে পারত না। 

মৌসুমী ঘোষ ও তাঁর সহযোগীবৃন্দকে অনেক অভিনন্দন জানাই এই সুন্দর সংখ্যাটির জন্য। অমিয় বিশ্বাস ও সায়নী কুন্ডু আলাদা করে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে।

পরের সংখ্যার অপেক্ষায় রইলাম।


গল্পে গল্পে ক্যুইজ 
রাজীব কুমার ঘোষ
পর্ব ১
ক্যুইজের মহামারী, উজবেকিস্তানের এক বাদশা আর ক্লাস সিক্সের এক স্কাউট

উজবেকিস্তান দেশটার নাম শুনেছ? 
চটপট গুগুল ম্যাপে খুঁজে নাও তো দেশটা কোথায়। খুঁজে পেলে দেখে নিও তার আশেপাশে কী কী দেশ আছে। আমাদের সময় ম্যাপ পয়েন্টিং বলে একটা খেলা হত। ম্যাপের মধ্যে কোনো জায়গার নাম বললে সেটা এক মিনিটের মধ্যে খুঁজে বার করতে হতো। এখন তো সব উত্তর দিয়ে দেয় ‘গুগুলবাবা’। তা গল্প করার মাঝে মাঝে সেই গুগুল ম্যাপেই আমরা ম্যাপ পয়েন্টিং খেলে নেব। গুপি বাঘার সেই গান শুনেছ নিশ্চয়ই তোমরা, “দুনিয়ায় কত আছে দেখবার/কত কী জানার, কত কী শেখার/ঘরে কেন বসে রয়েছি বেকার/ আর কি সহ্য হয়”। না শুনে থাকলে ইউ-টিউবে শুনে নিও অবশ্যই। 
আমাদের সময় ম্যাপ বই ছিল সেই দুনিয়াকে চেনার প্রথম পাঠ। ম্যাপে গোটা দুনিয়াটাকে দেখলে তবেই না বোঝা যায় আমাদের বাড়ি, আমাদের পাড়া, আমাদের গ্রাম বা শহর এমনকি আমাদের দেশটাও গোটা দুনিয়া নয়। এর বাইরে পড়ে আছে বিশাল, বিরাট একটা জগৎ। সেই বাইরেকে ঠিকঠাক না চিনলে নিজের ঘর, নিজের মহল্লা বা নিজের দেশটিকেও কিন্তু ঠিক ঠাক চেনা যায় না। 
এত দেশ ছেড়ে উজবেকিস্তান কেন? কারন এই দেশের এক রাজকুমারের জন্য আমাকে বিপদে পড়তে হয়েছিল। ঠিক আমাকে নয়, ক্লাস সিক্সের রাজীবকে। এই রাজকুমার যখন বাদশা হলেন, নিজের সিংহাসনটাই সামলাতে পারলেন না। শুধু তাই নয় নিজের দেশটাও বেহাত হয়ে গেল। কিন্তু শুনলে তাজ্জব হয়ে যাবে এই বাদশাই দিল্লি দখল করে একটা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে প্রায় পাঁচশো বছর আগের কথা। 
তা পাঁচশো বছর আগের বাদশা, কয়েক দশক আগে ক্লাস সিক্সের রাজীবকে কীভাবে বিপদে ফেলেছিল সেটা জানতে গেলে ক্যুইজের একটা মহামারীর গল্প জানতে হবে। আশির দশকের শুরু থেকেই ক্যুইজের ছোঁয়াচে রোগ ধরে ফেলেছিল স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের, কলেজের দাদাদেরও, এমনকি বড়দেরও। যাকে ঠাট্টা করে তোমরা মহামারীও বলতে পারো। এখন কল্পনাও করতে পারবে না কী ‘ক্যুইজময়’ ছিল সেই সময়। স্কুল, কলেজ তো আছেই তাছাড়া পাড়ার ক্লাব থেকে নানা পূজা কমিটি, লাইব্রেরি কমিটি আরো নানাবিধ প্রতিষ্ঠান ‘ক্যুইজময়’ হয়ে উঠেছিল। টিভিতেও হতো রকমারি ক্যুইজের অনুষ্ঠান। সারা বছরে বিভিন্ন জায়গায় নানা অনুষ্ঠানে এত ক্যুইজের আয়োজন করা হতো যে বলার নয়। বইয়ের দোকানে বিভিন্ন ক্যুইজের বই বিক্রি হতো - সরু, মোটা, মহা মোটা বই তো বটেই এমনকি ট্রেনে বাসেও অতি সরু সরু ক্যুইজের বই ফিরি হতো। অভিভাবকরা ক্যুইজের বই পড়াকে তাদের সন্তানদের একটা অত্যাবশ্যক এবং প্রয়োজনীয় কর্ম হিসাবেই গণ্য করতেন। উদ্দেশ্য ছিল ছেলে-মেয়েদের GK বাড়ানো। অনেকে আবার মনে করতেন ধাঁধা টাইপের ক্যুইজের সমাধান করলে IQ বাড়ে। 
সেই ক্যুইজময় যুগে আমাদের স্কাউট দল থেকে একটা ক্যুইজের টিম যাবে অন্য একটি স্কাউট দলেরর আয়োজন করা ক্যুইজে অংশ নিতে। আগের বছর আমরাই জিতেছিলাম, সেই জেতা দলের দু’জন সদস্য তো যাবেই কিন্তু মিটিং-এ কথা উঠল আরেকটা দল পাঠানো হোক। তাহলে আর কোন দু’জনকে পাঠানো যায়? 
তোমরা নিশ্চয়ই স্কুলে দেখেছো স্যারেরা যখন বলে, ‘কে এটা পারবে?’ বা ‘কে ভালো পারে?’, তখন কিছু ছেলেমেয়ে থাকে যাদের কাজ কেবল অন্যের দিকে আঙুল দেখানো। সেই একই ব্যাপার হল, আমি দেখলাম অনেককটা আঙুল আমার দিকে উঁচিয়ে আছে। আমার নিজেকে অঙ্গুলিমাল মনে হচ্ছিল আর ইচ্ছা হচ্ছিল এইসব ধড়িবাজদের আঙুলগুলো কেটে নিয়ে মালা করে পরি। সেই ভাব মনেই রেখে মিন মিন করে বললাম, আমি কিছু সেরকম জানি না। অর্থাৎ আমাকে নিলে হার সুনিশ্চিত। আসলে ক্যুইজ আমার দু’চক্ষের বিষ। ঝকঝকে চেহারার সব ছেলে মেয়েরা ফটাফট ফটাফট উত্তর দেয়। দেখে মনে হয়ে বাপরে! আমি তো কিছুই জানি না। সুতরাং আঙুর ফল টক।
 হঠাৎ স্কাউট মাস্টার আমার চোখের দিকে সোজা আঙুল তুলে দ্রুত গতিতে প্রশ্ন করলেন, সেই যে সেই বাদশা, তার বাবার নাম কী? ফট করে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল বাদশার বাবার নাম এবং আমি বিপদে পড়লাম। স্কাউট মাস্টার বললেন, ‘অনেক জানো’ এবং আমার নামটি নেওয়া হল। ‘তার পর কি হইল জানে শ্যামলাল’। 

এবার আমরা চলে আসি ক্যুইজে
১. সেই বাদশার নাম কী ছিল? কোন সাম্রাজ্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
২. স্কাউট মাস্টারের প্রশ্নের উত্তরটি কী?
৩. উজবেকিস্তানের রাজধানীর নাম কী? এই রাজধানী থেকে M39 রাস্তাটি ধরে নিচের দিকে আসলে তুমি এশিয়ার এক অতি প্রাচীন এবং বিখ্যাত শহরে এসে উপস্থিত হবে। শহরটির নাম কী? 
৪. এই রাজধানীর সঙ্গে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতের একজন প্রধানমন্ত্রীর নাম জড়িয়ে আছে। কে তিনি? 
৫. স্কাউটের প্রতিষ্ঠাতা কে? বিশ্ব স্কাউট দিবস কবে পালন করা হয়?
৬. যে ঘরে গুপি আর বাঘা গানটি গাইছিল সেই ঘরে একটি ঘড়ি ছিল। সেটি কী ধরণের ঘড়ি?
৭. IQ এর পুরো কথাটি কী?
৮. ‘তার পর কি হইল জানে শ্যামলাল’ সত্যজিৎ রায়ের বাবার লেখা এই পংক্তি আমরা কোন গল্পে পাই?
৯. অঙ্গুলিমালের নাম কোন মহাপুরুষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে? 
১০. ‘ধড়িবাজ’ শব্দের অর্থ কী?

পরের রবিবার মিলিয়ে নিও তোমাদের উত্তর। সেদিন এই উত্তরগুলো নিয়েই হবে কিছু গল্প। উত্তর মানে তো জানার শেষ নয়, আরো জানার শুরু। প্রতিটা উত্তর আরো আরো গল্প নিয়ে আসে। আর হ্যাঁ, জানাতে ভুলবে না গল্পে গল্পে ক্যুইজ তোমাদের কেমন লাগছে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 


Post a Comment

0 Comments