জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা― (তৃতীয় পর্ব)/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ২২

মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা― (তৃতীয় পর্ব)

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরে তখন দ্রোণাচার্যের হাট। একঝাঁক পণ্ডিত ব্যক্তি। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই কম। এক একজন এক একটি বিষয়ে দিকপাল। প্রধান শিক্ষক শ্রীনিবাস নন্দ। বিজ্ঞানের গুণী শিক্ষক মণীন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ী। গণিতের শিক্ষক চিত্তরঞ্জন দাস। ইতিহাসে শ্রী মহিতোষ দাস। বাংলায় শ্রী বীরেনচন্দ্র সাউ। শ্রী গঙ্গেশ আচার্য। শ্রী সরোজ মাইতি প্রমুখ। নিজ নিজ বিষয়ে যাবতীয় পাণ্ডিত্য তাঁরা উজাড় করে দেন শ্রেণীকক্ষে। সরস্বতীর আরাধনায় প্রাণ ফিরে পায় চির-ক্ষুধার ব্ল্যাকবোর্ড। তাদের সংস্পর্শে সাদা চকখড়ি চির ভাস্বর হয়ে ওঠে। চেয়ার বেঞ্চ টেবিল বই খাতা কলম প্রাণবন্ত হয় ক্ষণিকে। এতসব পণ্ডিতের অর্জুন কিন্তু একজনই। তিনি নারায়ণচন্দ্র রানা। শ্রেণীকক্ষে অদ্বিতীয় সে। একগুচ্ছ কৃতী বিদ্যার্থীর মধ্যে তার স্বতন্ত্র বিচরণ। সেজন্য দ্রোণাচার্যকূলে বিশেষ স্নেহভাজন সে। আর তার যোগ্য দোসর গৌর, গৌরহরি রাউৎ। ক্লাসের সেকেন্ড বয়। ক্লাসে বিদ্যার্থীদের মধ্যে বিষয় গভীরতার জোর টক্কর লেগে থাকত। অন্যজনকে ছাপিয়ে যাওয়ার সুস্থ গঠনমূলক কম্পিটিশন। এ যদি বলে আমাকে দেখ, তো সে বলে তাকে দেখ। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে খুনসুটি প্রায়ই লেগে থাকে। সহজ সরল নারায়ণকে খেপানো, পেছনে লাগা হামেশাই চলত। কেউ কেউ নারায়ণের গলার মাদুলি ধরে টানে। হোস্টেলে হ্যারিকেনের তেল ফেলে জল ভর্তি বা খালি করে দেওয়া হোক কিংবা খেপানো, সবেতেই খুব সমস্যায় পড়ে নারান। এমন বিড়ম্বনায় সে অনুযোগ করে মাত্র। তার অনুযোগ, কেন বন্ধুরা অকারণে তার এতটা সময় নষ্ট করল? পরক্ষণে কোনও বন্ধু ক্লাসের পাঠ অথবা কোনও টপিক বুঝতে না পারলে নারায়ণের কাছে আসবেই। তখন রাগ-অভিমান ভুলে বিষয়টা খুব সুন্দর বুঝিয়ে দেয়। সুতরাং তিক্ততা নয়, এ যেন অকৃত্রিম বন্ধুতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অবশ্য প্রত্যেকে নিজের নিজের লক্ষ্যভেদে অবিচল। নিজস্ব কলা দেখাতে উদগ্রীব। বিদ্যের ফুলঝুরি যেন। প্রয়োজন কেবল একটি স্বয়ম্বরের আয়োজন। একটি পরীক্ষা। একটি মূল্যায়ন। একটি মৌখিক। তাহলে পরিস্কার হয়ে যাবে 'সেরা কে'। আর সে সম্ভাবনা আপাতত নিয়ে এল গণিতের ক্লাসটেস্ট। 
      

স্থানীয় শ্রী চিত্তরঞ্জন দাস গণিতের শিক্ষক। বাটি স্কুল থেকে সামান্য হাঁটা পথ। পিচ রাস্তা বরাবর পাঁচশ মিটার দূরে সাউরি বাস স্টপেজ সন্নিকটে। ক্লাসে দুটো বিষয় পড়াতেন তিনি। গণিত আর রসায়ন। প্রায়োরিটি অবশ্যই গণিত। তিনি ক্লাসে যা অঙ্ক কষতে দেন, অনায়াসে তার সমাধান করে ফেলে নারান। সবার প্রথম খাতা দেখায়। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হাতের লেখা। যেন ছাপা অক্ষর। এ প্রসঙ্গে চিত্তবাবু জানান―
'ছোটবেলা থেকেই নারায়ণ প্রতিটি অঙ্ক লিখে লিখে নিঁখুত প্র্যাকটিস করত। ঠিক যেমন পরীক্ষার খাতায় অঙ্ক কষা হয়, সেভাবে গোটা অঙ্কটাই খুব সুন্দর হস্তাক্ষরে ক্লাসের খাতায় এঁকে দিত সে। তার অঙ্কের কনসেপশান বেশ ক্লিয়ার ছিল। যার জন্য সে খুব ভালো রেজাল্ট করে অঙ্কে।'

  প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। একদিন ক্লাস-টেস্ট নেবেন ঘোষণা করে দিয়েছেন অঙ্কের মাস্টার মশায়। মোটামুটি কঠিন প্রশ্নপত্রের একটি সেট তিনি তৈরি করেছেন। নির্ধারিত দিনে শুরু হল টেস্ট। শ্রেণীকক্ষে। একেকটি বেঞ্চে চার―পাঁচজন বিদ্যার্থী গাদাগাদি করে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে। প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে এ-ও'র মুখের দিকে তাকায় তারা। কোয়েশ্চেন পেপার পড়ে বাকিদের ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা। এত কঠিন সে প্রশ্নপত্র! অথচ নারান ভাবলেশহীন। তার কাছে অঙ্কগুলো বেজায় সহজ। অনাড়ম্বর আতিশয্যে সে একটার পর একটা অঙ্কের সঠিক সমাধান অবলীলায় করে ফেলল খাতায়। তার কাছে প্রশ্নপত্রটি এত সহজ প্রতিপন্ন হয়েছিল যে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সে উত্তর পত্র জমা দিয়ে দেয়। সব সমাধান একেবারে নির্ভুল। ফলে নাম্বার কাটার নো চান্স। কমা-পূর্ণচ্ছেদ সহ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে নারানের অঙ্কের খাতা স্ক্রুটিনি করে চলেন মাস্টার মশায়। ভুল কোথাও নেই। কিন্তু এ কী? নাম্বার কাটবার একটা মিথ্যা অজুহাত খুঁজে পেলেন তিনি। এক জায়গায় অঙ্কের উত্তর লিখতে গিয়ে শেষ লাইনে ভুলবশতঃ নারান লিখেছে― 
'...অতএব, AB = CD হইবে হইবে।'

  দু'বার 'হইবে হইবে'! এ কেমন কথা! ব্যাস, মিলে গেল মার্কস কমানোর অজুহাত। 'হইবে হইবে' শব্দগুচ্ছের তলায় লাল কালির আঁচড় টেনে দিলেন অঙ্কের মাস্টার। সে-অঙ্কের প্রাপ্ত মার্কস থেকে এক নাম্বার কেটেও নিলেন তিনি। সামান্য ভুলের জন্য এক নাম্বার কম পেয়ে মন খারাপ ছাত্রের। পরের বার আরও নিঁখুত অঙ্ক কষার দৃঢ় সংকল্প করে। এই ঘটনায় তার জেদ বহুগুণ বেড়ে যায়। এদিকে অঙ্কের মাস্টার মশায় ভালো মতো জানেন― এ সামান্য ভুল। তার জন্য নাম্বার কাটার মানে হয় না। আসলে তিনি নম্বর কমিয়ে দিয়েছেন ছাত্রের কথা ভেবে। তার কনসেনট্রেশন বাড়াতে। জেদ বাড়াতে। তাকে আরও নিঁখুত গড়ে তুলতে। অঙ্কে ধারালো তৈরি করতে।

  ধন্য ছাত্রের অধ্যবসায়। ধন্য তার প্রতিজ্ঞা। ওই একবার। শুধু একবারই ক্লাসের পরীক্ষায় অঙ্কে ফুল মার্কস থেকে এক কম পেয়েছিল সে। আর কখনও তার অঙ্কের নাম্বার কাটার সুযোগ হয়নি চিত্তবাবুর। সেজন্য দুঃখ নয়, মনে মনে গর্বিত তিনি। মেধাবী ছাত্রের গরিমায় সার্থক তাঁর শিক্ষাদান।
      
  ১৯৬৯ সাল। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় এবার একঝাঁক কৃতী বিদ্যার্থী। ফাইনাল পরীক্ষার সেন্টার বেলদা গঙ্গাধর একাডেমি, সাউরি থেকে পনেরো কিমি দূরে। মাস্টার মশায়ের ব্যস্ততা চরমে। পাটিগণিত, বীজগণিত, পরিমিতি আর ত্রিকোণমিতি নিয়ে চিন্তা নেই। যত ভয় জ্যামিতির এক্সট্রা উপপাদ্য নিয়ে। রাতের ঘুম উজাড় হবার জোগাড়। ছাত্রের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি সারতে অনুশীলনী থেকে বেছে বেছে চুয়ান্নটি এক্সট্রা উপপাদ্য কষে দিলেন। বিশেষতঃ নারানের কথা ভেবে। এর মধ্য থেকে যদি না আসে পরীক্ষায়, তখন কী হবে? দুশ্চিন্তা তবু পিছু ছাড়ে না মাস্টার মশায়ের।

  সেদিন ছিল স্কুল ফাইনালে গণিত পরীক্ষার দিন। পরীক্ষা শুরুর বেশ খানিকটা আগে সেন্টারে পৌঁছে গেছেন চিত্তস্যার। পরীক্ষার্থীদের স্নেহাশীষ দিলেন। শুরু হল পরীক্ষা। পরীক্ষা চলাকালীন চিত্তবাবু জানতে পেরেছেন, যে চুয়ান্নটি এক্সট্রা উপপাদ্য তিনি নারানকে তৈরি করে দিয়েছিলেন, তার একটিও পরীক্ষায় আসেনি এবার। ব্যাস, আকাশ কুসুম ভেবে ভেবে মনখারাপের অবস্থা তাঁর। এক এক সেকেন্ড যেন কয়েক যুগ সময়ের সমান। শেষ হতে চায় না সময়। কখন শেষ হবে পরীক্ষা! নির্ধারিত সময়ে সমাপ্ত হল পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষের ঘণ্টা বাজতেই ছুটে গেলেন পরীক্ষা সেন্টারের গেটের দোরগোড়ায়। নারানকে দেখা মাত্রই জিজ্ঞেস করে বসলেন তিনি―
'জ্যামিতির এক্সট্রা উপপাদ্য করেছিস, নারায়ণ?'
'হ্যাঁ, স্যার। এক্সট্রা দুটো খুব সহজ ছিল। সমাধান করতে বেশি ভাবতে হয়নি'― হাসিমুখে সপ্রতিভ উত্তর ছাত্রের।

  ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল এইবার। হাঁফ ছাড়লেন শিক্ষক মশাই। এতক্ষণ হাবিজাবি চিন্তা করে অহেতুক কষ্ট পাচ্ছিলেন তিনি। খারাপ চিন্তা মাথায় ভীড় করে আসছিল। এখন বেশ রিলাক্সড। প্রিয় ছাত্রের মুখে সাফল্যের কাহিনী শুনে আশ্বস্ত হলেন তিনি। মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর। 

(দুই)
স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় নারায়ণ চন্দ্র রানার আকাশ ছোঁয়া সাফল্য। অথচ প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রি-ইউনিভার্সিটি কোর্সে  সে-অর্থে তত সফল নয় সে। পি ইউ (সায়েন্স) পরীক্ষায় ১৩-তম স্থান এর জলজ্যান্ত প্রমাণ। রেজাল্টের অগ্রগতির গ্রাফ সামান্য অধোগামী। কারণ কী? রেজাল্টের ময়নাতদন্তে উঠে আসে মস্ত বড় কারণ। ইংরেজিতে প্রাপ্ত নম্বর কম। কেন কম? তার একগুচ্ছ পরিসংখ্যান। এদের মধ্যে দুটো বেশ যুক্তিযুক্ত। প্রথমত, প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে নারায়ণ। এতদিন তার পড়াশুনা বাংলা মাধ্যম স্কুলে। শিক্ষকদের পড়ানো, বোর্ড ওয়ার্ক, কথা বলা, প্রশ্ন করা, মায় বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি পর্যন্ত বাংলা ভাষাতেই হত। সেজন্য বাংলা ভাষায় খুব সাবলীল সে। সমস্যা বাধল গ্র্যাজুয়েশন পড়তে এসে। অনার্সের সব পাঠ্যপুস্তক ইংরেজিতে লেখা। ক্লাসে প্রফেসররা পর্যন্ত ফটাফট লেকচার ঝাড়েন ফিরিঙ্গি ভাষায়। সদ্য বাংলা মাধ্যম থেকে ইংরেজিতে উত্তোরণ হয়েছে তার। ইংরেজি ভাষায় অত সড়গড় হয়ে ওঠেনি এখনও। ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে আড়ষ্ঠ বোধ করে। ইংরেজিতে কথা বলতে গেলে কেউ যেন পেছন থেকে জিভ টেনে ধরে। অনেকক্ষণ ভেবে চিন্তে উত্তর দিতে হয়। মোটামুটি কাজ চালানোর মতো যাহোক কিছু। যা একেবারে ব্যাকরণ বিধি মেনেও হয় না। তাতেও উচ্চারণ দশবার আটকে যায়। তার এতদিনের কথ্যভাষা ছিল বাংলা। ফলে ইংরেজিতে পড়ানো এবং শোনার অসুবিধার জন্য ইংরেজির নম্বর কমে যায়। দ্বিতীয় কারণ সম্ভবত দেশজুড়ে চলা সেসময়ের নকশাল আন্দোলন। সে-আন্দোলনে ছেলে-বুড়ো, ধনী-গরীব, মাস্টার-ছাত্র অধিকাংশই জড়িয়ে পড়ে। জরুরী অবস্থা চলে সেসময়। সেজন্য প্রায়ই কলেজ বন্ধ থাকত। ক্লাস হত না।
      
  ১৯৬৯―৭০ সালে পি. ইউ. কোর্সে পড়াকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজে একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা হয়। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নারায়ণ। তার প্রবন্ধটি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়। প্রবন্ধ শ্রেষ্ঠত্বের জন্য কলেজ থেকে ভূ-বিদ্যা পুরস্কার পায় সে। ১৯৭২ সালে রামকৃষ্ণ মিশন কলকাতা স্টুডেন্টস হোম বেলঘরিয়া একটি পুনর্মিলন উৎসব আয়োজন করে। পুনর্মিলন উৎসবে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সেই পত্রিকায় নারায়ণচন্দ্র একটি প্রবন্ধ লেখে। প্রবন্ধের বিষয় : 'বিশ্বের স্বরূপ ও তার বক্রতা'। চতুর্মাত্রিক মহাবিশ্বের প্রকৃতি কেমন হবে, 'দ্য স্টিডি-স্টেট তত্ত্ব'-এর কী সীমাবদ্ধতা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উন্নততম প্রাণীর অস্তিত্ব ভবিষ্যতে টিকে থাকবে কী না প্রভৃতি বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে এতে।

  ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ফিজিক্স অনার্স বিভাগে ভর্তি হয়ে গেল সে। পদার্থবিদ্যার সঙ্গে দুটি পাস-পেপার। গণিত (Mathematics) আর ভূতত্ত্ব (Geology)। সহযোগী বিষয় হিসাবে গণিত ঠিক আছে; কিন্তু ভূতত্ত্ব! এ যে অদ্ভুত কম্বিনেশন! বন্ধুরা সকলে অবাক হলেও বিস্মিত নয় নারায়ণ। আসলে তার ছিল প্রখর অন্তর্দৃষ্টি। কলেজ জীবন থেকে লক্ষ্য স্থির করে এগোচ্ছে তার পড়াশুনা। তার বিশেষ ঝোঁক জ্যোতির্বিজ্ঞান আর জ্যোতিঃ পদার্থবিদ্যার দিকে। অ্যাস্ট্রোফিজিক্স এবং রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি-এর মোটা মোটা বই তার নখদর্পণে। অধ্যাপক অমল কুমার রায়চৌধুরীর লেখা এবং সংগৃহীত কসমোলোজীর বইগুলো ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছে সে। শুধু পড়ে ফেলা নয়, তার স্মরণশক্তি প্রখর ছিল। পঠিত পুস্তকের সমস্ত ঘটনাসমূহ তার ঠোঁটস্থ-কণ্ঠস্থ-মুখস্থ-স্মৃতিস্থ। এ প্রসঙ্গে তার গুরু ড. অমল কুমার রায়চৌধুরী পরে বলেছেন―
  'নারায়ণ আমার প্রিয় ছাত্রদের অন্যতম ছিল। ছাত্র হিসাবে অত্যন্ত ভালো। ক্লাসে খুব শান্তভাবে শুনত। ক্লাসে প্রশ্ন করত কম। বোধহয় অন্যান্যদের অসুবিধা হবে ভেবেই। ক্লাসের বাইরে তার অগাধ প্রশ্ন আর আলোচনা। ছেলেটার স্মরণশক্তি দেখে আশ্চর্য হতাম। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে কসমোলজী নিয়ে ওর বেশি উৎসাহ ছিল। আমার সংগ্রহের অনেক বই ওর মুখস্থ। মুখস্থ যে ছিল তা আলোচনা করতে গিয়েই টের পাই। সিলেবাসের মধ্যে নারায়ণ কখনও আবদ্ধ থাকত না, আর পরীক্ষার নম্বর পাওয়ার ব্যাপারে মাথা ঘামাত না। বি. এস. সি.-তে তাই সব মিলিয়ে খুব ভালো রেজাল্ট ও করতে পারেনি। তবে একশো ভাগ সৎ ছেলে ছিল এবং খুব সাহসী। পড়াশুনার ক্ষেত্রে সত্যি এবং ঠিকঠাক জিনিসটা নির্ভীকভাবে বলত।' 
তিনি আরও বলেন― 'ক্লাসের বাইরে নারায়ণ জুতো খুলে, পায়ে মাথা ঠেকিয়ে, একেবারে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করত। এ ব্যাপারে ওকে অনেকবার প্রশ্ন করেছি; উত্তরে ও বলত "যিনি আমার শিক্ষাগুরু, যিনি শ্রদ্ধেয় তাঁকে এভাবেই প্রণাম করতে হয়। আর এতে আপনি আমাকে আশির্বাদ করেন যাতে আমার আপনার উভয়েরই শুভ হয়"।'

  ড. অমল কুমার রায়চৌধুরী ছাড়াও কলেজে নারায়ণ শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপক চঞ্চল মজুমদার, অধ্যাপক কার্ত্তিক চন্দ্র দাস ও অধ্যাপক নিত্যরঞ্জন পান মহাশয়গণের স্নেহ-সান্নিধ্যে আসে।

  প্রেসিডেন্সি'র আরেক শিক্ষক প্রফেসর শ্যামল সেনগুপ্ত বলেন― 'শ্রী নারায়ণ ছিল ছাত্রদের কাছে একটা মডেল বা আদর্শ। তার সৌজন্য আজকালকার ছাত্রদের মধ্যে বিরল। নম্রতা বা ভদ্রতা, শ্রদ্ধা কী জিনিস জানতে হলে নারায়ণই অন্যদের কাছে আদর্শস্বরূপ।' 

  এ হেন মেদিনীপুরের নারায়ণ সহজে (ফ্লাইং কালারস) ফিজিক্স অনার্স পাশ করে ১৯৭৪ সালে।

(তিন)
'অর্থবান লোকদের ছলচাতুরীর তুলনা হয় না'― মুচকি হেসে বলল নারায়ণ।
'কেন?'― ভাবাত্মক প্রশ্ন অধ্যাপকের।
'জানেন স্যার, সাউরি'র জনৈক ধনাঢ্য ব্যক্তি ঘোষণা করেছেন― সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দির থেকে যে নারায়ণের চাইতে বেশি নম্বর পাবে, তাকে তিনি অনেক অর্থ দিয়ে পুরস্কৃত করবেন'― এমন আজগুবি বক্তব্যে নারায়ণের হাসি পায়। অর্থবান মানুষটির চালাকি কল্পনা করে মনে মনে ক্ষুব্ধ সে। 
'ক্ষমতা থাকলে গ্রামের দরিদ্র অসহায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাহায্য করে দেখাও। যাতে তারা শিক্ষার মূল স্রোতে মসৃণভাবে উঠে আসতে পারে। তা না করে কূটনীতির চাল চালছে। যাতে সকলে সমীহ করে চলে, হাততালি দেয় আর সম্ভ্রমের চোখে দেখে; সেজন্য কী এই ছলচাতুরী! এ বুজরুকি ছাড়া আর কী?'―নারায়ণের যুক্তিতে মাথা নেড়ে সায় দেয় মেদিনীপুর কলেজের তৎকালীন অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার ঘোড়াই। অনেক পরে ইনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদ অলংকৃত করেন। নারায়ণ তাঁকে 'স্যার' বলে ডাকে। অচিরেই স্পষ্ট হয়েছিল সে ছলচাতুরী। কেননা, ১৯৭০ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত কেউ নারায়ণের মার্কস কেউ টপকাতে পারেনি। ফলে ভদ্রলোকের অর্থের অপচয়ও হয়নি। 
     
  সন্তোষ স্যারের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। নারায়ণ তখন প্রেসিডেন্সি কলেজ ফিজিক্স অনার্স পড়ে। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ সেবার 'শক্তি-সংকট' বিষয়ে একটি প্রতিযোগিতা আহ্বান করে। এ হেন বিজ্ঞান পরিষদের সম্মানীয় সদস্য ড. ঘোড়াই। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে নারায়ণ। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের দিন প্রফেসর সন্তোষ কুমার ঘোড়াই-এর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় তার। ক্রমশ স্যারের সান্নিধ্যে আসে এরপর। প্রেসিডেন্সিতে পড়াকালীন পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হত। পদার্থবিদ্যার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে অনেক সমস্যার সন্তোষজনক সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন ঘোড়াই স্যার। যদিও তিনি অনেক আগে থাকতে নারায়ণের নাম শুনেছেন। এক দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায়। ১৯৬৯ সালে। সেবছর পশ্চিম বঙ্গের মধ্যে দ্বিতীয় হওয়ার খবরটা নিউজ পেপারের পাতায় এখনও জ্বলজ্বল করছে চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট দেখতে পান তিনি। কারণ অবিভক্ত মেদিনীপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম্যবালকের এ হেন সাফল্যের সুখবরটা তাঁকে বেশ আকৃষ্ট করেছিল সেদিন। কখন যে নারায়ণের নাম প্রফেসরের মনের মণীকোঠায় স্থান করে নিয়েছে, তা তিনি নিজেও জানেন না।
  
  তাই খবরের কাগজ দেখে এক আত্মিক টান অনুভব করেছিলেন সেদিন। ব্যাস, যোগাযোগ বলতে ওই পর্যন্ত। মুখোমুখি পরিচিতি একেবারে ছিল না। সশরীরী প্রথম দেখা পুরস্কার বিতরণী সভায়। অনুষ্ঠান শেষে দেখা করে কথা বললেন ছেলেটির সঙ্গে। অনেক বিষয়ে কথা হল। ছেলেটি তার পছন্দের কথা বলল। আকাশকে ভালোবেসে অজান্তে হারিয়ে যাওয়ার গপ্পো শোনাল। বড় হয়ে কী হতে চায়, কেন হতে চায় ইত্যাদি। তাদের সে-মধুর সম্পর্ক ক্ষণজন্মা নারায়ণের আমৃত্যু বজায় ছিল। যত দিন গড়িয়ে সময়ের কলেবর বেড়েছে, সংযোগ দিনকে দিন নিবিড় থেকে আরও নিবিড় হয়েছে। 

  ১৯৭৬ সাল। সেবছর এম এস সি পাস করে দেখা হয়ে গেল সন্তোষ স্যারের সঙ্গে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন―
'এবার কী করবে?'
'স্যার, আমার শরীর ভালো নয়। একটুতেই হাঁপিয়ে উঠি। তাই আমি আগে থেকে ঠিক করে রেখেছি জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করব।'
'তুমি অমলবাবুর সঙ্গে কথা বল'― পরামর্শ দিলেন সন্তোষ স্যার।
বিষয়টি কাকতলীয়। তবুও উল্লেখ না করে পারছি না। ড. সন্তোষ কুমার ঘোড়াই আর নারায়ণচন্দ্র রানা দুজনেই প্রেসিডেন্সি কলেজের স্টুডেন্ট। সে সুবাদে দুজনেরই মাস্টার মশাই অধ্যাপক অমল কুমার রায়চৌধুরী। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ এবং বিশ্বতত্ত্বের প্রবাদপ্রতিম পণ্ডিত মানুষ। নারানের খুব পছন্দের স্যার। প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স পড়াতেন। তিনি কসমোলজী'র ব্যাপারে খুব উৎসাহ প্রদান করেন নারানকে। সেজন্য অমল স্যার এত প্রিয় ছিল তার যে, নিজের লেখা 'ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স' গ্রন্থটি শ্রদ্ধেয় অমলবাবুর নামে উৎসর্গ করে নারায়ণ। এই গ্রন্থটি মাস্টার্স ডিগ্রির স্টুডেন্টদের এক অমূল্য সম্পদ। অবশ্য পাঠ্য। পি. এস. যোগা'র সঙ্গে যৌথভাবে লেখা তার 'ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স' ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক টাটা ম্যাকগ্র-হিল (Tata McGraw-Hill)। ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিদেশের অক্সফোর্ড, হাভার্ড ইউনিভার্সিটিতেও পড়ানো হয় পুস্তকটি।

  স্কুল লাইফে মণীন্দ্র স্যার আর কলেজে রায়চৌধুরী স্যার নারায়ণের দুজন আরাধ্য শিক্ষক। দুজনের নিকট চির-ঋণী সে। দুজনে খুব যত্নে তার কেরিয়ার গড়তে সাহায্য করেছেন। (চলবে)

তথ্য সহায়তা :
'নিউটনের আপেল ও নারায়ণ'― ড. সন্তোষ কুমার ঘোড়াই,
'মেদিনীপুরের বিশ্বজয়ী ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞানী'― বাদল চন্দ্র দে
'বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানা'― নন্দগোপাল পাত্র,
'N C Rana : Life and His Contribution on Astrophysics Science'― Utpal Mukhopadhyay and Saibal Ray,
'মেদিনীপুরের বিজ্ঞানীদের কথা'― ভাষ্করব্রত পতি,
উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন ব্লগ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments