জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -- পর্ব-(১০)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -- পর্ব-(১০)
সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মে ঈশ্বরের প্রবেশ 

আদিসত্তা যদি অপরিবর্তনীয়, তবে মহাজগতে সর্বক্ষণ এত পরিবর্তন কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রাচীনকালের ঋষিরা বললেন- দেহ অর্থাৎ মূর্ত রূপের পরিবর্তন হয়, কিন্তু জগতের নিয়ামক বা আদিসত্তা তার কোনো পরিবর্তন নেই। তাই এই আদিসত্তা চিরন্তন এবং মৃত্যুহীন। একথা স্পষ্টভাবে বলা আছে উপনিষদে।
 আজকের বিজ্ঞান ও বলে, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি অনুসারে, সৃষ্টির অমূর্ত্য উৎস চিরন্তন, মূর্ত প্রকাশ সর্বদা পরিবর্তনশীল। উপনিষদ বলছে ব্রহ্ম বা জগতের আদিসত্তা এক এবং অদ্বিতীয় হয়েও স্বইচ্ছায় দ্বিতীয় অর্থাৎ বহু হয়েছেন। কেন এই বহু হওয়া? কেন না, ঈশ্বরের একা একা ভাল লাগছিল না বলে। অর্থাৎ এই যে মানুষ নদী নালা, গাছপালা, জীবজন্তু পাহাড় সমুদ্র, সব ব্রহ্মার রসাস্বাদনের জন্য। 

  কিন্তু বিজ্ঞান বলছে- এ সব এসেছে ঈশ্বরকণার কৃপায়। কি এই ঈশ্বরকণা? কি এমন জিনিস ঈশ্বরকণা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে, কণাটির কি কাজ তা আমাদের জানতে হবে। এই কণা বিনে এই বিশ্বে আজ এসবের কোনো কিছুর চিহ্ন থাকতো না, এই ব্রহ্মাণ্ড হত প্রায় ফাঁকা, বিপুল এনার্জি আর কিছু কণার সমষ্টি। 
আজ ১৩৭০ কোটি বছর আগে এক বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণে ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের পর, ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ছিল কেবল তাপ অথবা এনার্জি। তা থেকে জন্মেছিল কিছু কণা, যারা শুরুতে ছিল ভরহীন। যেমন আলোর কণা ফোটন। তা ভারী নয় বলে, সেকেন্ডে ৩০০০০০ কিলোমিটার বেগে ছুটে বেড়ায়। এরকম আর এক কণা গ্লুয়ন। যার ভর নেই, সেও দৌড়ায় বেগে। সৃষ্টি সময়ের সব কণা কিন্তু ফোটন বা গ্লুয়নের মতো ভরহীন হয়নি। কিছু কণা পেয়েছে ভর, হয়েছে ভারী। তাই তারা আলোর বেগে ছুটতে পারেনি। 

   না ছুটতে পারা কণারা পরস্পরের কাছাকাছি এসে, জমাট বেঁধে তৈরি হয়েছে অণু পরমাণু গ্যালাক্সি গ্রহ তারা। এবং পৃথিবীর মতো একটা গ্রহে মানুষ সমেত এতকিছু। কারণ পদার্থের ভর না থাকলে গ্রাভিটি বা মহাকর্ষ কাজ করত না। তৈরী হতো না গ্যালাক্সি, তারা গ্রহ। কোথায় থাকতো প্রাণ? শুধু গ্যালাক্সি, তারা গ্রহ তৈরি হওয়ার কালে নয়, পৃথিবীতে প্রাণের টিকে থাকার জন্য গ্রাভিটি এখনও জরুরী, এই গ্র্যাভিটি আছে বলে আমরা বাঁধা আছি এই গ্রহের বুকে। এই গ্র্যাভিটি'র কারণে সূর্যে উপস্থিত বিপুল পরিমাণ পদার্থ আকৃষ্ট হচ্ছে কেন্দ্রের দিকে। তার ফলে মিলছে তাপ আলো। যা না হলে পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি কিংবা প্রাণ বেঁচে থাকত না। এসব সম্ভব হচ্ছে সব গ্র্যাভিটি'র জন্য। আর গ্র্যাভিটি সৃষ্টি হয়েছে, পদার্থের ভর আছে বলে। আর এই পদার্থের ভর যে জোগালো, তার নাম ঈশ্বরকণা। 

  আর এই কণার নামের মধ্যে ঈশ্বর কথা যোগ করেছেন, নোবেলজয়ী পদার্থবিদ লিও লেডারম্যান। এবং কেন তিনি এই নামে অভিহিত করলেন তার এক ইতিহাস আছে। বিজ্ঞানীদের চোখে ব্রহ্মান্ড্য মানে কোটি কোটি বস্তু আর হাজারো লাখো ঘটনা নয়। সামান্য কিছু কণা আর তাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল চারটে বলের খেলা মাত্র। 

  কনার পিণ্ড আপেল আর কণার পাহাড় পৃথিবীর মধ্যে কাজ করছে যে বল, তা গ্রাভিটি। পৃথিবী আর চাঁদ কিংবা সূর্য আর পৃথিবীর মধ্যেও ওই বলের খেলা। সুইচ অন করা মাত্র যে পাখা ঘোরে, কিংবা শয়ে শয়ে বৈদ্যুতিন যন্ত্র কাজ শুরু করে, তার মূলে তড়িৎ আর চুম্বকের মিলিত বল (ও দুটো বল আলাদাভাবে কাজ করতে পারেনা)। ওদের যৌথ নাম ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স। তড়িৎচুম্বকীয় বল। পরমাণু ছোট। তার কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস আরও ছোট। ওই একরত্তি জায়গার মধ্যে আবার অনেক কণা প্রচন্ড আকর্ষণে বাঁধা থাকে। ওই আকর্ষণ বল দারুন শক্তিশালী, তাই তার নাম স্ট্রং ফোর্স। দৃঢ় বল। রেডিয়াম ইউরেনিয়াম থেকে যে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়, তার মূলেও এক বলের খেলা। তবে তার শক্তি দৃঢ় বলের তুলনায় নেহাত ক্ষীণ। তাই তার নাম উইক ফোর্স। মৃদু বল। পদার্থবিজ্ঞানীরা জানেন, ব্রহ্মান্ডে তাবৎ ঘটনা কিংবা পরিবর্তন এই চার রকম বলের কোনও না কোনও একটির খেলা। এদের প্রভাবের বাইরে কোনও কিছু ঘটে না। 

  আর কণা? তার সংখ্যা ১৮। ভারী কনা কোয়ার্ক ছ'রকম। আপ, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ চার্ম, টপ, বটম। হালকা কণা লেপটন ছ'রকম। ইলেকট্রন, ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউয়ন, মিউয়ন নিউট্রিনো, টাউ, টাউ-নিউট্রিনো। এদের বাইরে আছে ছ'রকম কণা। যারা লুকিয়ে থাকে বলের ক্রিয়ার পিছনে। দুটো কণার মধ্যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ আসলে ওই ছ'টির মধ্যে কোনও একটির দেওয়া-নেওয়া। পিং-পং বলের মত ঘোরাফেরা। তড়িৎচুম্বকীয় বল মানে যে কণার হাতবদল, তা হল আলোর কণা ফোটন (আলো আসলে তড়িৎচুম্বকীয় বলেরই এক নমুনা)। স্ট্রং ফোর্স এ যে কণার দেওয়া নেওয়া, তাঁর নাম গ্লুয়ন (এই গ্লুয়ন অবশ্য সংখ্যায় একাধিক)। আর উইক ফোর্স- এর মূলে তিনটে কণা। ডব্লিউ-প্লাস, ডব্লিউ-মাইনাস এবং জেড- জিরো। এই ১৭ টার পরে ১৮ নম্বর হল ঈশ্বরকণা। যার কাজ ফোটন এবং গ্লুয়ন বাদে বাকি ১৫ টি কণাকে ভর জোগানো (ফোটন ও গ্লুয়ন ভরহীন)।
বিজ্ঞানের এই বিস্ময়কর ঘটনাবলি থেকে, আমরা কয়েকটি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি। 

  প্রথমত, এই অন্তহীন সৃষ্টি চরাচর কেউ একদিনে বা দশ দিনে ম্যাজিকের মত হঠাৎ সৃষ্টি করেনি। কোটি কোটি বছরে ক্রমশ প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে বিবর্তিত হয়েছে। আদি বিস্ফোরণ কেন হয়েছিল কিভাবে হয়েছিল তার পিছনে কি কারণ ছিল, মহা বিস্ফোরণের আগে কি ছিল এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে বিজ্ঞান এখনো পর্যন্ত পারেনি। কিন্তু সেই আদি বিন্দু থেকে মহাবিশ্বের বিবর্তনের যে ইতিহাস আবিষ্কৃত হয়েছে, তা থেকে সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, সৃষ্টি এবং স্রষ্টা সম্বন্ধে জ্ঞান বিজ্ঞানে অনুন্নত প্রাচীন মানুষের ধর্মীয় কল্পনা ভবিষ্যৎ মানুষের পাথেয় হতে পারে না। ধর্মগ্রন্থের বাণীর মাধ্যমে মহাবিশ্বের উৎস অথবা কারণ সন্ধান নিরর্থক। এভাবে মহাবিশ্বের আদি-অন্ত বা বিবর্তন সম্বন্ধে, পূর্ণ জ্ঞান লাভ করা একেবারেই অবাস্তব এবং অসম্ভব। (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments