জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৩৬

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৩৬

সম্পাদকীয়
যদিও তোমরা প্রায় এক বছরের বেশি সময় স্কুলে যেতে পারছ না, কিন্তু যখন রোজ স্কুলে যেতে তখন দেখেছ নিশ্চয়ই প্রত্যেক স্কুলের একটা নিয়ম শৃঙখলা আছে। আর কিছু ছাত্র-ছাত্রী সেই নিয়ম শৃঙখলাগুলো কখনও জেনে আবার কখনও না জেনে ভেঙে ফেলে। কি ঠিক তো? প্রকৃতির পাঠশালাতেও ঠিক এমনই ঘটনা ঘটে বইকি। আমরা মামুষরা জেনে শুনে গাছ কেটে, নদীতে বাঁধ দিয়ে, মোবাইল টাওয়ার বসিয়ে, কারখানার ধোঁয়া নির্গত করে প্রকৃতির নিজস্ব সাম্য নষ্ট করে চলেছি। তাই তো কল্যান সাহার তোলা প্রচ্ছদের চড়াইটা এখন একা। অনেকে মনে করেন, মোবাইল টাওয়ারের জন্য ওর বন্ধরা হারিয়ে যাচ্ছে। করোনাকালে অক্সিজেন সঙ্কটের মতো খুব শীঘ্র আমাদের মাটির তলার পানীয় জলে সঙ্কট দেখা দিতে পারে সেটা রূপক কুমার হাতী লিখেছেন। তুমি হয়তো গৌতম বাড়ইএর কবিতার মতো বলবে আমি পাখির মতো পাখা লাগিয়ে উড়ে যাব অন্য কোথাও। কিন্ত কোথায় যাবে পৃথিবীর সব খানেই একই অবস্থা! এই তো রাশিয়া থেকে তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন ওখানকার বার্চ গাছেও ফোঁড়ার মতো হচ্ছে। তারও চিকিৎসা চলছে। কি ভয় পেয়ে গেলে নাকি ছোটোরা? না না ভয়ের কিছু নেই। ৫ ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে তাই এসো আমরা অঙ্গীকার করি প্রকৃতির শৃঙখলা রক্ষার। কীভাবে? বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক গৌর বৈরাগী মহাশয় ছোট্টো নিয়ম-নিষ্ট পতঙ্গ মৌমাছিদের গল্প বলেছেন। পড়েই দেখো তাহলেই আবার কবি তারাপ্রসাদ সাঁতরার কবিতার মৌটুসী পাখিদের মতো নতুন নতুন ফুল-গাছের ডালে টুপটুপ ডেকে ডেকে ঝুপঝুপ করে যেতে কোন বাঁধা থাকবে না। রেনেসাঁর ছড়ার মতো প্রকৃতিতে নির্দিষ্ট সময় বর্ষা আসবে। তোমরা ইয়াস, আমফানের ভয়ে সিঁটিয়ে না থেকে রোজ দুপুরে খেলার সাথীদের সুহেনার মতো রূপকথার গল্প আর ফুলকুসুমুপুরের ছড়াপিসির মতো ছড়া শোনাবে। তোমাদের পাশে খাঁচায় দুলে দুলে অনিচ্ছে ঠাকুমার রাধাগোবিন্দ গমের দানা খাবে নিশ্চিন্তে। স্কুলে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন না করেও জ্বলদর্চির জন্য তোমরা যারা প্রকৃতির সজীব ছবি এঁকে পাঠিয়েছ, ঘোষ স্যারের গল্পে গল্পে ক্যুইজ পড়েছ, পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখে পাঠিয়েছ তাদের উদ্দেশ্যে বলি, এসো আমরা প্রত্যেকে গাছ লাগাই। প্রকৃতির শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। ওর অক্সিজেন প্রয়োজন। আমরাই পারি ওকে এর যোগান দিতে।    -মৌসুমী ঘোষ

মৌমাছির মৌচাক 
গৌর বৈরাগী

বাগানটা ফুলে ফুলে ভরে গেছে। গোলাপ, টগর, চাঁপা আর গন্ধ্রাজ ফুল। যেমন দেখতে তেমনি গন্ধ। মিষ্টি গন্ধে বাগান ম ম করছে। এর ওপর আমগাছে আবার মুকুল এসেছে। মুকুলকে কেউ কেউ বউলও বলে। বউল হল আসলে ফুল, আমফুল। আঃ কী সুন্দর গন্ধ।

বাগান জুড়ে থই থই করছে সুবাস। গন্ধের লোভে লোভে টুনটুনি, দোয়েল আর ফিঙে পাখি এসে জুটেছে। আর এসেছে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি। আর প্রজাপতি।

গুনগুন করে গান গাইছে নাকি?
না গান নয়। হাজার হাজার মৌমাছি একসঙ্গে হাওয়ায় সাঁতার কাটছে। তাই মৌমাছির ডানা থেকে শব্দ উঠছে গুন গুন।

শুধু সাঁতার কাটাই নয়, দল বেঁধে আবার আমের মুকুলে গিয়ে বসছে।

বসে কী করছে?
ওরা ফুলের মধু খাচ্ছে। শুধু খাওয়াই নয়, খানিকটা মধু মুখে করে আনছে বাসায়। ওদের বাসার নাম মৌচাক। মৌচাকে হাজার হাজার ঘর সেই ঘরে মধু স্টোর করব রাখে মৌমাছিরা। মৌচাক্ব মধু থাকে। অসময়ে সেই মধু খায় মৌমাছি।

মৌ-টুসি
তারাপ্রসাদ সাঁতরা

এক মানে একটা
দুই মানে দুটো
সুন্দর বাসা বোনে 
দিয়ে খড় কুটো।

থাকে ওরা ফুল গাছে
নাম মৌ-টুসি
দুটোকেই ধরে দাও
দুটোকেই পুষি।

টুক টুক ডাক দেয়
ঝুপ ঝুপ চলে
ভাষা কিছু বুঝি নাতো
কোন কথা বলে।

হাওয়া দিলে বুক কাঁপে
ভয়ে যেন মরে
ঘন ঘন ডাক পেড়ে
পাড়া মাৎ করে।

ভাবে ওরা ভাঙে বুঝি
ছোট এই বাসা
খড়কুটো দিয়ে বোনা
গাঢ় ভালবাসা।

জলের কথা 
রূপক কুমার হাতী

ছোটবেলায় যখন ক্লাসে স্যারদের কাছথেকে জল সংরক্ষণ বিষয়ে শুনতাম, তখন মনে মনে বিরক্ত হতাম! ভাবতাম, অযথা জল নিয়ে চর্চা! আমি গ্রামের ছেলে,  পুকুর - ক্ষেত- নদী-নালায় জল থইথই করতে দেখেছি !চাষের জমির বা পুকুরের জলে মুড়ি ভিজিয়ে খেয়েছি, কখনও বা পান করেছি। পাড়ার পুকুর থেকে জল নিয়ে রান্না করতে দেখেছি। তাই জল নিয়ে এত মাথা ব্যাথার কারণ আমি খুঁজে পেতাম না বলেই বিরক্তি লাগতো। বেশি দিনের কথা না ,আজ থেকে প্রায় 30- 35 বছর আগেই মানুষ, বিশেষ করে গ্রামের মানুষ নদী - পুকুর বা মাঠঘাঠের জল নির্দ্বিধায় পান করতে পারত। তখন কেবল বর্ষাতেই ধানের চাষ হতো এবং সম্পূর্ণই বাড়িতে তৈরি জৈব সার(গোবর,খড় -পাতা পচা, পুকুরের পাঁক ইত্যাদি) প্রয়োগ করে, ফলে গ্রামাঞ্চলে জল তখনও পানের যোগ্য ছিল। আমার বাড়ির পিছন দিকে প্রায় আধ কিলোমিটার দূর দিয়ে বয়ে গেছে কেলেঘাই ।অনেকে 'নদী' বলে কেউ আবার বলে 'খাল'। খুব একটা প্রশস্ত নয় কিন্তু বর্ষায় বড় কলেবরে রুদ্রমূর্তি ধারন করত (সংস্কারের ফলে গত কয়েক বছর ধরে কেলেঘাইর ভয়ংকরতা অনেটা কম )বর্ষাকালে প্রায়ই বন্যা আসত। নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় পলি জমা হতো। সেখানে লম্বা ঘন এক ধরনের ঘাস জন্মতো,যাকে গ্রাম্য ভাষায় 'ঠাটরা' বলা হত। মানুষ সেই জঙ্গল ধীরে ধীরে পরিষ্কার করে গড়ে তুলল কৃষি ক্ষেত্র। প্রথমদিকে আর্টিজিও কূপ খনন করে(দেড় -দু ফুট মাপের মোটা বাঁশকে মাঝখানে ফাঁককরে মাঝের গাঁটগুলোকে মসৃন করে দুটো টুকরোকে আবার জোড়া লাগানো হোত -খড় বা কলাগাছের শুকনো ছাল দিয়ে। এভাবেই প্রাচীন পদ্ধতিতে জলের পাইপ বানানো হোত। তারপর মোটা একটা বাঁশের টুকরোকে দেড় -দু ফুট মতো গভীরে ঢুকিয়ে আবার বেরকরে নিয়ে বাঁশ দিয়ে বানানো পাইপ ঢুকিয়ে দিলেই জল বেগে উপরে উঠে আসত), পুকুর বা খাল থেকে প্রাচীন পদ্ধতিতে জমিতে সেচ দিত । কয়েক বছর পর জলস্তর  নেমে যায়। দু-একজন পাম্প বসানো শুরু করে ।ধীরে ধীরে সেই পাম্পের সংখ্যা আরো বাড়তে থাকে আর নামতে থাকে জলস্তর! বিচ্ছিন্নভাবে বোরো চাষ শুরু হতে থাকে। ফলে নদী নালার পানীয় জল পানের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বোরোচাষ ব্যাপক আকারে হতে শুরু করলে জলের বারোটা বেজে যায়! ততদিনে জলস্তর আরো নিচে নেমে যায়। ফলে পাম্পকে কুয়ো খুঁড়ে নামাতে হয় নিচে। ফিতার সাহায্যে মেশিনের সঙ্গে সংযোগ করে জল তুলতে হয়। এইভাবে নির্বিচারে জল তুলতে তুলতে ছোট মেশিন গুলো অকেজো হয়ে পড়ে । ফলে কৃষকরা 'আলফা ' নামের এক বড় চাকা ওয়ালা মেশিন আমদানি করে। এখন আর সেই মেশিন গুলোর সেচের কাজে ব্যবহার নেই বললেই চলে।  তার বদলে কয়েক বিঘা অন্তর মিনি 'ডিপ টিউবওয়েল ' বসেছে।ছোটবেলায় স্যারের ' জল সংরক্ষণ ' পড়ানো  শুনে একসময় বিরক্ত হতাম। আর আজ আতঙ্কিত! মাত্র 30 থেকে 35 বছর আগে যে জল আপনা আপনি উপচে পড়ত, আজ তাকে কোথাও ২০০ ফুট, কোথাও ৫০০ ফুট গভীর কুপ খনন করে উচ্চ -ক্ষমতা সম্পন্ন পাম্প ব্যবহার করে তুলে আনতে হচ্ছে ! কোথাও আবার গভীর খনন করেও জলস্তরের নাগাল পাওয়া যায় না!  এই কয়েক বছরের মধ্যে যদি জলস্তরের এই ভয়ঙ্কর অবস্থা হয় তাহলে আগামী দিনে কী হবে?


উড়লে আকাশ পেতাম
গৌতম বাড়ই

ধরো আমি উড়েই গেলাম
চড়ুই শালিখ পাখির মতন
কে করেছে মানা?

কিন্তু আমি কোথায় পাব
ওড়ার মতন পাখাজোড়া
তাই তো ওড়া মানা।

উড়ি আমি  মনে- মনে
বনে-বনে আকাশপানে
রোজ মেলে দি ডানা।

গাছের ফোড়া
তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

ভোল্গা নদীর তীরে,
বীথি ধরেই ধীরে,
দেখছি ঘুরে যতই,
লাগছে ভালো ততই ।
গাছের-ফুলের শোভা,
বড়ই মনোলোভা ।
হঠাৎই চোখ ছোটে -
বার্চ-বৃক্ষস্ফোটে ।
“ও গাছ, ও কি ফোড়া?
বাকল দিয়েই মোড়া !
মানুষেরও যেমন,
ফোড়ার জ্বলন তেমন -
তোমার ব্যথা হয় ?
নাকি তেমন নয় ?”
গাছ বলে, “হে পথিক,
ধরেছো প্রায় সঠিক ।
বীজাণুদের আকর !
না অস্থানিক শিকড় -
শুধোয়নি কেউ কারণ,
হয়নিকো সঞ্চারণ ।
চিকিৎসকও এলেন,
গলেক্স মলম দিলেন ।
অস্ত্রোপচার ছাড়া -
এ রোগ হবে সারা ।
হয়তো এ নয় মারণ !
জল লাগানো বারণ ।
এমন লোকও আছে,
দেয় কুনজর গাছে ।
আব কেটে যায় নিয়ে,
তারপরে তা দিয়ে -
ঘর সাজানোর মতো,
জিনিস বানায় কতো !
যাইহোক, সে ব্যথা -
কমলো, বলে কথা ।
সময়-সুযোগ হলে,
আবার এসো চলে ।”
আগের থেকে ভালো -
আছে সে জানালো ।
এই আলাপের শেষে,
বিদায় নিলাম হেসে। 


মেঘের কান্না

রেনেসাঁ গঙ্গোপাধ্যায় 
সপ্তম শ্রেণী, স্যাক্রেড হার্ট স্কুল, আদ্রা, পুরুলিয়া

মেঘে কত জল ধরে 
ভেবে ভেবে রোজ 
আকাশে তাকিয়ে আমি
রাখি তার খোঁজ। 

এত যে পুকুর নদী
সাগরের জল 
মেঘ বুঝি তারও চেয়ে
গভীর অতল। 

কত জল কাঁধে নিয়ে
ওরা চলে যায় 
এই ভার বৃষ্টি হয়ে
তাদের কাঁদায়।


দুষ্টু-মিষ্টি

সুহেনা মন্ডল
চতুর্থ শ্রেণী, জি ডি গোয়েঙ্কা পাবলিক স্কুল,নর্থ কলকাতা

মাধবপুরের রাজবাড়িতে হুলস্থূল চলছে। ঝগড়া লেগেছে বীর রাজকুমার মথু আর বিড়াল রুমির মধ্যে। রুমি সুন্দর, চঞ্চল কিন্তু হিংসুটে। আর মথু খুব সুন্দর কিন্তু ঝগড়ুটে। রুমি দুষ্টুমি করে রাজকুমারের একটি হীরের মালা নিয়ে পালিয়েছিল। প্রচুর কষ্টে তাকে খুঁজে পাওয়া গেল। রাজকুমার তো রেগে লাল! রাগে চেঁচিয়ে মথু বলল "আমার অন্য বিড়াল চাই।" রাগের মাথায় ছুটে গেল রুমিকে ধরতে। বিড়াল রুমি তো লাফালাফি করে এক নিমিষে ঘরের জিনিসপত্র  ভেঙ্গে ফেলল। রাজকুমারের প্রিয় মূর্তির ও নিস্তার নেই। বড় কষ্টে তাকে ধরে বাড়ির বাইরে করা হল। কিন্তু দুষ্টুমি তার শেষ হয়না। সে প্রত্যেক দিন কোন না কোন ভাবে রাজবাড়ির রান্নাঘরে ঢুকে দুধ খেয়ে একটা আধটা জিনিস ভেঙ্গে খোলা জানালা দিয়ে পালিয়ে বাড়ির পেছনের বাগানে গিয়ে লুকিয়ে পড়ত। একদিন এক শীতের রাতে র‍্যাপার গায়ে দেওয়া একটা চোর ঢুকল রাজবাড়িতে। এদিকে রুমির খুব ক্ষিদে পাচ্ছে। একটা বাজতে চলল। রুমির আর দোষ কি!একটা গর্ত দিয়ে ঢুকে পড়ল রান্নাঘরে। ওদিকেই আসছিল চোরটি। যেইনা ওরা একে অপরকে দেখতে পেয়েছে অমনি চমকে গিয়ে দুধের বাটি উল্টে ফেলল রুমি। বাটি পড়ার আওয়াজে চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। চোরটি কে ধরার চেষ্টা করেও সব বিফলে গেল।বেড়ালেরা অন্ধকারে দেখতে পায়। "আমার খাবার ফেলে পালানো হচ্ছে! দেখাচ্ছি মজা!" আর ব্যস। এবার রুমি দৌড়নো শুরু করল চোরের পেছনে। পদ্মাবিটার জঙ্গলে একটি গুহার ভেতরে পালিয়ে বাঁচল চোর। বেড়াল ও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। গুহার সামনে একটা বড় পুরনো কাঠের টুকরো পড়েছিল। বেড়াল তো প্রচুর দুধ খায়। তাই গায়ে প্রচুর শক্তি। ওটাকে টেনে নিয়ে এসে গুহা থেকে বেরনোর রাস্তা বন্ধ করে দিল যাতে ভেতরটা অন্ধকার হয়ে যায়। একটি ছোট্ট গর্ত দিয়ে ঢুকে বিড়াল রুমি চোরকে দিল এক কামড়। যন্ত্রণায় সে তো শূন্যে ডিগবাজি খেতে খেতে একেবারে গুহার বাইরে ছিটকে পড়ল।ভোর হল। রাজবাড়ীতে সবাই যখন চিন্তায় আছে তখন হঠাৎ দূর থেকে রুমিকে চোরকে নিয়ে আসতে দেখে সবাই তো অবাক! মথু রুমিকে জড়িয়ে ধরে মুচকি হেসে বলল "এখন থেকে একটু আধটু দুষ্টুমি তো আমিও করবো।"

গল্পে গল্পে ক্যুইজ ।।প্রথম পর্বের প্রশ্নের উত্তর নিয়ে গল্প

১. মুঘল সম্রাট বাবর। বাবর শব্দটি  ফার্সি শব্দ, যার অর্থ ‘বাঘ’। পানিপথের প্রান্তরে দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে তিনি ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। এই যুদ্ধটিই ইতিহাসে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ (২১ এপ্রিল ১৫২৬) হিসাবে বিখ্যাত। ভাবতে অদ্ভুত লাগে, বাবরের জীবনের প্রধান লক্ষ ছিল তার পিতৃরাজ্য উদ্ধার করা এবং মধ্য এশিয়াতে রাজত্ব করা কিন্তু সংযোগে তিনি ভারতে প্রতিষ্টা করলেন দীর্ঘস্থায়ী এক সাম্রাজ্য। পানিপথের যুদ্ধের আগে বাবরের আত্মজীবনিতে এমন কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না, যার থেকে বোঝা যায় তিনি ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখছেন। 
পানিপথের যুদ্ধ বাবর তার রণকৌশলে জিতেছিলেন। কথিত আছে যে ইব্রাহিম লোদীর সৈন্য ছিল এক লক্ষ। পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীর সৈন্য ছিল চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার। সঙ্গে ছিল হাতি, যার সংখ্যা বলা হয় দু’হাজার। বিপরীতে বাবরের সৈন্যসংখ্যা ছিল অল্প কিন্তু তার অধীনে ছিল গোলন্দাজ বাহিনী ও ভারী অশ্বারোহী। ইব্রাহিম লোদীর হাতিরা গোলাগুলি কামানের শব্দের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিল না। ফলে বাবরের কামানের প্রবল আওয়াজে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে সমস্যা সৃষ্টি করে। বাবরের জিতে যাওয়ার পিছনে অবশ্যই কামান আর বন্দুকের ভূমিকা ছিল, ইব্রাহিম লোদীর সেই অর্থে কোনো গোলন্দাজ বাহিনী ছিল না। কিন্তু বাবরের জিতে যাওয়ার পেছনে শুধু কামানেরই ভূমিকাকেই বড় করে দেখালে ভুল হবে। বাবরের কৌশল কম কিছু ছিল না। বাবর তার সেনার ডান দিকের শাখাকে পানিপথ শহরের আড়ালে রেখেছিলেন আর ডান দিকের সেনাদের অবস্থা নিরাপদ করার জন্য একটা পরিখা খনন করিয়ে তার ওপর গাছপালার ডাল রেখে আড়াল সৃষ্টি করেছিলেন। আর মাঝে প্রায় সাতশো গাড়ি পর পর দড়ি দিয়ে বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। দুটো গাড়ি অন্তর ফাঁক রেখেছিলেন, সেখানে বন্দুকবাজদের মোতায়েন করেছিলেন। শুধু তাই নয় বন্দুক রেখে গুলি চালানোর জন্য এবং আত্মরক্ষার জন্য ইঁটের অল্প উঁচু দেওয়াল তৈরি করে দিয়েছিলেন। গাড়িগুলির পেছনে রেখেছিলেন কামান। কৌশলে তিনি ইব্রাহিম লোদীর সৈন্যদের আক্রমণ করার জন্য অপরিসর জায়গা রেখে দেন। এর মধ্যে দিয়ে ইব্রাহিম লোদী আক্রমণ করলে আফগান সৈন্যরা একেবারে বিদ্ধস্ত হয়ে যায়। ইব্রাহিম লোদী নিহত হন। তার প্রায় কুড়ি হাজার সৈন্য মারা যায়। 

২. ওমর শেখ মির্জা। ইতিহাসে তাকে ওমর শেখ মির্জা দ্বিতীয় বলে আখ্যা দেওয়া হয়। ইনি ফারগানা প্রদেশের শাসক ছিলেন। এই ফারগানা উপত্যকাটির বর্তমানে তিনটি দেশে ছড়িয়ে আছে, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান আর তাজিকিস্তান। তৈমুর লঙ্গ বংশের উত্তরপুরুষ ছিলেন তিনি। তার প্রথমা স্ত্রী কুতলুগ নিগার খানুম, যিনি বাবরের মা, তিনি চেঙ্গিজ খানের বংশের মেয়ে ছিলেন। অর্থাৎ বাবর তার বাবার দিক থেকে তৈমুর লঙ্গ আর মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিজ খানের বংশের প্রতিনিধিত্ব করতেন। তাহলে বাবরের নাম হবে বাবর মির্জা, পরে তাকে আমরা ‘মির্জা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর’ বলেই চিনি। একটি দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনায় ওমর শেখ মির্জার মৃত্যু হলে মাত্র এগারো বছর বয়সে বাবরকে সিংহাসনে বসতে হয়।

৩. উজবেকিস্তানের রাজধানী হল তাসখন্দ। তাসখন্দ থেকে M39 চিহ্নিত রাস্তা ধরে নিচের দিকে আসলে তুমি সমরখন্দ শহরে এসে উপস্থিত হবে। সমরখন্দ শুধু উজবেকিস্তান নয়, সমগ্র মধ্য এশিয়ার মধ্যে অতি প্রাচীন জনপদ। যীশুর জন্মেরও প্রায় সাতশো থেকে আটশো বছর আগে এই জনপদ গড়ে উঠেছিল। অর্থনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ কারন বিখ্যাত রেশম সড়ক যাকে তোমরা ইংরাজি নামেই বেশি চেন, সেই সিল্ক রুট এই সমরখন্দ দিয়েই গেছে। এই শহরটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা বাবরের কাহিনি থেকেই বুঝতে পারবে। বাবর সমরখন্দ পাঁচ পাঁচবার আক্রমণ করেছিলেন কিন্তু দখলে রাখতে পারেন নি। বর্তমানে শহরটি দু’টি ভাগে বিভক্ত একটি পুরনো অঞ্চল আরেকটি নতুন অঞ্চল। পুরনো অঞ্চলে সমস্ত ঐতিহাসিক সৌধ এবং প্রাচীন বাড়িগুলি আছে সঙ্গে মিউজিয়াম। 

৪. ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল তার অবসান ঘটাতে ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি তাসখন্দে ভারতের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আয়ুব খান একটি চুক্তি করেন, যা তাসখন্দ চুক্তি নামে বিখ্যাত। পরের দিন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী দুর্ভাগ্যজনকভাবে মারা যান, যা অনেক রহস্যের জন্ম দেয়। অনেকেই এই মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে মনে করেন না। 

৫. স্কাউটের প্রতিষ্ঠাতা হলেন লর্ড বেডেন পাওয়েল। তার জন্মদিন ২২ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব স্কাউট দিবস হিসাবে পালন করা হয়। বর্তমানে স্কাউটিং সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা একটি সংস্থা যার উদ্দেশ্য হল যুবকদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ যাতে তারা সমাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে এবং এই বিশ্বের এক সুযোগ্য নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। 

৬. ঘড়িটি বালিঘড়ি, যা ছাদ থেকে ঝুলছিল। বালিঘড়ির ব্যবহার খুব প্রাচীন। তাই সত্যজিৎ রায় সঠিকভাবেই এই ঘড়িকে ব্যবহার করেছিলেন। 

৭. IQ এর পুরো কথা হল Intelligence quotient, যার একটা খটোমটো বাংলা আছে ‘বুদ্ধ্যঙ্ক’। কারো বুদ্ধি পরিমাপ করতে নানা পরীক্ষার ফল বিচার বিশ্লেষণ করে এই আই কিউ বার করা হয়। বলা হয় যে আই কিউ বয়স ও শিক্ষা এবং পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। বুদ্ধি নিয়ে পরীক্ষার (Intelligence Test)  জন্ম ফরাসি দেশের এক মনস্তত্ত্ববিদের হাতে, তার নাম স্যার আলফ্রে বিঁনে। ১৯০৫ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বহু ইন্টেলিজেন্স টেস্ট বা বুদ্ধি অভীক্ষা তৈরি হয়েছে। আমরা তার জটিলতায় যাবো না। মোদ্দা কথা বিঁনে তার এই সব অভীক্ষায় মানসিক বয়সের একটি ধারণা প্রচলন করেছিলেন। সহজ উদাহরণ দিয়ে বলি। ধরা যাক কারো বয়স আট বছর, এবার সে যদি আট বছর বয়সের জন্য বিশেষভাবে তৈরি প্রশ্নের সবকটির উত্তর দিতে পারে তাহলে তার মানসিক বয়স হবে আট বছর। ধরা যাক সে নয় বছরের জন্য তৈরি প্রশ্নের উত্তর সব ঠিক দিল। তাহলে তার মানসিক বয়স হবে নয়। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে আরেক মনোবিদ উইলিয়াম স্টার্ন বুধ্যাঙ্ক বা আই কিউ এর ধারণা দেন। স্টার্ন একটি ফরমুলা দেন, সেটা এই রকম; কারো মানসিক বয়সকে তার দৈহিক বয়স দিয়ে ভাগ করে সেই ভাগফলকে একশো দিয়ে গুণ করলে আমরা তার আই কিউ পাব। ট্যারম্যান বলে আরেক মনোবিদ এই আই কিউ অনুসারে কয়েকটা শ্রেণী তৈরি করেছিলেন, যেমন আই কিউ ১৪০ এর বেশি মানে প্রতিভাবান; ৯০ থেকে ১১০ হলে স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন; আর ৭০ এর নিচে থাকলে তা ক্ষীণ বুদ্ধি বা মানসিক প্রতিবন্ধতা সূচিত করে। তোমরা ভাবছ বাঃ বেশ তো, বুদ্ধিটা একবার মেপে নিলে হয় কিন্তু মনে রেখো কোনো মানসিক অভীক্ষাই কিন্তু সম্পূর্ণভাবে নির্ভরযোগ্য নয়। তাছাড়া আই কিউ টেস্টের ফল কারো মধ্যে হীনমন্যতা তৈরি করতে পারে। সুতরাং শেষ কথা তুমিই বলবে। মনে রাখবে স্যার আলবার্ট আইনস্টাইনের প্রাথমিক স্তরে প্রথাগত শিক্ষায় ফল সন্তোষজনক ছিল না। এমনকি কথিত আছে তার প্রধান শিক্ষক, আইনস্টাইনের বাবাকে ডেকে বলে দিয়েছিলেন,‘লিখে নিন – এই ছেলের দ্বারা কিছু হবে না।’ সেই শিশু কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক। তা বলে কি আই কিউ-এর কোনো গুরুত্ব নেই? আছে, মনোবিদরা নানা কাজে একে ব্যবহার করেন। 
৮. সুকুমার রায়ের ‘আশ্চর্য কবিতা’ গল্প। সুকুমার রায়ের প্রয়াণের ১৭ বছর পর, ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘পাগলা দাশু’ গল্পগ্রন্থটি। গল্পগুলো কিন্তু সুকুমার রায়ের জীবদ্দশায় সন্দেশে প্রকাশিত হয়েছিল। পাগলা দাশু বইয়ের প্রকাশক ছিলেন এম সি সরকার এবং এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তোমরা সম্ভব হলে পড়ে নিও এই ভূমিকাটি। 
৯. গৌতম বুদ্ধ। আশা করি তোমরা এর মধ্যেই অঙ্গুলিমালের গল্পটি পড়ে নিয়েছ।
১০. ধড়িবাজ শব্দের একটি অর্থ হল প্রতারক, অর্থাৎ যে প্রতারণা করে। আমরা যাকে ধাপ্পাবাজও বলতে পারি। সংস্কৃত ধূর্ত থেকে ‘ধড়’ আর ফারসি শব্দ ‘বাজ’ যুক্ত হয়ে শব্দটি তৈরি হয়েছে। অবশ্য আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারে শব্দটি আরেক অর্থেই বেশি ব্যবহৃত হয়, সেটি হল ধূর্ত, কূটকৌশলী, ফন্দিবাজ। যেমন, লোকটা তো মহা ধড়িবাজ!
সামনের রবিবার আবার এক গল্প নিয়ে আসব, সঙ্গে থাকবে ক্যুইজ। তোমরা কিন্তু লিখে পাঠাবে ক্যুইজ নিয়ে তোমাদের ভয় কমছে কিনা।

ধারাবাহিক উপন্যাস
রতনতনু ঘাটী
[সংক্ষিপ্তসার (৫-৮)
ইচ্ছে দাদু আর অনিচ্ছে ঠাকুমার সংসারে ঘটনার ঘনঘটা। কখনো বিড়ালের নাম রাখা নিয়ে, কখনো গল্পকাকার কুকুরছানা আনা নিয়ে। এদিকে নৈবেদ্য প্রাথমিক স্কুলের বন্ধু চিকলুদা আর ঝিমলিকে বুম্বা আর তিন্নিরা ওদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছে। কেন? জানতে পারবে আগামী পর্বে।]
 
ফুলকুসুমপুর খুব কাছে ৯ 

মাধুরীজেম্মা, করবীকাকি আর বকুলকাকির জটলা অনিচ্ছেঠাকুরমাকে ঘিরে রাধাগোবিন্দর খাঁচার সামনে। এ সময় সকলের হাতের কাজ একটু কম। গনগন করে বিকেল নেমে এসেছে ত্রিপাঠিবাড়ির বাঁ দিকের আকাশ ছুঁতে চাওয়া ইউক্যালিপটাস গাছটার মাথায়। তার ওপাশে লম্বা বাঁশের বন বাতাসে দোল খাচ্ছে। 
   এই বাঁশবনে সন্ধে নামতে শুরু করলে ছড়াপিসি তিন্নি-বিন্নিকে উঠোনো মাদুর পেতে বসিয়ে ছড়া আবৃত্তি করে শোনাত: ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই/ মা গো আমার শোলোক-বলা কাজলা দিদি কই!’ তখন বুম্বা হয়নি। ছড়াপিসি এই এত্ত বড় ছড়াটা গড়গড় করে আবৃত্তি করে শোনাত। প্রমথ চৌধুরীর একটা মজাদার ছড়া মাঝে-মাঝেই মুখস্থ শোনাত ছড়াপিসি: 
ছোটং ছেলে চড়েং ঘোড়া
নীচেং উলটে পড়েং খোঁড়া।
ছোটং ছেলে বেশিং কাঁদে
ভূতং তাহার চাপেং কাঁধে।
দোলনা বেশি দুলেং দুলেং
কখন যে যায় ভুলেং ভুলেং।
   বিয়ের পর আজ কত বছর হল ছড়াপিসি চলে গেছে দুমকায়। ওর শ্বশুরবাড়ি পুরানা দুর্গা মন্দিরের কাছে, বাঙালিপাড়ায়। ছড়াপিসির বর সিধু কানু হাই স্কুলের মাস্টারমশাই। সে এক মস্ত বড় স্কুল! অনেক দিন হয়ে গেল ফুলকুসুমপুরে আসেনি ছড়াপিসি। 
   খাঁচার ভিতরে রাধাগোবিন্দ বেশ খুশিমনে ছোট্ট প্লেট থেকে গমের দানা খুঁটে-খুঁটে খাচ্ছিল। মাধুরীজেম্মা ঠাকুরমাকে বললেন, ‘মা, আজ আপনার রাধাগোবিন্দর মনটা বড়ই খুশি-খুশি!’
   ‘হবে না? নতুন খাঁচা পেয়েছে যে! দাঁড়ের একটা দোলনা পেয়েছে। নতুন ছোলা খাওয়ার বাটি পেয়েছে। জল খাওয়ার ছোট্ট গ্লাস! খুশি হবে না?’ বলে হাসলেন করবীকাকি।
   ‘দাঁড়াও, রথযাত্রাটা আসতে দাও না! তখন দেখবে আমার রাধাগোবিন্দকে আর পায় কে?’ ঠাকুরমা বললেন।

   বকুলকাকি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন, রথযাত্রা এলে কী হবে মা?’
   ইচ্ছেঠাকুরমা মুখ ভরতি হাসি নিয়ে বললেন, ‘আমি রাধাগোবিন্দর কাছে একটা প্রমিস করেছি। ও মাত্র কয়েকটা কথা বলতে শিখলেই ওর জন্যে আমি শ্যামসুন্দরপুর বাজারে গিয়ে ‘সোনার কাঁকন’ দোকান থেকে একটা সোনার শিকল গড়িয়ে দেব!’
   মাধুরীজেম্মা রাধাগোবিন্দর দিকে দেখতে-দেখতে বললেন, ‘দেখুন মা, কথাটা শুনেই একেবারে যেন আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল! সত্যি টিয়াপাখিও কত কথা বুঝতে পারে!’
   ইচ্ছেঠাকুরমা গলাটা একটু চড়া করে বললেন, ‘না, বড়বউমা, আমার রাধাগেবিন্দ টিয়াপাখি নয়! ও ভাল জাতের একটা হীরামন পাখি। জল আর জলপাই যেমন এক হয় না, তেমনি টিয়া আর হীরামন এক হয় না গো!’
   মাধুরীজেম্মা মুখটা লাজুক-লাজুক করে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমারই বলা ভুল হয়েছে মা! আসলে বাবা বারবার রাধাগোবিন্দকে ‘টিয়াপাখি’ বলেন তো? তাই ওটাই মনের মধ্যে গেঁথে গেছে।’
   এমন সময় তিন্নির বাবা মানে বড়বাবু বাড়ি ফিরে এলেন। পলাশবীথি গ্রামীণ ব্যাঙ্কে উনি চাকরি করেন। আজ তাড়াতাড়ি ছুটে হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরেই দেখলেন, খাঁচার ভিতর মন খারাপ করে বসে আছে মিঁউ। ঠাকুরমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মা, আমার মিঁউকে কি কেউ কিছু বলেছে? ও অমন চুপ করে বসে আছে কেন মা? ওর অমন মনভাব কেন? তুমি ওকে দুপুরে কি দুধ-ভাত খেতে দাওনি?’ তারপর মাধুরীজেম্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হ্যাঁ গো, তুমি মিঁউকে একটা মাছের টুকরো দিয়েছ তো? আমি তো বলেছি, এ বাড়িতে আমার ভাগে যদি মাছের টুকরো নাও থাকে, তাও সই। কিন্তু আমার মিঁউ যেন এর টুকরো মাছ পায়।’
   ‘ওর এখন এই বন্দিজীবন ভাল লাগছে না মনে হয়। ঘুরে-ঘুরে শিকার ধরবে, তা না কে আর এমন বন্দিজীবন চায়?’ মাধুরীজেম্মা বললেন।
   ‘না না, এটা বন্দিজীবন কেন হবে? পশু-পাখিদের বন্দি করে রাখলে তারা কি আর ভালো থাকে?’ বকুলকাকি বললেন।
   বড়বাবু বললেন, ‘আমি তো মিঁউকে সব সময় বন্দি করে রাখব না খাঁচায়। ওকে এমন ভাবে অভ্যস্ত করে তুলব, ও ওর ইচ্ছেমতো খাঁচায় থাকবে, ইচ্ছেমতো খাঁচা থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে যাবে। ওকে সেই আদবকায়দায় রপ্ত করাব যে, ও অন্য কারও বাড়ি যাবে না। অন্য বাড়ির মাছ চুরি করে খাবে না। আমাদের বাড়ির অন্য সব পোষ্যর সঙ্গে মিলমিশ করে থাকবে।’
   এতক্ষণ কথা বলে থামলেন বড়বাবু। বিন্নি বলল, ‘বড়বাবু, তুমি তো দারুণ-দারুণ স্টোরি বলো! বিড়াল নিয়ে একটা সত্যি স্টোরি বলো না আমাদের? মিঁউয়ের বড় হতে এখন ঢের দেরি। সবে এখন ওর চোখ ফুটছে।’
   বুম্বা বিন্নির সুরে সুর মেলাল, ‘হ্যাঁ, বিড়ালের গল্প। তবে সত্যি গল্প চাই কিন্তু!’
  বড়বাবু বললেন, ‘আচ্ছা, তবে বিড়াল নিয়ে একটা সত্যি গল্প বলি। তার আগে তোদের একটাই প্রমিস করতে হবে, তোরা গল্পটা কখনও ভুলে যাবি না, কেমন?’
(এর পর আগামী রোববার)

 পাঠ প্রতিক্রিয়া ১

(দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী অশোকনগরের স্নেহা মন্ডল ৩৫ তম ছোটোবেলা সংখ্যা পড়ে যা লিখল🖋️)
      
         জীবন নানারঙের প্রতীক।সময় ক্রমশই বয়ে চলে আর সময়ের এই টানাপোড়নে নানা জীবন-অভিজ্ঞতা অর্জন হয়।বহু কিংবদন্তির সঙ্গে আলাপচারিতাও ঘটে,ঠিক তেমনি একজন সুপরিচিত বিখ্যাত মহামানব হলেন আমাদের বাঙালিদের প্রিয় 'মানিকদা', "সত্যজিৎ রায়।"
           'ছোটবেলা'সংখ্যা-৩৫ এ ওঁনার জন্মমাস পালন উপলক্ষে যেসমস্ত গল্প প্রকাশিত হয়েছে তা সত্যই অভিনব।এই সংখ্যায় দেবাশিষ মহাশয়ের 'লেখক সত্যজিৎ', গল্পে সত্যজিৎসৃষ্ট বহু এডভেঞ্চারমূলক গল্প,প্রফেসর শঙ্কুর কাহিনী, বাংলা গোয়েন্দা সিরিজ,সন্দেশ পত্রিকা প্রকাশের ইতিহাস ইত্যাদি কর্মজীবন সম্পর্কিত নানা তথ্যের যেমন বিস্তৃত বিবরণ পেয়েছি তেমনি 'সন্দেশ' ও তাঁর পাঠক-পাঠিকারা কিভাবে তাকে লিখতে বাধ্য করেছিল তার সক্রিয় প্রমানেরও নজির এই গল্পটি।

                 এইবার চলে আসি রতনতনু মহাশয়ের 'ফুলকুসুমপুর খুব কাছে' গল্পে যেখানে প্রথমেই চোখে পড়ে নৈবেদ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠরত ছোট ছেলে-মেয়েদের শিশুমনের নানা পরিব্যাক্তি কিভাবে প্রকাশিত হয়েছে----তাদের বাড়িতে চারটে খাঁচায় বন্দি চারটে ভিন্ন পোষ্যর অবস্থান তাদেরকে যেন একটা ছোটখাটো চিড়িয়াখানার অনুভূতি প্রদান করেছে, যা তারা ভাগ করে নিয়েছে তাদের অন্যান্য সহপাঠীদের সাথে।এমনকি ওদের কথার সত্যতা প্রমানের জন্য শনিবার স্কুলের হাফ ডে ছুটির পর সেই দৃশ্য চাক্ষুষ দেখার আমন্ত্রণও জানিয়ে ফেলেছে তারা।তবে শেষপর্যায়ে গাছেরও যে চেতনা-অনুভূতি আছে একাধারে তার প্রকাশ ও সতর্কতাজ্ঞাপন গল্পটিকে ভিন্ন স্তরে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

           আমাদের প্রিয় 'মনিকবাবু' নাকি এখন সাই-ফাই গ্রহে আছেন এবং তিনি পৃথিবীর সমস্ত গতিবিধির উপর কড়া নজরও রাখছেন---হ্যাঁ এমনটাই জানতে পারলাম কৃষ্ণা ম্যামের 'সাই-ফাই গ্রহে কিছুক্ষন' গল্পটি পড়ে।ঠাম্মা-নাতনির মতো একটা প্রিয় সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত রোজিঠাম্মার মানু মামা তথা মনিকবাবু সম্পর্কিত নানা সংলাপ পড়ে যেমন রোমাঞ্চিত হয়েছি তেমনি কলুষিত, আবর্জনামিশ্রিত এক ভূষণ যেভাবে পৃথিবীকে ধীরে ধীরে ঢেকে ফেলছে এবং তা স্বপ্নের সত্যজিতের কাছে যে গ্লানিকর, কষ্টদায়ক অনুভূতির সৃষ্টি করেছে তা দেখে লজ্জিত এবং বিমর্ষও হয়েছি!
           এছাড়াও মৌসুমী ম্যাম ও সন্দীপন স্যারের 'মুগ্ধ থাকি সত্যজিতে' ও 'সেলাম মহারাজা' ছড়াদুটি সত্যজিৎ নির্মিত নানান শিল্পশৈলী,ছায়াছবি--কল্পনার নবসৃজন, মৌলিকতা ও বাঙালিয়ানার মিশ্রনে যেভাবে অভিনব হয়ে উঠেছে তারই উজ্জ্বল প্রকাশ বর্তমান ছড়াদুটির প্রতিটি শব্দ।

           পাশাপাশি শ্রীপর্ণার 'সেই সন্দেশ' গল্প এবং প্রবাহনীলের 'সব বাঙ্গালির বুকে' ছড়া--এই দুয়ের সংমিশ্রনে সত্যজিতের বিভিন্ন অভাবনীয়, চমকপ্রদ নির্মানকলা এবং খুদেদের লেখনী একাকার হয়ে গিয়ে যেভাবে এই সংখ্যাপাঠকে এক নতুনমাত্রা দিয়েছে তা নিঃসন্দেহে তারিফ করার সমস্ত দ্বারকে উন্মোচিত করে তোলে।

             সবমিলিয়ে এই সংখ্যাটি এক ভিন্ন স্বাদের হয়ে উঠেছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মৌসুমী ম্যাম আমাদের সামনে 'ছোটবেলা'-র মত এক ব্যাতিক্রমী পত্রিকার প্রকাশনার জন্য,যা এককথায় অসাধারণ এবং অনবদ্য!!
পাঠ প্রতিক্রিয়া ২
( দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র অশোক নগরের সৌগত রায় ৩৫ তম ছোটোবেলা সংখ্যা পড়ে যা লিখল🖋️)

"ছোটবেলা বিশেষ সংখ্যা ৩৫"* পড়লাম । 
সত্যি কথা বলতে এর আগে এই পত্রিকার কোন সংখ্যা হাতে আসেনি । এটাই প্রথম পড়লাম । আসলে ছোটবেলা থেকেই "শুকতারা" কিংবা "আনন্দমেলা" র মত পত্রিকা বারেবারেই আমার মন কাড়ে। এই পত্রিকার ক্ষেত্রেও যে তার ব্যাতিক্রম হবে না তা পত্রিকার শুরুতেই বুঝেছি। মৌসুমী ম্যাম এর লেখা সম্পাদকীয় অংশটি  আমায় যে ঠিক কতটা আনন্দ দিয়েছে তা লিখে এমনকি বলেও প্রকাশযোগ্য নয়। এই লকডাউন কোরোনা অতিমারী এসব এর মধ্যে বাইরে থেকে পত্রিকা কেনা বা পাওয়া কেমন যেন দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তাই বাড়িতে বসেই এত দারুণ একটা পত্রিকা পেয়ে আমি সত্যিই ব্যাপকভাবে মুগ্ধ। 

   এবারে আসা যাক পত্রিকার রচনাগুলিতে । 
প্রত্যেকটা রচনাই ভিন্ন স্বাদের। আর আমি মনে করি কোন পত্রিকা পড়ার ক্ষেত্রে স্বাদবদলটা খুব দরকার । দেবাশিস স্যার এর "লেখক সত্যজিৎ" সত্যিই অনবদ্য - ঝুড়ি ঝুড়ি তথ্যে পরিপূর্ণ। সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্কে এখানে দেওয়া তথ্যের বেশীরভাগটাই আমার অজানা। আর নতুন জিনিস জানতে কে না ভালোবাসে তাই না! লেখাতে আছে সত্যজিৎ রায়ের একটি উক্তি "'সন্দেশ' না এলে হয়তো আমার লেখাই হতো না!" - সত্যিই অবাক করল। আমাদের চেনা মানিকবাবুর যার লেখা এত্ত গল্প সেই ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসছি, পড়ে আসছি তার লেখা শুরুর ইতিহাসটা যে এই রকম তা জানতেই পারতাম না। 

 এরপর আছে , রতনতনু স্যার এর "ফুলকুসুমপুর খুব কাছে" যা একটি ধারাবাহিক তার একটি পর্বও আমি আগে পড়িনি। কিন্তু এই পর্বটি পড়ে আমার সত্যিই নিশ্চিন্দিপুরের কথা মনে পড়ল । এ যেন সেই চেনা নিশ্চিন্দিপুরেরই এক নতুন রূপ বা ইংরেজিতে যাকে বলা চলে "version"  ( বর্তমানের মোবাইল ফোন এর যুগে "version" কথাটি বেশ প্রচলিত)
বিন্নি যেন দিদির মত তিন্নি আর বুম্বাকে আগলে রাখছে। যাইহোক ধারাবাহিকটির পরের পর্ব গুলোর জন্য এবং স্যার এর আরো নতুন লেখার জন্য অপেক্ষায় রইলাম । 

  এবারে আসি, কৃষ্ণা ম্যামের "সাই-ফাই গ্রহে কিছুক্ষণ" গল্পটি। নাম পড়েই বুঝেছিলাম এটা কি বিষয়ের ওপর হতে পারে। রোজি ঠাম্মির কথার সত্যতা ঠিক কতটা তা না বলতে পারলেও আমি চাই আমায়ও রোজি ঠাম্মির মত একবার তার "মানু মামা" দেখা দিক । যাইহোক এই গল্পটিও আমার দারুণ লেগেছে।

  এরপর মৌসুমী ম্যাম এর "মুগ্ধ থাকি সত্যজিতে" আর সন্দীপন স্যার এর "সেলাম মহারাজা" কবিতা দুটিও প্রশংসার অবকাশ রাখে না। দুটিই সত্যজিৎ রায় এর প্রতি দুর্দান্ত দুটি শ্রদ্ধার্ঘ্য। 

  এরপর ছিল সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী শ্রীপর্ণা ঘোষ এর "সেই সন্দেশ" যা সন্দেশের মতই মিষ্টি আর অপূর্ব একটি লেখা । গল্পের বিষয়বস্তুও দারুণ । সত্যিই একদম অন্যরকম । তাকে আমার আন্তরিক ভালোবাসা জানাই।
এছাড়া সপ্তম শ্রেণীর প্রবাহনীল দাসের "সব বাঙালির বুকে" কবিতাটিও  বেশ সুন্দর । তাকেও জানাই আমার আন্তরিক ভালোবাসা। 

  এছাড়া  সমগ্র পত্রিকাটি বিভিন্ন ছবিতে রঙিন ও আরো আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে । ছবির প্রচ্ছদে ঋপণ আর্যের তোলা ছবিটি ছোটবেলার "মেলা মেলা" খেলার কথা মনে করিয়ে দিল। 
আর সবশেষের পাঠ প্রতিক্রিয়াগুলি বুঝিয়ে দিল পত্রিকাটি বরাবরই একটি অসাধারণ পত্রিকা। 

  যাই হোক, সব মিলিয়ে ছোটবেলা বিশেষ সংখ্যা- ৩৫ আমায় ভীষণ মুগ্ধ করেছে । এটি সত্যিই একটি অসাধারণ সংখ্যা। আমার সত্যিই খুবই ভালো লেগেছে। ঘরে বসেই এভাবে ছোটবেলার স্বাদ পাবো ভাবি নি । 
পরের সংখ্যার অপেক্ষায় রইল।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments