জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৪৪/শ্যামল জানা


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৪৪

শ্যামল জানা

সাররিয়েলিজম্ (তৃতীয় অংশ)

আমরা সালভাদোর দালির আঁকা সাররিয়েলিস্টিক ছবি ‘মেটামরফোসিস অফ নার্সিসাস’ আলোচনা করেছি গত সংখ্যায়৷ যেহেতু সাররিয়েলিজম-এর সূত্রপাত ঘটেছে সাহিত্য থেকে, এবং তারপর তা চিত্রশিল্পে এসেছে, তাই সাহিত্য অংশটুকুর আলোচনাও সামান্য হলেও করা প্রয়োজন৷ তবে, যেহেতু ছবি নয় সাহিত্য, সেহেতু ভাষার প্রশ্ন এসে যায়৷ সেক্ষেত্রে এই লেখাটি যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা বাংলাতে লেখা হচ্ছে, এবং বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতায় সার্থক সাররিয়েলিজম্-এর প্রয়োগ আছে, তাই আলোচনার ক্ষেত্রে নির্দ্ধিধায় বাংলা সাহিত্যকেই বেছে নেওয়া হল৷ বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা কবিতায়, আমার বিবেচনায় সাররিয়েলিজম-কে প্রথম প্রয়োগ করেন জীবনানন্দ দাশ৷ তাঁর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ বইয়ের ‘বেড়াল’ কবিতাটিতে৷ এটি লেখা হয়েছিল ১৯৩৬ সালে(বাংলায় চৈত্র ১৩৪৩)৷ কবিতাটির শেষ চারটি পংক্তি সাররিয়েলিজম-এর উদাহরণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপযুক্ত—
“হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান রঙের সূর্যের নরম শরীরে
শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে;
তারপর অন্ধকারকে ছোটো ছোটো বলের মতো থাবা দিয়ে লুফে আনল সে,
সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল৷”
আামি তখন ইস্কুলে পড়ি৷ মা একটা বেড়াল পুষেছিল৷ নাম দিয়েছিল ফুলি৷ খুব আদুরে৷ শীতকালে মা যখন সোয়েটার বুনত, মাঝে মাঝে কোল থেকে উলের গোলাটা নিচে পড়ে যেত৷ কী করে যে বুঝতে পারত ফুলি, ছুট্টে এসে ওই উলের গোলাটা নিয়ে তার থাবা দিয়ে খেলতে লেগে যেত৷ ওটা দেখে, একদিন আমি আমাদের ক্রিকেট খেলার ক্যাম্বিস বলটা ওর সামনে ফেললাম৷ দেখলাম, সে ওটাকে নিয়েও থাবা দিয়ে দিয়ে খেলতে শুরু করে দিয়েছে৷ বুঝলাম, বেড়াল কোনো গোল জিনিস নিয়ে খেলতে ভালোবাসে, যেহেতু সেটা গড়ায়৷

  নিশ্চিতভাবে জীবনানন্দের এই পর্যবেক্ষণটি ছিল৷ তাই, তিনি বলের গোলাকার আকৃতির সঙ্গে সূর্যের গোলাকার আকৃতির জাক্সটাপজিশন করতে পারলেন, যাকে আমরা বিশুদ্ধ পরাবাস্তব(Surrealism)বলতে পারি(ছবি-১)৷ আর, বিস্ময়কর এই যে, তিনি এই বিশুদ্ধ পরাবাস্তবে পৌঁছাতে গিয়ে ইম্প্রেশনিজম্-এর সাহায্য নিলেন— “হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান রঙের সূর্যের নরম শরীরে”৷ নির্দিষ্ট একটি সময়ের প্রাকৃতিক দৃশ্যকে ধরলেন, যা এক কথায় বলা যায় সার্থক ইম্প্রেশনিজম্৷ কেন করলেন? এর নির্দিষ্ট কারণটি হল— দিনের বেলায় সূর্য যখন প্রখর, তখন তার দিকে তাকানো যায় না৷ ফলে, তার নির্দিষ্ট গোলাকার আকৃতিকে ঠিকমতো বোঝাই যায় না৷ সন্ধ্যায়, ডোবার ঠিক আগে, যখন সূর্যের তেজ ফুরিয়ে যায়, নরম হয়ে কমলা(জাফরান)রঙের হয়ে যায় তার শরীর৷ তখনই সবচেয়ে স্পষ্ট হয় সে৷ অনায়াসে চোখে ধরা পড়ে তার গোলাকার আকৃতি, যেটা দিয়ে কবি জাক্সটাপজিশন তৈরি করেছেন বলের সাথে৷

  এখানেই থামলেন না তিনি! সাররিয়েলিজম্-এর এক অবিশ্বাস্য প্রয়েগ করলেন তিনি৷ অপটিক্যল সায়েন্সকে প্রয়োগ করলেন তিনি এই দ্বিতীয় সাররিয়েলিজম্-কে ধরার জন্য৷ সেটি হল— আমরা যখন যে কোনো আকৃতির আলোর দিকে খানিকক্ষণ তাকাই, তা, সে অপসৃত হলে বা তার থেকে চোখ সরিয়ে নিলেও তার অস্তিত্ব বেশ খানিকক্ষণ রেটিনায় থেকে যায় চোখ বুজলেও(অন্ধকার হলেও)৷ সূর্য ডোবার পর, তার গোলাকার আকৃতি, যেটি রেটিনায় থেকে যাচ্ছে, তার সাহায্যে তিনি অন্ধকারের আকৃতিকে গোলাকার হিসেবে তৈরি করে নিলেন(“তারপর অন্ধকারকে ছোটো ছোটো বলের মতো থাবা দিয়ে লুফে আনল সে”)৷ আর, এটি করলেন, কারণ অন্ধকারের নিজস্ব কোনো আকৃতি হয় না৷ সামগ্রিকভাবে আলোহীনতার নামই অন্ধকার৷ এবার আমরা যদি সামগ্রিকভাবে দেখি, আমরা বুঝতে পারব কী অবিশ্বাস্য মুন্সীয়ানায় ত্রিমাত্রিক বলের গোলাকৃতির সঙ্গে তিনি আলো এবং অন্ধকার, এই দুটোর সঙ্গেই জাক্সটাপজিশন তৈরি করলেন৷ এখানেই থামলেন না তিনি৷ বিস্ময়করভাবে লিখলেন— “সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল৷” লক্ষ করার বিষয়, পৃথিবীও গোল৷ অর্থাৎ ছোটো ছোটো গোলাকার বলের মতো অন্ধকারগুলিকে বেড়ালটা থাবা দিয়ে লুফে এনে সে আরও অনেক বড় গোলাকার আকৃতির পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল৷ অর্থাৎ গোলাকার বলের আরও একটি পরোক্ষ জাক্সটাপজিশন তৈরি হল পৃথিবীর সঙ্গেও৷ কী অবিশ্বাস্য!
    এবার অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে লক্ষ করার বিষয় হল— এই যে কবিতার মধ্যে সার্থক সাররিয়েলিজম তৈরি করলেন জীবনানন্দ, সেটি পারলেন সম্পূর্ণভাবে দৃশ্যের সাহায্য নিলেন বলে৷ অর্থাং, সাররিয়েলিজম্-এর ক্ষেত্রে ইতিহাস একটু ভিন্নভাবে তৈরি হল৷ সাধারণত যে কোনো ইজম্-এর সূত্রপাত হয় চিত্রশিল্প বা দৃশ্যশিল্প থেকে৷ কারণ, মানুষ দৃশ্যের সাহায্য ছাড়া ভাবতে পারে না। কিন্তু সাররিয়েলিজম্-এর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটেছিল৷ তার সূত্রপাত বা অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল সাহিত্যের মাটি থেকে ফরাসি কবি আন্দ্রে ব্রেতোঁ-র হাত ধরে৷ কিন্তু দেখা গেল সেই সাহিত্য যথারীতি দৃশ্যের সাহায্য ছাড়া এগোতে পারছে না৷ ফলে, সে ট্রান্সফার হল চিত্রশিল্পে৷ ওখানে গিয়ে সাররিয়েলিজম্-এর অঙ্কুরটি ডাল-পাতা-ফুল-ফলে মহীরূহ হল৷ এবং আবার পরিণত অবস্থায় ব্যবহার হতে শুরু হল সাহিত্যে!

    এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে৷ এখানে যে দৃশ্যের কথা বলা হল, তা, আমরা সাধারণভাবে যে দৃশ্য দেখি, সেই দৃশ্য নয়৷ আন্দ্রে ব্রেতোঁ প্রথম ‘সাররিয়েলিস্ট ম্যানিফেস্টো’-তে(ছবি-২)খুব স্পষ্টভাবেই এই দৃশ্য বিষয়টিকে উল্লেখ করেছিলেন— যে দৃশ্য “আপনা থেকে অবচেতন মনের বিশুদ্ধ ক্রিয়া("pure psychic automatism")” হিসেবে তৈরি হয়, সেই দৃশ্যই আমাদের সৃষ্টির মূল উপাদান৷ তাই, তৎকালীন সাররিয়েলিস্ট শিল্পী-সাহিত্যিকরা তাঁদের সৃষ্টির ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম গুরুত্ব দিতেন এই অবচেতন মন সংক্রান্ত যে দার্শনিক আন্দোলন, সেই অভিব্যক্তিকে(expression of the philosophical movement)ফুটিয়ে তোলা৷ তারপর সেই অভিব্যক্তি বা দৃশ্যকে কেন্দ্র করে ছবি বা লেখার বাকি অংশের পরিকল্পনা করা৷ এটাই ছিল সাররিয়েলিস্টদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় ও ধরন, যা সাররিয়েলিজম্-এর মূল হোতা আন্দ্রে ব্রেতোঁ খুব স্পষ্ট করে বিবৃতির মাধ্যমে তাঁদের ইস্তাহারে ঘোষণা করেছিলেন৷ এবং একে তিনি বৈপ্লবিক আন্দোলন(Revolutionary movement)হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন৷ তাই হয়তো দেখা গিয়েছিল, সেই সময় যে সব রাজনৈতিক আন্দোলনগুলি দানা বেঁধেছিল, যেমন ‘কমিউনিজম্’ বা ‘অ্যানার্কিজম্(নৈরাজ্যবাদী)’, তাদের আন্দোলনের কারণগুলিও সাররিয়েলিস্টদের সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছিল৷                                                 (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments