জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -- পর্ব-৭/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -- পর্ব-৭
সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মে ঈশ্বরের প্রবেশ

মানুষ ঈশ্বর সৃষ্টি করেছে, অন্য প্রাণীর ক্ষেত্রে এই সৃষ্টির কোন অবকাশই নেই। একমাত্র মানুষ নিত্য প্রয়োজনের জগতে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না বলেই সে নিরন্তর প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছুকে অবিরাম খুঁজতে থাকে। সে ইচ্ছে করলে অনাহারে থাকতে পারে, নিদ্রা ত্যাগ করে দীর্ঘদিন কাটাতে পারে, চরম সংযমী হয়ে যৌনজীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারে ও বিশেষ সাধনার বলে ভয় মুক্ত জীবন লাভ করতে পারে। তার চিরন্তন খোঁজ কী? সেই অদৃশ্য শক্তি, যা অর্জন করতে পারলে জৈবধর্মের চাহিদাগুলোকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অথবা কোন সাধনা ও সংকল্পের বলে সে এই চাহিদাগুলিকে আর ও বিপুলভাবে আয়ত্ত করতে পারে। এখানেই তার সৃষ্টিধর্মী জীবনের ব্যাপ্তি এবং এই বোধের জাগরণকে বাড়িয়ে তুলতে তার অন্বেষার অভাব নেই। 

  একদিকে ভোগ, অপরদিকে ত্যাগ- দু দিকেই মানুষ সমৃদ্ধ হতে শিখেছে। জন্মের পর থেকেই মানুষ বহির্জগতের দৈনন্দিন সংঘাতপূর্ণ পরিবেশগুলি থেকে সঞ্চয় করতে পেরেছে- কিভাবে সে তার আচরণিক ক্ষেত্রগুলোকে পরিশুদ্ধির ভিতর দিয়ে গড়ে নিয়ে, সাধনা ও সংকল্পগুলিকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে আপনাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করবে? আত্মপ্রীতি তার আত্মরক্ষার মূল শক্তি, যা অন্য প্রাণীর নেই। এই আত্মপ্রীতিই তাকে স্বভাবে, আচরণে প্রচন্ড রকম স্বার্থপর হতে শিখিয়েছে। 

  জ্ঞান ও কল্পনা এক নয়। জ্ঞান কষ্টার্জিত। বহু মানুষের বহু সাধনার ফল। কল্পনা অনায়াস, উদ্দাম। তাই মানব সভ্যতায় জ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে ধীরে ধীরে, অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে, অনেক বিচার বিতর্কের শেষে। সে পথ অনন্ত, এক সত্য থেকে আরেক সত্যের উত্তরণের পথ। কিন্তু কল্পনায় সত্য অসত্যের সীমানা নেই, কারন সে বন্ধনহীন। তাই আদিম মানুষের কষ্টার্জিত জ্ঞান ছিল সামান্য, কল্পনা ছিল অফুরন্ত। আকাশের গ্রহ তারাদের দিকে তাকিয়ে এবং নিজের পৃথিবীকে দেখে বিস্ময়ে তার মনে প্রশ্ন জাগতো, এই মহাবিশ্ব কোথা থেকে এলো? ঋগ্বেদসংহিতায় এই বিস্ময় এবং জিজ্ঞাসা ধ্বনিত হয়েছেঃ "কেই বা প্রকৃত জানে? কেই বা বর্ণনা করবে? কোথা থেকে জন্মালো? কোথা থেকে এসব নানা নানা সৃষ্টি হল? একেক বার প্রশ্নকর্তার মনে হয়েছে, মহাবিশ্বের উৎস হয়তো বা অজ্ঞেয়। তাই তিনি নিজেই উত্তর দিয়েছেনঃ "এই বিবিধ সৃষ্টি যে কোথা থেকে এল, কার থেকে হলো, তা তিনিই জানেন, যিনি এসবের প্রভুস্বরূপ পরমধামে বিরাজ করছেন। অথবা হয়তো তিনিও জানেন না। অন্যত্র দেখি অজ্ঞেয়বাদেরই আর ও জোরালো অভিব্যক্তিঃ "যিনি এ সৃষ্টি করেছেন, তাকে তোমরা বুঝতে পারো না। তোমাদের অন্তঃকরণ তাকে বুঝবার ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়নি। কুজ্ঝটিকাতে আচ্ছন্ন হয়ে লোকে নানা প্রকার জল্পনা করে। তারা আপন প্রাণের তৃপ্তির জন্য আহারাদি করে, এবং স্তব স্তুতি উচ্চারণ করে বিচরণ করে। কিন্তু এই অতৃপ্ত জিজ্ঞাসা নিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনুন্নত প্রাচীন মানুষ সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি। সে কল্পনা করেছে যে তার যেমন পিতা-মাতা থেকে জন্ম হয়েছে, বিশ্বভুবনের ও তেমনি কোন আদি জন্মদাতা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। আর এই আদি স্রষ্টার সৃষ্ট ভূমি রুপে সে কল্পনা করেছে আদি মহান্ধকার, আদি মহাজল, আদি বিশ্বডিম্ব ইত্যাদি। 

  স্টিফেন হকিং তাঁর 'A Brief History of Time" গ্রন্থের এক জায়গায় লিখেছেন "mind of God"- যখন তিনি প্রকৃতির রহস্যময়তাকে কিছুতেই ধরতে পারছেন না। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আগাপাশতলা নিরীশ্বরবাদী। তাহলে ব্যাপারটা কি? God বলতে আমরা কি বুঝবো? 

  বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন(খ্রিঃ ১৮৭৯) বলছেন, "God does not play dice".আবার বললেন, ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান খোঁড়া আর বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ (Science without religion is lame, and religion without science is blind.) আইনস্টাইন 'God' 'Lord' 'Religion' শব্দগুলি ব্যবহার করে কি বুঝেছিলেন? বিজ্ঞান এবং ধর্মকে দুই প্রতিপক্ষ যদি ধরা হয়, তবে তার চিন্তা দু দিক দিয়েই যুক্তিযুক্ত। তিনি বলছেন, তিনি মনে প্রাণে ধার্মিক এবং ভগবানে বিশ্বাস করেন, তবু অনেকেই তাকে নাস্তিক বলে অভিযুক্ত করেন। 

  অপরদিকে বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় সমস্ত কাজকর্ম প্রমাণ করে তিনি মোটেই ঈশ্বর বিশ্বাসী নন। সে ক্ষেত্রে কিভাবে ধারণা করা যায়- তিনি বিশ্বাসী অথবা নাস্তিক অথবা ঈশ্বর আছেন কি নেই, এই প্রত্যয়ে তিনি পৌঁছতেই পারেননি। ১৯৩৬ খ্রিঃ একটি ছেলের নির্দিষ্ট প্রশ্ন- বিজ্ঞানীরা প্রার্থনা করে কি না, তার উত্তরে লিখেছিলেন: যে কেউ খুব যত্ন করে যদি বিজ্ঞান বিষয়ে অনুসন্ধান চালায়, সে অতি অবশ্যই বুঝতে পারবে যে, এই বিশ্বের যাবতীয় তত্ত্বের পিছনে কোন একটি শক্তির হাত রয়েছে এবং সেই শক্তি মানুষের শক্তির চেয়ে অনেকগুণ বড়। এই ভাবেই বিজ্ঞানের অনুসন্ধান থেকেই সে ধর্ম ভাবনার জীবনকে পাবে, যা কিনা সাধারণ ও সচারাচর ব্যবহারিক ধর্ম-কর্ম থেকে অবশ্যই আলাদা। তিনি বলতে চেয়েছেন সেই সব ভক্তদের, যারা ধর্মের বাহ্যিক দিকটি নিয়ে মেতে আছে শুধু নয়, তারা ভগবানের ভয়ে মরে আছে (God Fearing)।আইনস্টাইনের এই ধর্ম-ভাবনাটি অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়নি। তিনি বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে যে রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তা বুঝতে গিয়েই  Superior Spirit কথাটি উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু তিনি মনে প্রাণে ব্যক্তি ঈশ্বরকে অস্বীকার করেছিলেন এবং তার এই ধারণা অন্ধ ছিল না। তবু Did Einstein believe in God? এই বিতর্কের নিরসন হয়নি। প্রশ্ন হল, যে মনোজগতকে ঘিরে তার মধ্যে ঈশ্বর ভাবনা জেগে উঠেছে, সেই মনোভূমিই কি তাকে বিজ্ঞানের বিষয়ের চর্চায় বিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে শিশুকাল থেকে তার জীবনের ঘটনা প্রবাহের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। এই বিষয়ে বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী ঐতিহাসিক Max Jammer এর লেখা গ্রন্থ Einstein and Religion (Princeton University Press) বইটি পড়তে হবে। আইনস্টাইনকে দার্শনিক  Benedict de spinoza,Immanuel Kant,Schopenhauer,David Hume প্রমুখের দর্শন অনেকটাই প্রভাবিত করেছিল ছোটবেলা থেকে। তিনি প্রায়ই বলতেন রহস্যময় অনুভূতি- Sense of Mysterious এর কথা, যা তার বিচারে 'অতীব সুন্দর' এবং এক প্রকার 'গূঢ় অভিজ্ঞতা'- "Most Beautiful and deepest experience one can have"। যখনই তিনি প্রকৃতির রহস্যময়তার আনন্দলোকে প্রবেশ করেছেন, তখনই তিনি এই অনুভূতিটি প্রকাশ করেছেন। 

  স্পিনোজার মতে- ঈশ্বর অপরিবর্তনীয় (Immutable) এবং সেই অর্থে সবকিছুই অপরিবর্তনীয়। আইনস্টাইন "Unified field theory" সন্ধানে নিয়োজিত হলেন। 'Cosmological Constant' প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখলেন, সব কিছুই পরিবর্তনশীল (Non-static, Expanding) এখানেই তিনি সর্বশেষ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না শুধু নয়, শেষ পর্যন্ত তিনি নিজস্ব এক গভীর উপলব্ধির জগতেই ফিরে এলেন, যা হল বিশ্ব অপরিবর্তনীয় এবং অচল। তাঁর 'Cosmic religion' এমন একটি মহাজাগতিক ধর্ম, যেখানে বিরোধ নেই, সংঘাত নেই। শেষ জীবনে তার অতীতের সব বিচার ধারণা' Cosmic Religion' এ এসে শেষ হলো। আর এই কারনেই আধুনিক বিজ্ঞান 'Unified theory'-কে নতুন করে আইনস্টাইনের জীবন দর্শনকে স্বীকার করেই বিচার করা হচ্ছে, কারণ ধর্ম ঈশ্বর বিজ্ঞান বিষয়ে মতামত বৈষম্যের নিরসন এখনও সম্ভব হয়নি। কিন্তু তার এই বিষয়ে নির্দ্ধিধ প্রত্যয়টিকে অস্বীকার করার উপায় নেই- "My position concerning God is that of an agnostic. I am convinced that a vivid consciousness of that primary importance of moral principles for the betterment and enablement of life does not need the idea of a law-giver, especially a law-giver who works on the basis of reward and punishment." ১৯৫৪ খ্রিঃ একটি চিঠিতে তিনি দৃঢ় প্রত্যয় হলেন ওই বাক্যটি লিখে- "Deeply religious non-believer." যা হল- "Somewhat a new kind of religion."

  একবিংশ শতাব্দে বিজ্ঞান প্রযুক্তি উৎপাদন যখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে, তখন মানুষের ভাব রাজ্যের অন্দরমহলে নিত্যনতুন চিন্তার উদ্ভব ঘটে চলেছে। নৃ-বিদ্যা এই সত্য স্পষ্ট করেছে যে, মানুষের জীবনধারণ ক্রমশই সহজ থেকে জটিলতম হয়ে উঠেছে। 

  বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ধর্মবিশ্বাস মানব জীবনে একটি দশা মাত্র। এর বাইরে কিছু নয়। কিন্তু এই সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই- মানুষের জীবনকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করার জ্ঞান এখনও অনায়ত্ত। 
ডঃ রাধাকৃষ্ণন ধর্ম ও সমাজ বিষয়ে চর্চা করতে গিয়ে একটি গল্পের অবতারণা করেছিলেন। কোন ও এক ভারতীয় দার্শনিক সক্রেটিসের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সক্রেটিস এই আগন্তুক দার্শনিককে বলেন, মানুষের জীবন সম্বন্ধে খোঁজখবর করাই তার কাজ। ভারতীয় আগন্তুক হেসে বলেছিলেন, যে দিব্যজীবন বিষয় বোঝেনা, সে মানুষের বিষয় ও বুঝতে পারবে না। 

  বর্তমান জগতে সবচেয়ে গভীর সমস্যা হল, ধর্মীয় মতবাদ গুলি নয়, বিশ্বকে এখন ও বিজ্ঞান সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করতে অপারগ। ঠিক এই কারণেই দৈবের দিকে মানুষের দৃষ্টি ক্রমপ্রসারিত।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments