জ্বলদর্চি

ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার)-র লোকগল্প (বাঘ আর হনুমান-- দুই বোকার গল্প) / চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প-- ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার)
চিন্ময় দাশ  

বাঘ আর হনুমান-- দুই বোকার গল্প  

একদিন বনের ভিতর বাঘ আর হাতির মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। রাস্তাটা সরু, আর দুজনে এসেছে দু'দিক থেকে। বাঘ গর্জন করে বলল-- রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াও। দেখছো না, রাজা যাচ্ছে?
এমনিতেই হাতির চোখ ছোট। সেই ছোট চোখ কুঁচকে হাতি বলল-- তুমি আবার কবে থেকে রাজা হলে হে? একমাত্র সিংহকেই আমরা রাজা বলেমানি। ভালোয় ভালোয় রাস্তা থেকে নেমে দাঁড়াও। নইলে, এমন একটি আছাড় মারব, আর উঠে দাঁড়াতে হবে বাছাধনকে। রাজা সাজার কেরামতি বেরিয়ে যাবে চিরকালের মত।
  বাঘ কিন্তু এতে একটুও ঘাবড়ালো না। বলল-- তাহলে, আর কী? হয়ে যাক একটা হার-জিতের পরীক্ষা। যে জিতবে, সে অন্যকে মেরে খাবে। বলো, রাজি?
হাতি বলল-- আমারও কোন আপত্তি নাই। হয়ে যাক লড়াই।
বাঘ বলল-- ওই কথা রইল কিন্তু। যে হারবে, বিজয়ী তাকে মেরে খাবে। বলেই, বিকট এক গর্জন করে উঠল বাঘ। হয়েছে কী, সেসময়ই কয়েকটা শেয়াল যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। আচমকা বাঘের এমন গর্জনে, ভয়ের চোটে আঁতকে উঠে, মরেই গেল কয়েকটা শেয়াল।
   বাঘ হেসে বলল-- দেখলে তো, বাঘের ক্ষমতা? 
হাতির মাথা গরম হয়ে গেল। লম্বা আর মোটা শুঁড়খানা উঁচিয়ে, সেও বিশাল জোরে গর্জন করে উঠল। সারা বন পাহাড় সব যেন থরথর করে কেঁপে উঠল সেই শব্দে। কিন্তু মরল না কোন প্রাণী। 
বাঘ গর্বের হাসি হেসে, বলল-- প্রমান হল তো, কে বড়?
  হাতি চিরকাল ভালোমানুষ। সে বলল-- মেনে নিলাম, তুমিই জিতেছ। তবে, এখুনি মেরো না আমাকে। একটু সময় চাই আমার। বাড়িতে খবরটা জানিয়ে আসি। শেষবার দেখা করে আসি বউ-ছেলেমেয়ের সাথে।
বাঘ বলল-- কোনও আপত্তি নাই। 
দুজনে ঠিক করে নিল, ঠিক সাত দিন বাদে এখানেই এসে হাজির হবে দুজনে। সেদিন বাঘ হাতিকে মেরে খেতে পারবে।
  ঘরে ফিরে এল হাতি। মনে মনে ভারি মুষড়ে পড়েছে বেচারা। টানা পাঁচদিন বেরুলোই না ঘর থেকে। সে না থাকলে, কোথায় কীভাবে খাবার জোগাড় করতে হবে, কী ভাবে আপদ-বিপদ সামাল দিতে হবে, সব বুঝিয়ে বলতে লাগল বউকে। 
  ছ'দিনের দিন হাতি বেরুল ঘর থেকে। এতদিনের এই বন-পাহাড়। আর তো দেখা হবে না। শেষবারের মত আজ একবার ঘুরে দেখে নেওয়া যাক। মনের দুঃখ মনে চেপে, থপ থপ করে চলেছে হাতিটা।
এক খরগোশ দেখল হাতিকে। মন ভার কেন গজরাজের? চেহারায় ছোটটি হলে কী হবে? সবাই জানে, খরগোশ যেমন ভালোমানুষ, তেমনই বুদ্ধিমান। সে এগিয়ে এসে বলল-- কীগো, হয়েছেটা কী? মন খারাপ কেন?  
  হাতি তাকে সব কথা খুলে বলল। দুঃখের হাসি হেসে বলল-- কী কপাল করে যে বেরিয়েছিলাম সেদিন। অকালে জীবনটা দিতে হচ্ছে। আজকের দিনটা হাতে আছে কেবল। কাল সকাল হলেই আমার মরণ।
খরগোশ একটু ভেবে নিয়ে বলল-- রোস, রোস। অত ভেঙে পোড় না তো। দেখছি, কী করা যায়। 
একটু ভেবে খরগোশ বলল-- এক কাজ করো। কাল সরাসরি বাঘের কাছে চলে যেও না। এইখানটাতে এসো। তারপর যা করবার, আমি করবো। কাল সকালে, এক্কেবারে সূর্য উঠবে যখন, এইখানে এসে হাজির হবে কিন্তু।
  সারাদিন বসে বসে একটা ফন্দি আঁটল খরগোশ। ভোর না হতেই, শুধু পাড়াপড়শি নয়, বনের সবাইকে ডেকে জড়ো করল সে। বাদ গেল কেবল বাঘ আর হনুমান। বাঘকে তো বলার প্রশ্নই ওঠে না। আর, হনুমানের সাথে ভাব নাই খরগোশের। হনুমানগুলো যেমন বদমাস, তেমনি ফিচকে। 
  অনেকে এসে জড়ো হয়েছে। খরগোশ বলল-- একটা কাজ করে দিতে পারবে আমার জন্য? পরিষ্কার করে বলো।
  কেউ না করল না। আপদে বিপদে কত সাহায্য পাওয়া যায় খরগোশের কাছ থেকে। সবাই রাজি হয়ে গেল। 
খরগোশ বলল-- সবাই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যাও। মুখে ভয়ের ভাব করে, বনের ভিতর চারদিকে দৌড়ে বেড়াবে। আর চিৎকার করে বেড়াবে-- সাবধান, সামনে ভীষণ বিপদ। হাতিকে যুদ্ধে হারিয়ে, তার মাথা খুবলে ঘিলু খাচ্ছে খরগোশ। এবার আসছে বাঘকে মারবে বলে।
  কথাগুলো শুনলো সবাই। কিন্তু কারও মাথায় কিছু ঢুকল না। খরগোশ বলল-- পরে সব বুঝিয়ে বলব তোমাদের। এখন যা বললাম, তাই করো দেখি। দৌড়ে বেড়াও, আর চিৎকারটা করতে থাকো। তাতেই কাজ হয়ে যাবে।
সবাই তাই করতে লাগল। 
   চিৎকারটা বাঘেরও কানে গেল। বিশ্বাস হচ্ছে না তার। এমনটা আবার হতে পারে কখনও! একটা খরগোশ হাতি বা বাঘকে জিতে নিতে পারে নাকি? কিন্তু মনে একটা ভয়ও হচ্ছে। ভাবল, সাবধানের মার নাই।
   আশপাশের কয়েকটা প্রাণীকে জড়ো করে, বাঘ বলল-- কারা এমন করে চেঁচিয়ে বেড়াচ্ছে বল তো? হাতিকে তো আমি হারিয়েছি। একটু বাদে আসবে সে। আমিই খাবো হাতিকে। বিশ্বাস নাহয়, যে কেউ আসতে পারিস আমার সাথে। যে সাথে আসবে, সেও মাংসের ভাগ পাবে।
   কেউই রাজি হল না। বলল-- না বাপু, তোমাদের মারামারি খাওয়া-খাওয়ির মধ্যে আমরা নাই। তাছাড়া, মওকা পেলে, তুমিই কখন খেয়ে ফেলবে আমাদের, তার নাই ঠিক। আকাট মূর্খ ছাড়া, কে যাবে তোমার সাথে?
   কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে ভেবে, সবাই সরে পড়ল সেখান থেকে। গেল না কেবল একটা হনুমান। খরগোশ হাতিকে মেরে, এবার বাঘকে মারতে আসছে-- বিশ্বাসই হল না তার।
   গাছের ডাল থেকে নেমে, হনুমান এসে বাঘকে বলল-- চলো, আমি যাচ্ছি আমার সাথে।
হনুমানকে নিয়ে বাঘ এসে হাজির হল সেই জায়গায়। যেখানে হাতি এসে হাজির হওয়ার কথা। তখনো হাতি এসে পৌঁছয়নি। সাবধানের মার নাই-- এই ভেবে, দুজনে একটা ঝোপের আড়াল দেখে লুকিয়ে রইল।
খানিক বাদে আবার শোনা গেল সেই চিৎকার-- সাবধান, খরগোশ আসছে বাঘের খোঁজে। এখন চিৎকারটা যেন আরও কাছে। আরও জোর, আরও ভয়ার্ত। বাঘ আর হনুমান দুজনেরই বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। হনুমান ভাবল-- বাঘ যা ধুরন্ধর। বিপদ বুঝলে, আমাকে ফেলেই সটকে পড়বে। তখন আমাকেই বেঘোরে মরতে হবে। সে বাঘকে বলল-- একটা কাজ করি আসুন। দুজনের দুটো লম্বা লেজ আছে আমাদের। লেজদুটোকে ভালো করে গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখা যাক। তাহলে, বিপদের সময় ছাড়াছাড়ি হবে না।
   ঠিক এরকম ভাবনাই খেলা করছিল বাঘের মনে। এই হতচ্ছাড়া হনুমানকে বিশ্বাস নাই। বিপদ বুঝলে, বাঘকে ফেলে, এক লাফে সরে পড়বে ধূর্তটা। বাঘ বলল-- ঠিক বলেছিস। একতাই হল বল। বিপদের সময়ে একতাই হল শক্তি। সেসময় পাশাপাশি থাকতে হয়। কাছাকাছি  থাকতে হয়। 
 অতএব বেশ শক্ত করে দুটো লেজে গিঁট বেঁধে, হাতির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল দুজনে।
খানিক বাদেই হাতিকে দেখা গেল। ভারী মন্থর পায়ে এগিয়ে আসছে। তার পিঠের উপর বসে আছে একটা খরগোশ। 
  খরগোশ করেছে কী, হাতির মাথার উপর পুরো এক কাঁদি কলা চাপিয়ে নিয়ে এসেছে। একটা একটা কলা তুলছে আর কুচ কুচ করে চিবিয়ে খাচ্ছে। তা দেখে, বাঘও একটু থতমত খেয়ে গেল। 
খরগোশ চেঁচিয়ে বলল-- কোথায় বাঘ? হাতির ঘিলু খেয়ে খেয়ে মুখ ধরে গেল। এবার বাঘের ঘিলু চাই আমার। এখানেই তো থাকার কথা ছিল। কোথায় পালালো?
  এবার আর সন্দেহ নাই বাঘের। সত্যি সত্যিই মারা পড়তে হবে আজ। ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল বাঘটা।
  তা দেখে হনুমান বলল-- আচ্ছা বোকা তো। ওটা কি বাঘের ঘিলু নাকি? ওগুলো কলা। আমি তো রোজদিনই খাই। ভয় পাচ্ছ কেন?
যেই না হনুমান কথা বলেছে, অমনি দুজনকে দেখতে পেয়ে গেল খরগোশ। সে কটমট করে হনুমানের দিকে চেয়ে বলল-- আরে, হনুমান! এই তোর বুদ্ধি? তোকে বললাম একটা নাদুস-নুদুস দেখে যুবক বাঘ ধরে আনতে। তুই কি না কোথা থেকে এই হাড় জিরজিরে একটা বুড়ো বাঘকে ধরে এনেছিস। বোকার বেহদ্দ কোথাকার। আজ তোর একদিন, কি আমার একদিন। দাঁড়া, ব্যাটা। দেখাচ্ছি মজা।
   আর যায় কোথায়? আঁতকে উঠে, জোর এক লাফ লাগলো বাঘবাবাজী। দৌড় দৌড় দৌড়! পালাতে পারলে বাঁচে। দৌড়াচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে-- ওরে ব্যাটা হনুমান, এবার বুঝেছি, কেন আগ বাড়িয়ে আমার সাথে আসতে চেয়েছিলি। এবার বুঝেছি, কেন লেজে গিঁট বেঁধেছিলি। কেন হাতির ঘিলুকে কলা বলে আমাকে ভড়কে দিতে চাইছিলি। মনে মনে এত ফন্দি তোর।
   বাঘ অত চেঁচালে কী হবে? একটা কথাও কি আর হনুমানের কানে যাচ্ছে? বাঘের লেজে তার লেজ বাঁধা। বাঘ দৌড়চ্ছে, আর হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে পিছনে টানা হয়ে হয়ে চলেছে হনুমানের শরীরটা। কাঁটার খোঁচা খাচ্ছে। গাছে পাথরে ধাক্কা খাচ্ছে। সে একেবারে প্রাণ যায় যায় অবস্থা বেচারার।
   হনুমানের মুখখানার অবস্থা বলবার মত নয়। থেঁতলে, রক্তারক্তি হয়ে, ধুলো-কাদায় মাখামাখি।
এদিকে খরগোশ তো হেসে বাঁচে না। বুদ্ধু বানিয়ে দিতে পেরেছে বাঘকে। বাঁচাতে পেরেছে হাতিকে। 
অতটুকু পেট খরগোশের। কত আর খাবে? কলার কাঁদিটা ফেলে দিল নিচে। নিজেও নেমে পড়ল লাফ দিয়ে। হাতিকে বলল-- পেন্নাম হই, গজরাজ। প্রাণে বেঁচে গেছো এবারের মত। মনের আনন্দে কলার কাঁদিটা নিয়ে বউ-বাচ্চাদের কাছে বাড়ি ফিরে যাও। আর কখনও ঝমেলায় জড়িয়ো না।
  বাঘ আর হনুমান? সে আর বলবার মত নয়। কতদূর দৌড়েছিল বাঘ, মাপজোক করা হয়নি। এটুকুই জানা যায়, শেষমেষ একটা গাছে লেগে তাদের লেজের গিঁট খুলে গিয়েছিল। কিন্তু বাঘের দৌড় থামেনি তাতেও। সে যে কোথায় গিয়ে দম নিয়েছিল, সে কথা বাঘই জানে। 
  তবে, কাতরাতে কাতরাতে হনুমানটা কোন রকমে একটা গাছের ডালে উঠতে পেরেছিল। অনেক দিন লেগেছিল তার মুখের ঘা শুকোতে। মুখটার কী অবস্থা হয়েছিল, প্রথমে বুঝতেই পারেনি বেচারা। যেদিন জল খেতে গিয়েছিল নদীতে, জলে মুখের ছায়া দেখে আঁতকে উঠেছিল সে। সেই থেকে পোড়া মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় হনুমানের দল। 
  সেদিন থেকে ভয়ানক শত্রূতা বাঘ আর হনুমানের মধ্যে। বনের সব জীবকে শিকার করে খায় বাঘ। কেবল হনুমানকে পারে না। কারণ? সেই সুদূর অতীত কাল থেকে আজও, বাঘের কাছটিও ঘেঁষে না হনুমানের দল।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments