জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৪৬/শ্যামল জানা


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৪৬

শ্যামল জানা

সাররিয়েলিস্টদের দর্শন 

১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ফরাসি কবি, গীয়োম অ্যাপোলোনিয়ার ‘সাররিয়েলিজিম্’ মতবাদটিকে সৃষ্টি করে যে বৈল্পবিক ধারণার জন্ম দিলেন, তার উত্তরাধিকারের দাবী নিয়ে ১৯২৪ সালের অক্টোবরের মধ্যে পরস্পর-বিরোধী দুটি দল প্রকাশ্যে এল, এবং দুটি দলই তাদের নিজ নিজ পরাবাস্তব ইস্তাহারও(Surrealist Manifesto)প্রকাশ করল৷
এদের মধ্যে একটি দল ছিল অনেকটা কিউবিজম্, দাদাইজম্ ইত্যাদি পূর্বতন দর্শন ঘেঁষা৷ কারণ, এই দলের মধ্যে অনেকেই ছিলেন, যাঁরা ওইসব দলের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণভাবে যুক্ত ছিলেন৷ এই দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন— ইভান গল৷ আর, তাঁর সাথে অন্যান্য প্রধান সদস্য যাঁরা ছিলেন— পিয়েরে অ্যালবার্ত-বিরোত, পল দেরমি, সিলিনে আরনল্ড, ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, ত্রিস্তান জারা, গিউসেপ উনগারেত্তি, পিয়েরে রিভার্দি, মার্শেল আরল্যান্ড, যোসেপ দেল্তেইল, জাঁ পেনলেভ, রবার্ট ডিলুনে প্রমুখ৷

   আর একটি দল ছিল আধুনিকপন্থী৷ এঁদের সৃষ্টির মূল দর্শন ছিল অবচেতন মনের ক্রিয়া(Automatism)৷ এই দল বেশ স্পষ্ট করেই বলেছিল— সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সৃষ্টিকে যদি হাতিয়ার করতে হয়, তাহলে এই অটোম্যাটিজম্ই সবচেয়ে সেরা পদ্ধতি, যা অন্যান্য পুরাতন ইজম্, বিশেষ করে দাদাইজম্-এর থেকেও অবশ্যই অনেক বেশি কার্যকরী৷ স্পষ্টই বোঝা গেছিল, এই কথাগুলি বলা হয়েছিল তাদের বিরোধী দলের উদ্দেশ্যে৷ এই দলের নেতা ছিলেন— আন্দ্রে ব্রেতোঁ৷ এই দল সব দিক থেকেই একটু ভারি ছিল৷ কারণ, এই দলের সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা শুধু লেখক ছিলেন না, তাঁদের মধ্যে লেখক, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্রকার ও অন্যান্য মাধ্যমের শিল্পীরাও ছিলেন৷ আর, সংখ্যায়ও তাঁরা বেশি ছিলেন৷ যেমন— পল এলুয়ার, বেঞ্জামিন পিরে, রেনে ক্রেভেল, রবার্ট দেসঁস, জ্যাকুইস ব্যারন, ম্যাক্স মরিসে, পিয়েরে নাভিলে, রজার ভিত্রাক, গালা এলুয়ার, ম্যাক্স আর্নস্ট, সালভাদোর দালি, লুই বুনুয়েল, ম্যান রে, হান্স আর্প, জর্জেস মালকিনে, মিচেল লেইরিস, জর্জেস লিম্বোর, আন্তোনিন আর্তুদ, রেমন্ড কুইনেউ, আন্দ্রে ম্যাশঁ, হোয়ান মিরো, মার্শেল দুশাম্প, জ্যাকুয়েস প্রেভের্ত, ইভেস ট্যাঙ্গে, প্রমুখ৷

   এই দল সাররিয়েলিজম্ বলতে যেটা বোঝাতে চাইল, সেটা হল— তাঁদের যে প্রকাশভঙ্গি, সেটা কখনই জটিল বা বিমূর্ত হবে না৷ হবে সহজ-সরল৷ প্রকৃতিতে ঠিক যে রকমটা দেখা যায়, অর্থাৎ গাছটা গাছের মতো, মানুষটি মানুষের মতোই, তার চোখ মুখ হাত পা ঠিক যে রকম হয় সে রকমই৷ কিন্তু সেটি প্রকাশ করতে গিয়ে যে চিত্র বা অনুভূতির প্রয়োগ করা হবে বা সাজানো হবে(Arrangement), তাতে যেন কল্পনার পূর্ণ ব্যাপ্তি ঘটে৷ তবে, এখানে কল্পনা(Fantasy) বলতে কল্পনা বোঝানো হয়নি৷ এখানে কল্পনা মানে পরাবাস্তব(Surrealism)বলা হয়েছে৷ আপাতভাবে ফ্যান্টাসি আর সাররিয়েলিজম্-এর মধ্যে আমরা তফাৎ করতে পারি না৷ কিন্তু তফাৎ অনেকটাই৷ দুটোই মন থেকে ঘটলেও, জেগে থাকা অবস্থায় বা সচেতন অবস্থায় ঘটে কল্পনা(Fantasy) যা অবদমন থেকে আসে না, আর ঘুমের সময় স্বপ্নের মধ্যে অবচেতনে ঘটে পরাবাস্তবতা(Surrealism) যা অবদমন থেকে আসে৷ তাই, কল্পনায় যেটা ঘটে, তাকে পরিবর্তন (Modification) বলা হয়, আর পরাবাস্তবে যেটা ঘটে, তাকে রূপান্তর (Metamorphoses)বলা হয়৷ যেমন রূপকথার গল্পে আমরা কল্পনা ব্যবহার করি, পরাবাস্তব নয়৷ একটি ঘোড়ার পিঠে ডানা দিলে সে পরিবর্তিত হয়ে পক্ষিরাজ ঘোড়া হল বটে, কিন্তু তার কোনো রূপান্তর হল না, সে ঘোড়া ঘোড়াই থাকল৷ কিন্তু একটি ল্যাতপ্যাতে রুটিতে যখন ঘড়ির দুটো কাঁটা লাগানো হয়, তখন সে রূপান্তরিত হয়৷ রুটিও থাকে না, ঘড়িও থাকে না, এক তৃতীয় বাস্তবতা(পরাবাস্তবতা)তৈরি করে (ছবি-১)৷ 
  
   অর্থাৎ ব্রেতোঁ-র দল বোঝাতে চাইলেন— আমরা আমাদের সৃষ্টির মধ্যে যেগুলি ব্যবহার করব, সেগুলি প্রকৃতিতে যেমনটি থাকে তেমনই থাকবে৷ রুটিটা রুটির মতনই ল্যাতপ্যাতে ও গোল থাকবে, ঘড়ির কাঁটাদুটি যেরকম দেখতে সেরকমই থাকবে, কোনও অ্যাবস্ট্রাকশন থাকবে না৷ কিন্তু দুইয়ে মিলে রূপান্তরিত হয়ে এক তৃতীয় বাস্তবতা(পরাবাস্তবতা)তৈরি করবে, যেরকম ছবিতে দেখা যাচ্ছে৷ আর, এইভাবে সৃষ্টি করতে গেলে একজন সাররিয়েলিস্ট কবি বা শিল্পী, সৃষ্টির বিষয়কে সাজাবার জন্যে, তার যে অনুভূতির প্রয়োজন হয় তাকে আয়ত্ব করা অত্যন্ত কঠিন কাজ৷ এ জন্য তাকে কোনো এক দ্বান্দ্বিকতার দর্শনকে কাজে লাগাতে হবে৷ সেক্ষেত্রে তারা চিরাচরিত প্রাচীন দ্বান্দ্বিকতার দর্শনকে(Thesis, Antithesis, Synthesis)বাতিল করে হেগেল-এর দ্বান্দ্বিকতার(Hegelian Dialectic)দর্শনের সাহায্য নিয়েছিল( Abstract, Negative, Concrete)৷
শুধু তাইই নয়, পরবর্তীকালে কার্ল মার্কস হেগেল-এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে গিয়ে তাঁকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিলেন৷ সাররিয়েলিস্টরাও এক সময় হেগেলকে অতিক্রম করে কার্ল মার্কস-এর এই দ্বান্দ্বিকতার দর্শনকেই(Marxist dialectic)মান্যতা দিয়েছিল৷ কারণ, মার্কস এই দর্শনের সঙ্গে ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে(Historical materialism)যুক্ত করেছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন— মানুষের মগজ কোনো সময় থামে না৷ সারাক্ষণ তার প্রক্রিয়া চলে৷ প্রক্রিয়াটির নাম চিন্তা৷ এই চিন্তা থেকেই ধারণা(The Idea)তৈরি হয়৷ যা সামগ্রিকভাবে তো হয়ই, ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রেও ঘটে৷ মূলত অভিজ্ঞতার সঙ্গে চিন্তা জারিত হয়ে ধারণার জন্ম দেয়৷ আর, এই অভিজ্ঞতা মানুষ সঞ্চয় করে বহির্জগৎ থেকে৷ আর, পৃথিবী বলতে একমাত্র বহির্জগৎকেই বোঝায়৷ আর, বহির্জগৎ মানে অগুনতি বস্তুর সমন্বয়৷ এই বস্তুর জগৎটাই মানুষের মনে প্রতিফলিত হয়, এবং তা চিন্তায় পরিণত হয়৷ সংক্ষেপে এই হল মার্কস-এর দ্বান্দ্বিকতার দর্শন(Marxist dialectic) যা সাররিয়েলিস্টরা গ্রহণ করেছিল৷
এ তো গেল দর্শনের কথা৷ কিন্তু এই দর্শন অনুযায়ী সৃষ্টি করতে গেলে কাঁচামাল (Raw material) জোগান দেবে কে? এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড৷ তাঁর মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব (Psychoanalytic theory)৷                                 (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

3 Comments

  1. ৪৩ তম থেকে ৪৬ তম পর্যন্ত সব লেখাই পড়ছি। অনুধাবন করতে
    গিয়ে কত কিছুইচ্ছে যে জানছি,
    তা বলার না।
    পড়তে পড়তে ভাবছিলামনে এই
    কঠোর শ্রম সাধ্য প্রবন্ধ, যা ছবির
    জগতের হাজার দুয়ার খুলে পাঠক
    তথা উৎসাহীদের যে ভাবে আমন্ত্রণ
    করছে, তারা যদি এর মান্য দেন।তবে শ্যামলের এই অভিনব উদ্যোগ সার্থক ও সুন্দর হয়ে উঠবে।
    আমি চাই পাঠক,বুদ্ধিজীবন,শিল্পী
    মহলে সমাদৃত হোক। তারা ঋদ্ধ
    হোক।
    হার্দিক শুভেচ্ছা রইল।

    ReplyDelete
  2. বুদ্ধিজীবন (নয়)
    বুদ্ধিজীবী (হবে)

    ReplyDelete
  3. ভাবছিলামনে (নয়)
    ভাবছিলাম (হবে)

    কিছুইচ্ছে (নয়)
    কিছুই (হবে)

    ReplyDelete