জ্বলদর্চি

অথ মাস্ক থুড়ি মুখোশ কথা/প্রীতম সেনগুপ্ত

অথ মাস্ক থুড়ি মুখোশ কথা

প্রীতম সেনগুপ্ত 

এই তো কিছুদিন আগেই গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে। সেখানে আমার কুটির থেকে শুরু করে খোয়াইয়ের হাট, বোলপুর স্টেশনের ধারে হস্তশিল্পের শো রুম সর্বত্রই দেখা গেল বাহারি মাস্কের ছড়াছড়ি। শিল্পের ছোঁয়া লেগেছে মাস্কে। বিশেষত সব বয়সের মহিলাদের মধ্যেই ম্যাচিং মাস্ক পরার ধুম লেগেছে যেন। এর জন্য খরচ করতে কার্পণ্য করছেন না অনেকেই। এই ছবি এখন সারা বিশ্ব জুড়েই। আলাদা করে মাস্ক ও স্যানিটাইজারের বিপণন চোখে পড়ে  সর্বত্র। মাস্ক এখন জোরদার স্টাইল স্টেটমেন্ট হওয়ার পথে। করোনা থেকে রক্ষা পেতে অপরিহার্য সঙ্গী হিসেবে মাস্ককে মেনে নিতে হবে। আর সেটি বুঝেই মানুষ একান্ত আপন করে তুলতে চাইছে একে। 

    অভিজ্ঞতা বলছে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মাস্ক ব্যবহারে সুবিধা অসুবিধা দুইই আছে। না-কামানো দাড়ি আড়াল করতে, রেগে গিয়ে বা নিছকই অন্য কোনও কারণে কাউকে ভেঙচে দিতে এর জুড়ি নেই! একেবারে সামনাসামনি গলার ভল্যুম কমিয়ে অপছন্দের কাউকে নরম করে খিস্তি দিতেও মাস্ক পরম বিশ্বস্তজনের মতো পাশে থাকে। নস্ট্রাডামুসের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াবে বরাহমুখী মানুষ। সেই সময় বোধহয় এসে গেল। তবে মানুষ এই গ্রহের সবচেয়ে উন্নত ও বুদ্ধিমান জীব। বরাহমুখী হয়ে ঘুরতে ফিরতে সে পছন্দ করবে কেন? এখন পর্যন্ত তো অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে না, সুতরাং কোভিড থ্রি  লেয়ারড মাস্কের নিবিড় ও মনোযোগী সৌন্দর্যায়নে আপত্তি কোথায়? এখন পর্যন্ত ভাইরাস মুখ-নাককেই প্রবেশপথ হিসেবে নির্ধারিত করে ফুসফুসে গিয়ে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটাচ্ছে, একেবারে শেষ করে দিচ্ছে ফুসফুসের কার্যকারিতা। এই মুখাবরণ বা মুখাভরণের স্থায়িত্ব কতদিন অর্থাৎ আর কতকাল এগুলি ব্যবহার করতে হবে তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার অন্ত নেই। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এখনও বেশ কিছুদিন হয়তো একে সম্বল করেই চলতে হবে! বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতির উপর ভরসা রেখে এমন একটা কল্পনা করে নেওয়া খুব দোষাবহ হবে না যে মাস্কের বদলে মলম বা জেল হয়তো আবিষ্কৃত হল যা নাকে মুখে মেখে বের হলে ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না করোনা ভাইরাস!

    যত স্টাইলই মাস্ককে নিয়ে শুরু হোক না কেন, মাস্কবিহীন ফের কবে নিশ্চিন্তে ঘুরতে ফিরতে পারব তা নিয়েই এখন যত আক্ষেপ বিক্ষেপ। মাস্ক পরে গান গাওয়া যায় না, আবৃত্তি করা যায় না, পরম আবেশে ফুচকা খাওয়ারও দফা রফা-কত আর স্যানিটাইজার দিয়ে সামলানো যায়! সবচেয়ে বড় কথা বৃক্ষের আড়ালে ওই যে বসে থাকা প্রেমিক প্রেমিকা যুগল তারাও থমকে গিয়েছেন। ঘনিষ্ঠ জড়াজড়ি বসা সোস্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের হাড়িকাঠে মাথা গলিয়ে দিয়েছে। আর নিবিড় চুম্বন,  নৈব নৈব চ!! এখন ওপারে তুমি সখা এপারে আমি...। সতীনাথ-উৎপলা বেঁচে থাকুন। 

    কোভিডের ভাইরাসরোধী মাস্কের ধারণা থেকে একটু সরে এসে যদি ভাবা যায় তাহলে দেখা যাচ্ছে বাংলার নাট্য সংস্কৃতিতে মাস্ক থুড়ি মুখোশের ব্যবহার। এই প্রসঙ্গে বর্ষীয়ান নাট্য ব্যক্তিত্ব দেবেশ চক্রবর্তীর কথা স্মরণ করা যায়। তাঁর বয়স এখন ৯০।একসময় উৎপল দত্তের সঙ্গে ছিলেন। তাঁর পরিচালনায় 'তিতাস একটি নদীর নাম' নাটকে ঈশ্বরের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এছাড়া 'অঙ্গার', 'কল্লোল', 'মানুষের অধিকারে', 'ফেরারী ফৌজ' ইত্যাদি নাটকেও অভিনয় করেছিলেন। সেসব বহুদিন আগের কথা। উৎপল দত্তের নাট্যদল পরিত্যাগ করে নিজের দল তৈরি করেন--এপিক থিয়েটার। এই এপিক থিয়েটারের প্রযোজনায় কলকাতার শিশির মঞ্চে মঞ্চস্থ হয় ব্রেখটের 'সেন্ট জোন অফ দ্য স্টক ইয়ার্ডস' অবলম্বনে 'মালবাজারের মা মালতী '। ১৯৮২-৮৩ সালে। এখানে দেবেশ চক্রবর্তী শ্রমিক চরিত্রগুলিকে রেখেছিলেন মুখোশের আড়ালে। যেখানে মানুষকে পণ্য হিসাবে দেখা হয় সেক্ষেত্রে তার আলাদা কোনো পরিচয় থাকে না। শ্রমিক সেখানে উৎপাদনের অঙ্গমাত্র। ‌শোষণের শিকার। এই জরুরি কথা মনে রেখেই তিনি মুখোশকে নানা রঙে রঞ্জিত করলেন-- নানা রূপ দিলেন। হুবহু মানুষ নয়, খানিকটা আদিম আদিরূপ দিয়ে তাকে ভিন্ন করে দিলেন। চোখ কান নাক অন্যমাত্রায় চিহ্নিত করলেন। হয়তো মানুষ হতে চেয়েছিল তাঁরা, কিন্তু সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারছে না। এই বৈপ্লবিক ভাবনা থেকেই 'মালবাজারের মা মালতী ' নাট্য প্রযোজনা। কোভিডের মাস্ক একইভাবে যেন একটি সর্বজনীনতায় বেঁধে দিয়েছে। বিশ্ব নাগরিকের সামনে এক বড় যুদ্ধ --কোভিড যুদ্ধ। হাতিয়ার হয়ে উঠেছে মাস্ক, সিম্বলও।পুরনো বাতাস,  পুরনো আলোয় ফেরার লড়াই। নাটকের মতো একটি পারফর্মিং আর্টে মুখোশ ব্যবহারের ইতিহাস অতি প্রাচীন। মিশর, ইতালি, চিন, জাপান এবং গ্রিসে মুখোশের ব্যবহার নাটককে সমৃদ্ধ করেছে। তবে শ্রেষ্ঠ মুখোশের ব্যবহার হয়েছে গ্রিসে এসকাইলাসের নাটকে। সেই মুখোশ ছিল কাঠের তৈরি,মুখোশকে স্থায়ীভাবে অনেকদিন ব্যবহারের জন্য। খ্রিস্টপূর্ব সময়ে এসকাইলাসের মুখোশ সমৃদ্ধ নাট্য প্রযোজনা আমাদের মুগ্ধ করে। 

   আসলে কোভিডের এই মারণবেলায় মাস্ক পরিহিত স্যানিটাইজার ধৌত আমরাও এক অদ্ভুত পারফর্মিং আর্টের অংশীদারি হয়ে পড়েছি। জীবনই তো সবচেয়ে বড় পারফর্মিং আর্টের বাস্তুভিটে!

আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments