জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা― (সপ্তম পর্ব)/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ২৬

মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা― (সপ্তম পর্ব)

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


মাঠ ভর্তি যেন কচি সবুজ ঘাসের চাদর বিছানো। নরম, মোলায়েম। স্থানে স্থানে ঘাসফুল ফুটেছে। কবাডী, হাডুডু, সীতাহরণ, ডাংগুলি খেলছে একদল ছেলে। শেষ বিকেলের সোনালী আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে স্কুলমাঠ। মাঠে তখন হরেকরকম কীটপতঙ্গ, ঘাসফড়িং, গঙ্গাফড়িং, প্রজাপতির খেলা। রক্তিম আকাশে ডানা মেলে পাখিরা উড়ছে। মাঠের থেকে ফিরে আসছে চাষার দল। শেষ বেলায় দল বেঁধে ঘরে ফিরছে সকলে। মাঠের পশ্চিমে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দির, উত্তর-দক্ষিণ বরাবর। প্রবহমান কাল ধরে শিক্ষা-সংষ্কৃতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। তার ছায়া পড়েছে খেলার মাঠে। বিকেল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিল্ডিং-এর অবয়ব ছাড়িয়ে ক্রমশ বড় হচ্ছে সে-ছায়া। ছায়ার করাল গ্রাসে মুড়ে যাচ্ছে পুরো ময়দান। একসময় অন্তর্হিত হয় সূর্যদেব আর তার লালচে আলো। তখন একদল ছেলে খেলা থামিয়ে হল্লা শুরু করে টিউবওয়েলের চারপাশে। বাকিরা পুকুর ঘাটে ভীড় করে। ময়দানের দক্ষিণে বিশাল এক পুস্করিণী। তার পরিস্কার জলে স্নান, হাত-মুখ-পা ধোয় সবাই। তখন ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুঁতির ধূম পড়ে যায়। কে আগে পা হাত মুখ ধোবে―এটা একটা চ্যালেঞ্জ! সবার লক্ষ্য এক― প্রথম, সবার প্রথম সারবে কাজ। এ ক্লাসরুম নয়, তাই দ্বিতীয় হতে চায় নয় কেউ। ইত্যবসরে সবাই মিলে ক্ষেপায় একদল হে ছেলেকে। তা-দেখে বাকিরা বেশ মজা নেয়। ইন্ধন জোগায় দুপক্ষে। টিউবওয়েলের সামনেটায় সেজন্য বেশ ভীড়। নিরীহ গোবেচারা যারা; একসঙ্গে সবাই মিলে জড়ো হয়ে শব্দ করে, হাসে, ভেংচি কাটে, ক্ষেপায়। একসময় যে-যার পা-হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে যায় হোস্টেলে। এটাই রোজনামচা। কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হবে প্রার্থনা সংগীত। গ্রাম্য-সন্ধ্যা নামবে দ্রুত। তারপর খাঁ খাঁ করবে এই মাঠ। 

  অঘ্রাণ পেরিয়ে সবে পৌষ পড়েছে। নভেম্বরের শুরু এটা।পূজার মরশুম সবে সমাপ্ত হয়েছে। তবুও আকাশে-বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ একদম ফুরিয়ে যায়নি। এরই মধ্যে বাতাসে বেশ খানিকটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। হিমের পরশ লেগেছে। শহরের চেয়ে গ্রামে একটু তাড়াতাড়ি শীত পড়ে যায়―এ তো জানা কথা। গ্রামের খাঁটি বাতাস দূষণমুক্ত, নির্মল। বিশুদ্ধতা মাপকাঠি হলে পল্লীগ্রামের পবনের চাইতে বেশি স্বাস্থ্যকর হাওয়া আর কোত্থাও নেই। সেজন্য এসময় ঘাসের ডগায় শিশির জমতে শুরু করে সূর্য থাকতে থাকতেই। এখন সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টা হবে বোধহয়। কোজাগরী চাঁদ লুকোচুরি খেলা খেলছে নীলিমায়। এই হয়তো মেঘের অন্তরালে লুকিয়ে পড়ে, পরক্ষণেই আবার হাসি মুখে উদয় হয়। বিল্ডিং-এর দক্ষিণপার্শ্বে হোস্টেল থেকে ছেলেদের পড়ার রব ভেসে আসে। ছোটবেলায় মাথা দুলিয়ে একটানা সুর করে পড়াশোনার চল আজও অটুট। প্রবহমান এ ধারা এত সহজে বন্ধ হবার নয়। কারণ এ চিরন্তন। এর ব্যতিক্রম নয় অধিকাংশের শৈশব। 

  মাঠের পুবদিকে বিশালাকার ড্রেন। ড্রেনের ওপাশে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। তারপর হেডমাস্টার শ্রীনিবাস নন্দ স্যারের বাড়ি। মাঠের দক্ষিণে পুকুর পাড়গুলোয় আম, নিম, অর্জুন, তেঁতুল, জাম, কেঁও প্রভৃতি গাছের বাগান। বাগান তো নয়, যেন আস্ত একখানা জঙ্গল! সন্ধ্যা নামতেই ঘণ আঁধারে ডুবে গেছে সবকিছু। একটু আগে গোধূলি আলোয় সেখানে একঝাঁক পাখির কিচিরমিচির কলরবে কান পাতা দায় হচ্ছিল। এখন কেমন শান্ত, নিস্তব্ধ। গা ছমছমে দৃশ্য। অন্ধকারে সেদিকে তাকালে গাছের কালো ছায়াগুলোর সঙ্গে অনেক ভৌতিক চেহারার সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। রাত্রির অন্ধকারে সেজন্য কোনও ছেলে সচরাচর পুকুর মুখো হয় না। নিতান্তই প্রয়োজন বিনা। গাছের পাতায় রূপালী জ্যোৎস্নার আলো পড়ে চারপাশে কেমন মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে। পুকুরের জলে চাঁদের আলো কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে। প্রকৃতিকে ভালো বাসলে আর মনে একটু সাহস সঞ্চয় করলে এমন পরিবেশে সবার ভেতরে কবিত্ব জাগ্রত হতে কতক্ষণ? আসলে জ্যোৎস্নালোকিত চরাচর নিজেকে নতুন করে চিনতে শেখায়। নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গুণগুলি তখন প্রকট হয়। ভেতর থেকে চকাৎ করে বেরিয়ে পড়ে ইচ্ছেরা; যেমন নিশুতি রাতে নির্দ্বিধায় বেরিয়ে আসে ভূতপেত্নীর দল। নিজেকে খুব রোমান্টিক লাগে তখন। প্রেমময় হয়ে ওঠে মন।
      
  মাস্টার মশাই শ্রী মণীন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ি একজন বিশুদ্ধ প্রকৃতি-প্রেমী রোমান্টিক মানুষ। প্রকৃতি-প্রেম তাঁর মজ্জায়। রোমান্টিক প্রকৃতির নির্যাস চেটেপুটে উপভোগ করার লোভ সম্বরণ করতে পারেন না তিনি। অন্ধকারের গহীন অরণ্যে আকাশের নিসর্গ রূপ চাক্ষুষ করার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। গাছপালা খুব ভালোবাসেন তিনি। তাঁর থাকার কক্ষ তথা ল্যাবরেটরি রুমের সামনে শখ করে তিনি একখান বকুল গাছের চারা লাগিয়েছেন। ডালপালা ছড়িয়ে সে-বকুল এখন ছোট বৃক্ষে পরিনত হয়েছে। কিন্তু এখনও ফুল আসেনি। তবুও মন অন্যরকম প্রসন্নে আচ্ছন্ন আজ। কণ্ঠ বেয়ে সুর নেমে আসে। খোলা মাঠে হারমোনিয়ামের রিডে সুর তোলার চেয়ে আর কী সুখ আছে তাঁর জীবনে! কণ্ঠ থেকে তখন সড়সড় বেরিয়ে পড়ে অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, নজরুল আর রবীন্দ্রনাথ। সবসময়ের শ্রোতা সাকুল্যে জনাকয়েক সমবয়সী বন্ধুবান্ধব― সাউরি'র শ্রী বঙ্কিম বিহারী মাইতি, শ্রী চিত্তরঞ্জন দাস, শ্রী নারায়ণ চন্দ্র মাইতি, শ্রী অশোক ভৌমিক প্রমুখ। প্রত্যেকে নিজ গুণে খ্যাত। 

  বাড়ি এলে বৈজ্ঞানিক নারায়ণ চন্দ্র রানাও হাজির থাকেন সাহিত্যের সেই আড্ডায়। চুপচাপ মন দিয়ে শোনেন প্রিয় স্যারের গাওয়া গানগুলি। শিষ্য নারায়ণের সঙ্গে লাহিড়ী স্যারের কথা হত মহাকাশ নিয়ে। ১৯৮৫ সালে ইংল্যান্ড থেকে কেনা দশ ইঞ্চি ব্যাসের টেলিস্কোপ নিয়ে। সেটি কীভাবে সেট করতে হয়, কারও জানা ছিল না। দীর্ঘদিন যন্ত্রটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে ছিল, বস্তা বন্দি হয়ে। ১৯৮৬ সালে স্কাই ওয়াচ অ্যাসোসিয়েসন (Sky Watch Association)-এর লোকজন এল কলকাতা থেকে। তারাই সেট করে সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে গেছে। আধুনিক টেলিস্কোপে কীভাবে দেখতে হবে আকাশ? ফলে আগের থেকে আরও পরিস্কার দেখা যাচ্ছে আকাশ। কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। এতে যারপরনাই আনন্দিত সাউরি অঞ্চলের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

  সেটা ছিল ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাস। দুর্গাপূজা, কালীপূজার পরে। একদিন সেরকমই এক ঘরোয়া গানের আসর বসেছে স্কুলের মাঠে। ভর সন্ধ্যা বেলায়। ক'দিন ধরে গলা খুসখুস করছে মণিবাবুর। ভেবেছেন, হঠাৎ ঠাণ্ডা পড়ায় হয়তো গলা সামান্য ধরেছে। লবন দিয়ে গরম জলের গার্গল করলে গলা ধরা ঠিক ছেড়ে যাবে। আজ ধরা গলায় গান গাইতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। তাই গান গাইছেন সাউরি'র বিশিষ্ট সমাজসেবী শিক্ষক নারায়ণবাবু, বন্ধুবর নারায়ণ চন্দ্র মাইতি। মন দিয়ে শুনছেন মণিবাবু ও বাকিরা। আড্ডা তখনও শেষ হয়নি, মণিবাবু হঠাৎ কী ভেবে আসর ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাঁটা দিলেন সোজা হোস্টেল অভিমুখে। সেদিনটা ছিল সম্ভবত অমাবস্যার সন্ধ্যা। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দৃষ্টির সম্মুখে শুধু নিকষ কালো। কিছুই ঠাহর হচ্ছে না অন্ধকারে। সেই ঘন অন্ধকারের ভেতর হনহন হাঁটা শুরু করেছেন মণীবাবু। আসলে প্রতিটি ঘাস-ইঁট-পাথর, মায় লম্বা করিডোরকে তিনি ভালো মতো চেনেন, জানেন। কিন্তু সেদিন তিনি যেই না মাঠের পশ্চিম ধারে স্কুল বিল্ডিংয়ের নিকট পৌঁছেছেন, অমনি হঠাৎ করে এক সাংঘাতিক বিপদ ঘটে গেল। মাঠের ধারে আঁধারের মধ্যে চরে বেড়াচ্ছিল একখানা ষাঁড়। গায়ে দেবাদিদেব শিবের ত্রিশূলের ছাপ আঁকা আপাত নিরীহ ষাঁড়। মাথার দুপাশে লম্বা দুটি শিং তার। আর গতরে বেজায় ক্ষমতা। ঘন অন্ধকারে যে-মূহুর্তে মণিবাবু ষাঁড়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন অজান্তে; মণিবাবুকে তীব্র জোরে গুঁতো মারে ষাঁড়টি। ষাঁড়ের গুঁতো খেয়ে তৎক্ষণাৎ মাটিতে পড়ে যান তিনি। পড়ে গিয়ে যন্ত্রণায় চিৎকার শুরু করে দেন। ঘটনার আকষ্মিকতায় অবাক তাঁর সঙ্গীসাথীরা। সবাই ছুটে আসেন মাঠের মধ্যিখান থেকে। ততক্ষণে ষাঁড় বাবাজী রণে ভঙ্গ দিয়েছে। সে-স্থান ছেড়ে পলায়ন করেছে। সকলে মিলে ধরে ভূপতিত মণিবাবুকে শূন্যে তুলে হোস্টেলে তাঁর কক্ষ পর্যন্ত নিয়ে আসেন। জনশ্রুতি এই যে, এই ঘটনার পর থেকে মণিবাবুর শরীর দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেদিনই ডাক্তার এল। এসে দেখে গেল তাঁর অ্যাক্সিডেন্ট কত বড়। খচখচ করে প্রেসক্রিপশন ভর্তি গাদাগুচ্ছের ঔষধ পত্তর লিখে বিদায় নিল ডাক্তার। ঔষধপত্র খেয়ে কোনও সুরাহা হচ্ছে না গত এক সপ্তাহ কাল। আগেও যেমন অবস্থা ছিল, সাতদিন পরেও একই বেহাল দশা। শরীরের উন্নতি একফোঁটা নেই। এক্স-রে'তেও কোন কিছু লক্ষণ নজরে পড়ছে না। গলা ধরা, গলা খুসখুস ইত্যাদি উপসর্গ পূর্বের মতো বহাল তবিয়তে রয়েছে।

  অবস্থা বেগতিক দেখে সাতদিন পর অসুস্থ শরীরে কলকাতার বাড়িতে চলে এলেন মণিবাবু। কলকাতায় এসে কলেজ পড়ুয়া ভাইপো গোপালকে ডেকে তাঁর গোপন আশঙ্কার কথাটা বলেই ফেললেন―
'আমার মোটেও ভালো ঠেকছে না গোপাল। খালি মনে হচ্ছে, এ ক্যানসার। এত্ত সব উপসর্গ! এ ক্যানসার না হয়ে যায় না!'
  আর বিলম্ব নয়, ভাইপোকে সঙ্গে করে চললেন ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হসপিটাল। কলকাতার এ হেন ক্যানসার হাসপাতালটি ১৯৭৩ সালে স্থাপিত হয়েছে। ফাউন্ডার বিশিষ্ট ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শ্রী সরোজ গুপ্ত। বেশ নামকরা ডাক্তার। সেখানে এক্স-রে'তে ফুসফুসের মধ্যে একটি সিস্ট ধরা পড়ল। তাঁর আশঙ্কা সত্যি হল। ডাক্তার গুপ্তের জহুরী চোখ চিনে নিতে ভুল করল না। এ মারণ রোগ। দুরারোগ্য ক্যানসার। যার পুরোদস্তুর চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। সুষ্ঠু চিকিৎসা নেই এ রোগের। সঠিক ঔষধ আবিষ্কার সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা নেই কারও। প্রথম স্টেজে রোগ ধরা পড়লে বাঁচবার সম্ভাবনা খুব বেশি হলে ফিফটি-ফিফটি। অন্তিম দশায় সে-সম্ভাবনাও গুড়েবালি। বাঁচার তেমন নজির নেই। চিকিৎসা বলতে নিয়মিত কেমোথেরাপি। কেমোথেরাপির সব ক'টা ডোজ সম্পূর্ণ করলে একটা আশার আলো জ্বলে ওঠে। সুস্থ হয়ে ওঠে রুগী। সেরকম সম্ভাবনার কথা শোনালেন ডক্টর সরোজ গুপ্ত। এখনও এত ঘাবড়ানোর কিছু হয়নি। অভয় দিলেন তিনি। যদিও তারাখসা রাত্রির ঘোর যুদ্ধফল বুঝে নিতে অসুবিধা হল না। ডাক্তার দেখিয়ে হুগলির গুড়াপে ফিরে এলেন মণি স্যার। 'আশায় মরে চাষা'―মার্কা প্রবাদবাক্য স্মরণ করে গুড়াপ থেকে নিয়মিত ঠাকুরপুকুর যেতেন তিনি, কেমোথেরাপির নির্দিষ্ট ডোজ নিতে। কেমো নেওয়ার সাইড-এফেক্ট খুব বেশি। যেদিন কেমোথেরাপি চলত, তারপর খুব বমি হত। বমি করতে করতে প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়।

  কেমোথেরাপির এত ধকল সহ্য হল না তাঁর। শরীর স্বাস্থ্য দিনকে দিন ভেঙে পড়ল। ধীরে ধীরে রুগ্ন হতে থাকলেন। হাঁটাচলার শক্তি ফুরোল। এখন প্রায় শয্যাশায়ী। গলার স্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হচ্ছে। ১৯৯০ সালের শেষের দিকে কথা বলার ন্যূনতম শক্তিটাও চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। যেন শেষের সে-দিন সমাগত প্রায়। প্রদীপের সলতে টুকু জ্বলে চলছে, এই যা! এসময় সাউরি থেকে অনেকে গুড়াপে আসতেন। প্রিয় স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হেতু।

  তেমনি একজন সাউরির বাসিন্দা দীনেশ চৌধুরী ওরফে নাথু। সাউরি ভোলানাথ বিদ্যায়তনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় ভোলানাথ চৌধুরীর নাতি দীনেশ। দীর্ঘদিন তিনি গুড়াপে ছিলেন। স্যারের সেবার সব কঠিন দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। একদিন সাউরি থেকে গুড়াপে পৌঁছলেন শ্রী অশোক ভৌমিক। তখনও মৃদু স্বরে কথা বলেন মণীন্দ্র স্যার। স্যারকে উদ্দেশ্য করে শ্রী অশোক ভৌমিক বললেন―
'আপনার লাগানো বকুল গাছে ফুল ধরেছে স্যার।'
সাময়িক খুশিতে স্যারের মুখ-চোখ চকচক করে উঠল। দীনেশকে শুনিয়ে তিনি তাঁর খুশি ব্যক্ত করলেন―
'দেখলে নাথু। একেই বলে জহুরী চোখ। সাউরি থেকে অনেকেই দেখা করতে এসেছে। অনেক কথা বলেছে। আমার বকুল গাছে ফুল ফুটেছে― একথা কিন্তু কেউ আগে বলেনি। হয়তো সামান্য ঘটনা, তবুও কথাটা আজ অন্যরকম প্রশান্তি বয়ে আনল হৃদয়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে স্কুল বিল্ডিং, খেলার মাঠ, পুস্করিণী, বকুল গাছ, স্কুলের মাঠে আকাশ দেখা, আরও কত কী! আহা, কী অনির্বচনীয় শিহরণ খেলে গেল শরীরে; বলে বোঝানো যাবে না রে নাথু!' রোগশয্যায় চোখ বন্ধ করে যেন স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
   
  কোনও এক সময়, সম্ভবত ১৯৯০-এর শেষে হুগলির গুড়াপে হাজির হলেন লাহিড়ী স্যারের সবচাইতে প্রিয় ছাত্র বৈজ্ঞানিক নারায়ণ চন্দ্র রানা। টি এফ আই আর-এ তাঁর গবেষণার সমস্ত কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন অসুস্থ মাস্টার মশায়ের সেবা শুশ্রূষা করতে। লাহিড়ী পরিবারের সঙ্গে এক বিশেষ হৃদ্যতার সম্পর্ক তাঁর। সকলেই খুব ভালোবাসে তাঁকে। তাঁর কাছে এটি দ্বিতীয় বাড়ির সমান। সকলের সঙ্গে এতটা টান! বাড়ির ছোটদের সঙ্গে বেশ খোশগল্পে কেটে যায় সারাটা দিন। ছোট বড় সকলেই খুব সমীহ, স্নেহ করে তাঁকে। তাঁর নিজের শরীর খুব একটা ভালো না। দুবার পেসমেকার বসেছে। তবুও দিনরাত এক করে স্যারের সেবায় নিযুক্ত রইলেন এক সপ্তাহ কাল। গুড়াপে সাতদিন অতিবাহিত করে ফিরে গেলেন। ফেরার সময় বাঁ চোখ নেচে উঠল প্রিয় ছাত্রের। অনবরত কু ডাকছে অন্তরে। জ্যোতিষবিদ্যার আলোয় সে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ঘোর যুদ্ধফল। খুব বেশি দিন দীর্ঘায়িত হবে না এ অসম লড়াই। নিয়তির অভিশাপে যেন সময়ের আগেই হেরে যাচ্ছেন তাঁর প্রিয় মাস্টার মশাই। পরাজয়ের বিষাদ শঙ্খ ধ্বণিত হচ্ছে দূর নীলিমায়। মনটা ডুকরে কেঁদে উঠল তাঁর। তিনি নিরূপায়। প্রিয় মাস্টার মশায়ের মৃত্যু প্রতিরোধের ক্ষমতা তাঁর সাধ্যাতীত। কুরুক্ষেত্রের পুণ্য যুদ্ধভূমিতে যেরূপ নিরূপায় হয়ে গুরু দ্রোণ-এর মৃত্যুর প্রহর গুনছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন, এখানে প্রেক্ষিত আলাদা হলেও ততোধিক নিরূপায় লাহিড়ী স্যারের প্রিয় শিষ্য নারায়ণ। তাঁর সমস্ত আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসের পাঁচ তারিখে নিভে গেল প্রদীপের শেষ সলতেটুকু। অমৃতলোকে পাড়ি দিলেন বিজ্ঞানের জনপ্রিয় শিক্ষক শ্রী মণীন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ী। বড় ক্ষতি হয়ে গেল সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরের। তাঁর অনেক স্বপ্ন, প্রোজেক্ট অধুরা থেকে গেল। অধরা থেকে গেল পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে সাউরি'র সুখ্যাতির শিখরে পৌঁছানোর স্বপ্ন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদে শোকের ছায়া নেমে এল সাউরি'তে। শোকে মূহ্যমান আবালবৃদ্ধবনিতা। আকাশ চেনানোর মানুষটি আজ নিজে আকাশের বাসিন্দা হয়ে গেলেন। হারিয়ে গেলেন লক্ষ কোটি তারকার ভীড়ে। মহাকাশে মিশে গিয়ে হয়তো চাক্ষুষ করছেন তাঁর সাধের স্কুল আর স্কুলের মাঠকে। তাঁর প্রিয় টেলিস্কোপটিকে।

(দুই)
টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে তাঁর সফর আপাতত শেষ। ড. নারায়ণ চন্দ্র রানার গন্তব্য এবার পুনে, মহারাষ্ট্র। পুনে ইউনিভার্সিটির বিস্তীর্ণ পরিধির ক্যাম্পাসের ভেতরে রয়েছে একটি স্বশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (Inter-University Centre for Astronomy and Astrophysics)। সংক্ষিপ্ত নাম IUCAA। এটির অবস্থান ন্যাশনাল সেন্টার ফর রেডিও অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বিল্ডিং-এর পরে। জায়ান্ট মিটারওয়েভ রেডিও টেলিস্কোপ (Giant Metrewave Radio Telescope) তৈরির পর অ্যাস্ট্রোনমি আর অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বিষয়ে স্বতন্ত্র গবেষণার সুযোগ সুবিধার কথা মাথায় রেখে ভারতের প্ল্যানিং কমিশন একটি পৃথক প্রতিষ্ঠান স্থাপনার গুরুত্ব অনুভব করেছিল। তারই ফলশ্রুতি IUCAA প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠান সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে অবতীর্ণ হলেন একঝাঁক পণ্ডিত। তাঁদের অন্যতম অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট প্রফেসর জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার।

  ১৯৮৮ সালে মূলত প্রফেসর নারলিকার-এর শুভ প্রচেষ্টায় এটা স্থাপিত হয়েছে। সে-থেকে প্রফেসর নারলিকার এই প্রতিষ্ঠানের ফাউন্ডার-ডিরেক্টরের পদ অলংকৃত করছেন। শুধু প্রতিষ্ঠান স্থাপনা করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বর্তায় আরও গুরু দায়িত্ব। প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে প্রয়োজন একঝাঁক গুণী প্রশাসক। গবেষণা-কাম-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পণ্ডিত গবেষক-শিক্ষকের দরকার। যাদের নিরলস প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠানের মুকুটে কৃতিত্বের, সফলতার নূতন নূতন পালক সংযোজিত হবে। উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে।

  তো, প্রফেসর নারলিকার-এর নজর পড়ল তাঁর এককালের প্রিয় ছাত্র বৈজ্ঞানিক নারায়ণ চন্দ্র রানা'র উপর। ড. রানা তখন মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের স্বনামধন্য গবেষক-অধ্যাপক। মহাকাশ বিজ্ঞানে তাঁর গবেষণায় মুগ্ধ দেশবিদেশের তাবড় তাবড় পণ্ডিত। জগদ্বিখ্যাত এ হেন ছাত্রকে তিনি আমন্ত্রণ করলেন IUCAA-তে। মাস্টার মশায়ের সে-ডাক উপেক্ষা করতে পারলেন না ড. রানা। সেটা ছিল ১৯৯১ সাল। আমন্ত্রণ স্বীকার করলেন তিনি। সেবছর এপ্রিল মাসে TIFR ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চলে এলেন IUCAA-তে। পুনের IUCAA-তে যোগ দিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসাবে। মাইনে ছিল বার্ষিক ৭৯,০০০ টাকা। অথচ এসময় আমেরিকা থেকেও তাঁর কাছে অধ্যাপনার সুযোগ ও আহ্বান আসে। তখন আমেরিকায় তাঁর মাইনে হত ভারতীয় মুদ্রায় মাসে আড়াই লাখ টাকা প্রায়। কিন্তু অর্থের প্রতি লোভ তাঁর কোনদিনই ছিল না। তিনি সর্বদা নিজের পড়াশুনা আর শিক্ষাদানের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে নিজেকে বন্দি করে রাখতে পেরেছিলেন। সেজন্য বিরল প্রতিভাধর এই মানুষটি হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বিদেশি প্রস্তাবনা। স্বদেশে গবেষণাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। দেশের মধ্যে অধ্যাপনা করাই তাঁর স্বপ্ন। দেশের বিদ্যার্থীদের পাঠদানের মধ্যে পরম তৃপ্তি খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। সেজন্য IUCAA-তে পাকাপাকি থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁর। পাঁচ বছর পর এখানে তাঁর পদোন্নতি হয়। ১৯৯৬ সালে 'অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অফ রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি এবং অ্যাস্ট্রোফিজিক্স' বনে যান তিনি। তখন তাঁর মাইনে ছিল বছরে ১,২০,০০০ টাকা।
      
  পুনে এসে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার সুবর্ণ  সুযোগ এসে গেল বৈজ্ঞানিকের কাছে। তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিল সুন্দর একখানা কোয়ার্টার। আর ছিল বিশাল লাইব্রেরি ও নির্মল পরিবেশ। কোয়ার্টার-এর দেওয়ালে শোভা পেত দেবদেবীর ফটো। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, জগৎ জননী সারদাময়ী দেবী আর স্বামী বিবেকানন্দের সুন্দর বাঁধানো ফ্রেমে প্রতিদিনই শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতেন তিনি। IUCAA-তে থাকাকালে অসুস্থ শরীরের জন্য খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারতেন না। বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে ন'টা―দশটা বেজে যেত তাঁর। ঘুম ভেঙে উঠে স্নান সেরে নিতেন। স্নানের পর স্তোত্রাদি পাঠ করে আহ্নিকে বসতেন। কেননা, তিনি বেলুড় মঠের অধ্যক্ষ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজের নিকট রামকৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। 

  এরপর সাড়ে দশটায় সকালের জলখাবার ডিম-রুটি খেতেন। এত দেরিতে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার জন্য দুপুরে ক্ষিদে পেত না। দুপুরের আহার সারতে সারতে তিনটা―সাড়ে তিনটা বেজে যেত। এদিকে সারাদিন তাঁর কোয়ার্টারে ভীড় লেগে থাকে। দিনভর ভিজিটর আসতে থাকে। ছাত্রছাত্রী, সংসারে অভাবী লোক থেকে সাংবাদিক― কেউ বাকি থাকত না। তাঁর গবেষণার সুবিধার জন্য দুখানা সর্বাধুনিক পার্সোনাল কম্পিউটার (PC) কিনেছিলেন তিনি। এছাড়াও অফিসের পার্সোনাল কম্পিউটার তাঁর শোবার ঘরে বিরাজ করত। এমন পরিবেশ ভালো গবেষণায় ইন্ধন জোগায়, উদ্বুদ্ধ করে। সেজন্য এই পরিবেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন না তিনি।

  পুনে ইউনিভার্সিটি-তে তিনি মাস্টার ডিগ্রি (M.Sc.)-র ক্লাস নিতেন। একজন ভালো শিক্ষকের সমস্ত গুণ তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর অপূর্ব পঠনশৈলীর নৈপুণ্যে ছাত্রছাত্রীর কাছে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর ক্লাসে কোনও ছাত্রছাত্রী অনুপস্থিত থাকত না। ছাত্রছাত্রীদের খুব ভালো বাসতেন। বন্ধুর মতো তাদের সঙ্গে মিশতেন। অনেক দুস্থ ছাত্রছাত্রীর আর্থিক সমস্যার তিনিই একমাত্র সমাধান। পুনের বেশ কয়েকটি পরিবারকে ভেসে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন তিনি। অসংখ্য বিকলাঙ্গ শিশুর প্রতি তাঁর স্নেহ-ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। বিকলাঙ্গ শিশুর বিকলতা নিয়ে কেউ হাসি ঠাট্টা কিংবা অবজ্ঞা করলে অসম্ভব রেগে যেতেন তিনি। রীতিমতো তর্ক জুড়ে দিতেন। হার স্বীকার করতেন না। শারীরিকভাবে অক্ষম শিশুর পক্ষ অবলম্বন করে সামাজিক প্রয়োজনীয়তার কথা আওড়াতেন। তাঁর জোরালো প্রতিবাদী ভাষায় রণে ভঙ্গ দিত দুর্বল প্রতিপক্ষ।

  ড. রানা'র ব্যক্তিত্বের প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী। সৎ আর নিষ্ঠাবান ভালো বিদ্যার্থীদের পাশাপাশি দু-একজন অসৎ ছাত্র ছিল যাদের তিনি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সৎ পথে নিয়ে আসেন। অসংখ্য দরিদ্র ছাত্রকে তিনি নিজের IUCAA-এর বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছেন। তাঁর আপ্তসহায়ক (P.A.) শ্রী ডি. কুল ছিলেন এমনই একজন আশ্রয় প্রাপ্ত ছাত্র।

  বৈজ্ঞানিক নারায়ণ চন্দ্র রানার রিসার্চ গাইড প্রফেসর জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার-এর মতে―'একজন শিক্ষক রূপে রানা'র ছাত্রদের সঙ্গে আদানপ্রদান, তাদের উদ্দীপিত করা এবং তাদের কল্পনাগুলিকে প্রজ্বলিত করার ক্ষেত্রে ছিলেন একজন সফল ব্যক্তিত্ব। তাঁর অতিবাহিত জীবন প্রণালী ছিল 'গুরুকুল' প্রথার মতো― যেখানে তিনি ছিলেন সাধক বা মুনি আর ছাত্রেরা হলেন শিষ্যদের মতো। কোন একটি বিষয়ে বক্তব্য রাখতে রানা শীঘ্রই নিজেকে চরম অবস্থায় তুলতেন বিষয়ের গভীর থেকে গভীরতর দিকে প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে এমনকী নির্ধারিত সময়কে অতিক্রম করে যেতেন। বস্তুতঃ তিনি এর পর পরিশ্রান্ত হতেন―তবুও তিনি তাঁর বক্তৃতার বিষয় অভ্যাসের অনুশীলন বার বার চালিয়ে যেতেন।'

(তিন)
ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের আগ্রহ পুষ্পপল্লবে পল্লবিত করার অভিপ্রায় কার না থাকে? হৃদয়ের অন্তস্থলে সেই সুপ্ত বাসনা লালিত করে চলে প্রত্যেকে। এর ব্যতিক্রম নন বৈজ্ঞানিক রানা। IUCAA-এর বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কর্মসূচির দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলেন তিনি। এই কাজগুলি খুব গুরুত্ব সহকারে সম্পন্ন করতেন। IUCAA ছাড়াও ইন্ডিয়ান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি-তে সায়েন্স পপুলারাইজেশনের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন-এর এডুকেশন সাব-কমিটি'র সম্মানীয় সদস্য ছিলেন।

  প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের আঠাশ তারিখটি ভারতবর্ষের জাতীয় বিজ্ঞানে একটি স্মরণীয় দিন। ১৯২৮ সালের ওই দিনে বৈজ্ঞানিক চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন তাঁর বিখ্যাত 'রমন এফেক্ট' আবিষ্কার করেছিলেন। এই আবিষ্কারের দরুণ ১৯৩০-এ তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। সেজন্য ওই দিনটিকে ভারতবর্ষে 'জাতীয় বিজ্ঞান দিবস' হিসাবে পালন করা হয়। এদিনে IUCAA-তে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। আর সেই কর্মসূচি সফলভাবে রূপায়ণের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন প্রফেসর রানা। তাঁর পরিচালনা ছিল খুবই কল্পনা প্রসূত। তাঁর সমকক্ষ হতে চ্যালেঞ্জ করা ছিল খুব শক্ত একটা কাজ। এদিন ক্যুইজ আর বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা হত IUCAA-তে। সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর দলকে উৎসাহ দিতেন। তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতেন তিনি। 

  তাঁর ক্রিয়াকলাপ কেবল মাত্র বিজ্ঞান দিবসে সীমাবদ্ধ থাকত না। বরং বছরভর চলত তাঁর সৃজনশীল কর্মসূচি। স্কুল পড়ুয়া বিদ্যার্থীদের কথা মাথায় রেখে মহাকাশ বিষয়ে গ্রীষ্মকালীন কর্মসূচি (Workshop)-র ব্যবস্থা করতেন ইউনিভার্সিটির চন্দ্রশেখর অডিটোরিয়ামে। উক্ত অডিটোরিয়ামে প্রত্যেক মাসের দ্বিতীয় শনিবার প্রদর্শন মূলক বক্তৃতার আয়োজন করতেন তিনি। প্রতিটি অনুষ্ঠানের সিংহভাগই নিজ ব্যবস্থাপনায় সংঘটিত করতেন তিনি। এমন সব অভিনব আয়োজনে শিশুমনে বিশাল প্রভাব ফেলে। তাদের কল্পনাশক্তি প্রখর হয়। আনন্দের সঙ্গে মহাশূন্যের সংবাদ শুনতে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করে― কবে আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন, যেদিন সশরীরে উপস্থিত থেকে চাক্ষুস করবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অপার লীলাময় ঘটনাবলীর সৃষ্টির রহস্য আর তার পিছনের যুক্তিসমূহ।
        

  ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে IUCAA এবং পুনা'র জ্যোতির্বিদ্যা পরিসংস্থার সহযোগিতা ও পরিচালনায় প্রথম অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীকূলের সভা 'অল ইন্ডিয়া অ্যামেচার অ্যাস্ট্রোনমারস মিট' (All India Amateur Astronomers' Meet বা AIAAM)  অনুষ্ঠিত হয়। এ হেন সম্মেলনের শুভ উদ্বোধন করেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রফেসর নারলিকার। সভায় তিনি তাঁর আশা ব্যক্ত করে বলেন―'ছোটবেলা থেকে কেউ যদি আকাশ পর্যবেক্ষণে রীতিমত অংশগ্রহণ করে, পরবর্তী কালে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে তার জীবন গঠনের লক্ষ্য রূপে গ্রহণ করে তবে যে উৎসাহী ও কৃতী গবেষক পাওয়া যাবে সাধারণত ভবিষ্যৎ জীবনে পঠনপাঠন সূত্রে এই পথে আসা অন্যান্য গবেষকদের তুলনায় তার কাজের ঝ চিন্তার ধরন অনেকটা উন্নত মানের তো হবেই, সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র তাতে আরও সমৃদ্ধ হবে।'

  ১৯৯২ আর ১৯৯৩ সালে আরও দুটি অপেশাদার সর্বভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে ওয়ার্ধা এবং আমেদাবাদে। কিন্তু এভাবে সম্ভব নয়, প্রফেসর নারলিকার ভাবলেন― সারা ভারতের সমস্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একই ছাতার তলায় আনতে হবে। তবেই দেশজুড়ে অখণ্ড জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার ধারা শক্তিশালী হবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো ছেটানো যত সংস্থা আছে, তাদের সবাইকে একটি সর্বভারতীয় সংস্থার আওতায় আনা আশু প্রয়োজন। সেজন্য ১৯৯৩ সালে গঠিত হয় সারা ভারত অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সংগঠন 'কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান অ্যামেচারস অ্যাস্ট্রোনমারস' অথবা সংক্ষেপে CIAA (Confederation of Indian Amateurs Astronomers)। সেবছর জানুয়ারি মাসের একুশ আর বাইশ তারিখে চতুর্থ সারা ভারত অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সভা (4-th All India Amateur Astronomers' Meet বা AIAAM) বসে কলকাতায়। বাইশে জানুয়ারির সেই সভায় CIAA তৈরির ব্যাপারে শীলমোহর পড়ে এবং সেবছরই CIAA-এর রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়। এ হেন সংগঠনের হেড-অফিস পুনায়; ঠিকানা ৭৫৫/১, Mayur Colony, Kothrud, Pune―৪১১০২৯। যদিও এর প্রশাসনিক কাজকর্ম বসন্ত-বিহার, নিউ দিল্লি থেকে সংগঠিত হয়। CIAA স্থাপনের পর সংস্থার বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন অধ্যাপক রানা।

  CIAA-এর পরবর্তী পঞ্চম এবং ষষ্ঠ সভা বসে যথাক্রমে ভুবনেশ্বর আর মাদ্রাজে। এই দুই জায়গায় মুখ্য উপস্থাপনের দায়িত্ব বর্তায় অধ্যাপক রানা'র উপর। অধ্যাপক রানা তাঁর মূল বক্তব্যে বলেন―'আজকের দিনে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কাছে দেশবাসী যতখানি আশা করে ততখানি তারা পায় না, তার আসল কারণই বোধহয় তাদের সচেতনতার (sincerity) অভাব।' তিনি তাঁর পরিচালনার গুণে সারা ভারত অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নিকট প্রকৃতই ছিলেন একজন বন্ধু, দার্শনিক ও পথপ্রদর্শক।

  এতসব সফল কাজে একছটাক চোনাও মজুত ছিল। তাঁর উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়লেন অনেকে। কারণ সম্ভবত বহুবিধ। প্রথম কারণ, সাংঘাতিক প্রফেশনাল জেলাসি; যাকে বলে পেশাগত অসূয়া। পরশ্রীকাতরতা। এমনকি প্রফেসর নারলিকার-এর সঙ্গে পর্যন্ত তাঁর কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যেত। দ্বিতীয় কারণ, দিনকে দিন তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি আর একগাদা ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ডাক্তারের পরামর্শ মতো প্রতিদিন তাঁকে ১২―১৪ টা ঔষধ খেতে হত। ঔষধ খেয়ে রোজ প্রায় বারো ঘণ্টা ঘুমাতে হত। খাওয়ার উপর বিস্তর বিধিনিষেধ ছিল। যত্রতত্র জল খাওয়া চলবে না। খেতে হবে বিশুদ্ধ মিনারেল ওয়াটার। সেজন্য মিনারেল ওয়াটারের বোতল ছিল তাঁর সবসময়ের সঙ্গী। শেষের দিকে তিনি অল্পতেই রেগে যেতেন। মেজাজ সবসময় খুব রুক্ষ হয়ে থাকে। তিনি দেশবিদেশের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কমিশন (International Astronomical Union Commission)-এর ভারতীয় প্রতিনিধি তিনি। বিভিন্ন সেমিনার এবং সম্মেলনে প্রায়শই পৃথিবীর নানান দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়। বক্তা ও বিশেষজ্ঞ হিসাবে। দেশের ভেতরে ও বাইরে এত ছোটাছুটিতে তিনি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। সেজন্য বন্ধুমহলে তিনি প্রায়ই বলতেন―
'নিয়মিত বিদেশ যাতায়াত, আকাশ যাত্রার ধকল, লাগেজ বইতে আর ভাল্লাগে না।' (চলবে)

তথ্য সহায়তা :
'নিউটনের আপেল ও নারায়ণ'― ড. সন্তোষ কুমার ঘোড়াই,
'মেদিনীপুরের বিশ্বজয়ী ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞানী'― বাদল চন্দ্র দে
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক-শিক্ষক শ্রী অতনু মিত্র
মণিস্যারের ভাইপো শ্রী গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী
'বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানা'― নন্দগোপাল পাত্র,
'N C Rana : Life and His Contribution on Astrophysics Science'― Utpal Mukhopadhyay and Saibal Ray,
'মেদিনীপুরের বিজ্ঞানীদের কথা'― ভাষ্করব্রত পতি,
উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন ব্লগ

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments