জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-২৭/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-২৭
শুভদীপ বসু

বিষয়- শিবসুন্দর বসু:অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার আবৃত্তি চর্চার প্রাণপুরুষ

শিব সুন্দর বসুর জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ই আগষ্ট। পিতা ভূপেন্দ্র নাথ বসু,মাতা লীলাবতী বসু। স্ত্রী অনিতা বসু ও পুত্র জনপ্রিয় আবৃত্তিশিল্পী শোভনসুন্দর বসু। ওনার ছোটবেলা কেটেছে বৈপ্লবিক আবহাওয়ায়। উনি ছিলেন ঋষি রাজনারায়ণ বসুর পৌত্র। ঋষি অরবিন্দ ঘোষ ওনার পিসতুতো দাদা। স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারী সত্যেন্দ্রনাথ বসু,জ্ঞানেন্দ্র নাথ বসুর ভাইপো ছিলেন উনি। ওনাকে মিথ্যা অভিযোগে জেল খাটতে হয়েছে এ কথা খুব কম লোকই জানে।

  জীবন শিল্পী: শিব সুন্দর বসুর জীবন নানা বৈচিত্র্য পরিপূর্ণ। ষাটের দশকে মেদিনীপুরের কেরানি চটিতে চাষবাড়িতে তিনি থাকতেন।পুতুরিয়া মৌজার কলাই চন্ডী খালের পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রায় ৭০একর জমি ছিল ওনার চাষের এলাকা।ওনার প্রতিভার অন্যতম দিক ছিল উনি একজন প্রতিভাবান ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার। কলাইকুন্ডা উইং কমান্ডার আর. এন.মজুমদার,টুলু সরকার,মুকুল মিত্র,বিমলেন্দু রায়,পরিতোষ মুখার্জি,অনুরাধা সরকারের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলেছেন উনি।ওয়াই. এম.সি.এ সৌজন্যে উনি কলকাতার কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চ্যাটার্জির স্ত্রী দীপা চ্যাটার্জির সাথেও ডাবলস খেলেছেন।ভারতীয় রেলে উনি চাকরি পেয়েছিলেন এই খেলার সূত্রেই।কিন্তু পরে বার্নপুর এ ওনাকে বদলি করা হলে অবলীলাক্রমে মেদিনীপুর শহরের প্রতি ভালোবাসায় চাকরি ছেড়েছিলেন।উনি একজন অসাধারণ ফটোগ্রাফার ছিলেন। তার আলোকচিত্র সেই সময়ের জনপ্রিয় মাসিক পত্রিকা ভারতবর্ষ, বসুমতি ও প্রবাসী তে প্রকাশিত হয়েছিল।রাইফেল শুটিং এ উনি ডিস্ট্রিক্ট চ্যাম্পিয়নও ছিলেন।
আবৃত্তির গুরু: যে কারণে তাকে সময় ও সমাজ চিরতরে হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন তা তিনি আবৃত্তিশিল্পী ও আবৃত্তি প্রশিক্ষক বলে।ছোটবেলায় দিদি সীতা ঘোষ, পূর্ণেন্দু মাইতি কাছে ওনার আবৃত্তি চর্চা।পরবর্তীকালে নাট্যাচার্য্য শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছে  শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।১৯৮০ সালে 'আবৃত্তি তীর্থ'নামে প্রতিষ্ঠান তৈরি করছিলেন উনি।পরবর্তী সময়ে রেজিস্ট্রেশন এর বিধিসম্মত কারণে তার নাম পরিবর্তন করে রাখলেন'স্বর- আবৃত্তি'।মনে রাখতে হবে অখন্ড মেদিনীপুর জেলায় স্বর-আবৃত্তি একমাত্র আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে মেদিনীপুর বাসীকে পথ দেখিয়েছিল।ওনার অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী আজ সারা জেলা ও জেলার বাইরে এই শিল্পমাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।

  ওনার শেখানোর পদ্ধতিতে ছিল আন্তরিকতা।কোন ছাত্র বা ছাত্রী কিছুদিন তার কাছে না গেলে উনি নিজে ছাত্র-ছাত্রীর বাড়িতে যেতেন।আবৃত্তির প্রতি ভালোবাসা তৈরি করতেন।যেকোনো বিষয়ের গভীরে তিনি প্রবেশ করতেন।এই মফ:স্বলে থেকে চিঠিপত্রে যোগাযোগ রাখতেন কলকাতার বিশিষ্ট মানুষদের সাথে।ব্যাকরণ বিদ পবিত্র সরকারের সাথে তার উচ্চারণ বিষয়ে বহু চিঠি দেওয়া নেওয়া হতো।কবিতার ভাবার্থ, শব্দের সঠিক উচ্চারণ ইত্যাদি বিষয়ে নাট্যাচার্য শম্ভু মিত্রের সাথেও তার চিঠিতে আলোচনা হতো।মেদিনীপুর শহরে সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের কাছে স্বর আবৃত্তির বাৎসরিক অনুষ্ঠান ছিল মনোগ্রাহী।অনুষ্ঠানের সর্ব পরিকল্পনায় থাকতেন উনি। শুধুমাত্র আবৃত্তি কে নিয়ে প্রদ্যুৎস্মৃতি ভবনে এমন অনুষ্ঠানের কথা সে সময়ে এত সহজ ছিল না।পরবর্তীকালে কলকাতা শহরের রবীন্দ্র সদন থেকে শিশির মঞ্চে স্বর-আবৃত্তি পরিচালিত বাৎসরিক একটি অনুষ্ঠান হোত।

  শিব সুন্দর বসু আবৃত্তিশিল্পে জনপ্রিয় হবার জন্য কখনোই মফ:স্বল ছেড়ে যাননি।বরং এই মফ:স্বলে থেকে শত শত জনপ্রিয় আবৃত্তিশিল্পী গড়ে তুলেছেন। মেদিনীপুর শহরের কেদেন বাবুর গলির ওই একতলা বাড়িতে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম থেকে কবি নজরুলের পদধূলি আছে।আজও যখন ওই বাড়ির বারান্দায় গিয়ে জেঠিমার সাথে গল্প করি মনে হয় এবাড়িতে কবিতার বিপ্লবের গন্ধ আছে। চরৈবেতি মন্ত্রে এখনো স্বর- আবৃত্তি পথ চলা থামায়নি।মেদিনীপুরে আমি,খড়গপুরে শ্রীমতী লীনা গোপ স্বর-আবৃত্তির কবিতা ধারাকে প্রবাহিত করার জন্য এখনও বদ্ধপরিকর।

প্রাপ্ত পুরস্কার:
১৯৯০: অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস কর্তৃক'আবৃত্তি শাস্ত্রী'উপাধি প্রদান।
১৯৯৬: খড়গপুর ঋত্বিক সংস্থা সংস্থা কর্তৃক সংবর্ধনা।
২০০৩:কলা ভারতী সম্মান, আবৃত্তি উত্তম সম্মাননা।
২০০৬: জাতীয় আবৃত্তি উৎসবে কথাসরিৎ হাওড়ার সম্মাননা।
২০০৬: স্বরলিপি সম্মাননা।
২০০৭: পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের একুশে সম্মান।
পরলোকগমন:২০১২ সালে ২৫শে মে এক মেঘলা দিনে ইহলোক ত্যাগ করেন উনি।যতদিন এই আবৃত্তিশিল্প থাকবে ততদিন অখন্ড মেদিনীপুর জেলার আবৃত্তি শিল্পের প্রাণপুরুষ পথিকৃৎ হিসেবে শিল্প-সংস্কৃতির আঙিনায় চির বন্দিত হয়ে থাকবেন শিব সুন্দর বসু।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments