জ্বলদর্চি

রিকিসুমের পিশাচ(উপন্যাস) পর্ব-১/আবীর গুপ্ত

রিকিসুমের পিশাচ
পর্ব-১
আবীর গুপ্ত
(এক)

রাজেশ গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল –একা একা এরকম একটা অভিযানে না এলেই ভালো করতো। সামনে কতটা বিপদ অপেক্ষা করে আছে কেউ জানে না। হয়তো বিপদসংকুল পথ ছাড়া আর কোন বিপদই নেই। যদি সেটা হয় তো বাঁচোয়া। বিপদ সংকুল পথকে কিভাবে ট্যাকেল করতে হয় তা ওর ভালই জানা আছে। গ্রামের পথ শেষ হয়েছে যেখানে সেখান থেকে শুরু হচ্ছে গভীর জঙ্গল। এই জঙ্গল পাহাড়ের গা বেয়ে ধীরে ধীরে উপর দিকে উঠে গেছে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগোলে পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি যে জায়গায় পৌঁছাবে অর্থাৎ জঙ্গল যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে খানিকটা চাতালের মত আছে। বহুদূর থেকে বাইনোকুলারের সাহায্যে ওই চাতালের গায়ে একটা গুহার মতন দেখতে পেয়েছে। গ্রামবাসীদের দৃঢ় বিশ্বাস, ওই গুহাটিতে থাকে একটি পিশাচ। যার নাম ওরা দিয়েছে “মোয়ামা”। লোকালভাষায় “মোয়ামা” মানে শয়তান। এই শয়তানের ডেরা দেখার উদ্দেশ্যেই রাজেশের এই অভিযান।

   জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রাজেশের চলতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল কারণ একেতো খাড়া স্লোপ আর তার সঙ্গে অদ্ভুত এক ধরনের কাটা ভর্তি আগাছার ঝোপ বড়ো বড়ো গাছের মাঝে মাটিতে রয়েছে। ওর অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পিঠের হ্যাভারস্যাকটা। এতে নানা ধরনের নানা রকম জিনিস রয়েছে, শুধু আগ্নেয়াস্ত্র বাদে। তবে আত্মরক্ষার জন্য দুই তিন রকমের ছোরা অবশ্য সঙ্গে আছে। অনেকটা যাবার পর যখন বুঝল আর দেহটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না, একটু ফাকা জায়গা দেখে বসে পড়লো। স্মার্টফোনে সময় দেখল –দুপুর ঠিক দুটো বাজে।

   হ্যাভারস্যাক খুলে লাঞ্চ বক্স' বারকরলো –রুটি, সবজি, ডিমসেদ্ধ আর মিষ্টি। এটাই ওর কাছে মনে হল অমৃত। খেতে খেতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল হঠাৎ একটা মৃদু শব্দে সম্বিৎ ফিরলো। দূরে মনে হল কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে! হঠাৎ ওর সামনে দিয়ে কি একটা দৌড়ে চলে গেল! একটা খরগোশ। ওঃ যা ভয় পেয়েছিল! নিজের মনেই হেসে উঠলো। দিনের আলো খুব একটা ভালোভাবে উপরে ডালপালা আর পাতার আচ্ছাদনের জন্য ঢুকতে পারছে না। আলো থাকতে থাকতেই কোন একটা মোটামুটি সেফ জায়গায় পৌঁছনো দরকার। হ্যাভারস্যাকটা পিঠে তুলে হাঁটা লাগালো। যতই ওপর দিকে উঠছে, ততই নিস্তব্ধতা বাড়ছে। প্রথমে মৃদু যে কথাবার্তার আওয়াজ শুনেছিল, সেটা বোধহয় মনের ভুল। কিন্তু, এত নিস্তব্ধতা! স্ট্রেঞ্জ!

   হঠাৎ, ভয়ে, বিষ্ময়ে, আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেল – সামনে একটা বিশাল বড়ো ভালুক দাঁড়িয়ে আছে, যার পিছনে তিন তিনটে লেপার্ড। ভঙ্গি, আক্রমনাত্মক। রাজেশ মুহূর্তের মধ্যে বুঝে গেল, আর কিছু করার নেই, সবশেষ। এদের হাত থেকে বাঁচার উপায় ওর জানা নেই।

(দুই)
রাজেশ বসু পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করে। বয়স বেশি নয়, মাত্র সাতাশ বছর। বিয়ে করেনি। মাউন্টেনিয়ারিং করতে ভালোবাসে। আসলে মাউন্টেনিয়ারিং একটা বাহানা, যে কোনো রকম অ্যাডভেঞ্চারই ওর অত্যন্ত প্রিয়। মাউন্টেনিয়ারিংয়ে অ্যাডভেঞ্চার খুব ভালোমতো যুক্ত বলে মাউন্টেনিয়ারিং করে। ওদের তিন বন্ধুর একটা গ্রুপ আছে। এই তিনজনেই দু তিন মাস অন্তর অন্তর বেরিয়ে পড়ে। কখনও মাউন্টেনিয়ারিং, কখনও বা দুর্গম অঞ্চলে ট্রেকিং। 

   নভেম্বর মাসের শেষ দিক। রাজেশ সিকিমের  রিকিসুম বলে একটা জায়গায় ট্রেকিং কাম মাউন্টেনিয়ারিংয়ের একটা প্রোগ্রাম বানালো। মোট আট দিনের ট্যুর। ট্রেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে, হোটেল বুকিংও কমপ্লিট। রিকিসুম একটি ছোট্ট গ্রাম। এখানে একটি মাত্র হোটেল। এই গ্রামে টুরিস্ট আসে না বললেই চলে। হঠাৎ, যেদিন রওনা দেবে তার দুদিন আগে জানতে পারল বাকি দুই বন্ধু যেতে পারবে না। কারণ, ওরা দুজনে যে অফিসে চাকরি করে সেই অফিস ওদের ছুটি স্যানক্শন করে নি। রাজেশের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ট্রেনের টিকিট আটচল্লিশ ঘন্টা আগে ক্যানসেল করলে অল্প কিছু কেটে বাকিটা রেল কোম্পানি ফেরত দেবে। কিন্তু, হোটেল? অলরেডি, সাত দিনের যা হোটেল ভাড়া তার অর্ধেক অ্যাডভান্স পেমেন্ট করে বসে আছে। হোটেলের কর্তৃপক্ষ নাকি কোন টাকা ফেরত দেবে না - এরকমই  যে এজেন্টের মাধ্যমে হোটেল বুক করেছিল তারা জানালো। রাজেশ ঠিক করলো, একাই যাবে। অতীতে এরকম একা একা ট্রেকিং করেছে, তাই অসুবিধা হবে না। এতে  অনেকগুলো টাকা বেঁচে যাবে।
  ট্রেনে হাওড়া থেকে নিউ জলপাইগুড়ি, তারপর ওখান থেকে বাসে রিকিসুম।  বাসে সকাল আটটায় ছেড়ে পৌঁছলো প্রায় দুপুর বারোটা নাগাদ। নব্বই  কিলোমিটার পথ হলেও পাহাড়ি রাস্তা আর রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম, তাই, প্রায় চার ঘণ্টা সময় লেগে গেল। হোটেলে মালপত্র রেখে লাঞ্চ সেরে হোটেল থেকে একটি ছেলেকে গাইড হিসেবে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রিকিসুম পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট্ট গ্রাম। জুলুকের  সিল্ক রুট  বিখ্যাত হওয়ার পর দু চারজন ট্যুরিস্ট  জুলুক  থেকে ফেরার পথে রিকিসুম স্টে করে। তাই, একমাত্র হোটেলটিতে জায়গা পাওয়া মাঝেমধ্যে মুশকিল হয়ে যায়। রাজেশের সঙ্গে বাইনোকুলার আর ক্যামেরা। আপাতত ট্রেকিং নয়, ট্রেকিংয়ের রুট খুঁজে বার করাই লক্ষ্য। গ্রামের একধারে কিছুটা ফ্ল্যাটল্যান্ড, আর তারপর সেই ল্যান্ড শেষ হয়ে শুরু হয়েছে জঙ্গল আর পাহাড়। ঘন জঙ্গল পাহাড়ের গা বেয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। ও বাইনোকুলারে পাহাড়ের চূড়ার দিকটা দেখতে গিয়ে একটা চাতাল আর গুহার মতো দেখতে পেল। গাইড ছেলেটি জানালো ওই গুহাটিতে নাকি একটা পিশাচ থাকে। পরদিন ও ওখানে যেতে চায় শুনে ও সঙ্গে যেতে পারবে না জানিয়ে ওকেও যেতে নিষেধ করল। এমনকি, আশেপাশে গ্রামবাসী যাঁরা ছিলেন তারাও নিষেধ করলেন। এরপরের ঘটনা তো আগেই বলা হয়েছে।
(এরপর সামনের বৃহস্পতিবার) 
-----------------------------------------
এই ধারবাহিক উপন্যাস পড়ে অভিমত জানাতে আবেদন জানাই  -mail:  jaladarchi@yahoo.in
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments