জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা― (অষ্টম পর্ব)/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ২৭
মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা― (অষ্টম পর্ব)

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

'আমরা এখন কঠিন পরিতাপের দিনগুলি গুজরান করছি। পবিত্র ভূমি আজ তৃষ্ণার্ত। একটি সাংঘাতিক প্লেগ আমাদের বিস্তীর্ণ শষ্যক্ষেত আক্রমণ করেছে। ফসল নষ্ট করছে। পীড়ার চাবুকের আঘাতে আমরা আকস্মিক উৎপীড়িত, ব্যথিত। তাঁরা বলেন এ হেন দ্বন্দ্ব আমাদের দুর্বল করছে। যার জন্য আমরা নিঃস্ব, শূন্য হয়েছি। সূর্যের নিশানধারী মহান লোক আমরা। আমি বলি― আমরা শক্তিশালী। আমরা ভবিতব্যের মানুষ। পরম করুণাময় ঈশ্বরের নিকটতম হওয়াই আমাদের লক্ষ্য। একমাত্র গন্তব্য।'―কথাগুলো বলে একটু থামলেন বিকট দেখতে লোকটা। সে কথাগুলো বলছিল এল-কাস্টিলো'র শীর্ষে দাঁড়িয়ে। 

  এল-কাস্টিলো আসলে এক বিশালাকার ধাপ-পিরামিড, যা নির্মিত হয়েছিল মায়া দেবতা কুকুলকান-এর উদ্দেশ্যে। পিরামিডের শীর্ষবিন্দুতে রয়েছে ঈশ্বর কুকুলকান-এর ভাস্কর্য আঁকা মন্দির! কে এই কুকুলকান? কী তাঁর মাহাত্ম্য? মায়া জনপদের উপর তাঁর প্রভাব কতখানি? মায়া জনগোষ্ঠী কাদের বলা হয়? আর এমন নরবলি'র রহস্যই বা কী?

  প্রাচীন বিশ্বে যে ক'টা সভ্যতার অস্তিত্ব টিকে ছিল, মায়া সভ্যতা তাদের অন্যতম। মেসোআমেরিকা (বর্তমান মেক্সিকোর দক্ষিণ ভাগ এবং উত্তর-মধ্য আমেরিকা)-র বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মায়া সভ্যতা গড়ে উঠেছিল খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ৩০০০ অব্দে। সপ্তদশ খ্রিস্টাব্দে স্পেনীয় আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত সেখানে মায়া সভ্যতা বিরাজ করছিল। এ হেন সভ্যতা লিখন প্রণালী, বর্ষপঞ্জিকা, শিল্প, স্থাপত্য, গণিত আর জ্যোতির্বিদ্যাসহ একগুচ্ছ বিষয়ে বেশ পারদর্শী ছিল। 

  আর ছিল চতুর্প্রান্তবিশিষ্ট এই এল-কাস্টিলো পিরামিড নির্মাণ! গ্রাণাইট শিলাস্তম্ভ দিয়ে তৈরি। ৯৮ মিটার (৩২১ ফুট) উঁচু। এর প্রত্যেক প্রান্তে একানব্বইটি ধাপ। সর্বমোট ৩৬৫ টি সিঁড়ির সোপান। এক একটা সোপান একেকটি পার্থিব দিবস বোঝাত। পিরামিডের একেবারে উপরে রয়েছে আয়তক্ষেত্রাকার ভবন। সেখানে প্রস্তুত হয়েছে একখানা বেদী। 

  বেদীর উপর সিংহাসনে আসীন মায়া জনগোষ্ঠীর একজন নৃপতি। তাঁর পাশে নীচু বেদীতে মায়ান পুরোহিত-কুলগুরু। রাজা মায়ান জনগণ এবং দেবতা কুকুলকান-এর মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী মহান ব্যক্তি। তাঁর মাথার উপরে সামিয়ানা টাঙানো। খালি গায়ে অনেক গয়না, নকশা আঁকা। কান-নাক-গলায় অদ্ভুত কারুকার্য― উল্কি। রানী আর ছোট্ট রাজকুমার একে একে সব বসে রয়েছে নিজেদের নির্ধারিত সিংহাসনে। আর আছে রাজার অনুগত একজন ঘোষক এবং বল্লম, ফালা, তীর-ধনুক প্রভৃতি অস্ত্রধারী কিছু প্রহরী। বেদীর সম্মুখে বেশ কিছুটা প্রসস্থ জায়গা।

  নীচে ভূমি পর্যন্ত সিঁড়ির ধাপ। আনত। পিচ্ছিল। রক্তের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। পিরামিডের নীচে মাটিতে তখন হাজার হাজার মায়ান নরনারী। কেউ কাঁদছে। কেউ কপাল চাপড়ে শোক ব্যক্ত করছে। কৃতকর্মের পরিনতিতে হাহাকার করছে। উল্লাসে মত্ত নয় কেউ। মোট কথা, সকলে এই নিদারুণ দুঃসময়ে নিয়তির নাগপাশ থেকে নিষ্কৃতি চাইছে।

  মনে পড়ে প্রিয় পাঠক, ২০১২ সালে ডিসেম্বর মাসের একুশ তারিখে (২১/১২/২০১২) পৃথিবী ধ্বংসের যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে, তার একটি কারণ মায়া ক্যালেন্ডার মতে সেদিনটি ছিল অন্তিম দিবস। এরপর আর কোনও তারিখের উল্লেখ ছিল না সে-ক্যালেন্ডারে। মায়া সভ্যতার অধিবাসীরা প্রাণপণে এই অন্ধ বিশ্বাস পোষণ করত যে ওই দিন পৃথিবী বিলুপ্ত হবেই হবে। তারপর পুনরায় নূতন সভ্যতার আবির্ভাব ঘটবে। তো, সেই মায়ান অধিবাসীদের পরমপূজ্য দেবতা হলেন নাগদেব কুকুলকান। কোনও অনির্দিষ্ট কারণে তিনি রুষ্ট, অপ্রসন্ন। তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে মায়ান জনগণকে। কারও কুনজর পড়েছে তাদের উপর। তাই তাদের শ্রীবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘদিন মাঠের ফসলে মড়ক লেগেছে। ভয়ঙ্কর প্লেগে আক্রান্ত হয়ে উজাড় হচ্ছে জনপদ। এ হেন বিপদের রক্ষাকারী স্বয়ং কুকুলকান। তিনি ব্যতীত এ যাত্রায় কেউ রক্ষা করতে পারবে না। সেজন্য তাঁকে সন্তুষ্ট করা আশু প্রয়োজন। খুশি করার একমাত্র উপায় নরবলি। গ্যালন গ্যালন রক্তের স্রোত বইয়ে দিতে হবে। তবেই তাঁর পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি লাভ সম্পন্ন হবে। কিন্তু কোথায় আছে এমন মানুষ যাদের নির্দ্বিধায় বলিতে চড়ানো যায়? খোঁজ শুরু হল জঙ্গলের আদিবাসী বসতিগুলিতে। সেখান থেকে শয়ে শয়ে মানুষ ধরে এনে বলি দিচ্ছে মায়ানরা। 

  ইত্যবসরে, মায়ান সর্দার জিরো উলফ (Zero Wolf) এবং তার দলবল দূরের জঙ্গল থেকে বসতি পুড়িয়ে ধরে এনেছে একদল আদিবাসী যুবক―জাগুয়ার প এবং তার সঙ্গীসাথীদের। ধরে এনে তাদের গোটা শরীর নীল রঙে রাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু মুখটুকু রঙ করা বাকি। শরীরে আর তিল ধারণের জায়গা নেই। এমন অবস্থায় দড়ি বেঁধে তাদের হাজির করানো হয়েছে পিরামিডের উপর। পিরামিডের যেখান থেকে সিঁড়ি খাড়া নীচে নেমে গেছে, সেখানে রাখা আছে একটি বলিকাঠ। তার ওপর একটি ফুট চারেকের লম্বা কাঠের তক্তা বিছানো। পিরামিডের শীর্ষে একপাশ থেকে অন্যপাশে পায়চারী করতে করতে বক্তব্য রাখছে সেই ঘোষক। যে ঘোষক, সে কসাইও বটে! পিরামিডের উপর পায়চারী করতে করতে সে বলছে―
'মহাপরাক্রমশালী কুকুলকান! এই ক্ষুদ্র বলিদান গ্রহণ করুন। এই ক্ষুদ্র ভেট স্বীকার করে আমাদের উপর সহায় হউন। আমাদের জনগোষ্ঠীর সুখ সমৃদ্ধি পরিপূর্ণ করুন। আপনার প্রত্যার্বতণের পথ সুগম করুন। আপনার পবিত্র শোনিত দিয়ে এই পৃথিবীকে পুনর্জীবন দান করুন।' 

  বলার শেষে জল্লাদ ঘোষক বলিকাঠের কাছে পৌঁছয়। তার হাতে বিশালাকার ধারালো একখানা ছুরি ধরা। ছুরিকার ধারগুলি চকচক করছে। দুজন সৈন্য একজন আদিবাসী যুবককে চ্যাংদোলা করে ধরে বলিকাঠের তক্তায় শুইয়ে দেয়। যুবকের মুখ-বুক-পেট  উপরে আকাশের দিকে ঘোরানো। নাগদেবতা কুকুলকানকে স্মরণ করে ঘোষক ধারালো ছুরি বসিয়ে দিল যুবকের বক্ষস্থলে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। চিৎকার শুরু করে যুবক। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। নীচের সমবেত জনগণের তীব্র আওয়াজের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় তার আকুতি। দেহ থেকে নিমেষে হৃৎপিণ্ড আলাদা করে নিজের হাতের তালুতে রাখে পিশাচ ঘোষক। তারপর আগুনে ঝলসিয়ে নেয়। শেষে ঝলসানো হৃৎপিণ্ড ছুঁড়ে দেয় নীচে অপেক্ষমান জনতার উদ্দেশ্যে। শুধু তাই না, হৃদয় বিচ্যুত করার পর তরবারির তীক্ষ্ণ আঘাতে ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেয়। মুক্ত মস্তক সিঁড়ির ধাপ গড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নীচে পড়ে। আর সেটা কুড়ানোর জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায় নীচে। সে এক বিশৃঙ্খল নারকীয় পরিস্থিতি। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না―এমনই হৃদয় বিদারক সে-দৃশ্য।
       
  পরপর দুটি নরবলি দেওয়ার পর এবার ঘোষকের নজরে জাগুয়ার প (Jaguar Paw)। অরণ্যের সর্দার ফ্লিন্ট স্কাই-এর পুত্র। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা জঙ্গলে রাজত্ব করে আসছে। তা, কাঠের তক্তার উপর শুয়ে ভাবলেশহীন চোখ বন্ধ করে জাগুয়ার তার গর্ভবতী স্ত্রী সেভেন আর একমাত্র পুত্রকে স্মরণ করে। ঠিক এমন সময় একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এতক্ষণ মধ্যাহ্ন সূর্য মাথার উপরে বিরাজমান ছিল। মেঘমালা কিংবা বৃষ্টি বাদলের দিন নয়। সুন্দর রৌদ্রস্নাত উজ্জ্বল ঝকঝকে আরেকটা দিন। অথচ বলা নেই, কওয়া নেই; হঠাৎ চারিদিকে ঘন অন্ধকার ছেয়ে গেল। নেমে এল পুরো রাত্রির আঁধারময় পরিবেশ। তরবারি হাতে হতচকিত কসাই। অজানা বিপদের আশঙ্কা করে সেও বলি দেওয়া বিরত রাখে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় সবাই। যেন পাপের ষোল কলা পূর্ণ হয়েছে। এদিকে কুলপুরোহিত মন্ত্র আউড়ে চলেছে। অজানা বিপদের পূর্বাভাসে তার হাত -পা-শরীর সর্বাঙ্গ কাঁপছে। অগত্যা সম্রাটের স্মরণাপন্ন হয় জল্লাদ। নেত্রের সুক্ষ্ম ইশারায় সম্রাট বলি দেওয়া থেকে তাকে নিবৃত্ত থাকতে বলে। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড ... দশ সেকেন্ড অতিক্রান্ত! নিরুপায় ঘোষক মুখমণ্ডলে শুকনো হাঁসির মৃদু আভাস মিশিয়ে হঠাৎ বলে ওঠে―
  'সূর্যের নিশানধ্বারী মানুষের দল ভীত সন্ত্রস্ত নয়। আশা করি মহান কুকুলকান-এর রক্তের পিপাসা মিটেছে। সম্পূর্ণ হয়েছে তাঁর রক্তপান। প্রভু কুকুলকান, আপনি যদি খুশি হয়ে থাকেন, তবে আমাদের সম্মুখে আবির্ভূত হোন। আপনার আশির্বাদমূলক আলোকবর্তিকা পুনরায় আমাদের উপর বর্ষণ করুন।' সঙ্গে সঙ্গে সর্বশক্তিমান সূর্যের রশ্মি আপতিত হল। ব্যাস, বলি বন্ধ রেখে সবাই উল্লাসে মত্ত। ভাবছে, ঈশ্বর কুকুলকান খুশি হয়েছেন। 
 
  আসলে, ওই দিনের ঘটনাটি ছিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের একটি বিরল দৃষ্টান্ত। এ হেন সূর্যগ্রহণের অপূর্ব দৃশ্য 'অ্যাপোক্যালিপ্টো' (Apocalypto) চলচ্চিত্রের অংশবিশেষ। দেশে-দেশে, বিভিন্ন সময়ে সূর্য গ্রহণ ঘিরে রোমান্টিকতার অন্ত নেই। চলচ্চিত্র হোক কিংবা ধর্মবিশ্বাস, সূর্য গ্রহণের দৃশ্যাবলীকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পৌরাণিক লোকগাথা, মহাকাব্য, সনাতন রীতিনীতিতে মজার মজার ঘটনা বর্ণিত আছে। পূর্বে মানুষ সূর্যগ্রহণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। তাই সূর্যগ্রহণের সময় অনেক অন্ধ কুসংস্কার প্রচলিত ছিল সমাজে। ওই রকমের একটি সূর্যগ্রহণের ঘটনা ঘটবে বাস্তবে। ১৯৯৫ সালের অক্টোবর মাসে চব্বিশ তারিখে। আর তা নিয়ে মেদিনীপুর জেলার সাউরিতে সাজো সাজো রব।

(দুই)
মাঠ জুড়ে মানুষ। বয়সের মাপকাঠি নেই। আট থেকে আশি―সবাই উপস্থিত। ক্লাস তখনও শুরু হয়নি। হব হব করছে। অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছে সকলে। সময় হলে এসে পড়বেন প্রিয় প্রশিক্ষক। না, প্রিয় পাঠক; এ কোনও প্রথাগত ক্লাস নয় কিংবা নয় কোনও নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচি। আশির শেষ ভাগ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশকের প্রথম পর্যন্ত রমরমিয়ে চলেছে নিরক্ষর মানুষের অক্ষর পরিচয়ের যে দগদগে কাহিনী; তা এখনও টাটকা, জ্বাজল্যমান। স্বনামের বানান টুকু লেখা শিখতে কত যে কলমের নিব ভেঙেছে গ্রামে-ঘরের লেখাপড়া না-জানা বয়স্ক মানুষজন, তার ইয়ত্তা নেই। অথচ স্কুলমাঠে উপস্থিত সকলে কমবেশি শিক্ষিত। ভীড়ের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেশ ক'জন মাস্টার মশাই উপস্থিত আছেন। তাহলে কীসের টানে মাঠে উপস্থিত হয়েছে এত লোক? কী তাদের চাহিদা? সব কাজ ফেলে কোন দেশ উদ্ধার করতে সমবেত হয়েছে তারা?

  সময়টা ছিল ১৯৯৫ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস। উৎসব প্রিয় বাঙালির পূজার মরশুম আসছে। আর ক'দিন বাদে মহালয়ার তর্পণ। তারপর দূর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা আর ভাইফোঁটা। বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই আছে। এর সঙ্গে ফাউ আর একটা বড় উৎসব। বাঙালির সংস্কৃতিতে এ বছরের সংযুক্তি। যদিও এ উৎসব পৌনে সাত কোটি বাঙালির একার নয়, আপামর বিশ্ববাসীর উৎসব। বছর বছর হয় না। শ-দেড়শ বছরে এক-আধবার কদাচিৎ আবির্ভূত হয় ধরাধামে। কিন্তু যখন আসে, ওলটপালট করে যায় সবকিছু। বৈজ্ঞানিকগণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ব্যস্ততা এত চরমে ওঠে যে নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন পণ্ডিতরা। তাদের হাতে সময় খুব অল্প। মাত্র এক মিনিট কিংবা তারও কম। এই ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে হাসিল করতে হবে সমস্ত কাজ। সূর্যের সমস্ত তথ্য অবশ্যই সুষ্ঠুভাবে পর্যবেক্ষণ ও গণনা করতে হবে। আর তা না করতে পারলে আবার হয়তো ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে কয়েক দশক কাল। তাই সে রিস্ক, ক্ষতি কোনও পণ্ডিত ব্যক্তি স্বীকার করতে চাইবেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু উৎসবটাই বা কী? বিজ্ঞানীদের কীসের এত তোড়জোড়? রেডিও, টিভি, খবরের কাগজ―সব ক'টা গণমাধ্যমে সাজো সাজো রব। ট্রেন, বাস, চায়ের ঠেক কিংবা হাটে-বাজারে সর্বত্র একটাই আলোচনা। আশা ও আশঙ্কার দোলাচল। কী হয়, কী হয়―টানটান উত্তেজনা।

  আসলে এ হেন উৎসব একটি অতি বিরল প্রাকৃতিক ঘটনা। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। সাধারণ সূর্যগ্রহণ বছরে দু-একটা এমনিতে ঘটেই থাকে। সেটা বড় কথা নয়। তায় এ আবার পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ! সম্পূর্ণ জীবদ্দশায় এক-আধবার ঘটলে ধন্য হয়, সার্থক হয় মানব জীবন। আর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সাতজন্মের তপস্যার ফল এই গ্রহণের সাক্ষী হতে পারা। কিন্তু কী এই সূর্য গ্রহণ? কী তার গুরুত্ব? মানবজীবনে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব কতটুকু? কীভাবে দেখতে হয় গ্রহণ? পশ্চিমবঙ্গের কোত্থেকে গ্রহণ দেখলে সবচেয়ে পরিস্কার ও মসৃনভাবে দেখা যাবে? এত সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে আসছেন প্রিয় এক বৈজ্ঞানিক। তিনি ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা। খুব ব্যস্ত একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। অল্প সময়ের জন্য নিজের ঘর সাউরিতে এসেছেন। এসে অব্দি নিঃশ্বাস ফেলার জো নেই। সকলের হরেক রকম আবদার মিটিয়ে এখন ছুটে চলেছেন সূর্যগ্রহণের পাঠ পড়াতে। কীভাবে দেখতে হয় বিরলতম ঘটনাটি? এখানে হবে, না-কি অন্য কোথাও যেতে হবে? হাজারো জিজ্ঞাস্য সকলের।
      
  অজ পাড়াগাঁ সাউরি। বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান!― উল্লেখ করার মতো নয়। এক, সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দির আর বৈজ্ঞানিক নারায়ণ চন্দ্র রানা ব্যতীত। লেখাপড়ার সংষ্কৃতি পুরোদস্তুর বজায় রয়েছে। বিদ্যালয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি নিয়মিত চলে আকাশ পর্যবেক্ষণ। স্থানীয় যত মডেল প্রতিযোগিতার আসর বসত, সাউরি'র বিদ্যার্থী সকল অধিকাংশ বিজ্ঞান মডেলই বানাতে পছন্দ করে। বিজ্ঞানের প্রতি এত ভালোবাসা! এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের শিক্ষক মণীন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ী'র অবদান অপরিসীম। ১৯৮৩ সালে যে হ্যালির ধূমকেতু পর্যবেক্ষণের ধূম পড়ে গিয়েছিল সাউরিতে, তার পুরো কৃতিত্ব মণি স্যারের। এলাকায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষা-সংষ্কৃতির জোয়ার নেমেছিল। সে-ধারা এখনও অব্যাহত। ১৯৯৫ সাল। আজ মণিবাবু নেই। তবুও উৎসাহ, উদ্দিপনায় এতটুকু ভাটা পড়েনি। সাউরি স্কুলের মাধ্যমে গ্রামে গঞ্জে রটে গেল বিরলতম পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ সমাচার। শুধু সাউরি নয়, আশেপাশের দশ-বিশটা গ্রামের বাসিন্দা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল কখন আসবে সেই ক্ষণ! সেবছর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বাড়ি এলেন বৈজ্ঞানিক নারায়ণ চন্দ্র রানা। এমনিতে, বৈজ্ঞানিক রানা সাউরি এলে সারাক্ষণ ঘিরে থাকে জনতার ঢল। তায় এবার না-চাইতে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের অদ্ভূৎ সমাপতন। রাজযোটক মিল। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের পাঠ পড়াবেন ব্যস্ত বৈজ্ঞানিক। স্কুলের মাঠে খোলা আকাশের নীচে বসবে তেমন আসর। গ্রহণের খুঁটিনাটি জিনিসের বিস্তারিত আলোচনা হবে। আলোর গতিতে ছড়িয়ে পড়ল সে-সংবাদ। নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত আট থেকে আশি। সেজন্যই এত ভীড়! এই অপেক্ষা!

(তিন)
আকাশের রঙ্গমঞ্চে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় যে অপ‍রূপ দৃশ্যের অবতারণা হয়, আর কোনও প্রাকৃতিক দৃশ্যায়ন তার সমকক্ষ হতে পারে না। এতটাই তার ক্রেজ! তার আকর্ষণ! ১৯৯৫ সালের চব্বিশে অক্টোবর সকালে এমনই এক পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের দৃশ্য চাক্ষুষ করতে পারবে বিশ্বের মানুষ। যদিও বিশ্বের সব জায়গায় পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের দৃশ্যাবলী অবলোকন সম্ভব না। তবে খণ্ডগ্রাস দর্শন বিভিন্ন স্থান থেকে সম্ভব। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দর্শন করতে হলে পূর্ব নির্ধারিত কিছু জায়গায় ওৎ পেতে বসে থাকতে হবে, শিকারি বাঘের মতো। এ তো বিমাতাসুলভ আচরণ!―কোথাও পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ, কোথাও আবার খণ্ডগ্রাস! এর কারণ কী?
    
  ৩৬৫ দিনে একবার বৃত্তাকার (প্রকৃতপক্ষে, ডিম্বাকার) পথে সূর্য পরিক্রমা করে ধরিত্রী। আর পৃথিবী পরিক্রমা সম্পূর্ণ করতে চাঁদের সময় লাগে মাত্র ২৭.৩২১ দিন। তাই বছরে বেশ কয়েক বার সূর্য আর পৃথিবীর মাঝখানে কখনও কখনও চাঁদ এসে পড়ে। তখন সূর্যের আলো সরাসরি পৃথিবীর সব জায়গায় পৌঁছতে পারে না। যে যে জায়গায় সূর্য রশ্মি পৌঁছয় না, সেখানে আসলে চাঁদের প্রচ্ছায়া (ঘন ছায়াযুক্ত অঞ্চল) পৌঁছে যায়। আবার চাঁদের প্রচ্ছায়াশঙ্কু এত বিস্তৃত নয় যে পুরো পৃথিবী ঢেকে ফেলবে। কিন্তু চাঁদের উপচ্ছায়া (কম ছায়াযুক্ত অঞ্চল)-এর আওতার মধ্যে ঢুকে পড়বে পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গা। অর্থাৎ পৃথিবীর উপর কিছু জায়গায় সূর্যের আলো আপতিত হবে, কোথাও হবে না। চাঁদের প্রচ্ছায়া পৃথিবী পৃষ্ঠের যে সংকীর্ণ স্থান দিয়ে যায়, কেবলমাত্র তার অন্তর্গত স্থান থেকেই অল্প একটু সময়ের জন্য সূর্যের পূর্ণগ্রহণ দেখা যাবে। চব্বিশ তারিখের পূর্ণগ্রহণের সময়কাল এক মিনিটের কম। এবারের গ্রহণের সময় ছায়ার গতিপথটি ইরানের তেহরানের একশো কিলোমিটার দক্ষিণে শুরু হয়ে ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান অতিক্রম করে রাজস্থানের ভরতপুরে পৌঁছবে সকাল ৭ টা ২৪ মিনিট ৪৬.৯ সেকেন্ড সময়ে। ভারতবর্ষে পূর্ণ গ্রাসের স্থিতি কাল খুবই অল্প, তেতাল্লিশ সেকেন্ড থেকে প্রায় এক মিনিট ষোল সেকেন্ড। চাঁদের প্রচ্ছায়াপথ চল্লিশ থেকে আঠান্ন কিলোমিটার চওড়া। এই চওড়া অঞ্চলের মধ্যিখানে যে সব স্থান পড়বে, সেসব জায়গা থেকে খালি পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের পূর্ণরূপ দৃশ্যালোকিত হবে। মধ্যরেখা থেকে ডাইনে বা বাঁয়ে, উত্তরে কিংবা দক্ষিণে সরে গেলে গ্রহণের সময় তত কমবে।

  মোদ্দাকথা, ভারতের রাজস্থান থেকে শুরু করে উত্তর ভারত পরিক্রমা সম্পূর্ণ করে পশ্চিমবঙ্গের গাঙ্গেয় উপত্যকার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় চাঁদের প্রচ্ছায়াপথের অন্তর্গত কোনও স্থানে যদি উপস্থিত থাকা যায়, তবে প্রকৃতির সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ দৃশ্যের দর্শন লাভের ষোলআনা সম্ভাবনা। সে না-হয় হল। অপরূপ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যাবে। কিন্তু কী কী দেখা যাবে, তার আগাম লিস্ট যদি হাতের কাছে না-ই থাকে, তবে তো মুশকিল, মহাসমস্যা। গ্রহণের স্থিতি যেহেতু অল্প সময়, যদি চোখের পলকে হুট করে কখন গ্রহণের দৃশ্যমালা অন্তর্হিত হয়; তাহলে তো এত এত আয়োজন সব পণ্ডশ্রমে পরিগণিত হবে, তার বেলা? তখন আপসোসের শেষ থাকবে না। তার থেকে বরং গ্রহণ সম্পর্কে মৌলিক ধ্যান ধারণা আগাম করে রাখা ভালো। গ্রহণের শুরু কখন ধরা হয়? শেষ হয় কখন? ঠিক কোন সময়ে পূর্ণগ্রাস চলবে? গ্রহণ চলাকালে কী কী প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যাবে? এমন হাজারো প্রশ্নে চিত্ত বিগলিত সবার। 

  নিজ অক্ষের চতুর্দিকে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আবর্তন করছে বসুন্ধরা। ঘটনাচক্রে চাঁদও পশ্চিম দিক থেকে পূর্বে সূর্যের দিকে অগ্রসর হয়। সূর্যের পূর্ণগ্রাসের চারটি পর্যায়।  বৈজ্ঞানিক নারায়ণ চন্দ্র রানা'র কথায়―
  'সূর্যগ্রহণের সময় উত্তর গোলার্ধে চাঁদের পূর্বপ্রান্ত দিয়ে প্রথমে সূর্যের পশ্চিম প্রান্ত ঢাকা পড়তে শুরু করে। সেই মূহুর্তটিকে বলে প্রথম স্পর্শ। এই হল গ্রহণের শুরু। তারপর চাঁদের দেহ ধীরে ধীরে সূর্যের পূর্বপ্রান্তের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে এবং যতক্ষণ না সূর্যের পূর্বপ্রান্তস্পর্শ করে ততক্ষণ আংশিক গ্রহণ হয়।

   চাঁদের পূর্বপ্রান্ত সূর্যের পূর্বপ্রান্ত স্পর্শ করলে সেটি হয় দ্বিতীয় স্পর্শ। দ্বিতীয় স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদের দেহ দিয়ে সূর্য সম্পূর্নরূপে ঢাকা পড়ে এবং পূর্ণগ্রাস গ্রহণ শুরু হয়। 

  চাঁদ পূর্বদিকে আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে যখন চাঁদের পশ্চিমপ্রান্ত সূর্যের পশ্চিমপ্রান্ত স্পর্শ করে তখন হয় তৃতীয় স্পর্শ। তৃতীয় স্পর্শে পূর্ণগ্রাসগ্রহণ শেষ হয়। 

  সূর্যের পশ্চিমপ্রান্ত ধীরে ধীরে দেখা দিতে শুরু করে। চাঁদের পশ্চিমপ্রান্ত সূর্যের পূর্বপ্রান্ত থেকে মুক্ত হলে হয় চতুর্থ স্পর্শ এবং চতুর্থ স্পর্শে গ্রহণ শেষ।'

  গ্রহণ চলাকালে পর্যায়ক্রমিক ভাবে সূর্যালোকের তীব্রতার তারতম্য দেখা যায়। আলোকের তীব্রতার মাত্রা প্রথমে কমে, পূর্ণগ্রাসের সময় কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয় আর তারপর পুনরায় বাড়ে। গাছের ছায়ায় পাতার ফাঁকে ফাঁকে আলো এসে গাছের নিচে সূর্যের যে প্রতিকৃতি পড়ে, দেখা যাবে সেই প্রতিকৃতি ক্রমশ বাঁকা চাঁদের আকার নিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও জানান―
  'পূর্ণগ্রাস শুরু হওয়ার ২০/২৫ মিনিট আগে ধীরে ধীরে রাত নেমে আসছে মনে হবে। যাঁরা কোন উঁচু পাহাড়ে থাকবেন মিনিট তিনেক আগে তাঁরা পশ্চিম দিগন্তের দিক থেকে চাঁদের ছায়াটিকে এগিয়ে আসতে দেখতে পাবেন। ছায়া সেকেন্ডে প্রায় ১ কিমি বেগে এবারের গ্রহণকালে ভারতবর্ষের উপর দিয়ে এগিয়ে আসবে। প্রায় মিনিট খানেক আগে পশ্চিম দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ছায়াটি যেন ভীমবেগে এগিয়ে আসছে।'

  একগুচ্ছ প্রাকৃতিক ঘটনা হঠাৎ করে চক্ষুর সম্মুখীন হবে। সূর্যের চড়া আলোকে দিনের বেলা যে-সব গ্রহ দৃষ্টির অন্তরালে লুকিয়ে ছিল, পূর্ণগ্রাসের সময় তারা আকাশে প্রকট হতে শুরু করে। সূর্যের প্রায় সতেরো ডিগ্রি পূর্বে শুক্র গ্রহ আর পনেরো ডিগ্রি পশ্চিমে বুধ গ্রহকে উজ্জ্বলভাবে দেখা যায়। সূর্য থেকে সামান্য দক্ষিণ-পশ্চিমে চিত্রা (Spica) নক্ষত্র টি দেখা যাবে কন্যা রাশিতে। সূর্যের উত্তরে দেখা যাবে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বাতী (Arcturus)।

  পূর্ণগ্রাস গ্রহণ শুরুর পনেরো মিনিট আগে থেকে বেশ কিছু অবাস্তব ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। গ্রহণ শেষে তার রেস অক্ষুন্ন থাকে। সবচাইতে অত্যাশ্চর্য ঘটনা 'ছায়ালহরী' (Shadow Bands)। ছায়ালহরী কী? 

  পূর্ণগ্রাস গ্রহণের চার-পাঁচ মিনিট আগের কথা। পঁচিশ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার দূরত্ব ছাড়া ছাড়া কয়েক সেন্টিমিটার চওড়া সাদা কালো ঢেউ খেলে বেড়ায়, চারপাশের জমি অথবা দেওয়ালের উপর দিয়ে। ঠিক যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। কেন ঘটে এ দৃশ্য? বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা হল― সরু ফালির মতো সূর্যের দেহ থেকে আগত আলোকরশ্মি বাতাসের বিভিন্ন স্তরে অসমভাবে প্রতিসৃত আর ব্যবর্তিত হয়ে ছায়ালহরী তৈরি করে। সূর্যের দিকে মেলে রাখা সাদা কাগজ অথবা সাদা কাপড়ের উপরেও দেখা যায় ছায়ালহরী তরঙ্গ। ছায়ালহরী দেখে আসন্ন পূর্ণগ্রাস গ্রহণের পূর্বাভাস পাওয়া যায়।

  'চাঁদের দেহের আড়ালে সূর্য পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যাওয়ার সময় চাঁদের পূর্ব প্রান্ত ঘিরে একটি সরু আলোর রেখা আর তার মাঝে মাঝে আলোকবিন্দু দেখা যায়। একে 'মুক্তামালা' (Baily's Beads) বলে। দ্বিতীয় স্পর্শকালে পাহাড় পর্বত ঘেরা চাঁদের দেহ সূর্যের সর্বশেষ অংশ আবৃত করার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে পাহাড়ের উপত্যকা অংশের ফাঁকা স্থান দিয়ে সূর্যের আলোর ঝলক বাইরে আসে। চাঁদের গতির জন্য ওইভাবে ঝরে পড়া আলো স্থির নয়। কখনও এদিক ওদিক দিয়ে আসার ফলে মনে হয় চাঁদের কালো দেহের চারদিকে এক আলোর মালা মুক্তামালার মত দুলছে। তৃতীয় স্পর্শকালে অপর পাশ দিয়ে সূর্যদেহ উন্মুক্ত হতে শুরু হ ওয়ার ঠিক প্রাক্কালে অনুরূপ কারণে আবার মুক্তামালা দেখা যায়।'
       
  এর পরের ঘটনা 'হীরার আংটি' (Diamond Ring)। এ বৈজ্ঞানিক রানা'র বর্ণনায়― 
'চাঁদের দেহ দিয়ে সূর্যের প্রান্তসীমা ঢাকা পড়তে গিয়ে চাঁদের অপেক্ষাকৃত নিচু কোন একটিমাত্র স্থান দিয়ে আলোর ঝলক বাইরে বেরিয়ে এসে এই হীরার আংটি সৃষ্টি হয়। ততক্ষণে আকাশে প্রায় রাতের পরিবেশ। এখানে সেখানে দু একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র ফুটে উঠেছে, চাঁদের দেহের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়ে গেলেও চাঁদের কালো দেহের চারদিক ঘিরে একটি রূপালী আভা আংটির আকারে চাঁদের দেহকে ঘিরে রয়েছে, আর তারই এক স্থান তীব্র আলোয় ঝলমল করছে। সত্যিই তখন মনে হয় মহাকাশে একটি হীরার আংটি ভাসছে।'

  হীরার আংটির দ্যুতি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষণিকের জন্য সূর্যের চারপাশে কমলা রঙের চাকা র উদয় হয়। এটি সূর্যের 'বর্ণমণ্ডল'। এ সময় বর্ণমণ্ডলের মাঝখান দিয়ে সূর্যের জ্বলন্ত হাইড্রোজেন গ্যাসের লাল আগুনের শিখা প্রজ্বলিত হতে দেখা যায়। মাঠের ক্লাস আপাতত সমাপ্ত। বাড়ি ফিরে গেল সবাই। প্রিয় মাস্টার মশায়গণের সঙ্গে অন্তিম মুহূর্তের আলোচনা শেষ করে ফিরে গেলেন বৈজ্ঞানিক রানা। তাঁর এখন অনেক কাজ। খুব বড় একটা প্রোজেক্টে হাত লাগিয়েছেন। গ্রহণের দিন সূর্যের ব্যাস পরিমাপের গুরুদায়িত্ব নিজ স্কন্ধে গ্রহণ করেছেন স্বেচ্ছায়। তার আগে পর্যন্ত সূর্যের সঠিক ব্যাসের মান কারও জানা ছিল না। সূর্যের নিঁখুত ব্যাস পরিমাপ সম্পূর্ণ করতে পারলে ধন্য ধন্য পড়ে যাবে তাঁকে নিয়ে। (চলবে)

তথ্য সহায়তা :
'নিউটনের আপেল ও নারায়ণ'― ড. সন্তোষ কুমার ঘোড়াই,
'মেদিনীপুরের বিশ্বজয়ী ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞানী'― বাদল চন্দ্র দে
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক-শিক্ষক শ্রী অতনু মিত্র
বিশিষ্ট শিক্ষক শ্রী অশোক ভৌমিক
মণিস্যারের ভাইপো শ্রী গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী
'বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানা'― নন্দগোপাল পাত্র,
'N C Rana : Life and His Contribution on Astrophysics Science'― Utpal Mukhopadhyay and Saibal Ray,
'মেদিনীপুরের বিজ্ঞানীদের কথা'― ভাষ্করব্রত পতি,
উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন ব্লগ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

2 Comments

  1. মণীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ীর ভাইপো নাম "গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী" নয় ... জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী৷ ছোটবেলায় মণীন্দ্রনারিয়ণ তাঁর ভাইপোকে "গোপাল" নামে ডাকতেন৷ তাই সাউড়িতে আজও গোপাল নামটা রয়ে গেছে৷ আমিই মণীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ীর ভাইপো৷

    আর একটি কথা হ্যালির ধূমকেতু দেখা গিয়েছিল ১৯৮৬ সালে৷ এই নিবন্ধে লেখা হয়েছে ১৯৮৩

    ধন্যবাদান্তে

    জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী৷

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যালির ধূমকেতু ১৯৮৬ সালেই দেখা গিয়েছিলো l ঠিকই বলেছেন
      ধন্যবাদ

      Delete