জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম --পর্ব--১১/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম ----পর্ব--(১১)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল
ধর্মে ঈশ্বরের প্রবেশ 

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগবে, যে বিজ্ঞান ঈশ্বরের বিরোধিতা করছে, সে আবার কেন, বিজ্ঞানের দ্বারা আবিষ্কৃত একটি কণার নাম ঈশ্বর কণা রাখবে। নামের মধ্যে ঈশ্বর! তবু বলবে ঈশ্বর অস্তিত্বহীন। 

  এবার আসি নামকরণের ইতিহাসে। ১৯৯২ সালে চিহ্নিত হয়ে গেছে স্ট্যান্ডার্ড মডেল সংসারের ১৬ টি কণা।  বাকি শুধু টপ কোয়ার্ক এবং ঈশ্বরকণা। ১৯৯৫ সালে টপ কোয়ার্ক ধরা পড়ল। বাকি রইল ঈশ্বরকণা। যে বিশ্বসংসারে সমস্ত কণাকে ভর জুগিয়ে চলেছে। আবার সবাইকে সমান ভর দেয়নি। কেন ভরের এই কম বেশি? একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ধরুন, একটি হলঘরে সভা হচ্ছে। সেখানে অনেক মানুষ বসে আছেন। বক্তব্য রাখবেন প্রধানমন্ত্রী। সভার শুরুতে একজন প্রতিমন্ত্রী এলেন। তাকে নিয়ে সামান্য জটলা। একজন পূর্ণমন্ত্রী এলেন, তার থেকে বেশি ভিড়। এবার প্রধানমন্ত্রী আসতেই তাকে ঘিরে প্রচন্ড ভিড়। এবার ভাবুন- হলঘর হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, উপস্থিত সাধারণ মানুষ 'ঈশ্বরকণা' বা 'হিগস বোসন' কণা। প্রধানমন্ত্রী হলেন সবচেয়ে দামি ব্যক্তি তাই তাকে ঘিরে ভিড় বেশি। মানে তার ভর বেশি- টপ কোয়ার্ক। প্রতিমন্ত্রী পূর্ণমন্ত্রী মাঝারী ভি.আই.পি- এদের ঘিরে ভিড় কম ইলেকট্রন কণা। আর যাদের ঘিরে ভিড় হয় না তারা হলো ফোটন কণা। যার যতটা দরকার তাকে ততটা দিয়েছে। 

  এই কণা খোঁজার জন্য আমেরিকা ১,০০০ কোটি ডলার বাজেট করে, তার জন্য ৫৪ কিলোমিটার মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে হবে। এবং একটি মেশিন লাগবে যার নাম 'সুপারকন্ডাক্টিং সুপারকোলাইজার। সুড়ঙ্গ খোঁড়া এগোতেই আমেরিকার জনগণ এত খরচের সমালোচনা শুরু করলেন। এই অবস্থায় নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লিও লেডারম্যান সে দেশের নেতা ও জনগণকে বোঝাতে কলম ধরলেন। তিনি একটি বই লিখলেন, যার নাম 'দ্য গড পারটিকল; ইফ দ্য ইউনিভার্স ইজ দ্য আনসার, হোয়াট ইজ দ্য কোয়েশ্চন?'

  কেন গড পার্টিক্যাল নাম? বিজ্ঞানে 'ঈশ্বর' নাম আমদানি লেডারম্যান করেননি। আইনস্টাইন একবার ভাবলেন- বিজ্ঞানের নিয়ম-কানুন যেমন দেখা যাচ্ছে, তার বদলে একটু আলাদা হলো না কেন? আর এই কথা ভাবতে গিয়ে তিনি বললেন- 'আমি জানতে চাই, ইচ্ছে করলেই ঈশ্বর পারতেন কিনা এই ব্রহ্মাণ্ডকে অন্য নিয়মে গড়তে। বিজ্ঞানী 'নীলস বোর' অবশ্য জুতসই জবাব দিয়েছিলেন ওই কথার।তিনি বললেন, 'আপনাকে বলে দিতে হবে না ঈশ্বর কি করবেন'। তাই যতই বিজ্ঞানীরা বিরক্ত হন লেডারম্যানের উপর এই কণার নাম ঈশ্বরকণা দেওয়ার জন্য, তবু তাকে খুব একটা বেশি দোষ দেওয়া যায় না। আসলে লেডারম্যান বলতে চাইলেন- যেহেতু মানুষ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে জানার জন্য এত ব্যাকুল, ঈশ্বর স্বয়ং মর্তে এসে মানুষের হাতে তুলে দিলেন এই কণা। 

বিজ্ঞানীরা কিন্তু চেনে এই কণাকে অন্য নামে। হিগস বোসন কণা নামে। এই নামের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯২৪ সালে আলোর কণা ফোটন বিষয়ে একটি পেপার লিখে আইনস্টাইনের কাছে পাঠান। আইনস্টাইনের বোসের এই পেপার এবং নিজের একটি পেপার জার্মান পত্রিকায় ছাপান পাশাপাশি, যার পোশাকি নাম 'বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিকস'। বোঝা গেল বোসন নামটা কেন, কিন্তু হিগস কেন। তার কারণ ১৯৬৪ সালে বিজ্ঞানী পিটার হিগস একটি পেপার লিখলেন এই ফোটন কণা নিয়ে। বিজ্ঞানী ওয়েনবার্গ ১৯৬৭ সালে একটি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক এবং উইক ফোর্সের সম্বন্ধে একটি পেপার লিখলেন, যাতে এই কণাটির নাম দিলেন 'হিগস বোসন' কণা। কিন্তু হওয়া উচিত ছিল 'বোসন হিগস' কণা। ওয়েনবার্গ ভুল স্বীকার করে বললেন, আমারই ভুল হয়েছে, আমি মনে করেছিলাম, প্রথম পেপারটি পিটার হিগস লিখেছিলেন। 

  এবার আসি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিতে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর কিংবা বিজ্ঞানের কতটা হাত আছে। কঠোপনিষদে বলা হয়েছে- "একস্তথা সর্বভূতান্তরত্মা রুপং রুপং রুপং প্রতিরুপো বহিশ্চ।' অর্থাৎ একই আত্মা, মানে আদিসত্তা বা সৃষ্টির আদি উৎস বিভিন্ন জীবের রুপে প্রকাশিত। অর্থাৎ একই অদ্বিতীয় ব্রহ্ম বিশ্বের সবকিছুর মধ্যে থেকেই বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই রবীন্দ্রনাথ লিখলেন- " প্রথম আদি তব শক্তি/ আদি পরমোজ্জ্বল জ্যোতি তোমারি হে/ গগনে গগনে।" মহাভারতের সৃষ্টি তত্বেও আদি অন্ধকার এবং বিশ্বডিম্বের উল্লেখ আছে। "প্রথমত এই বিশ্বসংসার কেবল ঘোরতর অন্ধকারে আবৃত ছিলো। অনন্তর সমস্ত বস্তুর জীবভূত এক অন্ড প্রসূত হলো। ঐ অন্ডে অনাদি, অনন্ত, অচিন্তনীয়, অনির্বচনীয়, সত্যস্বরপ, নিরাকার, নির্বিকার, জ্যোতির্ময় ব্রহ্ম প্রবিষ্ট হলেন। 

  তারপর এই অন্ডে ভগবান প্রজাপতি ব্রহ্মা স্বয়ং জন্ম পরিগ্রহ করলেন। তারপর স্থানু, স্বায়ম্ভূব মনু, দশ প্রচেতা, দক্ষ, দক্ষের সাত পুত্র, সপ্তর্ষি এবং চতুর্দশ মনু জন্মলাভ করলেন। মহর্ষিগণ একমনে যার গুণকীর্তন করে থাকেন, সে পরিমাণশূন্য পুরুষ, দশ বিশ্বদেব, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্টবসু, যমজ অশ্বিনীকুমার, যক্ষ, সাধুগণ, পিশাচ, গুহ্যক এবং পিতৃগণের উৎপন্ন হলেন। তারপর অনেক বিদ্বান মহর্ষি এবং রাজর্ষিরা উৎপন্ন হলেন। তারপর জল, পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, দশ দিক, সংবৎসর, ঋতু, মাস, পক্ষ, রাত্রি ও অন্যান্য বস্তু ক্রমশ সঞ্জাত হলো। কিন্তু প্রলয়কাল উপস্থিত হলে এই বিশ্ব সংসার সমস্তই সেই একমাত্র ব্রহ্মে লীন হবে, আর কোনই চিহ্ন থাকবে না। যেমন কোন ঋতুর পর্যায়কালে সব ঋতুলক্ষণ একসঙ্গে দেখা যায়, তেমনি যুগের আরম্ভে জীবজন্তু ও অন্যান্য সমস্ত পদার্থই নিজ নিজ আকার ও স্বভাব পরিগ্রহ করে। একবার প্রলয়, পূর্নবার উৎপত্তি ও স্থিতি, এভাবেই সংসারচক্র নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ঘুরে চলেছে।" এখানে উল্লেখ্য যে আদি বিশ্বডিম্বে অনাদি অনন্ত ব্রহ্মের প্রবেশ এবং তা থেকে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার জন্মের কল্পনা থেকেই পৌরাণিক হিন্দু ধর্মে মহাবিশ্বকে ব্রহ্মাণ্ড বলা হয়। এরপর খোঁজার চেষ্টা করবো, বিজ্ঞান না ঈশ্বর এই বিশ্বসংসার সৃষ্টির জন্য দায়ী।  (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments