জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম --পর্ব--(১৪)/ সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম --পর্ব--(১৪)

 সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মে ঈশ্বরের প্রবেশ 

স্ট্রিং থিওরি অনুযায়ী মহাকর্ষ নিতান্ত জরুরি হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, মিলেছে সেই চূড়ান্ত তত্ত্ব, যা ব্যাখ্যা করবে এই ব্রহ্মান্ডের সবরকম কণা ও বলের অস্তিত্ব। পাওয়া গেছে তথাকথিত সেই 'থিওরি অফ এভরিথিং' বা একটিমাত্র নিয়ম। এক এবং একমাত্র নিয়ম যদি সত্যি পাওয়া যায়
 তেমন কোনও নিয়ম- এবং বিজ্ঞানীদের অধিকাংশের বিশ্বাস পাওয়া যাবেই- তা হলে তা নিশ্চয়ই শাসন করছে এই বিশ্বের তাবৎ ক্রিয়াকর্ম। সব। সব কিছু। অনেক আলোকবর্ষ দূরে কোনও গ্যালাক্সির ঘূর্ণন থেকে এই পৃথিবীর বুকে গাছে ফুল ফোটা পর্যন্ত। তেমন নিয়মের প্রভাবে- আমাদের জ্ঞানের রাজ্যে হতে পারে বিশাল। অকল্পনীয়। দুশো বছর আগে প্যারিসে এক বক্তৃতায় ফরাসি গণিতজ্ঞ পিয়ের সিমন দ্য লাপ্লা বলেছিলেন, "তেমন বিশাল জ্ঞান যদি করায়ত্ত হতো আমাদের, যাতে প্রকৃতিতে বিদ্যমান সবকটি বলের হদিস পেতাম, আর জানা থাকতো সমস্ত অণু-পরমাণুর অবস্থান, তাহলে সবকিছু বিশ্লেষণ করে পেয়ে যেতাম সেই একটিমাত্র ফর্মুলা যা নির্ধারণ করতে পারে এই বিশ্বের বৃহত্তম বস্তু থেকে ক্ষুদ্রতম কণার আচরণ। তেমন জ্ঞানের কাছে অস্পষ্ট হতো না কোনও কিছু। অতীতের মতন স্পষ্ট হতো ভবিষ্যৎ। জ্যোর্তিগণনায় রাশিনক্ষত্রের ভূত-ভবিষ্যৎ নির্ভুল বলে দেওয়ার মধ্যে মানুষের মেধা কিছুটা ইঙ্গিত দেয় তেমন প্রজ্ঞার।"

  কি সাংঘাতিক ঘোষণা! লক্ষ্য সেই একটিমাত্র ফর্মুলা শাসন করবে সবকিছুর আচরণ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তাবৎ বস্তুর? বস্তুরা তো অণু-পরমাণুর পিণ্ড। তফাৎ কেবল আকারে। কিংবা আকৃতিতে। এই যে আমরা মানুষেরা, আমরাও তো অণু-পরমাণুরই পিণ্ড। আমরাই বা তাহলে ওই নিয়মের দাস নই কেন? আমাদের প্রাণ আছে বলে? প্রাণ থাকলে প্রভেদ টা কি? 

  সব মানুষজন কিংবা তাবৎ জড় ও জীব- আমরা সব অমৃতের পুত্র। সবাই নক্ষত্রের সন্তান। আমার শরীরে রয়েছে যে কার্বন পরমাণু, অথবা অক্সিজেন কিংবা নাইট্রোজেন, তাদের সবগুলো তারাদের দান। সবকটি কণাই একদিন তৈরি হয়েছিল কোনও না কোনও নক্ষত্রের অগ্নিশিখায়। বাড়িতে আমরা যে আসবাবপত্র, কাঁসা পিতলের বাসনকোসন, তার ধাতব উপাদান মিলতে পারে এই পৃথিবীরই কোনও খনিতে। কিন্তু তাতে কী আসে যায়? মাটির তলায় আকরিকের কোলে আশ্রয় পাওয়ার কয়েকশো কোটি বছর আগে প্রতিটি পরমাণুর জন্ম হয়েছিল কোনও তারার জঠরে। সে তারাটি নেই আজ। হারিয়ে গেছে কোনও বিস্ফোরণে প্রায় দধীচির মতন নিজে শেষ হয়ে। কবে, কখন আর আকাশের কোনখানে, তা আজ আর বলতে পারবে না কেউ। সেই মৃত্যু ইতিহাস ধরা পড়বে না কোনও বিজ্ঞানীর গবেষণাগারে। শুধু যে সত্যটা আমাদের জানাচ্ছে বিজ্ঞান, তা হল এই যে, এই ব্রহ্মান্ডে হাইড্রোজেন আর সামান্য হিলিয়াম লিথিয়াম বাদ দিলে বাকি সবকটা মৌলের প্রতিটা পরমাণুর জন্ম তারার আগুনে। সুতরাং, আমার দেহের অনেকটাই মহাশূন্যে একাধিক ধ্বংসাবশেষের স্মৃতিচিহ্ন। আমার শরীরে রয়েছে যে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, ক্যালসিয়াম কিংবা ফসফরাস পরমাণু, হিমোগ্লোবিনের অংশবিশেষ লোহার যে কণাগুলো, তাদের একটিও ছিল না অন্য কোথাও। আসেনি আর কারও কাছ থেকে। সবগুলো একাধিক শবদাহের ফলশ্রুতি। নক্ষত্রের আত্মত্যাগ, আসলে, আমাদেরই জন্য। কে বলে সবকিছু অর্থহীন? 

  যদি একমেবাদ্বিতীয়ম নিয়ম হয় সবকিছুর নিয়ন্তা, তা হলে যে পরমাণু দিয়ে আমরা তৈরি তারাই বা তা মানবে না কেন? প্রাণ বা প্রাণীও যেসব কিনা উপাদানে তৈরি তারাও মানতে বাধ্য সেই অমোঘ আইন। চেতনার রহস্য সমাধানে মগ্ন বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক তার সাম্প্রতিকতম বই "দি অ্যাসটনিশিং হাইপোথিসিস" এ সম্প্রতি লিখেছেন, "আপনি, আপনার আনন্দ ও বেদনা, স্মৃতি কিংবা অভিলাষ, সত্তা ও স্বাধীন ইচ্ছা- একগুচ্ছ স্নায়ুকোষের উপাদান অণুর আচরণ মাত্র।" এ এক অদ্ভুত ঘোষণা দাসত্বের। যদি এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি অনু-পরমানুই শাসিত হয় একমেবাদ্বিতীয়ম নিয়মে, তা হলে মানুষের মস্তিষ্ক- এবং সেই অর্থে মানুষ নিজেও- তার দাস। এবং তখন আমাদের "ফ্রী উইল" বা ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলে আর কিছু থাকে না। থাকবে কী করে? একটু ভেবে দেখুন। আপনি যখন যা করছেন, তা করছেন আপনার মস্তিষ্কে কতগুলো চিন্তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে। এখন, ওই চিন্তা যদি কেবল অণু-পরমাণুর খেলা বই অন্য কিছু না হয়, আর সেই খেলারও যদি একটা নিজস্ব নিয়ম থাকে, তা হলে তো চিন্তাভাবনা চলছে তারই জোরে। তার পেছনে আপনার-আমার যে কোন হাত নেই! আসলে আমরা  ক্রীড়নকমাত্র। চালক সেই নীতি বা নিয়ম। কোনও শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আপনার তাকে কোলে তুলে নেওয়ার ইচ্ছা, কিংবা ফুলের ঘ্রাণ পেয়ে তাকে প্রশংসার বাসনা- এ সবের কোনওটাই আপনার নিজের নয়। নিজের নয় আপনার খাওয়া, শোওয়া, বসা, কাজকর্ম বা অন্য কোনও কিছু। একটা উদাহরণ দিলে আরও সহজ হবে ব্যাপারটা। বিশ্বনিখিলের নিয়মের সামনে মানুষের কী হাল দাঁড়াবে তা নিয়ে একদা ভেবেছিলেন আইনস্টাইন ও। রমাঁ রোলাঁর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথের ৭০ তম জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তিকায় যে রচনাটি তিনি পাঠিয়েছিলেন, তার প্রতিপাদ্য ও ছিল ওই প্রশ্নটা। ইংরেজি অনুবাদে "অ্যাবাউট ফ্রী উইল" শিরোনামে লেখা ওই প্রবন্ধের শুরুতে আইনস্টাইন বলেছেন: "চাঁদের যদি চেতনা থাকত, তা হলে পৃথিবীর চারদিকে তার শাশ্বত আবর্তন চালিয়ে যেতে যেতে তার নিশ্চয়ই এটাই মনে হত যে, সে পথ চলছে নেহাতই স্বেচ্ছায় এবং নিজের প্রতিজ্ঞায়! ঠিক তেমনই কোনও সত্তা- যার গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও অধিকতর প্রজ্ঞা আছে- সে নিশ্চয় মানুষের এই ভ্রান্ত ধারণায় কৌতুক পাবে যে, তারা কাজ করে তাদের নিজেদের ইচ্ছায়!"

  একমেবাদ্বিতীয়ম নিয়ম যদি থাকেই, তা হলে আমাদের ভালো লাগুক বা না লাগুক আমরা পরাধীনই। দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট একদা বলেছিলেন, যে ক'টি প্রশ্ন মানুষের উত্তরের অসাধ্য তাদের মধ্যে মুখ্য দুটি। এক, ঈশ্বর আছেন কি-না। আর দুই, মানুষ "ফ্রি উইল" এর অধিকারী কি-না। বিজ্ঞানীরা, বলা বাহুল্য, মনে করেন, উত্তর ইতিমধ্যেই মিলেছে প্রথমটির। আর, সমাধান শিগগিরই হবে দ্বিতীয়টার ও। কি রকম সমাধান? ওই যেমন চাঁদের ক্ষেত্রে মহাকর্ষের জ্ঞান। যদি আমরা অচিরে পেয়ে যাই "থিওরি অফ এভরিথিং" তা হলে বুঝতে পারব আমরা কোথায়। চাঁদ যেমন জানতে পারলে দুঃখ পাবে এটা বুঝে যে, পৃথিবীর চারপাশে ঘোরাটা তার 'নিজস্ব' ইচ্ছার কাজ নয়। নেহাতই অন্যের হুকুম তামিল করার ব্যাপার, তেমনই "থিয়োরি অফ এভরিথিং" আবিষ্কৃত হলে আমরাও জানতে পারবো স্বাধীনতা বা ফ্রী উইল একটা ইল্যুশন। একটা ভ্রান্তিবিলাস। আমরা নিতান্তই দাস। শুধু তাই নয়। একটা মাত্র নিয়ম সবকিছু শাসন করলে, কিসের পর কি হবে তাও পূর্বনির্দিষ্ট। ঠিক যেমন নির্দিষ্ট চাঁদ আজ আকাশের এক জায়গায় থাকলে কাল কোথায় থাকবে। "থিওরি অফ এভরিথিং" প্রমাণিত হলে আমাদের দাসত্ব হবে চূড়ান্ত ও নির্লজ্জ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments