জ্বলদর্চি

একশো শতাংশ পাশ : সমস্যার শুরু?/সজল কুমার মাইতি

একশো শতাংশ পাশ : সমস্যার শুরু?

সজল কুমার মাইতি

আমাদের রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। একশো শতাংশ পাশ। খুশির খবর। সেই খুশির আনন্দে ছাত্রছাত্রীরা সেল্ফি তুলতে ব্যস্ত। বাবা মা রাও খুশি। যদিও নিন্দুকেরা এই পরীক্ষাকে ' নিরক্ষরতা দূরীকরণ' এর সঙ্গে তুলনা টানেন। তবে পরীক্ষা নামক যে পদ্ধতিতে ছাত্র ছাত্রীদের মূল্যায়ন এতদিন হতে আমরা দেখে এসেছি, এই রেজাল্ট সেই পদ্ধতিতে হয় নি বা করা সম্ভব হয় নি বিশ্বব্যাপী এই অতিমারির প্রকোপে। এই রেজাল্ট সেই অর্থে প্রথাগত মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল নয়। অনেক জটিল অংকের ফল এই রেজাল্ট। শুধু কি একশো শতাংশ পাশ ( গতবার পাশের হার ছিল 86.34 শতাংশ)?  প্রথম শ্রেনীতে পাশ নব্বই শতাংশ। সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে উনআশি জন। আর প্রথম দশে আছে তেরশো আঠাশ জন। এই সব কিন্তু এরাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় সর্বকালীন রেকর্ড। পাশ তো হোল, রেকর্ড ও হোল, সেল্ফিও হোল; কিন্তু তারপর?

সমস্যা 

ভর্তির সমস্যা 
এবার কি সমস্যার শুরু? পাশের পরে ভর্তির সমস্যা। ছাত্র অভিভাবক সবাইর রাতের ঘুম ছুটে যায় ভর্তির জন্য। প্রথমত, একাদশে ভর্তির স্কুলের সংখ্যা ও তাদের সিটের সংখ্যা এবারের উত্তীর্ণের সংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। সিটের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এই সমস্যার কতদৃর সমাধান করা সম্ভব তা যুক্তি তর্কের বিষয়। এবং অদূর ভবিষ্যৎ ই এর উত্তর দেবে। 

দ্বিতীয়ত, ভর্তিতে পছন্দের বিষয় পাওয়া। বিশেষত বিজ্ঞান ভিত্তিক বিষয়ের ক্ষেত্রে। এবং ল্যাববেজড সাবজেক্টে। এই ব্যাপারে চাহিদার তুলনায় জোগান কম। রাতারাতি এর সরবরাহ বৃদ্ধি ও সম্ভব নয়। তাছাড়া, পছন্দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তার সংখ্যা ও সীমিত। সবাইকে তার পছন্দসই বিষয় পছন্দসই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা কখনও সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ও তা সম্ভব হবে না। তার ফলে কিছুজনের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।

তৃতীয়ত, কলা, বিজ্ঞান অথবা বানিজ্য যে বিষয়ে ছাত্র ভর্তি হতে চায় মার্কশীটের ভিত্তিতে হয়তো সে সেই বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু যোগ্যতার প্রশ্নে তার মূল্যায়ন এই রেজাল্টের ভিত্তিতে কখনও সম্ভব নয়। কারণ সে তো ওই বিষয়ে পরীক্ষাই দেয় নি। তার মূল্যায়ন ও হয় নি। এই বিষয় পড়ার তার যোগ্যতা আছে কিনা তা বিচারের কোন উপায় নেই। ফলে, কিছু ছাত্র তার যোগ্য বিষয় থেকে বঞ্চিত হবে। আর কিছু ছাত্র তার সঠিক বিষয় চয়নে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে। এই সম্ভাবনা প্রবল।

চতুর্থত, যেহেতু ভর্তির ব্যাপারে ডিমান্ড সাপ্লাই বিশাল গ্যাপ থাকছে, তদ্বির তদারকি ভীষণভাবে চলবে। উৎকোচ উপঢৌকন ব্যবহারে অকৃপণ হতে অনেকেই পিছপা হবেন  না। ক্ষমতার প্রদর্শনী, দুর্নীতি, রাজনীতি একে একে সবার প্রবেশ কেবল সময়ের অপেক্ষা। সবলের জয়জয়কার দুর্বলের বঞ্চনা পেছু হঠা স্বাভাবিক পরিনতি এসব ক্ষেত্রে। আর্থিক, পারিবারিক ও অন্যান্য কারণে আরও বেশ কিছু সংখ্যকের পড়া বন্ধ হবে। তাদের ক্ষেত্রে জাতি গঠনের কাজ (Nation building ) থমকে যাবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমস্যা 
অতিরিক্ত পাশের জন্য স্কুলগুলিতে সিট বাড়িয়ে ভর্তি সমস্যার তাৎক্ষণিক অস্থায়িভাবে সমাধানের চেষ্টার ফলে সবচেয়ে ভুক্তভোগী হবে স্কুলগুলি। রাতারাতি তো ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। ক্লাসরুম বাড়ানো, ল্যাবরেটরি বাড়ানো, শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়ানো কোনটাই চটজলদি করা সম্ভব নয়। কিন্তু ছাত্রদের ভর্তি নিতে হবে। লাইব্রেরি সংখ্যা বা সেখানে বইের সংখ্যা স্বল্প সময় বাড়িয়ে ফেলা কক্ষনো সম্ভব নয়। অথচ, এই অতিরিক্ত ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে হবে। পরীক্ষা ও আনুসঙ্গিক সব কাজই করতে হবে। সব দায় স্কুল কর্তৃপক্ষের। সবকিছু সীমিত সংখ্যায় থাকার ফল ভোগ করবে ছাত্ররা। ছাত্র স্বার্থ সর্বৈবভাবে ক্ষুণ্ণ হবে। ফলস্বরূপ, শিক্ষার মান নিম্নমুখী হতে বাধ্য। এই ট্রেন্ড সামগ্রিক শিক্ষার পরিবেশকে কলুষিত করবে। আমার আপনার বাড়ির ছেলেমেয়েরা এই কলুষিত পরিবেশের শিকার হবে ভবিষ্যতে।

ড্রপ আউটের সমস্যা 
আমাদের রাজ্যে এইবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় ড্রপ আউটের সংখ্যা দু লক্ষাধিক। এই হিসেবে আছে নবম শ্রেণিতে নিবন্ধিকৃত ছাত্র সংখ্যা,  কন্টিনিউং ক্যান্ডিডেট{ সি সি) ও কম্পার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেটের যোগফল। তার থেকে এবারের পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বাদ দেওয়ার পর যে অংশ বাকি থাকে তাদের সংখ্যাই হোল এই দু লক্ষাধিক ড্রপ আউট। বাড়িতে বসে পরীক্ষা দেওয়ার এই সুবর্ন ষুযোগ থাকা সত্বেও কেন এই বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এই সুযোগ গ্রহণ কোরল না তার কারণ গভীরে গিয়ে অন্বেষণ করা প্রয়োজন। 

ড্রপ আউটের কারন
ডিজিটাল ডিভাইড
এই করোনা অতিমারিতে আমাদের দেশে বারে বারে এই ডিজিটাল ডিভাইড বা আন্তর্জাল দুনিয়ার বৈষম্যের কথা উঠে এসেছে। গাঁ গঞ্জের এক বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এই সুযোগ সদ্ব্যবহারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তাদের বহু সংখ্যের কাছে স্মার্টফোন নেই বা কেনার ক্ষমতা নাই। তাছাড়াও দ্রতগতির ইন্টারনেট কেনার ক্ষমতা তাদের অনেকেরই নেই। অথবা ওই সকল প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্রুতগতির ইন্টারনেট পাওয়াই সম্ভব নয়। নিদেনপক্ষে স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা অনলাইনে দেওয়া ও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে নি। 

আর্থিক ও অন্যান্য কারণ 
এই অতিমারিতে বহুজন চাকরি খুইয়েছেন কিংবা রোজগার হারিয়েছেন।  বিশেষত, অসংগঠিত ক্ষেত্রে। হকার, রিকশাওলা, ঠেলাওয়ালা, অটো টোটোওলা, ডোমেস্টিক হেল্প, ছোট দোকানদার, তাদের কর্মচারি, স্কুলবাস কর্মচারি ইত্যাদি প্রভৃতি বহু সংখ্যক মানুষ। তাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা নামক বিলাসিতা বর্জন করে জীবন বাঁচানোর তাগিদ অনেক বড় মনে করেছে। তাদের পরিবারের সাহায্যের জন্য তারা সব্জি ফল প্রভৃতি বিক্রি বা সরবরাহের কাজে হাত মিলিয়েছে। আগে তো জীবন বাঁচানো তারপর পড়াশোনার মতো বিলাসিতার কথা ভাবা যাবে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন বিশাল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী যে ড্রপ আউটের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে তা বলাই বাহুল্য। এখনো গ্রামাঞ্চলের বহু জায়গায় মেয়েরা পনেরো ষোলোয় পৌঁছলে মা বাবারা বিয়ে দিয়ে দেন। এক, বিয়ের দায় থেকে মুক্তি ঘটে। দুই, সোমত্ত মেয়ে বাড়িতে বেশিদিন রাখার ভয় থেকে ও মুক্তি ঘটে। অতএব বিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারার কাজ করে দেয়। সেকারনেও ড্রপ আউটের সংখ্যায় বৃদ্ধি ঘটে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির লোকেদের ক্ষেত্রে এই সমস্যার প্রাবল্য দেখা যায়।

  করোনা অতিমারি যে বিশাল ক্ষতচিহ্ন সমাজের বুকে এঁকে দিল, তার সেই দগদগে ঘা শুকোতে হয়তো বহু সময় লেগে যাবে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই ক্ষতের সুদূর প্রভাবী ফল ভূগতে হবে এই সমাজকে। অগ্রনী সমাজ পিছিয়ে পড়াদের সাহায্যের হাত ধরে টেনে না তুললে এই ক্ষত দীর্ঘস্থায়ী হবে।

তথ্যসূত্র: বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও ওয়েবসাইট।

-------------------------
প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, বানিজ্য বিভাগ, হুগলী মহসীন কলেজ। পূর্বতন অধ্যাপক, গোয়েঙ্কা কলেজ অফ কমার্স এ্যান্ড বিজনেস অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন, কলকাতা। চৌত্রিশ বছরের অধিক কাল ইউ জি ও পি জি শিক্ষা দানের অভিজ্ঞতা। বতর্মানে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কলেজের বানিজ্য বিষয়ে সিনিয়র সার্ভিসের একমাত্র অধ্যাপক।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments