সম্পাদকীয়,
বাচ্চাগুলো বসে বসে হি হি করে হাসছিল আমি বললাম, তোমরা হাসছ কেন? সবাই মিলে একসাথে বলল, পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই। এরা কারা জানো? এরা কবি ঋপণ আর্যের পাড়ায় থাকে। ওরা না বললে কি হবে আমি তো জানি ওরা কেন হাসছে। ঐযে শ্রীকান্ত আঙ্কেল তালের বড়া খাবার সিজিনে ভূতের ভয় দেখিয়ে তাল তলায় যেতে বারণ করেছে সেই শুনেই ওরা হাসছে। ওদের আবার ভয় ডর আছে নাকি! ওরা শুভশ্রী আন্টির উরুম্বুটে কাকটার মতো। যখন যাকে পায় তাকে জ্বালিয়ে মজা পায়। মজার কথায় মনে পড়ে গেল দীপ আঙ্কেল আর জগদীশ জ্যেঠু তোমাদের দারুণ মজার মজার ছড়া শুনিয়েছেন। মজার কথায় যতই হাসো আপত্তি নেই। ভয় কাউকে না পাও তাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু মনে রেখো ফুলকুসুমপুরে বুম্বা তিন্নিদের বাড়িতে মাস্টারমশাই আসবে পড়াতে, তোমাদেরও সেদিন শীঘ্রই আসবে। তার আগে তৈরি হয়ে যাও ভ্যাকসিন নেবার জন্য। ছোটোদের ভ্যাকসিন আর এলো বলে। আর ভ্যাকসিন যাতে সবাই নেয় তারজন্য বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন অফার দিচ্ছে সেটা জানো তো? না জানলে জেনে নাও তথাগত আঙ্কেলের কাছে। ভ্যাকসিনের কথায় একটু ভয় পেয়েছো মনে হচ্ছে? এবার তাহলে শুনে নাও এক নির্ভিক মনিষীর কর্মকান্ডের কথা পীযূষ প্রতিহারের কলমে। এবার তোমরা খাতা কলম নিয়ে বসে যাও, ঝটপট স্বস্তিকা দিদির গল্প আর বন্ধু অভিকের ছড়া পড়ে জানিয়ে দাও, কেমন লাগল এবারের ছোটোবেলা। -- মৌসুমী ঘোষ।
রাম রাবণ
দীপ মুখোপাধ্যায়
যেই না ওকে প্রশ্ন করা
মুখ শুকিয়ে আমশি তার
কান্ড দেখ সেই ছেলেটার
নাম শোনেনি রাম -সীতার।
গোদাবরীর পূর্বতটে
সত্যি ছিল ভর দূষণ?
দাপিয়ে ছিলেন জংলাবনে
শূর্পনখা খর -দুষণ?
এক জটায়ু পক্ষী সেদিন
ধমকে ছিলেন রাবণকে
ফল পাবি তুই করলি যখন
এই অপমান মা-বোনকে।
করতে পালন প্রতিজ্ঞা রাম
বলেন কেমন বাক্য সে?
রাম,লক্ষণ,বানরসেনা
পিটিয়ে মারে রাক্ষসে?
কীসের জন্য বিখ্যাত আজ
লংকাদেশের আমড়া বন
বাল্মীকি তাঁর রামায়নে
ঠিক এঁকেছেন রাম-রাবণ?
রাঙাপিসির গল্প
তাল ত্যালামো
শ্রীকান্ত অধিকারী
এক দেশে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ ছিল । অ্যাই দাদা , ও রাঙাপিসি আমার গল্পটা শোনো না। ভূতের গল্প কিন্তু। ছমছমে ভূতের গল্প। একদম কথা বলবে না । ছোটো গল্প বলতে শুরু করে। --এক দেশে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ ছিল। সারাদিন ভিক্ষা করে যা আনতো তাই দিয়ে ব্রাহ্মণী মাটির হাঁড়িতে দুফুট ফুটিয়ে দু জনে চাট্টি খেত। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি একদিন এক গ্রামের মাঝে তালদিঘীর পার ধরে যেতে যেতে ব্রাহ্মণের সামনে ধুপ করে একটা পাকা তাল পড়ে। সেই তাল কুড়িয়ে মনের আনন্দে ঝোলায় ভরে এনে ব্রাহ্মণীকে দেয়। ব্রাহ্মণীও খুশিতে তাল ঘসতে লেগে পড়ে। তারপর তালের ফুলুরি , লুচি পিঠে কত কি বানিয়ে খাবে , ব্রাহ্মণের খুশি আর ধরে না । ঘরের এ পাশ থেকে ওপাশ সব জায়গায় তালের গন্ধে ম’ম’ করে। এদিকে সন্ধে পেরিয়ে রাত ঘন হয় । ব্রাহ্মণ তো খিদে সইতে পারে না। ব্রাহ্মণীকে তাড়াতাড়ি লুচি ফুলুরি দিতে বলে। কিন্তু ব্রাহ্মণী রান্নাঘর থেকে বেরোয় না। ব্রাহ্মণ খিদে সহ্য করতে না পেরে ব্রাহ্মণীকে বকাঝকা করে। ব্রাহ্মণী গোমরা মুখে বলে , কী বলব বল । এই মাত্র তুমি থালা চেটেপুটে সব খেলে। আমার জন্য কিছুই রাখলে না। এমন কি আমি দুটো লুকিয়ে রেখেছিলাম সেটাও পেলাম না। আর তুমি আবার এসেছ তাললুচি চাইতে! - পেট না প্যাটরা । ব্রাহ্মণ রেগে কাঁই। নিজে খেয়ে এখন মিথ্যে বলা হচ্ছে ! এই চললাম ঘর ছেড়ে।
--তুমি খাওনি বলছ, তাহলে কি ভূতে খেল? ব্রাহ্মণী মাথা চাপড়ায় । হ্যাঁ গো তাহলে ওই একনেড়েটা এসেছিল তোমার বেশ ধরে। আমি বুঝতে পারি নাই গো। বলেই ব্রাহ্মণী কাঁদতে বসে। ব্রাহ্মণ আসল সত্যিটা বুঝতে পারে। তার বউ মিথ্যে বলছে না। পুকুর পারে তালগাছের ওই একনেড়েটা আবার কোন ফাঁকে এসেছিল । -- ‘দাঁড়া তোর মজা দেখাচ্ছি’ বলে ব্রাহ্মণ এক ঘটি জল নিয়ে ছোটে ওই তালগাছটার দিকে । নিষ্ফলা তালগাছ। তাল ধরে না । কী করে ধরবে ওখানে যে একনেড়ে থাকে। পাড়ার লোক তাই এড়িয়ে চলে । ব্রাহ্মণ অবশ্য রাগে ওসব কথা চিন্তা না করে এক গণ্ডূষ জল নিয়ে ‘অং বং চং লং , ভূতের চোদ্দ পুরুষ উচ্ছেদ হং’ -- মন্ত্র বলে যেই না গাছের গায়ে ছিটিয়ে দিতে যাবে অমনি খোঁড়া পায়ে একনেড়ে এসে হাত জোড় করে খোনা গলায় বলে , আঁমায় কিঁছু কঁরো না। লোঁভে সঁব খেঁয়ে ফেঁলেছি , কীঁ কঁরতে হঁবে বঁল আঁমি কঁরে দিঁচ্ছি ।
-- তুই আমার খাবার খেয়েছিস। আবার আমার বউকে ভুল বুঝিয়েছিস । যেখানে পারিস আমার তাল এনে দে। তা বাপু ব্রাহ্মণের ভয়ে সেই একনেড়ে ভূত কোত্থেকে ফুড়ুৎ করে গোটা কয়েক পাকাতাল এনে তালগাছের মাথা থেকে টুপ টাপ করে ফেলে দেয়। ব্রাহ্মণ সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে একনেড়ে ভূতকে আদেশ দেয়, তুই দুটো অন্যায় করেছিস । তার জন্য দুটো শাস্তি পেতে হবে। তাল এনে একটা দোষ কাটিয়েছিস। আর একটা -- এই নিষ্ফলা গাছটাকে সু ফলা করে দিতে হবে।
--সেঁ কীঁ কঁরে কঁরব? এঁটা তোঁ আঁমার হাঁতে নাঁই।
ব্রাহ্মণ রেগে গিয়ে হেঁরে গলায় বলে, - তবেরে দে করে দে বলছি। নইলে তোর চোদ্দ পুরুষের শ্রাদ্ধ করে ছাড়ব।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে একনেড়ে রাজি হয় ,--ঠিঁক আঁছে ঠাঁকুর মঁশাই । আঁপনি কাঁলকেঁই দেঁখবেঁন এঁই পুঁকুঁরপাঁরে যঁত নিষ্ফঁলা গাঁছ আঁছে সঁব গাঁছেঁই কেঁমন এঁক গাঁছ কঁরে হাঁড়ি হাঁড়ি তাঁল ধঁরবেঁ। তার পরদিন সত্যি সত্যি সকালে গাঁয়ের লোকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল ,--গাছে গাছে এত্তো তাল! ---- কেমন লাগলো ব্রাহ্মণ আর ভূতের গল্প ? অ্যাঁ ? ছোটো জানতে চায় ।
---ঘোড়াড্ডিম! কোত্থেকে সব আজগুবি গল্পগুলো পাস? যে গাছে ফল হয় না সে গাছেও ফল ধরে গেল!
--অ্যাঁ । এতক্ষণ শোনার পর বলে কিনা ঘোড়াড্ডিম! ছোটো চেঁচিয়ে ভেঁভিয়ে একশা। -- আমার বন্ধু সুশীলা এই গল্পটা শুনিয়েছে ।ওদের গাঁয়ে নাকি এ রকম বহু তালগাছের সারি ছিল । তুই জানিস না।
আহা তোরা হাতাহাতি থামাবি? – রাঙাপিসি গুনগুন করে,-- ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি / আছে আমাদের পাড়াখানি । দিঘী তার মাঝখানটিতে / তালবন তারি চারিভিতে।
বাবা হঠাৎ কোত্থেকে এসে বলে, না না এ রকম ঘটনা বাস্তবে ঘটে। পুরুষ গাছ , যে গুলোতে ফল হয় না , সে গাছেও ফল হয়। আমাদের দেখা।
আজ সারাদিন এত বৃষ্টি এত বৃষ্টি বাবা অফিসই যেতে পারে নি । তবে ওয়ার্ক ইন হোমে ছিল। অন্যদিন অফিস ফেরত বাবা আমাদের গল্পে যোগ দেয় না। আজ হঠাৎ আমাদের কাছে বসে পড়ে গল্প শোনাতে ।
সেদিন সকালে উঠেই দেখি পাশের বাড়ির দামুজেঠুর বাড়ির সামনে অনেক ভিড়। রাস্তার পাশে ঠিক তালগাছটার সামনে । ওটা দামুজেঠুদের । কিন্তু ওই তালগাছে তাল ধরে না। কেমন লম্বা লম্বা দড়ির মত মুকুল হয় । তারপর এক সময় শুকিয়ে যায়। সেই নিয়ে দামু জেঠি-জেঠার আফসোসের অন্ত নেই। অথচ পাড়ার আর যত গুলো গাছ আছে, তাল বোনা , শাল পুকুরের ধারে জামতলার মাঠে সব গাছে তাল ধরে। বেশ কালো কালো তিন আঁঠি । কোনোটা আবার চার আঁঠিও হয়। তাল পাকার আগে তাল শাঁস , পাকলে তালমারি দিয়ে তালের ফুলুরি, পিঠে, তালরুটি কত না করে সব। ভাদ্র মাসে আশপাশে পাকা তালের গন্ধে ঘরে থাকা দায়। আর তার কিনা গাছ থাকতে তাল নেই। এই সময়ে লোকের কাছে ধার করে কিংবা চেয়ে আনতে হয়! দামুজেঠির মনে ভীষণ কষ্ট । এ দুখের কথা কাকে বলা যায়। অথচ এই দামরা গাছটাতে তালের বদলে তালখাংরা পড়ে । নিঃশব্দে। মানা যায়!
সেই দামরা তালগাছটাকে ন্যাড়া করা হচ্ছে । ভাবলাম রাগে দুঃখে দামুজেঠু এই হতচ্ছাড়া কান্ড ঘটিয়েছে। উনি কি জানেন না পাতা কেটে দিলে গাছ মরে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আমার ভুল ভাঙে । অবাক হয়ে দেখি ঘরা ঘরা দুধ দইয়ে স্নান করানো হচ্ছে। সবার মুখ তখন ওই ন্যাড়া গাছটার দিকে। কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলে , কত দুধ রে ! মনে পড়ে গেল আমি সকালে একবার মেজদার বাটি থেকে লুকিয়ে একটুখানি দুধ ঢেলে নিয়েছিলাম আমার মুড়ির বাটিতে । সে কি দাদার কান্না।
দুধের পর দই । বালতি বালতি। কেমন গড়িয়ে গড়িয়ে মাটি কাদা করে দিল। এদিকে তখন ঢাক বাজতে শুরু করেছে। চড়াম চড়াম বাজনায় গাঁ মাত করে তুলেছে। তারপর সেই ন্যাড়া তালগাছের গোড়াতে সিঁদুর লাগিয়ে ফুল বেলপাতা দিয়ে পুজো করে আমাদের চানা ঠাকুর।
সকাল বেলায় এ কি কান্ড!-- আমার মা বাবাকে বলে।
বাবা বলে, - দেখছ না ফল ধরে না। এবার ফল ধরবে।
-- মানে ?
--দেখে যাও। যেমন ওরা দেখছে তুমিও দেখ। মা গলা উঁচিয়ে তালগাছের ন্যাড়া মাথাটার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে। একটু আগে ঝাঁকুর ঝুকুর পাতা ছড়িয়ে কি সুন্দর ছিল । এখন একেবারে ন্যাড়া !
হঠাৎ দেখি বাগদি পাড়ার গদাইকাকা মাথায় বিশাল চাল ভাজার খোলা নিয়ে সর সরিয়ে গাছে উঠছে। এতক্ষণ খেয়াল করিনি নিচেও ওই রকম অনেক মাটির খাপুরি ডাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে। দেখতে না দেখতে একটা একটা করে গদাইকাকা ওই ন্যাড়া মাথায় খাপুরি গুলো চাপিয়ে দেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে দামুজেঠি দেখি গলা ফাটিয়ে উলু উলু দিতে শুরু করে। দামুজেঠু বিশাল বড় একখান শাঁখে ফু দিতে থাকে। সে এক দৃশ্য বটে!
এই দেখেই কি রবি ঠাকুর লিখে ফেললেন সেই কবিতাটা –তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে / সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে।
মায়ের কথাতে বাবা ছাড়া রাঙাপিসি আমরা দু ভাইবোন আর মা ফিক ফিক করে হেসে ওঠি । মা বলে, নাও নাও দুটো মুচমুচে তালের ফুলুরি খাও দেখি। মন চনমনে হয়ে উঠবে।
--বউমনি তুমিও না এমন একটা সিরিয়াস গল্পে এমন কথা কেউ বলে ?
-- ও বিশ্বাস হলনা বুঝি !বাবা বলে , রাঙাদি তুমি শোননি গল্পটা ? দামু মণ্ডলদের বাড়ির ঘটনা। বাবা রাঙাপিসিকে সাক্ষি মানে।
রাঙাপিসি কিছু বলার আগেই মা আবার মুখ চেপে বলে , -তা পিসি এই তালগুলো কি ওই ন্যাড়া তালগাছটার ? বলেই মা ঝট করে রান্না ঘরে চলে যায়। ওখান থেকেই বলে ,--আজ কিন্তু তাললুচি আর তালমারির পায়েস হবে ।
বাবা গুম মেরে বসে। কোনো উত্তর দেয় না। চার্যারের ঢিমে আলোতে বাবার মুখটা কেমন লালচে হলদে লাগে।
বাইরে অঝরে বৃষ্টি । কিছুক্ষণের জন্য থামছে , আবার ঝমঝম করে শুরু হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বারান্দার ফাঁক দিয়ে ঝিরঝিরে আলো তালমারির মত ছিটকে ছিটকে পড়ছে। আমাদের বাড়ি আসা রাঙাপিসির বেশ ক’দিন হয়ে গেল। সঙ্গে কুলের আচার, নারকোল নাড়ু, মুড়ির মোয়া , কুসুম বীজ দিয়ে হলুদ মাখানো কড়কড়ে তো ছিলই । এবার সঙ্গে জুটে ছিল গোটা কতক হেরো হেরো তাল । ক’দিন তালগুলো বাড়ির মধ্যে থাকার পরই পাকা তালের গন্ধে ঘর ভরে গেছিল । আর রাখা যায় না। সকাল থেকে রাঙাপিসি একটা একটা করে তাল আঁঠিগুলো ঝাঁঝরির উল্টোদিকে ঘষে ঘষে তালমারি বের করেছে।তারপর গরম করেছে। সারাদিন ওই করেছে।
কফির মগটা টেবিলে নামাতেই রাঙাপিসি বলে , না বউমা এটা তোমার কাছে আশ্চর্য মনে হলেও সত্যি। গ্রামাঞ্চলে এখনো যে গাছে পেপে ধরে না সেই গাছের গুঁড়ির মধ্যে কাঠের গুঁজি মানে এই ধর যে কোনো একটা কাঠ গুঁজে এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে দিয়ে রেখে দেয়। কেউ কেউ আবার গাছের ওপরে নিচেও দেয়। এবং কিছুদিন পর দেখা যায় তাতে দিব্যি ফল ধরেছে।
রাঙাপিসি তুমিও না ! সে হয়তো জেব্বারেলিন এথিলিনের মত উদ্ভিদ হরমোনের ব্যবহার করে গাছের প্রকৃতি বদলে দেয়। কিন্তু ওই ভাবে গাছকে ন্যাড়া করে, ঘোল ঢেলে , মাথায় মাটির খোলা খাপুরি চাপিয়ে পুরুষ থেকে মহিলাতে রুপান্তর করা কেমন আজগুবি লাগছে না ? তারপর আবার তাল ধরা।
না মা ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেবার নয়। এর একটা সাইন্টিফিক কজ আছে। অ্যাকচুয়ালি বোরাসাস ফ্ল্যাবেলিফার নামে এই তাল গাছধর্মী গাছের প্রকৃতির রূপান্তর হতে পারে। ভূট্টার ক্ষেত্রে বেশি ফলনের জন্য জেব্বারেলিন ব্যাবহার করা হয়। আবার কুমড়ো গাছে এথিলিন হরমোন প্রয়োগ করলে কুমড়োর সংখ্যা এবং পরিমাণও বাড়ে । তালের ক্ষেত্রেও তাই। আবার কখনো কখনো কৃত্রিম হরমোন যেমন ইন্ডোল বিউটারিক অ্যাসিড ইন্ডোল অ্যাসিটিক অ্যাসিডের ব্যবহারও হচ্ছে।
আমার মা এবার এক বাটি তালের মালপোয়া আমাদের সামনে আলতো করে রেখে দিয়ে , রাঙাপিসির গা ঘেঁসে বসে বলে , এই শোনো তোমাদের অনেক তাল ত্যালামো শুনলাম। মাথা ধরে গেল ।এবার রাঙাপিসির কাছে সত্যিকারের ভূতের গপ্প শুনবো । যদি ছোটো বড় মিলিয়ে একটু ট্যাঁ ফুঁ করেছো দেখবে রাতের মেনুতে তাল উধাও । একনেড়ে ভূতটা এসে রান্নাঘর ফাঁকা করে দিয়ে গেছে। সে ক্ষমতা তো নেই যে ঘটি-জল নিয়ে ভূতকে ভয় দেখাবে। বলেই ছোটোকে একটা তালের মাল পোয়া হাতে দিয়ে বলে, নাকি রে ছোটো ।
রাঙাপিসিও একটা মালপোয়া হাতে নিয়ে শুরু করে, -- তখন গ্রামের ভেতরে কিংবা বাইরে অনেক তালদিঘী ছিল। পুকুরের গায়ে গায়ে কিংবা রাস্তার ধারে ধারে সব তালগাছের সারি। বিভূতিবাবুর ‘তালনবমী’ তো তোদের মত বাচ্চাদেরই গল্প । তাল নিয়ে কত যে কান্ড হতো। তখন চৈত্র বৈশাখ মাস থেকেই তাল নিয়ে লম্ফঝম্ফ শুরু হয়ে যেত। আমাদের তো আগে হতো। স্কুল থেকে ফিরে তালের ভুটুং নিয়ে পুকুরের জলে সে কী নাচানাচি! ও হো তোরা আবার ভুটুং কি জিনিস জানিস না। আমগাছে দেখেছিস বড়ো হওয়ার আগেই ছোটো ছোটো আম কেমন গাছথেকে খসে খসে পড়ে । কুসি কুসি আম। ঠিক তেমনি তালের হয়। অনেক তাল বড়ো না হয়ে ছোটো থেকেই পড়ে যায় । এ গুলোই ভুটুং । জলে এরা ডোবে না। সে নিয়ে চলত জলখেলা। তারপর শ্রাবণ ভাদ্র মাসে পাকা তাল হলে তখন তাল কুড়োবার ধুম পড়ে যেত। তাল তলাতেই তখন খেলা। খেলতে খেলতে মন থাকত তাল পড়ার শব্দের দিকে। কখন ধুপ করে শব্দ হবে আর আমরা ছুটে যাব । হুটোপুটি লেগে যেত কে আগে তাল কুড়োবে। এ তো গেল দিনের বেলা। রাতে ঘুম হত না গভীর রাতে কে কখন যাবে তালবনে কিংবা দিঘীর পারে তাল কুড়োতে । সেই অন্ধকার রাতে কখন হ্যারিকেনের বা টর্চের আলোতে তালের খোঁজে । এমন হয়েছে রাত বুঝতে পারিনি। পাখিরা কিচিরমিচির করে ডেকে উঠেছে আর ধরফর করে উঠেছি তাল কুড়োতে। সবার আগে যেতে হবে তো। তালতলাই এসে দেখি কেউ কোথাও নেই । ভালোই হল আমি একাই তাল কুড়োবো। তারপর বাঁশঝোঁপে ঝাড়ে জলে নেমে আতিপাঁতি তাল খুঁজছি এমন সময় দেখি একটা আলো ঝুলতে ঝুলতে আমার দিকেই আসছে। এই সময়ও কেউ এসে গেছে তাল কুড়োতে। আমার হাতে কোনও আলো ছিল না। তাই সে আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু খানিকক্ষণেই বুঝলাম আমি ভুল । ঠিক সে আমাকে দেখতে পেয়েছে। কেমন একটা ঠান্ডা ফ্যাস ফেসে গলায় বলে কে রে? গলা শুনে আমি চমকে উঠি । এ রকম গলা তো একমাত্র নবীনচাচার। মানে ফকিরপাড়ার নবীনুদ্দিনের । ও তো গরুর ব্যবসা করে। ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ায় । গরু ছাগল দেখে । এই তালের সময় দু একটা করে পাকাতাল দিয়ে দু পয়সা রোজগার করে নেয়। নবীনচাচাও কি তাল কুড়োতে এসেছে। বললাম, কে নবীনচাচা নাকি! কিন্তু ওই আলোটা আমার কথা শুনলো না। বলল , বাড়ি যাও। সকালে এসো।
---উঁ নবীনচাচা খুব চালাক না। তালগুলো তুমি একাই কুড়োবে? মুখে বললাম,-- সকালে এলে তাল পাব না তো।
--- বেশ তবে তাল খোঁজো। কিন্তু তুমি যেখানে বসে আছো সে গাছে তাল ধরে না। তালও পাবে না। তার চেয়ে তুমি বাড়ি যাও । আমি ঠিক তাল দিয়ে আসব।
বলতে চাইলাম , নবীনচাচা তুমি আমাদের বাড়ি অনেকদিন যাও নি তো , কিন্তু বলার আগেই দপ করে আলোটা মিলিয়ে গেল । বুকটা একবার কেমন করে উঠল। ভাবলাম ভূত বুঝি । বর্ষা শেষে ভিজে আঁশটে অন্ধকারে তালগাছে ভূত থাকবে না তা কি হয় ! তারপরেই স্থির করে নিলাম হাওয়া বয়ছে তাই হ্যারিকেনের আলোটা নিভে গেল। তাল কি আমি একাই কুড়োবো ! নবীনচাচার কথা না শুনে তাড়াতাড়ি এখান ওখান করে এক গাদা তাল জোগার করেছি। তখন চিন্তা হল এই তালগুলো কী করে বাড়ি নিয়ে যাব। আবার ফেলে চলে যেতে পারছি না। রাতের অন্ধকারে বাড়ির লোককে না জানিয়ে ঠাই হেঁটমুন্ডু হয়ে বসে বসে তাল আগলাচ্ছি । আর অপেক্ষা করছি কখন আকাশ ফর্সা হয়। এদিকে টিপটিপ বৃষ্টিতে পাশের বাঁশবনের ভেতর থেকে একটানা বাঁশে জোরে হাওয়া লেগে কটাকট শব্দ আর ঝিঁঝিঁ পোকার কান ঝালাপালা করা শব্দ মিলেমিশে একাকার । এরপর একটু দূরে নদীর গায়ে ধেনো মাঠ থেকে ভেসে আসা শিয়ালের হুক্কি হুই আর খটাসের ভয়ঙ্কর খ্যাক খ্যাকে আওয়াজ আমার হাড় হিম হয়ে দাঁত কপাটি লাগার জোগার। শুধু তালগুলো আঁকরে কতক্ষণ বসে আছি জানি না হঠাৎ দেখি কে যেন হাঁঊ মাঁউ করে ও বাবাগো মাগো ভূতে ধরলে গো বলে চিৎকার করে বিভ্রাট ঘটিয়ে কুপোকাত। হঠাৎ এমন কান্ডে আমার এতক্ষণের জমানো সাহসও কোথায় উবে যায় । ভয়ে আমিও ওই সাধের তালগুলো ফেলে ভূ–ত ভূ--ত করে চেল্লাতে চেল্লাতে বাড়ির দিকে আড়িপাড়ি ছুটছি দেখি সামনে একটা আলো । দুলছে। কাছে যেতেই সেই ফ্যাস ফেসে গলায় বলে , তোমাকে বাড়ি যেতে বলেছিলাম না। চল আমার সঙ্গে । তারপর আর মনে নেই । এক্কেবারে বাড়ির দরজায় চোখ মেলে দেখি বাবা আর পাশের বাড়ির কাকু লাঠি - হ্যারিকেন হাতে রাস্তায় বেরিয়েছে আমার খোঁজে। তারপর মাকে বাবার সে কী বকুনি। কতবার বলেছি তোমরা তালতলায় যাবে না। জানো কাল বিকেলে ফকির পাড়ার নবীন হাট থেকে ফিরছিল। সেই সময়ে তালগাছে বাজ পড়ে মরে গেছে। সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম । তবে বাবার বকাঝকার জন্য নয়, বা নবীনচাচার মাথায় বাজ পড়ে যাওয়ার জন্যও নয় । মন খারাপ হয়েছিল অতগুলো তাল তালতলাতেই ফেলে এলাম !
টিকাকরণ কর্মসূচি
তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়
রাজ্যে এখনো কেন টিকার জোগান নেই !
বলেছি যা রাগ ছিলো - সবাইকে জানিয়েই ।
এ প্রথম অতিমারি, বাপের জন্মে দেখে –
গেলো হায় কতো দিন, গৃহবন্দীই থেকে !
খবরের কাগজটা পড়ে দেখে চটি বেশ,
ঘুষ-টুষ দিয়ে টিকা দিচ্ছে অনেক দেশ !
আমোদ-প্রমোদে বাধা দিয়েছে ইসরায়েল,
জমায়েতে টিকা নিয়ে না এলেই হবে জেল ।
টিকা নিলে, নিউ জার্সিতে সুরাতেও ছাড়!
রাশিয়া, সার্বিয়ায় টাকা দেবে সরকার ।
থাইল্যান্ডে কোথাও ঘর পিছু গরুদান !
ছাত্রবৃত্তি দেবে নিউ ইয়র্ক, যদি চান ।
চীনে নাকি দেবে কেউ বিনাপয়সায় ডিম !
দুবাইয়ে ছাড় পাবে, কেউ যদি যায় জিম ।
ওহিও’র মতো ফেলে লটারি জেতার টোপ -
অস্ট্রেলিয়াতে কিছু মানুষের বাড়ে কোপ ।
টিকা নিয়ে গুজরাটে নাকছাবি পাচ্ছে,
অন্ধ্রয় বিনিময়ে বিরিয়ানি খাচ্ছে ।
এমন উদ্দীপক নেই কেন বঙ্গে ?
চায়ের দোকানে মাতি পড়শির সঙ্গে ।
চর্চায় ডুবে ভুল মুখাবরণের স্থানে;
রয় থুতনির নীচে, পড়শির এক কানে ।
তার ওপর ভুয়ো টিকা আর নৈরাজ্য,
করোনা, করুণা করো, জেরবার রাজ্য !
এতো লোক, এতো শোক, এই দুরাবস্থায়,
ভোরের স্বপ্নে টোকা মেরেছে বহু টিকায় !
কোভ্যাক্সিন বা হোক কোভিশিল্ড, স্পুৎনিক,
সাদরে ফুটিয়ে নেবো - ভাবতাম যা’ই দিক ।
ক্ষোভ ছিল টিকা কেন সহজলভ্য নয় !
উল্টে স্বপ্নে বেশি টিকা দেখে সংশয় ।
কে বেশি কার্যকর, তুলনায় কে যে কম?
অনাক্রম্যতায় কোনটার বেশি দম ?
ডাক্তারে বলে – “যা পাবেন, তা’ই নিতে যান !”
জ্যোতিষী দেখিয়ে ভাবি রাশি বুঝে পাবো ত্রাণ ।
হাত বা কপাল বুঝে, তিল-টিল খুঁজে ত্বকে,
কোন টিকা লেখা আছে জানবো জন্মছকে !
একে তো প্রাণ বাঁচাতে টিকা, তায় ঘুষ চাই;
মানুষের জীবনের শত্রু মানুষেরাই ।
যখন টিকা আসেনি, ভয় ছিলো - বাঁচবো কি !
টিকা এসে গেছে তাই আর ক-টা দিন দেখি ।
বেশতো চলছে ঘরে বসে, জমা টাকাতে,
গানে, ছড়া-কবিতায় আর ছবি আঁকাতে ।
টিকা বানানোটা শুধু গবেষকদেরই দায়,
আমাদের মনোযোগ - ভয়ে, পরনিন্দায় ।
উরম্বেটে কাক!
শুভশ্রী সাহা
রসোর ওই এক দোষ বরাবরের! খাবারের গন্ধ পেল তো পৃথিবী রসাতলে গেলো। পিসির জন্যে গয়েশপুরের হাটের থেকে গোরুর ওষুধ আনতে এসেছিল। তা, আবার হাটের মুখেই সুবলের জিলিপি তেলেভাজার দোকান, উল্টোদিকে নন্দ ফুলুরি! যেই না জিলিপির গন্ধ এলো নাকে, তক্ষুনি খ্যাটন চাই! রইল পড়ে গোরু আর তার ওষুধ, আহা কি রঙ, চালকুমড়োর পুর দিয়েছে বেশ মিহিতে, শালপাতার উপর একটা জিলিপি পড়তেই রসো গালে দিয়ে এগাল ওগাল করে মুখটা রসস্থ করে নিতে না নিতেই আর একটা পড়লো পাতায়। অমনি ঠিক অমনি হতভাগা সেই কাকটাই মনে হয় হাজির হয়ে টুই করে তুলে নিলো জিলিপি টা! রসো, মানে ভালো নামের দু কড়ি গায়েন হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। না হে না, রসোর জীবনে আর রস নেই। হতভাগা কাক টা---
ক দিন থেকেই অমন হচ্চে বটে, রসো অত সব কাজ টাজ করতে মোটে পছন্দ করে না। সে দুপুর বেলায় কেজি খানেক ভাত ডাল ঘ্যাট আর পিসির দেওয়া এক টুকরো মাছ নিয়ে বসতে না বসতেই-- টুই করে দাওয়া থেকে মাছ নিয়ে লোপাট। পরের দিন ছানাগজা মালপোয়া পজন্তি উধাও! আবার খাবার আগে খালি ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে দেখবে!
রসো ওর জন্য ভেবে চিনতে বানালো খটখটি!গুলতির বাবা একেবারে, যেমন শক্তি তেমন টিপ। যেই বাড়ীর নিম ডালে এসে বসেছে, দিলে এক টিপ! ওমা কোত্থাও কিছু নেই, খটাং করে গিয়ে গুলতি পড়লো রসোর পিসির মাথায়! পিসি হা রে রে করে ছুটে আসার আগেই রসো আবার দিলো টিপ। কি জানি কি হলো! গুলি ঘুরে এসেই লাগল রসোর কপালে । সে চোখ মুখে অন্ধকার দেখে পড়তে পড়তে পরিস্কার যেন শুনলো কাক বলছে-- আর গিলবি!! ক্ষমতা থাকে গিলে দেকা হতভাগা!
কাক কথা বলে! এমন শত্রুতা করে! এসব কি হচ্ছে রে বাবা! এতটাও ভুল শুনবে!
চট জলদি বাড়ী ফিরে এসেই সে চানকরে সবে দুটো খানেক ভাত দেবে গালে,আজ পিসি সকাল সকাল রসা রসা করে ফ্যাসা মাছে ঝাল করেছে। দেখে থেকেই তার মন আনচান! অমনি আবার কাক এসে মাছ ছোঁ করে নিয়ে পগার পার! ডান্ডা নিয়ে তাড়া করতে গিয়ে দড়াম করে রসো পড়লো উঠানে! স্পষ্ট শুনলো বলছে, হাতি,হাতি ব্যয়াম করে বাড়া ছাতি! ডানা ফরফর করছে আর হি হি করে হাসছেও!
পিসিকে বলতেই পিসি বলল, আ মর! কতা কি! কতা শুনচিস কই, এতো কা কা করে হদ্দ হচ্চে
রসিকের মাথা আর ঠিক থাকছে না, শুধু সে শুনছে কথা, তার খাবারে ছোঁ মারছে, খেয়ে নি চ্ছে, অথচ বাকিরা কেউ দেখছেও না, শুনছে না! ভূতের ব্যাপার নাকি! রসোকে এতকাল পরে সবাই চিন্তিত দেখলো।
ভোর বেলা গড়িয়ে সকাল না হলে রসো বিছানা ছাড়ে না। মা পিসি রোজ গালমন্দ করে। কবে ইস্কুল ছেড়ে দিয়েছে ক্লাস এইটের পর থেকেই, অথচ দিব্য অঙ্কে মাথা ছিল তার। ওই যে খাওয়া খাওয়া করেই সব গোল্লায় গেল তার। ইস্কুল, ফুটবল বন্ধু, এখন শুধুই খাওয়া আর ঘুম, ঘুম আর খাওয়া। বাবার কিছু জমি জমা আর মা পিসি ধান গম ভেনে মুড়ি টুড়ি ভেজে, গইলের গোরু দুটোর দুধ বিক্রি করে চালিয়ে নেয় আর কি।
-- অ রসো, বলি ঘুম ভাঙ্গলো তোর! দীনু কা এসেছে, আমার হাত জোড়া একটু ধানের কাগজ টা দেক দিকি!
--ভালো লোক কে কইলে ঠাকরান! ও দেকপে হিসেব, তাও ধান চালের! একেনে পিটে পাটা থাকলেও কতা ছিল এট্টা!
দীনুকাকা ভুঁড়ি দুলিয়ে হেসে উঠল!!
কি জানি, ক্রমাগত ঝাড় খেতে খেতে রসোর মটকা গরম হয়ে গেল। যে যা পারবে তাকে বলবে! একটা সামান্য কাক পজ্যন্ত!
হাত থেকে কেড়ে নিল ধানের কাগজ রসো। গম্ভীর মুখে আঁক কসতে গিয়েই চোখ পড়ল কাক টা টগর গাছের পাঁচিলে বসে তাকেই দেখছে যেন! ওই কাক টাই হবে নির্ঘাত! কি পাজি, কি পাজি, এইবার কিছু খেলেই ছোঁ!
-- দেখে নাও তো হয়েছে কিনা!
-- দীনু অভিজ্ঞ ব্যাপারী, এক নিমেষে মিলিয়ে দেখেই বুঝল একদম সঠিক মিলিয়েছে! উরে বাবা, পারিস তো করিস নে কেন হতভাগা! খাতা লিখেও তো ভালো রোজগার হয় একন!
রসোর কিন্তু চোখ কাকের দিকে! মনে হলো ঠোঁট নড়ে উঠল,
হ্যাঁ পরিস্কার শুনলো, কাজ করেই গিলতে হয়! উড়ে চলে গেলো।
রসোর মন মেজাজ ভারি খারাপ! দিব্য ছিল খেয়ে দেয়ে, কি আপদ জুটলো রে বাবা! এখন খেতে গেলেই খালি মনে হচ্ছে কি না কি শুনতে হবে! কাল সকালে বাঁধের ধারে বসে একটু মাছ ধরা দেখছিল,কাহাঁতক ঘরে থাকা যায়! ওমা খাবার নেই তো কি, মাথায় ঠোক্কর দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল!
এ কি বেয়াদবি! এ কি অকারণ হেনস্তারে বাবা!
-- কাজ কর্ম কিছু আছে নাকি! ও কাকা
-- বাবা রে হলো টা কি তোর,কাজ চাইছিস
-- কেন! আমি কি পারিনা নাকি! মনে মনে বলল না পেরে আর কি উপায় আছে! না পারলেই নয় ছোঁ, নয় ঠোক্কর!!
-- পারবিনে কেন! নিজ্জস পারবি! কিন্তু তোরই তো শুদু খাওয়া আর শোওয়া, কাল থেকেই আয়!
টং করে মাথা গরম হয়ে গেল দীনু কার উপর! মনে হল ওই কাক টাই যেন বিদ্রুপ করছে, হাত নিশপিস করতে লাগতে না লাগতেই দেখল পেছনের চালে কাক টা বসে রয়েছে--, হ্যাঁ ওই কাক টাই তো! ঘাড় ব্যাকা ব্যাটা! মনে হলো কি যেন বলছে!
নির্ভুল কানে শুনতে পেল বলছে, বেশ বেশ! কাজ করো! কাজ করে খেতে গেলে লজ্জা লাগে না,ওমন গত্তিও লাগে না বুঝলে হে!
বলেই হুসসসসস করে উড়ে গেল কোথায় যেন--
জগদীশ শর্মার ছড়া
(১) নোনাজল
টাক্ ডুম টাক্ ডুম
রাতে জাগি দিনে ঘুম
খটাখট্ খটা খট্ খট্
এ সময় কট্ মট্ কট্
ছলছল ছলাৎ ছল
আঁখি দিঘি নোনা জল।
(২) জলছুড়ি
ফুলেরা ফুটছে ফুটুক
রোদে জলে
ঝলসে উঠুক
জলছুড়ি রঙে আঁকা
আমার এই ভুবনডাঙা।
ফুলকুসুমপুর খুব কাছে ১৭
রতনতনু ঘাটী
বেশ শুরু হয়েছিল তিন্নি-বিন্নি আর বুম্বাদের আজকের দিনটা। আজ শনিবার। স্কুল নেই। তার উপর পরশু থেকে ক্রিসমাসের ছুটি টানা সাতদিন। আজ থেকে সবে ওদের আনন্দের শুরু। কিছুক্ষণ পরেই দুমকা থেকে ছড়াপিসি লিমেরিক আর হাইকুকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসবেন ওদের বাড়িতে। সকাল থেকে ওরা তিনজন যেন তিনটে রঙিন প্রজাপতি। বাড়িময় উড়ে বেড়াচ্ছে তো উড়েই বেড়াচ্ছে।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে হঠাৎ সে আনন্দের সুর কেটে গেল। বড়বাবু, গল্পকাকা আর শুধুকাকাকে উদ্দেশ্য করে ইচ্ছেদাদু ঘোষণা করলেন, ‘সকলে মনে দিয়ে শোনো।’
তারপর অনিচ্ছেঠাকুরমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘অনিচ্ছে, তুমিও এদিকে এসো। কথাটা তোমারও শুনে রাখা দরকার।’ তারপর রান্নাঘরের দিকে গলা তুলে দাদু বললেন, ‘মাধুরী, করবী আর বকুলও এসো!’ একটু থামলেন দাদু। যেন মস্ত বড় কিছু একটা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন, এরকম গলায় বললেন, ‘যাদের নিয়ে কথা বলব, তারা তো সকলে আছেই!’ বলে তিন্নিদের তিনজনের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে নিলেন।
খাওয়ার টেবিলের চারপাশটা থমথম করছে। সকলকে ডেকেহেঁকে কী এমন ঘেষণা করতে চলেছেন ইচ্ছেদাদু? দাদু ফের গলা তুলে ডাক দিলেন, ‘কই রে, বিলম্ব! তুই কোথায় গেলি? শিগগির এদিকে আয়!’
দোতলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে তরতর করে নেমে এল বিলম্বদাদু। এবার ইচ্ছেদাদু সেই চরম খারাপ খবরটা ঘোষণা করলেন, ‘আমাদের বাড়িতে একদিকে পোষ্যদের ট্যাঁ-ট্যাঁ, মিঁউ-মিঁউ, ভৌ-ভৌ, কুঁই-কুঁই—ফুটবলের ধারাবিবরণীর মতো শোনা যাচ্ছে! ছোটরা মেতে আছে সেই সব নিয়ে। তাদের পড়ায় মন নেই বললেই চলে। দিন দুই আগে ‘নৈবেদ্য’ স্কুলের স্বয়মাগতা হেডমিসের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। উনি বললেন, ‘ইচ্ছেদাদু, আপনার বাড়ির ছোটদের পড়ার দিকে একটু নজর দিতে হবে। মনে হয় ওরা খুব বেশি ফাঁকি দিচ্ছে!’ কাল সারাদুপুর ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভাবলাম। আমার মনে হল, আমাদের বাড়িতে একজন ভাল গৃহশিক্ষকের খুব দরকার।’
একথা শুনে ছোটদের মুখগুলো থমথমে হয়ে উঠল। দাদু এ কথার রেশ টেনে বললেন, ‘তাই আমি ঠিক করেছি, প্রতিদিন সকালে দু’ ঘণ্টা করে আমাদের বাড়িতে একজন গৃহশিক্ষক আসুন।’ তারপর বড়বাবু, গল্পকাকা আর শুধুকাকার মুখের উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে দাদু বললেন, ‘তোমরা অফিসের কাজ আর সোশ্যালওয়ার্ক নিয়ে পরপর এত ব্যস্ত হয়ে পড়ছ যে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া লক্ষনজর করার মতো তোমাদের হাতে একটুও সময় নেই।’
বড়রা সকলে মুখ নিচু করে দাদুর কথা শুনছিলেন। অনিচ্ছেঠাকুরমা বললেন, ‘সেরকম ভাল মাস্টারমশাই কোথায় পাবে ভেবে দেখেছ কিছু?’
দাদু বললেন, ‘সে নিয়ে একদম ভেবে দেখিনি যে তা তো নয়! তোমার হয়তো মনে পড়বে অনিচ্ছে, কাঞ্চনপুরের ভবতারণ সামন্তকে? উনি মস্ত বড় স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। ব্রিটিশ সাহেবকে বোমা মারার চেষ্টা করে ধরা পড়ে অনেক দিন জেলও খেটেছিলেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফের পুলিশকে আক্রমণ করতে গিয়ে ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে মারা যান। ওঁর ছেলে বিপদভঞ্জন আমার ছেলেবেলার বন্ধু! বিপদভঞ্জন সামন্তকে কাল ফোন করেছিলাম। আমারই মতো বয়স। তবে ভাল শিক্ষক হিসেবে ওর নাম আছে আমাদের ফুলকুসুমপুর অঞ্চলে। কেন্দ্রিয় সরকার ওকে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষক’ হিসেবে সম্মান জানিয়েছে বছর তিনেক আগে। ও তো এখন আর ছেলেমেয়েদের পড়ায়-টড়ায় না। চাদ্দিকে সমাজসেবা করে বেড়ায়। আমি অনুরোধ করতে রাজি হয়ে গেল। এককালে আমার বন্ধু ছিল তো? তাই পুরনো বন্ধুর কথা ফেলতে পারল না।’
বুম্বা প্রায় সকলের চোখ এড়িয়ে সমূহ বিপদের আশঙ্কার কথা ভেবে একবার তাকাল বিন্নিদির মুখের দিকে। বিন্নি ক্লাসের অঙ্কমিসের মতো চোখ গোল-গোল করে যা বোঝাল, তার মানে হল, ‘বুম্বা, এক্ষুনি অত ভাবার দরকার নেই।’ বড়রা সকলেই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন।
অনিচ্ছেঠাকুরমা দাদুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে থেকে উনি আসবেন, বললেন কিছু?’
দাদু বললেন, ‘লিমেরিকরা দুমকা ফিরে গেলেই বিপদভঞ্জন পড়াতে শুরু করবে। তবে তার আগে একদিন সকালে এসে ছোটদের সঙ্গে আলাপ করে যাবে বলেছে।’
এ বাড়িতে দাদুর প্রস্তাব মানে হল, তা গৃহীত হয়। তাই গৃহশিক্ষকের পড়ানোর প্রস্তাবটা বিনা প্রতিবাদেই ফাইনাল হয়ে গেল।
ব্রেকফাস্ট শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আজকের মতো মিটিংও শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ইচ্ছেদাদু হাসি-হসি মুখে শুরু করলেন, ‘ছোটবেলায় বিপদভঞ্জনের একটা মজার খেলার গল্প আমাদের অঞ্চলে চালু ছিল। ও তো স্বাধীনতার বছর সাতেক পরে জন্মেছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সুযোগই পায়নি। অনেক গল্প শুনেছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুখ থেকে। তাই খোলামকুচি, শুকনো ডালপালাকে ব্রিটিশ পুলিশ সাজাত মনে-মনে। তারপর গাছ থেকে সাদা কাঞ্চন ফুল তুলে এনে সাজাত একদল স্বাধীনতা সংগ্রামী। এর পর নিজে কখনও গান্ধীজি, কখনও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, কখনও জওহরলাল নেহরু, কখনও ক্ষুদিরাম বসু হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একা-একা ধানের গোলার পাশে স্বাধীনতাযুদ্ধ-স্বাধীনতাযুদ্ধ খেলত। এ খেলা কিশোর বয়স পর্যন্ত খেলত বিপদভঞ্জন। চাদ্দিকে বিপদভঞ্জনের এই খেলার কথা ছড়িয়ে পড়েছিল!’ বলে হা-হা করে হেসে উঠলেন ইচ্ছেদাদু। বড়রাও সে হাসিতে যোগ দিলেন। মা-কাকিমারা হাসতে-হাসতে রান্নাঘরে চলে গেলেন। ঠাকুরমার মুখে তখনও একটা হাসির রেখা লেগে আছে।
হাসি দেখা গেল না শুধু ছোটদের মুখে। মুখভার করে তারা খাওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল দোতলায়। বুম্বার এখন আবার রাধাগোবিন্দকে কথা-বলা শেখানোর ক্লাস নেওয়ার সময় হয়ে গেছে। না হলে ঠাকুরমা দুপুরবেলার পুজোর বড় সন্দেশটা বুম্বাকে এখন থেকে বলে দেওয়া যায় না।
বেলা একটু বাড়তে একটা ট্যাক্সি এসে থামল ত্রিপাঠীবাড়ির গেটের সামনে। ঠাকুরমা দোতলা থেকে চেঁচিয়ে বললেন, ‘ও বিলম্ব, দ্যাখ তো, ছড়াপিসিরা এসে গেল বলে মনে হচ্ছে।’
সঙ্গে-সঙ্গে নীচে ট্যাক্সির কাছে ছুটে গেল বিলম্বদাদু। তিন্নি-বিন্নিও ছুটল নীচে। বুম্বাও ছুটল ওদের পিছন-পিছন। রাধাগোবিন্দকে কথা-বলা শেখানোর ক্লাস আচমকাই তক্ষুনি বন্ধ হয়ে গেল!
(এর পর আগামী রোববার)
গল্পে গল্পে ক্যুইজ
রাজীব কুমার ঘোষ
পর্ব ৫ ।। উত্তর
১।।আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে আন্দোলনকারী নেতাদের একটি দল আমেরিকার তেরোটি কলোনিকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একত্রিত করেন। এদের ‘ফাউন্ডিং ফাদার অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস’ বা ‘ফাউন্ডিং ফাদার’ বা আরো ছোটো করে ‘ফাউন্ডার’ নামে অবহিত করা হয়। এদেরই একজন ছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। রাগ নিয়ে এই উদ্ধৃতিটি তার। রাষ্ট্রনেতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন লেখক, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ, উদ্ভাবক এবং বিজ্ঞানী। তড়িৎ বিজ্ঞানে তার অবদান তোমরা নিশ্চয়ই বড় হয়ে পড়বে। এই যে এখন এত বাজ পড়ে আর তোমরা কাগজে পড়ো যে বজ্রনিরোধক দন্ড বাড়িতে লাগানোর কথা সেটি কিন্তু এনারই আবিষ্কার।
২।। এই উক্তিটি করেছিলেন আন্তর্জাতিক স্তরে বিখ্যাত লেখক পল কোয়েলহো। তার ‘অ্যালকেমিস্ট’ নামের বইটির কথা হয়ত তোমরা শুনেছ। কথিত আছে দু’বছর অন্তর ইনি একটি উপন্যাস লেখেন। তার উক্তির প্রথম অংশটি আসলে গৌতম বুদ্ধের উক্তি। রাগ নিয়ে গৌতম বুদ্ধের বহু উপদেশ আছে। বৌদ্ধ দর্শনে রাগ বা ক্রোধকে তিনিটি বিষের মধ্যে অন্যতম বলে মনে করা হয়। অন্য দুটি বিষ হল ‘লোভ’ আর ‘অজ্ঞতা’।
৩।। এটিও গৌতম বুদ্ধের উক্তি। ক্রোধকে ক্ষমা দ্বারা জয় করার কথা তিনি বলেছিলেন। শুধু গৌতম বুদ্ধ নয়, প্রত্যেক মহাপুরুষ রাগকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেই নিয়ে অনেক কিছু বলেছেন। রাগ, মানুষের পরিশ্রম করে গড়ে তোলা জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। রাগকে ‘ক্ষমা’ দিয়ে বা ‘ধৈর্য’ দিয়ে জয় করতে হয়। আমাদের ক্ষেত্রে আধুনিক যুগে সবচেয়ে সহজ হবে রাগকে ভালোভাবে বোঝা, কেন আমরা রেগে যাই, রেগে গেলে শরীরে কী কী হয়, ইত্যাদি। তোমরা যদি রাগকে জানার চেষ্টা করো, তাহলে দেখবে রাগকে বাগে আনা সহজ হয়ে যাবে।
৪।। এই উক্তি বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের। তাকে বাংলায় তোমরা আরিস্ততল-ও লিখতে পারো। আর যদি গ্রিক রীতি অনুসারে লিখতে হয় তাহলে লিখতে হবে, ‘আরিস্ততেলিস’। আরেক বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটোর শিষ্য ছিলেন তিনি। প্লেটো আবার ছিলেন সক্রেটিসের শিষ্য।
৫।। অন্নদাশংকর রায়ের বিখ্যাত ছড়া এটি। ছড়াটির নাম ‘খুকু ও খোকা’। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতে এই ছড়াটি লেখা হয়েছিল।
৬।। প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষের ছড়া এটি। ২১ এপ্রিল কোভিড তাকে আমাদের মধ্যে থেকে ছিনিয়ে নিল। বাংলা কবিতার এমন কোনো পাঠক নেই যিনি এই কবির গুণমুদ্ধ নন। কবি শঙ্খ ঘোষ আক্ষরিক অর্থেই একজন ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয়’ কবি।
৭।। বিখ্যাত সুরকার ও গীতিকার গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এই গানটি। গানটির সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গেয়েছিলেন তারই কন্যা রাণু মুখোপাধ্যায়।
৮।। বাদশা চলচ্চিত্রে এই গানটি ছিল। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৩ সালে। গানটিতে তিনটি প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়, একটি কুকুর, একটি বাঁদর আর একটি ছাগল। সম্ভব হলে চলচ্চিত্রটি দেখে নিও।
৯।। অতিরিক্ত রাগের ফলে শরীরের বহু ক্ষতি হয়। অতিরিক্ত রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসার, হার্ট অ্যাটাক থেকে শুরু করে অনিদ্রা, মাথা ধরা, উদ্বিগ্নতায় ভোগা, অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়া আরো অনেক কিছুই হয় অতিরিক্ত রাগের জন্য। একটু সহজ করে বলি, কেউ যদি প্রচন্ড রেগে যায় তাহলে তার রক্তে বিশেষ কিছু রাসায়নিক পদার্থ চলে আসে এবং সেগুলো আবার কমে স্বাভাবিক হতে মোটামুটি ধরে নাও দু’দিন লাগে। অর্থাৎ রাগ ঠিকঠাক চলে যেতে দু’দিন সময় লাগবে। এখন এই দু’দিনের মধ্যে যদি সেই লোক আবার প্রচন্ড রেগে যায় তাহলে এবার সে কিন্তু ঝট করে রেগে যাবে, কারণ আগে থেকেই রক্তে সেই পদার্থগুলো আছে। এর ওপর দ্বিতীয় রাগের জন্য সেগুলো আবার রক্তে চলে আসবে। ফলে এবার রাগ চলে যেতে কিন্তু বেশি সময় নেবে। কারণ রক্তে এখন সেই পদার্থগুলো আরো বেশি পরিমাণে আছে। এখন কোনো লোক যদি নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে তাহলে বার বার রাগতে রাগতে তার রক্তে ঐ উপাদানগুলো থেকেই যাবে। আর সে হয়ে উঠবে বদমেজাজি। একসময় সে নিজেই বুঝতে পারবে না যে কেন সে এত রেগে যাচ্ছে।
১০।। প্রশ্নটা ছিল, “তোমার কাছে থেকে অভিভাবকরা যদি কোনো কারণে মোবাইল নিয়ে সেটি সরিয়ে রাখেন বা তোমাদের মোবাইল নিয়ে ঘাঁটতে না দেন, তখন কি তোমাদের খুব রাগ হয়? সেটা কোন ধরণের রাগ, ভালো রাগ না খারাপ রাগ? সেই রাগ কি তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারো? ভেবে বলো তো কেন রাগটা হয়।” এখন এটা তো তোমরা বুঝতেই পারছ যে এই রাগ ‘খারাপ রাগ’। রাগ তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারো কি পারো না সেটা তুমিই জানবে। কেউ পারে কেউ হয়ত পারে না। কিন্তু রাগটা কেন হয় সেটা খুব সহজে বলা মুশকিল। ক্লাস সিক্সে পড়া ছেলে বা মেয়ে যে কারণে রেগে যাবে ক্লাস নাইন-টেনে পড়া ছাত্র সেই কারণে রাগবে না আবার আরো উঁচু ক্লাসের ছাত্র অন্য কারণে রাগবে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রাগার কারণগুলো আর রেগে যাবার ধরণটাও পাল্টে যায়। তবুও আমরা একটু সহজ করে নিয়ে ভাবতেই পারি।
মোবাইল এখন আর শুধু কথা বলার জন্য নয়। মোবাইল এখন বিনোদনের একটা যন্ত্র। এইরকম যন্ত্রের কথা আমরা স্মার্টফোন যুগের আগে শুধু কল্পবিজ্ঞানেই পড়তাম। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিনোদনের বিষয়গুলো প্রযুক্তি এবং ব্যবসায়ীবুদ্ধিতে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের হাতের মুঠোর মধ্যে অনায়াসে চলে এসেছে। এই বিনোদনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যাকে ইংরাজিতে বলে ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’। তুমি একবার যে নায়কের বা নায়িকার ছবিতে ক্লিক করে দেখেছ বা কোনো জিনিসের বিজ্ঞাপণ দেখেছ, দেখবে সেই নায়ক বা নায়িকার ছবি বা সেই জিনিসের বিজ্ঞাপণ তোমার পিছু ছাড়বে না। তুমি যদি ইউ টিউবে ‘শিন-চ্যান’ দেখো তাহলে ইউ টিউব খুললেই ‘শিন-চ্যানের’ কার্টুন চলে আসবে। আর বুঝতেই পারছ যে জিনিস আমাদের ভালো লাগে, সেই জিনিস না ক্লিক করে থাকা যায়! এইভাবেই কিন্তু মোবাইল আমাদের কাছ থেকে সময় চুরি করে নেয়। আর মোবাইল গেমসের তো কথাই নেই। সেটা নিয়ে আরেকদিন কিছু বলা যাবে। এখন তুমি যখন এইসব ‘ভালো লাগার কাজ’ মোবাইলে করছ তখন মোবাইলের সঙ্গে তোমার একটা যুক্ত হয়ে যাবার ব্যাপার ঘটবে। ঠিক যেমন আমরা আমাদের প্রিয় শার্ট বেশি পরি, বা প্রিয় পেনকে বা প্রিয় খেলনাকে হাতছাড়া করতে চাই না । তোমাদের মা বাবা কিন্তু বুঝতে পারছেন তোমরা তোমাদের অমূল্য সময় নষ্ট করে ফেলছ। চোখও নষ্ট করতে বসেছ। তাই তারা মোবাই কেড়ে নেন শেষ চেষ্টা হিসাবে। যেই তুমি মোবাইল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও সঙ্গে সঙ্গে তুমি রেগে যাও। রেগে এইজন্য যাও কারণ কোনো যুক্তিতেই তুমি মা বাবাকে বলতে পারবে না কেন তোমাকে আরো মোবাইলটা হাতে রাখতে দেওয়া উচিত। তোমার মন তখন রাগকে এগিয়ে দেয়। মানে যদি ঝামেলা করে, চিৎকার করে, ঝগড়া করে মোবাইলটা ফেরত পাওয়া যায়। এইসময় তোমাকে কীরকম দেখতে লাগে তা জানার ইচ্ছে হলে কাউকে বলো সেটা ভিডিও করে রাখতে। পরে যদি ঠান্ডা মাথায় সেই ভিডিও দ্যাখো, নিজেই লজ্জা পাবে। যদি তুমি না জানতে ভিডিওতে ওটা তুমি, তাহলে তুমিই বলে বসতে ব্যাপারটা হাস্যকর। এটা আরেকটা প্রমাণ যে রাগলে আমরা কীভাবে পাগলের মতো আচরণ করি। মোবাইল যে সময় নষ্ট করে তার হাত থেকে বাঁচার একটাই উপায়, জীবনের একটা উদ্দেশ্য খুঁজে নাও, তাহলে সময়টা সেই উদ্দেশ্যের পিছনেই যাবে, মোবাইলের পিছনে কম যাবে। এমনকি মোবাইলকে তখন তুমি সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করবে। অনেক কিছু শিখবে।
সামনের রোববার আবার কিছু গল্প নিয়ে দেখা হবে।
পিকনিকের মজা কই
অভিক রায়
অষ্টম শ্রেণী, লিলুয়া ডনবস্কো, হুগলি
লকডাউনে ঘরে বসে পাই না কোনো আনন্দ।
সবারই লাগে যে মন্দ।।
যখন মহামারী ছিল না,
তখন পিকনিক করে সবারই হলো করোনা।।
এবার এলো করোনার দ্বিতীয় ঢেউ।
এমন কেন হলো আমায় কি বলতে পারেন কেউ।।
না কেউ করে টিকা আবিষ্কার
না কেউ করে রোগের প্রতিকার।।
বলতে পারি দেশটা পুরো দুরাচারী।
তাই লেগেছে দেশে মহামারী।।
আর লাগে না ভালো দূর ছাই!
সবাই এখন চলছে নিজের ইচ্ছায়।।
ভাসমান
স্বস্তিকা চট্টোপাধ্যায়
দ্বাদশ শ্রেণী, চন্দননগর বঙ্গ বিদ্যালয়, হুগলি
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রূপাই। চারটে ছুঁই ছুঁই। জানালা দিয়ে দূরের গাছগুলোতে চোখ বোলালো একবার। আজ কোনো শিমুলতুলো হাওয়ায় ভেসে আসেনি। প্রতিদিন ভেসে যায় শুকনো ফলের মধ্যে সাদা তুলোগুলো। মাকড়সার জালের মতো তুলোগুলো জড়িয়ে যায় গাছের ডালে পাতায়। সঙ্গে থাকে ছোট্ট কালো একটা বীজ। বীজটা ভাসমান তুলোয় দেখা যায় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে রূপাই। না,চোখে পড়েনি আজ। এদিকে পশ্চিমের আকাশ লাল হয়ে এলো। হোটেল মালিকের কর্কশ শব্দে জানালা থেকে সরে গেল রূপাই।
ক্লাস নাইনে পড়ে রূপাই। মফস্বলের অন্নদাতা হোটেলের গায়েই-প্রায় আছে সরকারি ইশকুল। এই সরকারি ইশকুলে ক্লাস সেভেনে ভরতি করে দিয়েছিল হোটেল মালিক। করোনার জন্য এখন ইশকুল বন্ধ আছে। ক্লাসের সবার থেকে বয়েস অনেকটা বেশি রূপাই-এর। পুরুলিয়ার অভাবী সংসারের সন্তান রূপাই। গ্রামের বাড়িতে অনেকগুলো ছোট ছোট ভাই বোন আছে তার। তার বাবা রোজগার করতে পারে না। রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজ করতে গিয়ে পড়ে গেছিল অনেকটা ওপর থেকে। কোমর গেছে। অন্নদাতা হোটেলে আছে একটা টিভি। সারাদিন হোটেলে খাটাখাটনির পর রাতের দিকে রূপাই বই পড়ে অথবা টিভিতে ন্যাশানাল জিওগ্রাফির চ্যানেলে ঢুলু ঢুলু চোখে বিস্ময়কর জগৎটাকে মুগ্ধতার সঙ্গে দেখে।
রাতে স্বপ্নে দেখে প্রতিদিন রূপাই। ফেলে আসা তার গ্রামের শৈশব, বন্ধুদের, মাঠ বন জঙ্গল পুকুর বাবা মা ভাই বোন এসব স্বপ্নের প্রধান বিষয় থাকে।
আজ স্বপ্ন দেখছে রূপাই বাবলা শিমুল জাম তেঁতুলগাছের ডালে ডালে দোল খাচ্ছে সবাই। আকাশে ভাসছে রাশি রাশি শিমুল তুলো। লালা থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়া পলাশ ফুটে আছে পাহাড়ের কোলে কোলে। তার ভাই আর একটি বোন খালি গায়ে ছুটে আসছে তারই দিকে। হাতে তাদের পলাশ কৃষ্ণচূড়া ফুল। ঠিক তাদের পিছনে রূপাই-এর মা মাথায় নিয়ে আসছে এক বোঝা শিমুল তুলো। সেই বোঝা থেকে রাশি রাশি তুলো আকাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। রূপাই লাফ দিয়ে আকাশে উঠতে চাইছে কিন্তু পারছে না। গাছের ডালে যেন তার পা আটকে আছে। অথচ তার মাথার সামান্য ওপর দিয়েই উড়ছে সাদা পেলব শিমুলতুলো। মায়ের মুখটা স্বপ্নে আর দেখতে পাচ্ছে না রূপাই। শুধু তুলো তুলো তুলো। ভাসমান শিমুলতুলো।
ঘুম ভেঙে যায় রূপাই-এর। রাত কতো এখন? আঁধার চারিধার। মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো রূপাই। অনেকগুলো সার সার মশারির মধ্যে ঘুমন্ত কালো-কালো যে মানুষগুলোকে সে পছন্দ করে না, যারা তাকে খুব খুব খাটায়,রাগায় তারা গভীর ঘুমে আছে। আঁধার ভেঙে বোতলের জল ঢক্ ঢক্ করে খেয়ে আবার মশারির ভেতর শুয়ে স্বপ্নের শিমুল তুলোগুলো ঠিক,যে-যে চেনা মাঠ বন-জঙ্গলের ওপর দিয়ে ভাসছিল সেগুলোর সঙ্গে তার গ্রামের ছবি মেলাতে থাকল রূপাই।
স্মরণীয়
পীযূষ প্রতিহার
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়
বর্তমান খুলনা(তৎকালীন যশোর)জেলার অন্তর্গত রাড়ুলি গ্রামের এক ভূস্বামী পরিবারে ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট তাঁর জন্ম। প্রফুলচন্দ্র ছিলেন হরিশচন্দ্র রায়ের তৃতীয় পুত্র। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে প্রফুল্ল চন্দ্র ১৮৭০ সালে হেয়ার স্কুলে (কলকাতা) ভর্তি হন। কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে তিনি দুবছরের বেশি সেখানে লেখাপড়া করতে পারেন নি। দুবছর বিরতির পর তিনি পুনরায় আলবার্ট স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন এবং সেখান থেকে ১৮৭৮ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর তিনি মেট্টোপলিটান ইনস্টিটিউশনে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৮৮০ সালে এফ.এ পরীক্ষায় পাস করেন। তিনি ১৮৮২ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৮৮৫ সালে বি.এসসি এবং ১৮৮৭ সালে রসায়ন শাস্ত্রে ডি.এসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসে যোগ দেন এবং ১৮৮৯ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের অস্থায়ী অধ্যাপক পদে যোগদান করেন।
১৯০২ সালে প্রফুল্ল চন্দ্র তাঁর বিখ্যাত History of Hindu Chemistry গ্রন্থ প্রকাশ করেন। মারকিউরাস নাইট্রাইট তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য বৈজ্ঞানিক মহলে প্রফুল্ল চন্দ্র একজন বিজ্ঞানী হিসেবে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেন। বিজ্ঞান গবেষণায় তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় ১৯১২ সালে তাঁকে সম্মানসূচক ডি.এসসি ডিগ্রি প্রদান করে। ব্রিটিশ সরকার প্রথমে তাঁকে রাজকীয় খেতাব সি.আই.ই এবং পরে ১৯১৯ সালে ‘নাইট’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯১৬ সালে প্রফুল্ল চন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে নব প্রতিষ্ঠিত ‘ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্স’-এ যোগদান করেন। ১৯২০ সালে তিনি ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের জেনারেল প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
বিজ্ঞানের উন্নয়নে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ কলকাতা, বেনারস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরপর তাঁকে সম্মানসূচক ডি.এসসি ডিগ্রি । তাঁর আত্মজীবনী Life and Experiences of a Bengali Chemist.
তিনি মাতৃভাষার মাধ্যমে শিল্পকলা ও বিজ্ঞান চর্চায় অনুরাগী ছিলেন। এই বিষয়ে তিনি প্রচুর লিখেছেন এবং অন্যদেরকেও মাতৃভাষায় লেখার জন্য উৎসাহিত করেছেন। তিনি ১৯০১ সালে ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’ নামক একটা কেমিক্যাল ফার্ম প্রতিষ্ঠা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
রাজীব তন্তুবায়
মৌসুমী ঘোষ সম্পাদিত "জ্বলদর্চি"-র ৪২ তম ছোটোবেলা সংখ্যা পাঠ করে রীতিমত মুগ্ধ। যেখানে পরতে পরতে কুশলী ও সচেতন সম্পাদনার ছাপ সুস্পষ্ট। সম্পাদকীয়তে "গল্পকার, কবি, শিল্পী ও অবশ্যই পাঠক" -দের মিলিত এক পরিবারের কথা উল্লেখ করেছেন সম্পাদক। সত্যি সত্যি মা-মেয়ে-পিতা-পুত্রের অপূর্ব এক মেলবন্ধন পাঠককে টেনে নিয়ে যাবে ভিতরের পাতায়।
প্রথমেই মশার ছবিতে চোখ স্থির হয়ে যায়। শিল্পী সৌগত বসাক রং তুলিতে যে ভাবে মশাকে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা যথেষ্ট দৃষ্টিনন্দন। সেই সঙ্গে তৃষ্ণা বসাকের কবিতা "বাড়ির মশা" মন ছুঁয়ে যায়। মশাকে নিয়ে নতুন ভাবনা, যেখানে অতিথিকে বাগান দেখাতে এনে মশার কামড় খায়িয়ে গর্ব করে বলেন, "হেঁ হেঁ, বাড়ির মশা, / আহা, আহা মারেন কেন?/ কত কষ্টে পোষা।" --- সত্যি সত্যি হাস্যরসাত্মক।
বিড়ালছানা, কুকুরছানা ও নামলেখা বকলেস নিয়ে সুস্মিতা কুন্ডুর গল্প "দুই বিল্লি আর একটা টমটম" মজাদার একটি উপস্থাপনা। উপাসনা সরকারের কবিতা যথেষ্ট পরিণত উপলব্ধির কথা বলে। "ঘৃণার উপশম ঘৃণা নয়/ আত্মস্থ করো/ আত্মাই সর্বশ্রেষ্ঠ মন্দির/ তাকে সাজাও/ ত্যাগের অঞ্জলিতে" ।
বিশ্বদীপ দের "টিটো ও বাঘ" গল্পটি ছোট বড় সকল পাঠকের কাছেই বেশ আনন্দ দায়ক। ছোট্ট টিটোর বাঘ-প্রীতিকে ঘিরে এ এক অনবদ্য শিশু-কিশোর গল্প। গদ্য ও সংলাপ যথেষ্ট সাবলীল।
ইন্দ্রনীল বক্সীর "ডোডোর App" গল্পতে কল্পবিজ্ঞানের ছোঁয়া, যা শিশু-কিশোর মনে নতুন ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাসের গল্প, "ছোট্ট মেয়েটা আর একটা দুপুর" অবশ্যই একটি সুন্দর শিশু-কিশোর ছোটগল্প। যা ছোটদের মনে কল্পনার জগতে নিশ্চিত ভাবে নাড়া দিয়ে যায়।
রতনতনু ঘটির ধারাবাহিক উপন্যাস "ফুলকসুমপুর খুব কাছে" নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। ১৫ তম পর্ব পাঠ করে এটুকু নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে এই পত্রিকার অন্যতম সেরা এক প্রাপ্তি এই ধারাবাহিক।
লকডাউনে যে সকলের প্রাণ হাঁসফাঁস করে উঠছে, সেই উপলব্ধির কথা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে সমাদৃতা রায় তার লকডাউন কবিতায়। আমাদের সকলের যেন এই একই প্রার্থনা, "সেই দিন টা দিও ঠাকুর ভীষণ তাড়াতাড়ি।" ছোট্ট গল্পকার অনুষ্কা চক্রবর্তীর "কম্পিউটার মেকানিক" গল্পটিও রীতিমতো মনে দাগ কাটে।
তবে "গল্পে গল্পে কুইজ" বিভাগে রাজীব কুমার ঘোষ যেভাবে নানান তথ্য তুলে ধরেছেন তা অবশ্যই সকলের কাছে এক উপরি পাওনা।
লেখার সাথে সাথে ছোটদের অলংকরণ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। সবমিলিয়ে "জ্বলদর্চি"-র ৪২ তম ছোটবেলা সংখ্যা পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য এক উপহার।
পরিশেষে, বড়দের সাথে সাথে ছোটোরাও যেভাবে মুন্সিয়ানার সাথে কলম ধরেছে এবং সম্পাদক যেভাবে তাদের সেই প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে তাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন, আগামী দিনে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ যে এক বিশেষ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা। এভাবেই এগিয়ে চলুক "জ্বলদর্চি"...
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
0 Comments