জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৫২


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৫২

শ্যামল জানা

সাররিয়েলিজম্ (সূত্রপাত)


সাররিয়েলিজম্-এর পূর্বসূরি হিসেবে দাদাইজম্-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য৷ এ কথা মেনে নিয়েও বলতে হয় তার মতবাদের অন্তর্দর্শনের সলতেটি পাকিয়েছিল “অধিবিদ্যক শিল্প(Metaphysical Art)৷ বস্তু জগতের অতীত যে বিদ্যা বা দর্শন, যাকে বলে আধ্যাত্মচেতনা, একেই এক কথায় বলা যায় ‘Metaphysics’ বা ‘অধিবিদ্যা’৷ এই দর্শন যখন ক্যানভাসে প্রতিফলিত হয়, তখন তাকে বলে metaphysical art বা বাংলায় ‘অধিবিদ্যক শিল্প’ ৷ ফলে, দৈনন্দিন জীবনে আমরা বাস্তবে যে ঘটনা তথা দৃশ্যের মুখোমুখি হই, সেই সব দৃশ্য সরাসরি এই শিল্পের ক্যানভাসে আসে না৷ সেই বাস্তবদৃশ্য আধ্যাত্মচেতনায় জারিত হয়ে ক্যানভাসে প্রতিফলিত হয়৷ ফলে সেই ছবি হয় স্বপ্নসদৃশ্য৷ অর্থাৎ, আমার আধ্যাত্মচেতনাপ্রসূত দর্শন থেকে, মনে মনে তার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী যে স্বপ্ন রচিত হয় আমার ভিতরে, সেই স্বপ্ন যে দৃশ্য তৈরি করে, সেই দৃশ্য ক্যানভাসে প্রতিফলিত হয়৷ অর্থাৎ, সে দৃশ্য সবটাই আমার অজান্তে তৈরি করে দেয় আমার অবচেতন মন৷ ফলে, খুব স্বাভাবিকভাবেই সেই দৃশ্য কখনই বাস্তবসম্মত হবে না! অনেকটাই আরোপিত ছিল সেই সব ছবি৷ গাঢ় ছায়া ও ঝকঝকে আলো দিয়ে আলো-ছায়ার প্রচণ্ড কনট্রাস্ট৷ আর, এমন একটা পার্সপেক্টিভ-এর মধ্যে সেই কনট্রাস্ট ব্যবহার করা হত, যে, সেইসব ছবি দেখলে কেমন যেন গা-ছমছম করত, গোটা ছবিটিতে লেগে থাকত কুহেলী বা রহস্যময়তা(ছবি-১)৷ 


  
এই মেটাফিজিক্যাল আর্ট সম্পর্কে শিল্প বিশেষজ্ঞ কনওয়ে মরিশ(Conway Morris) একটি অসাধারণ কথা বলেছিলেন— Painting that which cannot be seen. ৷ অর্থাৎ, ক্যানভাসে যেটা আমরা ওপর ওপর দেখছি, সেটা ছবি নয়, ওরা আসলে যেটা আঁকে, সেটা দেখা যায় না৷ তাকে অনুভব করতে হয়৷ ঘুরেফিরে সেই চলে আসছে অসচেতন-অবচেতন(Unconscious-Subconscious)মনের রহস্য, যার আবিস্কর্তা সিগমুন্ড ফ্রয়েড৷ অথচ, যখন মেটাফিজিক্যাল আর্ট তৈরি হচ্ছে, তখন, এই তত্ত্ব শিল্পে ব্যবহার করার কথা ভাবাই যেত না, ওনারা এই তত্ত্ব না ভেবেই আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যবহার করেছিলেন৷ কারণ, দাদাইজম্-এরও আগে মেটাফিজিক্যাল আর্ট-এর জন্ম হয়েছিল ১৯১০ সালে৷ চিত্রশিল্পী জর্জিও ডি চিরিকো(Giorgio de Chirico)-র হাত ধরে৷ যদিও তাঁর সঙ্গে সহযোগী হিসেবে ছিলেন ফিউচারিজম্-এর অন্যতম শিল্পী কার্লো ক্যারা ও তাঁর ভাই অ্যালবের্তো স্যাভিনি৷ আর, বিস্ময়কর হচ্ছে— সাররিয়েলিজম্-এর মতো এই Metaphysical Art-এরও নামকরণ করেছিলেন কবি গীয়োম অ্যাপোলোনিয়ার৷ আর, কার্লো ক্যারা তো আনুষ্ঠানিকভাবে মেটাফিজিক্যাল আর্ট-এর স্কুলও করেছিলেন ১৯১৭ সালে৷ যার অধ্যক্ষও ছিলেন তিনি৷

    সাররিয়েলিস্টদের যে দর্শন, আর তাঁরা ক্যানভাসে যে ছবিটি আঁকছেন, এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ৷ কারণ, মাঝখানে অবচেতন মনের ভূমিক থাকে প্রায় সবটাই৷ বিশ্বখ্যাত শিল্প-বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মেটাফিজিক্যাল আর্ট না থাকলে এই কাজ তাঁরা পারতেন কিনা সন্দেহ আছে৷ যেন, সাররিয়েলিস্টদের যে দর্শন আর তাঁদের ক্যানভাসে তৈরি করা দৃশ্যের মাঝখানে হাইফেনের মতো কাজ করছে এই মেটাফিজিক্যাল আর্ট৷

    এই মেটাফিজিক্যাল আর্ট-এর যিনি স্রষ্টা, জর্জিও ডি চিরিকো, মূলত এই আর্টকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন ১৯১১ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে৷ তিনি মূলত যেটি বোঝাতে চেয়েছিলেন— আধ্যাত্মচেতনায় কোনো আলংকারিক দৃশ্য থাকে না৷ তাই, তিনি ছবির থেকে সচেতনভাবে আলংকারিক দৃশ্যকে সম্পূর্ণ পরিহার করেছিলেন৷ এই যে তিনি ছবিতে অলংকার বর্জিত পৃষ্ঠতল ব্যবহার করলেন, তা অন্যতম দর্শন হিসেবে সাররিয়েলিস্টরা তাঁদের ছবিতে ব্যবহার করলেন৷ যেন, আমরা অহেতুক, কোনো কারণ ছাড়া, একটি বস্তুকে শুধুমাত্র সুন্দর দেখাবার জন্য তাতে অলংকার প্রয়োগ করি না৷ যেমন আগে চিত্রশিল্পীরা রিয়েলিস্টিক ছবিতে, বিশেষ করে পোশাককে সুন্দর দেখাবার জন্য, তাতে নানারকম ফুল-পাতা-নকশা, বা নানা রকম ডিজাইন যুক্ত করতেন৷

    আমরা একটু আগে ১৯১৩ সালে আঁকা ডি চিরিকো-র যে ছবিটি(ছবি-১) দেখিয়েছি— ‘দ্য রেড টাওয়ার’৷ ওটি যদি ভালো করে লক্ষ করা যায়, তাহলে আমরা দেখতে পাব— ওই ছবিতে তিনি অত্যন্ত কঠিন বা শক্ত রং(Stark colour)ব্যবহার করেছেন, অথচ ছবি আঁকার স্টাইলটা ছিল ইলাস্ট্রেটিভ৷ এই কারণেই কিন্তু এই ছবিটা দেখলে দর্শকদের গা ছমছম করে৷ ডি চিরিকোর এই মারাত্মক আবিষ্কারটিও সাররিয়েলিস্টরা সম্পূর্ণভাবে নিয়েছেন৷ তাঁদের ছবিতে ব্যবহার করেছেন৷

    ঠিক তার পরের বছর ১৯১৪ সালে তিনি, জর্জিও ডি চিরিকো, আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি এঁকেছিলেন৷ নাম— ‘দ্য নস্টালজিয়া অফ দ্য পোয়েট’(ছবি-২/১)৷ এতদিন ছবি দেখার যে গতানুগতিক বিজ্ঞান, যে গতানুগতিক ব্যাখ্যা, তিনি তা নস্যাৎ করে দিলেন এই ছবিতে৷ দদর্শকের দিকে একেবারে পিছন ফিরে আছে একজন৷ এই যে দর্শকের দিকে পিছন ফিরে থাকা, ছবি আঁকার ক্ষেত্রে একেবারে নিষেধ ছিল৷ এই দুঃসাহসিকতা তিনি অনায়াসে এই ছবিতে দেখালেন৷ পাশাপাশি, ঐতিহাসিকভাবে এই প্রথম একটি ছবিতে Juxtaposition-কে ব্যবহার করা হল৷ যদিও সেই প্রয়োগ একশো শতাংশ নিখুঁত নয়(ছবি-২/২)৷ তবুও পথিকৃত হিসেবে বা পাইওনীয়ার হিসেবে এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম!

   
 তিনি একজন সফল সাহিত্যিকও ছিলেন৷ তাঁর একটি বিখ্যাত উপন্যাসের নাম— হেবডোমেরোস(Hebdomeros)৷ যেখানে তিনি উপস্থাপন করেছিলেন সিরিজ অফ ড্রিমস্কেপ৷ এই ড্রিমস্কেপের জন্য চিত্রকল্পের যে বাতাবরণ ও কাঠামো তৈরি করেছিলেন, তা তৈরি করার জন্য যে পাঞ্চুয়েশন, যে শব্দবিন্যাস(Syntax), যে ব্যাকরণ-এর ডিজাইন তৈরি করলেন, তা সাহিত্যে ব্যবহারই করা হত না এতদিন৷ পরবর্তীকালে সাররিয়েলিস্ট সাহিত্যিকরা এই ডিজাইনটাই পুরোপুরি গ্রহণ করলেন৷ ছবি আঁকার ক্ষেত্রে যে দুজন সাররিয়েলিস্ট শিল্পী এই জর্জিও ডি চিরিকো-র দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ছিলেন, তাঁরা হলেন— সালভাদোর দালি ও রেনে ম্যাগরিত্তে৷

    তবে, যুগপৎ দুঃখের ও বিস্ময়ের ব্যাপার হল— জর্জিও ডি চিরিকো ১৯২৮ সালে সাররিয়েলিজম্ গ্রুপ পরিত্যাগ করেছিলেন!

    আমরা আগে জেনেছি— সাররিয়েলিজম্-এর সূত্রপাত প্রথম হয়েছিল সাহিত্যে৷ তারপর একে পেন্টিং-এ প্রথম ব্যবহার করেন ১৯২৪ সালে হোয়ান মিরো ও আন্দ্রে ম্যাসো৷ আর, প্রথম সাররিয়েলিস্ট চিত্র-প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯২৫ সালে প্যারিস-এর ‘গ্যালারী পিয়েরে’-তে৷ প্রদর্শনীটির নাম ছিল ফরাসি ভাষায়— La Peinture Surrealiste.৷ এই প্রদর্শনীতে আন্দ্রে ম্যাসো, ম্যান রে, পল ক্লে, হোয়ান মিরো ও অন্যান্যদের পেন্টিং প্রদর্শিত হয়েছিল৷

এটি একটি ঐতিহাসিক জয় এই কারণে যে, এই প্রদর্শনীর আগে পর্যন্ত শিল্প মহলের বিশ্বাস ছিল— সাররিয়েলিজম্-এর যে দর্শন, মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব, তাতে দৃশ্যশিল্পের কোনো উপাদান নেই৷ এই নিয়ে প্রচণ্ড বিতর্কও ছিল, যে, মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব থেকে আদৌ ছবি তৈরির উপাদান পাওয়া সম্ভব কিনা! এই প্রদর্শনী সমস্ত বিতর্কের সমাধান করে দিল৷

আর, সাররিয়েলিস্ট ছবি তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রথম যে টেকনিক ব্যবহার হয়েছিল, সেটি কিন্তু নেওয়া হয়েছিল দাদাইজম্ থেকে৷ টেকনিকটির নাম ছিল— ‘ফোটোমন্তাজ’৷ কতগুলো ফোটোকে বিচ্ছিন্নভাবে এনে এক জায়গায় আঠা দিযে যুক্ত করার নাম ফোটোমন্তাজ৷

সাররিয়েলিস্টদের প্রথম প্রদর্শনী সফল হওয়ার পর, ঠিক তার পরের বছরেই, ১৯২৬ সালে, ‘গ্যালারি সাররিয়েলিস্ত’ উদ্বোধন হল ম্যান রে-র ছবির চিত্র প্রদর্শনী দিয়ে৷ এটিও যখন সফল হল, তখন আন্দ্রে ব্রেতোঁ শুধুমাত্র চিত্রশিল্পের জন্য আংশিক ম্যানিফেস্টো— ‘সাররিয়েলিজম্ অ্যান্ড পেন্টিং’ প্রকাশ করল ১৯২৮ সালে৷ যেখানে সাররিয়েলিস্ট চিত্রশিল্পের আন্দোলনের নির্দিষ্ট সুচিগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া ছিল৷ এরপর নিরবিচ্ছিন্নভাবে এই আন্দোলন চলেছিল ১৯৬০ সাল পর্যন্ত৷ (ক্রমশ)


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments