জ্বলদর্চি

কোভিড তৃতীয় ঢেউ/ডা: পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

কোভিড তৃতীয় ঢেউ
ডা: পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

দ্বিতীয় ঢেউয়ের আবহের মধ্যেই করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। ভীতি এবং তার থেকে গুজব ছড়ানোর আগে দু একটা সহজ সত্যি সহজ ভাবে জানুন। 

  ধরুন কোনো স্থানে কোনো সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব চলছে। চলতে চলতে  পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেল কোনো একটা সময়ে কিছুদিন ধরে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা আগের তুলনায় হঠাৎ অনেক বেড়ে গেছে। অনেকটা শান্ত সমুদ্রে ঢেউ ওঠার মতো। এই ব্যাপারটিকে বলে ওয়েভ। এবার আপনি যদি স্বাভাবিক বুদ্ধি খাটান তাহলে নিজেও বুঝতে পারবেন, হঠাৎ করে এই আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভবত তিনটি  কারণ হতে পারে।

  প্রথম কারণ হলো, যে কারণে সংক্রমন হয় সে কারণ প্রতিহত করতে আমরা নিজেরা স্বাস্থ্যবিধি মানছি না। অর্থাৎ  এর দায় আমাদের। দ্বিতীয় কারণ হলো, যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রোগ প্রতিহত করতে পারে সেটির বা সেগুলির যোগান কম। অর্থাৎ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গলদ। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মানে চিকিৎসা পরিকাঠামো। তার মধ্যে ওষুধ, দরকারে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা এবং ভ্যাক্সিন সবই অন্তর্ভুক্ত। এর দায় মূলত প্রশাসনের। তৃতীয় কারণ হলো, প্রথম দুটো বিষয়ে গলদ নেই, কিন্তু ভাইরাস নিজেকে পরিবর্তিত করে ফেলেছে। ফলত ওষুধ ভ্যাক্সিন কোনো কিছু কাজ করছে না। এ পাল্টে ফেলার ব্যাপারটাকে বলা হয় মিউটেশন।

    তৃতীয় ঢেউয়ের জন্য ভাইরাসের ডবল মিউটেশন যা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, সেটাই দায়ী হবে বলে বিজ্ঞানীরা ভাবছেন।(প্রথমে ডেল্টা, তারথেকে ডেল্টা  ভ্যারিয়েন্ট, তার থেকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্লাস)। কিন্তু কেন এমন হলো? তার কারণটা খুব জটিল নয়। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যাঁরা আক্রান্ত হন, তাঁরা অনেকেই উপসর্গযুক্ত, অনেকেই উপসর্গহীন। যাঁরা উপসর্গযুক্ত তাঁরা তো রাষ্ট্রের চিকিৎসার নাগালে। কিন্তু যাঁরা তা নন তাঁরা নির্বিচারে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সমাজের সবথেকে সাংঘাতিক বিপদের সম্ভাবনা তাঁদের থেকে। তাঁদের শরীরে থাকা ভাইরাস কোনো চিকিৎসার আওতায় না এসে নিজেদেরকে পরিবর্তিত করার কারণে মানুষের আয়ত্বের  বাইরের চলে যাচ্ছে। শুধু তাইই  নয় তাঁদের থেকে যে সংখ্যক  মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁরা সকলেই  পরিসংখ্যানের বাইরের এবং সমাজের গুপ্ত শত্রুর মতো।
এই ঢেউ কবে আসবে নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। পারার কথা নয়। কারণ পুরোটাই নির্ভর করবে উপরে বর্ণিত কর্মকান্ডের গতির উপর। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঠিকঠাক ও স্বাস্থ্যবিধিতে নাগরিক দায়িত্ব পালন ঠিকঠাক হলে এমনও হতে পারে যে এই ঢেউ এলই না অথবা খুব হালকা চালে এল। এর তীব্রতাও আগাম বলা সম্ভব না। পুরোটাই নির্ভরশীল নাগরিক সংবেদনশীলতা ও প্রশাসনিক দায়িত্বের  প্ৰতি তাঁদের দায়বদ্ধতার উপর।
এর মারণ ক্ষমতা ও সংক্রমণের ক্ষমতা সম্বন্ধে এখনই পূর্বাভাস সম্ভব নয়। কারণ মিউটেন্ট ভাইরাসের ক্ষমতা কেমন হবে তা ভাইরাস নিজেই জানে না। হতে পারে বিষাক্ত। হতে পারে নির্বিষ। 

  আরো একটা বিষয় বলা হচ্ছে, এই ওয়েভে টার্গেটের অনেকটাই হবে শিশুরা। তার কারণ হিসেবে তিনটি  বিষয়ের কথা বলা হচ্ছে। প্রথম কারণ হলো, বেশির ভাগ শিশুকেই স্বাস্থ্যবিধি পালন করানো সম্ভব হয় না। দ্বিতীয় কারণ হলো শিশুরা এখনো ভ্যাক্সিন নেওয়ার টার্গেট গ্রুপেই আসেনি, তাই রোগের টার্গেট পপুলেশন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তাদেরই বেশি। আর তৃতীয় কারণ হলো, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতেই সময় লাগে নয় বছর,তার আগে শিশুদের প্রতিরোধের অভাবে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

  এখন বুঝে নেওয়া  যাক, শিশুদের জন্য অভিভাবক হিসেবে এক্ষেত্রে আমাদের কি কি জানা ও করা দরকার। এ বিষয়ে মতামতগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক এবং হু'র। তাঁদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রথম আশাব্যঞ্জক খবর এটাই যে, তৃতীয় ওয়েভে শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হবেন এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ এখনো পর্যন্ত তাঁদের হাতে আসেনি। ভারতে  ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার  চরিত্রগত পরিবর্তন  বা মিউটেশনের ব্যাপারটা নিয়ে গবেষক সংস্থার নাম Institute of Genomics and integrative biology। তাঁরা জানিয়েছেন সেকেন্ড ওয়েভ তৈরি করেছিল যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, তার সঙ্গে আরও মিউটেশন হয়ে তৈরি হওয়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্লাসের(যা কিনা তৃতীয় ওয়েভ তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।) বিরাট কোনো চরিত্রগত পার্থক্য নেই। প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট ডক্টর জ্যাকব জন ও একই মতামত দিয়েছেন।

  যদিও এতে গা ছাড়া দেওয়ার কিছু নেই। সব কিছুর দিকে নজর রাখতে হবে।

  নিউ নর্মাল একটি অভ্যাস। যত তাড়াতাড়ি শেখেন তত মঙ্গল। যিনি নিউ নরমাল শেখাচ্ছেন সে শিক্ষকের নয়, আপনার ও আপনার পরিবারের লাভ এতে।(হাত পরিস্কার রাখা, দূরত্ববিধি বজায় রাখা এবং বাইরে বেরোলে সঠিক ভাবে মাস্ক পরা, এই তিন মিলে যে লাইফস্টাইল তাই'ই হলো নিউ নরমাল)।

  এখনো পর্যন্ত গবেষণা এও বলছে যে শিশুদের শরীরে করোনা সংক্রমন হলেও স্বাস্থ্যে তা বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না।

  তাহলে প্রশ্ন হল, তাদের শরীরে সেক্ষেত্রে কি কি উপসর্গ দেখা দিতে পারে? জেনে নিন, সূত্র বলছে, বড়জোর সর্দিকাশি, পেটখারাপ, পেটব্যথা, জ্বর, খিদে কমে যাওয়া, ঝিমুনি, দুর্বলতা,  এসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে। নিউমোনিয়ার উপসর্গ যদি দেখাও যায়, তাহলে তা চিকিৎসায় সেরে যাবে।

  তবে সব শিশুদের ক্ষেত্রে কিন্তু এ তথ্য সত্যি নয়। যে সব শিশুরা স্থূলত্ব, টাইপ 1 ডায়াবেটিস, হৃৎপিন্ড ও ফুসফুসের জটিল রোগ, কিডনির রোগ, ক্যানসার ইত্যাদিতে ভুগছে, তাদের ক্ষেত্রে কিন্তু বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। শিশুদের কোভিড সংক্রমন হয়েছে এরকম সামান্যতম সন্দেহ হলেই শিশুকে ছ মিনিট দ্রুত গতিতে হাঁটিয়ে দেখতে হবে আঙুলে পালস অক্সিমিটার লাগানো অবস্থায়। যদি তাতে স্যাচুরেশন 95 শতাংশের নীচে নেমে যায় অথবা শিশুর মাথা ঘোরে, শ্বাস কষ্ট হয় বা সে অবসন্ন হয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিজেরা নেট দেখে শিশুদের ওষুধ খাওয়ানোর একেবারে চেষ্টা করবেন না।
তাতে শুধু নিজেদের নির্বুদ্ধিতাই প্রমাণিত হয়, অন্য কিছু নয়। সর্বদা চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলবেন। বাধ্য না হলে অন্য রোগের ক্ষেত্রেও এক্সপার্টের অনুমতিক্রমে টেলিমেডিসিন  করবেন। দরকারে ভিডিও কন্সাল্টেশন।
শিশুদের সংক্রমন হয়েছে সন্দেহ হলে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, হাওয়া বাতাস পূর্ণ জায়গায় আলাদা করে রাখবেন। পারতপক্ষে এসি চালাবেন না। তাদের যথা সম্ভব বাড়িতে থাকা সমীচীন। গণপরিবহন একেবারেই এড়িয়ে চলতে হবে। উষ্ণ গরম জলে তাদের গার্গল করাবেন অথবা স্টিম নেওয়াবেন। বোধহীন ছোট শিশু হলে তা করবেন নিজের কোলে বসিয়ে। তিন থেকে চার মিনিট করে করলেই হবে এ পদ্ধতি।

  দু বছরের বেশি বয়স হলে দিনে দুবার করে দাঁত ব্রাশ করাতে হবে। পাঁচ বছরের উপর বয়স হলে শ্বাসের এক্সারসাইজ শেখাতে হবে। পাঁচ বছরের পর থেকে শিশুদের মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। শিশুদের সঙ্গে থাকা অভিভাবকদের সঠিক পদ্ধতি মাস্ক পরতে হবে। পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের পথে বেরোলে তাদের কড়া তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে যাতে তারা সংক্রমিত না হয়। দরকারে মুখ ও নাকের উপর কাপড়ের স্তর দিয়ে বলয় তৈরি করতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে তিন স্তর বিশিষ্ট নন মেডিকেটেড ফেব্রিক মাস্ক যথেষ্ট।

  পুষ্টিকর এবং সুষম খাদ্য এ সময় অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়টি সম্ভব হলে আলাদা করে সাপ্লিমেন্ট অথবা ভিটামিন নেওয়ার কোনো দরকার পড়েনা।
অতিমারীর তীব্রতা বাড়লে স্বাভাবিক ও সাধারণ টিকাকরণ প্রক্রিয়া চিকিৎসকের পরামর্শ মত পিছিয়ে দিলে ক্ষতি নেই। এখানে দেখতে হবে প্রায়োরিটি এবং রিস্ক বেনিফিট।

  আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আবার স্মরণ করাই সকলকে। দেশের রোল মডেলরা, বিখ্যাতরা এবং নেতামন্ত্রীরা, নাগরিকদের মাস্ক পরতে হবে বলে প্রচার করছেন পোস্টার, ফ্লেক্স, বৈদ্যুতিন মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে, এটা দৃষ্টান্ত হিসেবে খুব ভালো সন্দেহ নেই, কিন্তু অনেক  ক্ষেত্রে এই প্রচারকালেও তাঁদের মুখেও মাস্কটি নেই অথবা সেটি থুতনি বা চোয়ালের নীচে ঝুলছে, বা পুরো নাকটি দেখা যাচ্ছে। এভাবে কিন্তু হবে না। আগে নিজেদের আচরণ ঠিক করার দিকে খেয়াল রাখতে। মানুষকে শেখানো সহজতর হবে নিজে শিখলে। Above all, its a team work।

 সকলে ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। পৃথিবী আবার সুন্দর হোক।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments