জ্বলদর্চি

জন্ম দ্বিশতবর্ষে মনীষী অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০ -১৮৮৬)/প্রসূন কাঞ্জিলাল

জন্ম দ্বিশতবর্ষে মনীষী  অক্ষয়কুমার দত্ত 
(১৮২০  -১৮৮৬)

প্রসূন কাঞ্জিলাল

বিগত বছর ১৫ জুলাই,  শ্রী অক্ষয়কুমার দত্তের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী ছিল। নামটা কি অপরিচিত মনে হচ্ছে ? অন্য একটি পরিচয় দিলে অবশ্য চিনতে অসুবিধা হবে না। তিনি ‘ছন্দের জাদুকর’ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পিতামহ। স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে দীর্ঘদিন থেকে সত্যেন্দ্রনাথের  কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়ে আসছে বলে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আজ পিতামহের চেয়েও হয়তো বেশি পরিচিত হতে পারেন, কিন্তু বাংলা ভাষা নির্মাণে ও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রবর্তনে অক্ষয়কুমার দত্তের যে অবদান, তার গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁর কীর্তির অলক্ষ্য প্রভাব আমাদের ওপর এখনো তাই বহমান।

  বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা’। কথাটি অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পর্কেও সমানভাবে সত্য। তিনি বিদ্যসাগরের পরম বন্ধুও ছিলেন। তাঁরা দুজনই যুগপৎভাবে বাংলা ভাষা গদ্যের মজবুত ও আধুনিক ভিত্তি নির্মাণ করে গেছেন। সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষা বিকশিত হয়েছে। তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ, একজন উৎকৃষ্ট চিন্তাবিদ এবং প্রথম বাঙালি সমাজবিজ্ঞানী।

  বর্ধমান জেলায় (নবদ্বীপের কাছে) চুপী গ্রামে ১৮২০ সালের ১৫ জুলাই জন্মেছিলনে অক্ষয়। তাঁর পিতা কলকাতায় পুলিশে চাকরি করতেন। গ্রামের স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর অক্ষয় কলকাতার "ওরিয়েন্টাল সেমিনারি"তে পড়তে আসেন। কয়েক বছর পড়াশোনা করার পর পিতার মৃত্যু হলে তাঁকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এত দূর পর্যন্তই। কিন্তু অদম্য ছিল তাঁর জ্ঞানস্পৃহা। তাই বাড়িতেই নিজ উদ্যোগে পড়াশোনা চালিয়ে যান। স্কুলের ইংরেজ শিক্ষক বহুভাষাবিদ পণ্ডিত জেফ্রয়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর কাছে গ্রিক, লাটিন, জার্মান, ফরাসি ও হিব্রু ভাষা ছাড়াও শেখেন পদার্থবিদ্যা, ভূগোল, জ্যামিতি, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, সাধারণ বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি। আর আমিরউদ্দীন মুন্সির কাছে শেখেন ফারসি ও আরবি ভাষা। পরবর্তীকালে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক থাকার সময় কিছুদিন তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে গিয়ে অতিরিক্ত ছাত্র হিসেবে উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র ও প্রকৃতিবিজ্ঞান পড়েছিলেন।

  ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ গঠন করলে তিনি তার সভ্য হন এবং মাসিক আট টাকা বেতনে ব্রাহ্মদের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক নিযুক্ত হন। এই বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় পাঠদানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাংলায় এসব বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক না থাকায় তিনি ১৮৪১ সালে ‘ভূগোল’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১ বছর। তখনো বিদ্যাসাগরের কোনো বই কিন্তু প্রকাশিত হয়নি। এই গ্রন্থটি অক্ষয় দত্তের প্রথম গদ্যগ্রন্থ হলেও তাঁর ভাষা পূর্ববর্তী বাংলা গদ্যের তুলনায় অনেক প্রাঞ্জল ও সরল। এই গ্রন্থে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় যতি চিহ্ন ব্যবহার করেন। এই রইল সেই ভাষার নমুনা:-----

  "যে বিদ্যা দ্বারা পৃথিবীর আকার পরিমাপ এবং তাহার উপরিভাগস্থ স্থান সমূহ সমুদয় জ্ঞাত হওয়া যায় তাহার নাম ভূগোল বিদ্যা।
  ‘ভূ' শব্দের অর্থ পৃথিবী এবং 'গোল' শব্দের অর্থ গোলাকার, অতএব গোলাকার পৃথিবী বিষয়ক বিদ্যাকে ভূগোল কহা যায়। পৃথিবীর আকৃতি প্রায় গোল যেমন কমলালেবু গোলাকার। অথচ তাহার বোঁটার নিকট কিঞ্চিৎ নিম্ন, সেইরূপ পৃথিবীও গোল কিন্তু উত্তর দক্ষিণে কিঞ্চিৎ চাপা।"

  রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছিলেন যে তিনিই বাংলা ভাষাকে ‘সর্বপ্রকার ব্যবহারযোগ্য’ করে তুলেছিলেন এবং ‘গ্রাম্য পাণ্ডিত্য ও গ্রাম্য বর্বরতা’—এই দুইয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। ‘ভূগোল’–এর ভাষা দেখে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ তাঁর জন্মের বিশ বছর আগে প্রকাশিত ও পরবর্তীকালে দুর্লভ এই গ্রন্থটি হয়তো বা তখনো দেখেননি।
 
  অক্ষয়কুমার দত্ত ‘বিদ্যাদর্শন’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা বের করেছিলেন কিছুদিন। তবে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'র সম্পাদক হিসেবেই তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। যদিও পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মধর্ম প্রচার, কিন্তু অক্ষয় দত্ত ও তাঁর বন্ধু বিদ্যাসাগরের কারণে এটি সে সময়ে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস ও সমাজ সংস্কার বিষয়ে একটি অগ্রণী পত্রিকায় পরিণত হয়। 

  বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলনের উদ্দেশ্যে লিখিত বিভিন্ন প্রবন্ধ এই পত্রিকায় ছাপা হয় এবং অক্ষয় দত্ত তার সমর্থনে সম্পাদকীয় লেখেন। বিধবাবিবাহকে তিনি কতটুকু সমর্থন করতেন, পৌত্র সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনীতে বর্ণিত একটি ঘটনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার অক্ষয় দত্তের এক কর্মচারী কয়েক হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। তাঁকে চিঠি লিখে জেল-পুলিশের ভয় দেখালে তিনি জবাবে তাঁকে জানান, ‘আপনি আমাকে বলেছিলেন আমি বিধবাবিবাহ করলে আমাকে পুরস্কার দেবেন। আমি বিধবাবিবাহ করেছি।’ অক্ষয়কুমার খোঁজ নিয়ে জানলেন, সত্যিই তিনি একজন বিধবাকেই বিয়ে করেছেন। তিনি সেই কর্মচারীকে চিঠি লিখলেন, ‘তোমার সকল অপরাধ ক্ষমা করলাম’।’

  ‘ভূগোল’ প্রকাশের পনেরো বছর পর প্রকাশিত তাঁর ‘পদার্থবিদ্যা’ বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানের বই। এ ছাড়া বিজ্ঞানের ও সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা ‘চারুপাঠ’ (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড) পাঠ্যপুস্তক হিসেবে প্রচুর জনপ্রিয় হয়েছিল। এসব গ্রন্থে প্রথম ব্যবহৃত শব্দগুলি হল —মাধ্যাকর্ষণ, আহ্নিক গতি, বিষুবরেখা, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা, চুম্বক, বিকিরণ, তড়িৎ, সুমেরু, কুমেরু, স্থিতিস্থাপকতা, আপেক্ষিক গতি, ভারকেন্দ্র, দূরবীক্ষণ, অণুবীক্ষণ — ইত্যাদি অসংখ্য পরিভাষা আজ বাংলা ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে এবং আমরা প্রতিনিয়ত তা ব্যবহারও করছি।

  অক্ষয় দত্তের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক  সম্প্রদায়’। তাঁর বইগুলো কোনো না কোনো ইংরেজি গ্রন্থ অবলম্বনে রচিত হলেও এই গ্রন্থে ভারতের উপাসক সম্প্রদায় সম্পর্কে তাঁর নিজের অনুসন্ধানলব্ধ তথ্য ও পর্যবেক্ষণ রয়েছে। বিখ্যাত জার্মান ভারতবিদ ম্যাক্সমুলার এ বইটি পড়েই অক্ষয় দত্তকে প্রশস্তিমূলক চিঠি লিখেছিলেন।

  অক্ষয়কুমার তেইশ বছর বয়সে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন চিন্তা ও নিবিড় বিজ্ঞানচর্চার কারণে এবং হয়তো বিদ্যাসাগরের সাহচর্যে এই সমাজবিজ্ঞানী সব ধরনের ভাববাদিতা ও সংস্কার থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। যাত্রার ‘শুভ-অশুভ’ ক্ষণ বলে কিছু যে নেই তা প্রমাণ করার জন্য শাস্ত্রে ‘অশুভ’ এমন দিনক্ষণ দেখে তিনি ভ্রমণে বেরোতেন। বিদ্যাসাগর বেদান্ত-সাংখ্য দর্শনের মতো হিন্দুধর্মীয় দর্শনকে ভ্রান্ত বলেছিলেন। তেমনি অক্ষয় দত্তও হিন্দু ও ব্রাহ্মদের নিকট ঐশ্বরিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত বেদকে মানুষের রচনা এবং সে কারণে অভ্রান্ত নয় বলে ঘোষণা করেন। তবে অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর ঈশ্বরবিষয়ক একটি সমীকরণের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত । ধর্ম–সম্পর্কিত এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ব্রাহ্মসমাজের পত্রিকা ‘তত্ত্ববোধিনী’তে কাজ করা অক্ষয় দত্তের জন্য অসুবিধাজনক হয়ে ওঠে। বিদ্যাসাগর শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘নরমাল স্কুল’এর প্রধান শিক্ষক করে নিয়ে আসেন বন্ধু অক্ষয়কে। তবে শারীরিক অসুস্থতার জন্য দীর্ঘদিন তিনি এ দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।

  নারী শিক্ষার পক্ষে একজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন অক্ষয় দত্ত। বিদ্যাসাগর শাস্ত্র না মানলেও যেভাবে শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত, তেমনি শাস্ত্র না-মানা অক্ষয়ও নারী শিক্ষার সমর্থনে হিন্দু শাস্ত্র থেকে উদাহরণ দিয়ে সেগুলোকে নারী শিক্ষার সমর্থক বলে ব্যাখ্যা করেতেন।
বাংলা ভাষার প্রসারে তিনি যে গুরুত্ব দিতেন, তা অতুলনীয়। আমাদের ভাষা আন্দোলনের শতবর্ষ আগে তিনি অফিস–আদালত ও উচ্চশিক্ষাসহ সব স্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের কথা বলেছিলেন। প্রখ্যাত শিক্ষাব্রতী ডেভিড হেয়ারের মৃত্যুর পর তিনিই প্রথা ভেঙে প্রথম বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

  অক্ষয় দত্তের শিক্ষাচিন্তার আধুনিকতা এবং আজকের প্রাসঙ্গিকতা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। এখন আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে মুখস্থনির্ভরতা থেকে মুক্ত করা নিয়ে চিন্তিত। অথচ প্রায় দেড়শ বছর আগে অক্ষয় দত্ত কী বলেছিলেন শুনুন— " কালেজ ও স্কুলে যেরূপ শিক্ষাপ্রণালী ব্যবহৃত হইতেছে তাহা কেবল স্মরণশক্তি উন্নতিসাধনপক্ষে বিশেষ অনুকূল, বুদ্ধিবৃত্তির পরিচালনা ও উন্নতিসাধনের পক্ষে তত অনূকূল নহে। শুনিতে পাওয়া যায় যে, প্রধান প্রধান কালেজের অধ্যাপকেরা ছাত্রদিগকে কোনো প্রশ্ন করেন না। কেবল গ্রন্থের ব্যখ্যা করিয়া যান, ছাত্রেরা কেবল নোট লয়। ইহাতে বুদ্ধিবৃত্তির কীরূপ পরিচালনা হইতে পারে, পাঠকবর্গ তাহা সহজে বুঝিতে পারেন।"

  অক্ষয় দত্ত আর বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন একই বছর, আজ থেকে দুইশ বছর আগে, ১৮২০ সালে। তাদের এই কীর্তিময় বন্ধুত্ব তাদের সমসাময়িক দুজন যুগপ্রবর্তক জার্মান দার্শনিকদ্বয়ের বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এঁদের একজন তাঁদেরই সমান বয়সী, তাঁর নাম ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, এবং অন্যজন দুই বছরের বড়, নাম কার্ল মার্ক্স।

  প্রকৃতপক্ষে অক্ষয়কুমার দত্তই ছিলেন বাংলায় বিজ্ঞান সংস্কৃতি গড়ে তোলার মূল কান্ডারি। ১৮৪০ সালের জানুয়ারি মাসে, তত্ত্ববোধিনী সভার সহকারী সম্পাদক রূপে নির্বাচিত অক্ষয়কুমার, উক্ত বছরেই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার শিক্ষক রূপে নিযুক্ত হন। এখানেই তিনি ভূগোল ও পদার্থবিদ্যা পড়ানোর সময়ে বাংলা ভাষায় ‘ভূগোল’ ও ‘পদার্থবিদ্যা’ নামে দু’টি পাঠ্যপুস্তক লিখে ফেলেন। ‘পদার্থবিদ্যা’ (১৮৫৭) ছিল তাঁর লেখা বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের (Pure Science) প্রথম বাংলা বই। বাংলায় বিজ্ঞানের পরিভাষা গঠনেও তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। আবার, ১৮৪২ সালের জুন মাসে প্রসন্নকুমার ঘোষের সহায়তায় অক্ষয়কুমার ‘বিদ্যাদর্শন’ নামে যে মাসিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন, তার মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল বাঙালি মননকে বিজ্ঞানচেতনায় সমৃদ্ধ করা। পাশ্চাত্য বেকনীয় দর্শনের গুণগ্রাহী অক্ষয়কুমার দত্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন এবং সেই উদ্দেশ্য পূরণে তিনি নিজেই এগিয়ে এসেছিলেন। 

  ১৮৪৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’-য় ব্রিটিশ phrenologist (করোটি পরীক্ষা দ্বারা কোনও ব্যক্তির চরিত্র ও বিবিধ গুণাবলি নির্ণয় করতে পারেন যাঁরা) জর্জ কুম্ব (George Combe)-এর "The Constitution of Man Considered in Relation of External Object" পুস্তকের ভাবধারায় ভারতীয় প্রেক্ষিতে তাঁর লেখা " বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার " প্রকাশিত হতে থাকে। পরে এটাই দু’খণ্ডের বই হয়ে প্রকাশিত হয়। 

  আর তিন খণ্ডে তাঁর লেখা ‘চারুপাঠ’ ছিল তৎকালীন সময়ের এক জনপ্রিয় পাঠ্যপুস্তক। সহজ, সরল ভাষায় ছোট ছোট প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান বিষয়ের নানা প্রবন্ধের মাধ্যমে এই বইয়ের মধ্য দিয়ে তিনি বিজ্ঞানকে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অনেকটা সম্পৃক্ত করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

  নিজের উপার্জনের প্রায় সব টাকাই তিনি বাংলায় বিজ্ঞান-সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলার কাজে নিঃস্বার্থে দান করেছিলেন। মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণার কেন্দ্র রূপে তাঁর অকৃত্রিম দানেই গড়ে উঠেছিল আজকের ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স’।

  আজকের ভারতকে যখন কুসংস্কার আর অন্ধত্বের এক কঠিন বেড়াজালে আবদ্ধ করে ফেলার বন্দোবস্ত বা ষড়যন্ত্র চলছে, তখন এই বাঙালি মনীষীর জন্মের দ্বিশতবর্ষের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বাঙালির বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে তাঁর অনন্যসাধারণ মৌলিক অবদানকে আজকের বাঙালি সমাজের সামনে তুলে ধরাই আমাদের একান্ত কর্তব্য। 

  ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানের লেখালিখি শুরু হয়েছে। তখন মূলতঃ ইংরেজ লেখকেরাই বাংলায় লেখালিখি করতেন।১৮১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত বিজ্ঞান সাহিত্যের বয়সকে মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।------

১। ইউরোপীয় লেখকদের আমল (হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠাতা থেকে শ্রী অক্ষয়কুমার দত্তের পূর্ব পর্যন্ত)।

২। শ্রী অক্ষয়কুমার দত্ত থেকে শ্রী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী।

৩।শ্রী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী থেকে শ্রী জগদানন্দ রায়। 

  আমাদের এও মনে রাখতে হবে, অক্ষয়কুমার দত্তের হাত ধরেই বাংলায় বিজ্ঞান সাহিত্য সাবালকত্ব লাভ করে। বিজ্ঞান, গণিত ও ভূগোলের অসংখ্য পারিভাষিক শব্দও তৈরি করেছিলেন অক্ষয়কুমার। অণুবীক্ষণ, চুম্বক, জ্যোতির্বিদ্যা, দাহ্য পদার্থ, জড়, তড়িৎ, পরিমিতি, ধ্রুবতারা, অঙ্গার, বাষ্প, বজ্র, জোয়ার, রামধনু, সৌরজগৎ, মাধ্যাকর্ষণ, গ্রহণ, সুমেরু, কুমেরু, মানমন্দির, জ্বালামুখী, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি তাঁরই তৈরি করা বাংলা শব্দ। 

  1855 সালের 17 জুলাই বিদ্যাসাগরের তত্ত্বাবধানে সংস্কৃত কলেজে একটি নর্মাল স্কুল খোলা হল। উদ্দেশ্য - বিভিন্ন জেলায় যে সমস্ত আদর্শ স্কুল স্হাপন করেছেন বিদ্যাসাগর সেই সমস্ত স্কুলের জন্য আদর্শ ও উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি করা। নর্মাল স্কুলটি দুটি ভাগে বিভক্ত। উচ্চ শ্রেণির ভার নিলেন প্রধানশিক্ষক শ্রী অক্ষয়কুমার দত্ত। অক্ষয়কুমার দত্তকে শ্রদ্ধা করতেন বিদ্যাসাগর। দুজনেই সমবয়সী। কয়েক মাসের বড় অক্ষয় দত্ত। স্কুল প্রতিষ্ঠার আগে শিক্ষা বিভাগের অধ্যক্ষকে তাই বিদ্যাসাগর চিঠিতে লিখলেন - " For the post of Head Master of the Normal classes, I would recommend Babu Akshay Kumar Dutt, the well known editor of the 'Tatwabodhini Patrika'. He is one of the very few of the best Bengali writers of the time. His knowledge of the English language is very respectable and he is well informed in the elements of general knowledge, and well acquainted with the art of teaching." 

  দীর্ঘদিন অক্ষয়কুমার দত্ত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শারীরিক কারণে যখন পত্রিকার কাজ থেকে বিরতি চাইছিলেন তখনি বিদ্যাসাগর তাঁকে নর্মাল স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদটি দান করেন। শুধুই কি শারীরিক কারণ? সে সময় দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মতানৈক্যও সর্বজনবিদিত। কারণ।দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এক চিঠিতে লিখছেন--

  " কতকগুলান নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষ হইয়াছে। ইহাদিগকে এই পদ হইতে বহিষ্কৃত না করিয়া দিলে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের সুবিধা নাই।" এর পর পরই অক্ষয়কুমার তত্ত্ববোধিনী ছেড়ে দেন। কেউ বলে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। অক্ষয়কুমার দত্তর অন্যতম জীবনীকার, নকুড়চন্দ্র বিশ্বাস তাঁর "অক্ষয় চরিত" (1887) বইতে লিখেছেন নর্মাল  স্কুলের কাজ পেয়ে অক্ষয়কুমার বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন "তাহলে বাঁচি।" কিন্তু শ্রদ্ধেয় শ্রী আশীষ লাহিড়ী মহাশয় তাঁর "আঁধার রাতে একলা পথিক" বইতে অক্ষয়কুমারের এই মতামতকে খণ্ডন করে অক্ষয়কুমারের আরেক জীবনীকার মহেন্দ্র রায়ের বিবরণকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অক্ষয়কুমার জীবিত থাকা কালেই প্রকাশিত হয় মহেন্দ্র রায়ের "বাবু অক্ষয়কুমার দত্তের জীবনবৃত্তান্ত"(1887)। সেখানে মহেন্দ্র রায় লিখেছেন তাঁর পড়াশুনার ব্যাঘাত হবে বলে মাসিক তিনশ টাকা মাইনের এই পদ নিতে অস্বীকার করেছিলেন অক্ষয়কুমার। কিন্তু বিদ্যাসাগর যেহেতু আগেই চিঠি লিখে শিক্ষাধ্যক্ষের অনুমতি আদায় করেছিলেন, বিদ্যাসাগরের মর্যাদার কথা ভেবে কিছুটা নিমরাজি হয়েই অক্ষয়কুমার এই পদে যোগদান করেন। তবে বেশিদিন এই কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেননি তাঁর শিরঃপীড়ার জন্য। বারবার অজ্ঞান হয়ে যেতেন। 1858 সালে তাই ছেড়েও দেন শিক্ষক-শিক্ষণ স্কুলের অধ্যক্ষের পদ। নিজের পড়াশোনা, লেখালিখির প্রতি মনোযোগী হন তিনি। 1870 এ প্রকাশিত হয় তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম দর্শন ইত্যাদি বিষয়ের ওপর অন্যতম মৌলিক গবেষণা গ্রন্হ  "ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়" - প্রথম খণ্ড।  এবং 1883 তে দ্বিতীয় খণ্ড।

    আগে কিন্তু কবিতাও লিখতেন অক্ষয়কুমার। সম্ভবত 1834 সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর একমাত্র কবিতার বই "অনঙ্গমোহন"। ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর কাব্যের আদর্শে রচিত সে বই অনেকটা বটতলার বই এর গোত্রে পর্যবসিত হয়েছিল। তাঁকে ঐ বই 'অনঙ্গমোহন' কবি হিসেবে অন্তত কোন স্বীকৃতি যে দিতে পারেনি এ এক আশ্চর্যের কথা। অক্ষয়কুমার দত্ত প্রথম কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও বাংলা সাহিত্য তাঁকে মনে রেখেছে গদ্যকার হিসেবে। বাংলা ভাষার বিবর্তনে এক বড় ভূমিকা ছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার। সে পত্রিকা অক্ষয়কুমার প্রচণ্ড দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন প্রায় বারো বছর,1843 থেকে 1855 পর্যন্ত। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন প্রায় দুই মেরুর লোক। দুজনের মধ্যে প্রচুর মতপার্থক্য থাকলেও শুধুমাত্র অক্ষয়কুমারের গদ্য লেখার হাতটির জন্য তাঁকে সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন।

     অক্ষয়কুমারের গদ্য লেখার সূত্রপাত নিয়ে এক কাহিনী আছে। অক্ষয়কুমারের মেজ জ্যেঠুর ছেলে হরমোহন দত্ত তখনকার ' সুপ্রীমকোর্টের মাস্টার আপিসের বড়বাবু ছিলেন।' হরমোহনের কাছে থেকেই শিক্ষালাভ করতেন অক্ষয়কুমার। তখনকার আমলে বিখ্যাত পত্রিকা ' সংবাদ- প্রভাকর' এর সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞাপন আদায়ের জন্য হরমোহনের কাছে যেতেন। সেখান থেকেই অক্ষয়কুমারের সঙ্গে গুপ্তকবির আলাপ। এছাড়া যে রামধন বসুর বাড়িতে থেকে অক্ষয়কুমার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়তেন সেই রামধন বসুর বাড়ির পাশে নরনারায়ণ দত্তের বাড়িতে ' বাঙ্গালা ভাষানুশীলনী' সভা হত। সেখানেও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এবং অক্ষয়কুমার যেতেন। ক্রমে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এছাড়াও বরাহনগরে ' নীতিতরঙ্গিনী' নামে এক সভাতেও দুজনের গতায়াত ছিল। একদিন অক্ষয়কুমার প্রভাকরের অফিসে গেছেন। সেদিন ঈশ্বরচন্দ্রের সহকারী অনুপস্থিত। গুপ্ত কবি অক্ষয়কুমারকে 'ইংলিশম্যান' পত্রিকা থেকে কিছুটা অংশ অনুবাদ করে দিতে বলেন। অক্ষয়কুমার এমন প্রস্তাবে বিস্মিত হয়ে ঈশ্বরচন্দ্রকে বলেন- "আমি তো কোনদিন গদ্য লিখিনি"। ঈশ্বরচন্দ্রের পীড়াপীড়িতে শেষ অবধি কাজটি করেন তিনি। বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হলেন গদ্যকার অক্ষয়কুমার দত্ত। তিনি ক্রমে 'সংবাদ প্রভাকর' এর লেখক হয়ে ওঠেন।

    অক্ষয়কুমার দত্তর জন্ম 1820 খ্রিষ্টাব্দের 15জুলাই বর্ধমান জেলার চুপীর গ্রামে। পিতা পীতাম্বর দত্ত। মা দয়াময়ী দেবী। পীতাম্বর আদি গঙ্গার ধারে কুঁদঘাটে ক্যাশিয়ার আর দারোগা ছিলেন। পীতাম্বর তাঁর মেজদার ছেলে হরমোহনের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাই পরবর্তীকালে হরমোহনও অক্ষয়কুমারের পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে সংস্কৃত, পার্সি ইত্যাদি পড়ার পর নয় বছর বয়সে হরমোহনের সঙ্গে খিদিরপুর চলে আসেন এবং দুজন শিক্ষকের কাছে ইংরেজি পড়তে শুরু করেন। এরপর পড়াশুনার প্রতি অক্ষয়কুমারের আগ্রহ দেখে তাঁকে 'ওরিয়েন্টাল সেমিনারি' স্কুলে ভর্তি করে দেন। যাতায়াতের সুবিধার জন্য অক্ষয়কুমার দর্জিপাড়ায় তাঁর পিসতুতো দাদা রামধন বসুর বাড়িতে থাকতেন। ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে হার্ডম্যান জেফ্রয় নামে এক ইংরেজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন অক্ষয়কুমার। স্কুলেই থাকতেন ঐ সাহেব। প্রত্যেকদিন সকাল সন্ধে অক্ষয়কুমার তাঁর কাছে গ্রীক, ল্যাটিন, হিব্রু, জার্মান, ইলিয়ড, ভার্জিল, পদার্থবিদ্যা, ভূগোল, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, অঙ্ক, বিজ্ঞান, শাস্ত্র ইত্যাদি পড়তেন। এভাবেই বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর অনুরাগ বাড়ে। 1822 সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট পাস কোর্সের যে নতুন পাঠক্রম চালু করেছিলেন অনেকটা সেগুলোই জেফ্রয় পড়াতেন অক্ষয়কুমারকে।অক্ষয়কুমারের এক নোটবুক থেকে জানা যায় প্রথম জীবনে অক্ষয়কুমার কী কী বই পড়তেন।  সে তালিকায় যেমন ছিল গণিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান তেমনি ছিল দর্শন, স্মৃতি, তন্ত্র, কাব্যনাটক ও অলঙ্কারের বই। অক্ষয়কুমার সম্ভবত সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয়েছিলেন কুম্ব এর 'Constitution of Man in Relation to External Objects' পড়ে। তাঁর ' বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার'( 1851)বইটি আদতে কুম্বের বইটির ভাবানুবাদ। তবে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে বেশীদিন পড়া সম্ভব হয়নি তাঁর। 1839 এ পীতাম্বর দত্ত মারা গেলে তাঁর মা তাঁকে পড়াশুনা ছেড়ে সংসারের হাল ধরতে বলেন।তবে তিনি নিজে নিজে পড়াশোনাটা চালিয়ে যান।

  ইতিমধ্যে 1835 এ অক্ষয়কুমার পনের বছর বয়সে বিয়ে করেন আগরপাড়ার রামমোহন ঘোষির মেয়ে নিমাইমণি কে। সে বিয়েও সুখের ছিল না। তাঁর তিনপুত্রের মধ্যে প্রথম দুজন  চন্দ্রকুমার এবং হেমচন্দ্র অকালে মারা যান। কনিষ্ঠপুত্র রজনীনাথ দত্ত ছিলেন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার, তাঁরই সুযোগ্য পুত্র হলেন ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। অবশ্য সত্যেন্দ্রনাথের যখন মাত্র চার বছর বয়স তখন প্রয়াত হন অক্ষয়কুমার। তখন সেটা 1886 সাল।

   ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর সঙ্গে যোগাযোগের সুফল পেয়েছিলেন অক্ষয়কুমার। তাঁর হাত ধরেই 1839 এ তত্ত্ববোধিনীসভায় প্রবেশ করেন তিনি। ঐ বছরের পঁচিশে ডিসেম্বর তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্য হন অক্ষয়কুমার। 1840 সালের 13 জুন তত্ত্ববোধিনী সভার উদ্যোগে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা প্রতিষ্ঠা হলে সে পাঠশালার বর্ণমালা, ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন অক্ষয়কুমার। শিবনাথ শাস্ত্রী History of the Brahmo Samaj' বইতে লিখেছেন -- "A Theological College, called Tattwabodhini Pathshala was started to train up a number of young men in the princile of new faith. A youthful and enthusiastic scholar and writer, named Akshay Kumar Dutta, was appointed a teacher of this institution. He took an important part in moulding the theology of the Samaj."  এই স্কুল স্হাপনের পেছনে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মিশনারি বিদ্যালয়গুলোর বাড়বাড়ন্ত বন্ধ করা। কিশোর ছাত্রদের মনে খ্রিষ্টধর্মর বীজ বপন হচ্ছিল। প্রসঙ্গত অক্ষয়কুমারের খগোল যন্ত্রপ্রীতি বা দূরবীক্ষণ যন্ত্রর প্রতি ভালোবাসা ছিল সর্বজনবিদিত। অন্ধকার রাতে বাড়ির ছাতে তিনি তাঁর প্রিয় খগোল যন্ত্রটি নিয়ে মহাকাশ নিরীক্ষণ করতেন। এর পরের বছর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হলে পত্রিকা সম্পাদনার ভার মহর্ষি তুলে দেন অক্ষয়কুমারের হাতে। মহর্ষি রীতিমতো পরীক্ষা করে তাঁকে বেছে নিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন - "পত্রিকার একজন সম্পাদক নিয়োগ আবশ্যক। সভ্যদিগের মধ্যে অনেকেরই রচনা পরীক্ষা করিলাম। কিন্তু অক্ষয়কুমার দত্তের রচনা দেখিয়া তাঁকে মনোনীত করিলাম। তাঁহার এই রচনাতে গুণ ও দোষ দুইই প্রত্যক্ষ করিয়াছিলাম। গুণের কথা এই যে তাঁহার রচনা অতিশয় হৃদয়গ্রাহী ও মধুর। আর দোষ এই যে, ইহাতে তিনি জটা-জূট-মণ্ডিত ভস্মাচ্ছাদিত-দেহ তরুতলবাসী সন্ন্যাসীর প্রশংসা করিয়াছিলেন। এই চিহ্নধারী বহিঃপ্রকাশ আমার মতবিরুদ্ধ। আমি মনে করিলাম, যদি মতামতের জন্য নিজে সতর্ক থাকি, তাহা হইলে ইঁহার দ্বারা অবশ্যই পত্রিকা সম্পাদন করিতে পারিব। ফলতঃ তাহাই হইল। আমি অধিক বেতন দিয়া ঐ কার্য্যে অক্ষয়বাবুকে নিযুক্ত করিলাম।" 

  মুক্তচিন্তাধারার অধিকারী অক্ষয়কুমারকে নিয়ে চলতে মহর্ষির একটু অসুবিধাই হচ্ছিল। তাই মহর্ষি লিখেছেন-- "আমি কোথায় আর তিনি কোথায়! আমি খুঁজিতেছি, ঈশ্বরের সহিত আমার কি সম্বন্ধ, আর তিনি খুঁজিতেছেন, বাহ্য বস্তুর সঙ্গে মানবপ্রকৃতির কী সম্বন্ধ। আকাশ পাতাল প্রভেদ।" অক্ষয়কুমার দত্তের চেষ্টায় এই পত্রিকায় ধর্ম ছাড়াও সাহিত্য, বিজ্ঞান, পুরাতত্ত্ব ইত্যাদি নিয়ে লেখা প্রকাশিত হত। এশিয়াটিক সোসাইটিরত মহর্ষি এক পেপার কমিটি করে দিয়েছিলেন যার কাজ ছিল লেখাপত্র মনোনীত করা। পাঁচ জন সভ্য ছিলেন এই কমিটিতে। তাঁদের অন্যতম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, মহর্ষি স্বয়ং, প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী, আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ প্রমুখ। পরে অক্ষয়কুমার এই কমিটির অন্তর্ভুক্ত হন। প্রায় বারো বছর এই পত্রিকার সম্পাদনা করে তত্ত্ববোধিনীকে বাংলা সাহিত্যে একটা বিশিষ্ট স্হান করে দেন। প্রায় সাতশ জন গ্রাহক ছিল সে সময়।
  রাজনারায়ণ বসু লিখেছেন-- "অনেকে অবগত নহেন যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট অক্ষয়কুমার দত্ত কত উপকৃত আছেন।তাঁহারা তাঁহার লেখা প্রথম প্রথম বিস্তর সংশোধন করিয়া দিতেন।" তবে যদি খুব কাছ থেকে নিরীক্ষণ করা যায় তবে দেখা যায় অক্ষয় দত্তর গদ্যর সঙ্গে মহর্ষির গদ্যর অনেক মিল। আবার দেবেন্দ্রনাথের বেদান্তের ঈশ্বরপ্রত্যাদিষ্ট ব্যাখ্যা বর্জনের পিছনে অক্ষয়কুমারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অক্ষয়কুমারের ভাবনাচিন্তায় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। আর মহর্ষির ভাবনায় বিজ্ঞানের স্হান ছিল গৌণ। একবার হিন্দু হোস্টেলের একদল ছাত্র অক্ষয়কুমারকে প্রার্থনার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন করেন। অক্ষয়কুমার তাঁদের প্রশ্ন করেন --' কৃষক পরিশ্রম করে কী পায়?' তারা বলে-'শস্য'। এরপর তিনি বলেন--' পরিশ্রমের সঙ্গে তারা যদি প্রার্থনাও করে তবে কী পাবে?' উত্তর আসে --' শস্য'। তখন অক্ষয়কুমার বলেন ' তাহলে প্রার্থনার মূল্য শূন্য।' বীজগণিতের প্রণালী দিয়ে দেখালেন--

        পরিশ্রম = শস্য
   পরিশ্রম+ প্রার্থনা = শস্য
  সুতরাং, প্রার্থনা = 0 (শূন্য) 

  তিনি বলতেন বিজ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞানের আধার। তত্ত্ববোধিনীর সম্পাদক থাকাকালীন তিনি নিয়মিত মেডিক্যাল কলেজে বহিরাগত ছাত্র হিসেবে বিজ্ঞানের ক্লাস করতেন।

  অক্ষয়কুমার প্রথমজীবনে ব্রাহ্ম হলেও পরবর্তী কালে তাঁর ধর্মমত পরিবর্তিত হয়। তিনি ভারতবর্ষে বেকনের আদর্শ প্রথম প্রচার করেন। তাঁর ব্রহ্মের থেকে ব্রহ্মান্ড সম্পর্কে কৌতূহল বেশি। সাংখ্য বেদান্ত কেন মিথ্যে, কেন প্রাচীন ভারতীয় দর্শন নিয়ে আমাদের ধ্যানধারণাগুলি ত্রুটিপূর্ণ এসবের ওপর তিনি টীকা লেখেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তিনি প্রবন্ধ ছাপতেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়। 1842 সালে টাকীর প্রসন্নকুমার ঘোষের সহযোগিতায় অক্ষয়কুমার 'বিদ্যাদর্শন' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ছমাস চলেছিল পত্রিকাটি। প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ প্রথম 'বিদ্যাদর্শন' এ প্রকাশিত হয়।

       ব্যক্তিগত জীবনে সুখী ছিলেন না অক্ষয়কুমার। বিয়েতে সুখ পাননি তিনি। 'বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার' বইতে তিনি লিখেছিলেন-----

1. বিবাহের আগে স্বামী -স্ত্রী পরস্পরের সঙ্গে আলাপ করে নেবে।

2. সাবালক না হলে বিয়ে করা যাবে না।

3. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের ফারাক যেন না থাকে।

4. নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে ঠিক না।

5. বহুবিবাহ পাপ। বিধবাবিবাহ নীতিসঙ্গত।

6. বিবাহবিচ্ছেদকে সমাজে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।

..........ইত্যাদি.......ইত্যাদি।

অক্ষয়কুমার লেখেন ----
"পরস্পর বিরুদ্ধ-স্বভাব, অসম-বুদ্ধি ও বিপরীত-মতাবলম্বী স্ত্রী-পুরুষের পাণিগ্রহন হইলে, উভয়কেই যাবজ্জীবন বিষম যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।"

  প্রগতিশীল মহলে আলোড়ন পড়েছিল তখন। 1854 সালের 15 ডিসেম্বর কাশীপুরে 'সমাজোন্নতিবিধায়িনী সুহৃদসমিতি'র সূচনা হয়। অক্ষয়কুমার দত্তর পৃষ্ঠপোষকতায় এই সভায় স্ত্রীশিক্ষার প্রবর্তন, বিধবাবিবাহ, বহুবিবাহ রদ, বাল্যবিবাহ বর্জনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

     দুরারোগ্য শিরঃপীড়ায় জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তাঁর। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে, চিকিৎসা করেও কিছু লাভ হয়নি। জীবনের শেষ দশ বছর বালিতে (হাওড়া জেলা) দেওয়ানগাজী অঞ্চলে 'শোভনোদ্যান ' নামক নিজের বাড়িতে কালযাপন করেন। এক বিঘা জমির ওপর এক সুন্দর বাগান ছিল বাড়িতে। মাথা ব্যথা অসহ্য হলে তিনি বাগানে বেড়াতেন। অনেক দুর্লভ গাছ ছিল বাগানে। বাড়িতে একটা ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা করতে চেয়েছিলেন। তিনি যেখানে বসতেন তার চারিদিকে বিভিন্ন শামুক, জীবকঙ্কাল, বিরল সামুদ্রিক প্রাণীর খোলস সাজানো থাকত।  তাঁর পড়ার ঘরে পাঁচটি ছবি ছিল --- রামমোহন রায়, আইজ্যাক নিউটন, চার্লস ডারউইন, টি এইচ হাক্সলি ও জন স্টুয়ার্ট মিলের। খুব কষ্ট পেয়েছেন শেষ জীবনে। তাঁর অসুখকে হিন্দু পেট্রিয়ট 'জাতীয় বিপর্যয়' হিসেবে ঘোষণা করেছিল। 1886 সালের 28 মে তিনি পরলোকগমন করেন। তখন 'সোমপ্রকাশ' পত্রিকা লেখেন --"বঙ্গবাসী মাত্রই তাঁহার শোকে ম্রিয়মান।"

  ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনের (১৫৬১-১৬২৬) চিন্তাধারা আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জন্ম দিয়েছিল। তাঁকে দর্শনে এম্পিরিসিজম বা অভিজ্ঞতাবাদের জনক বলা হয়। অভিজ্ঞতাবাদ অনুযায়ী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞানলাভ সম্ভব, এবং জ্ঞানের একমাত্র বা প্রাথমিক উৎস হল অভিজ্ঞতা। বেকন মনে করতেন যে প্রকৃতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ ও আরোহী যুক্তির প্রয়োগই হল বিজ্ঞানের নিয়ম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র পথ। এর সঙ্গে তিনি জোর দিয়েছিলেন পরীক্ষা করে সেই সিদ্ধান্তের সত্যতা যাচাইয়ের উপর। বিজ্ঞানীকে সবসময়েই নিজের সিদ্ধান্ত সম্পর্কেও সন্দিহান থাকতে হবে। অভিজ্ঞতাবাদ ও আরোহী যুক্তির সম্মিলনই ইউরোপে মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান ধ্যানধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের নবজন্ম ঘটিয়েছিল। বেকনের মতে বিজ্ঞানের লক্ষ্য হল মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি। আমাদের দেশে বেকনের প্রথম অনুসারী রামমোহন রায়, পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থনে ১৮২৩ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে লেখা রামমোহনের সেই বিখ্যাত চিঠিতে তিনি বারবার বেকনের মতকেই নিজের সমর্থনে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তিনি বেকনের পাশাপাশি বেদান্তের চর্চাও চেয়েছিলেন, স্পষ্টতই তা স্ববিরোধী। বেদান্তের ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’, এই উক্তির সঙ্গে অভিজ্ঞতাবাদকে মেলানো সম্ভব নয়। আধুনিক বিজ্ঞানের ভগীরথ বেকনের আমাদের দেশে প্রথম সার্থক শিষ্য তাহলে কে?

  এই বছর আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষ পালন করেছি। সমাজ সংস্কার, নারী শিক্ষার প্রসার, আধুনিক শিক্ষাচিন্তা – নানা দিক দিয়ে বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর সমবয়সী ও ঘনিষ্ঠ একজনের কথা আমরা প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। এ বছর তাঁরও জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে, তিনি অক্ষয়কুমার দত্ত। বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান রচনাতে তিনি পথিকৃৎ, সেই কথা যদিও বা মনে রেখে থাকি, আমরা ভুলতে বসেছি তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা ও দর্শনচিন্তার কথা। এই দুই ক্ষেত্রে অক্ষয়কুমারের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দিয়েছিল বেকনের দর্শন। বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দু’জনেই বেকনের অভিজ্ঞতাবাদের অনুসারী ছিলেন। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে তা জানতে পারি বারাণসীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ব্যালান্টাইনের নির্ধারিত সংস্কৃত কলেজের পাঠক্রম বিষয়ে তাঁর চিঠি ও রিপোর্টে, কিন্তু সেই সময় তা প্রকাশ্যে আসেনি।  বিদ্যাসাগর এ বিষয়ে তাঁর মত আলোচনাতে উৎসাহী ছিলেন না, তাঁর সেই সময়ও ছিল না। যিনি প্রথম আমাদের দেশে অভিজ্ঞতাবাদকে আত্মস্থ করে তার ধ্বজা প্রকাশ্যে তুলে ধরেছিলেন তিনি অক্ষয়কুমার দত্ত।

  বাংলা ভাষার বিজ্ঞান সাহিত্যের সূচনা করেছিলেন অক্ষয়কুমার। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে ‘ভূগোল’ (প্রকাশকাল ১৮৪১), ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ (প্রথম ভাগ, ১৮৫১; দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫৩) ‘চারুপাঠ’ (প্রথম ভাগ ১৮৫৩; দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫৪; তৃতীয় ভাগ ১৮৫৯), ‘পদার্থবিদ্যা’ (১৮৫৬), ধর্মনীতি (১৮৫৬), ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ (প্রথম ভাগ ১৮৭০; দ্বিতীয় ভাগ ১৮৮৩) প্রভৃতি। প্রথম দিকের বইগুলি মূলত অনুবাদ ও সংকলন। অনুবাদ বলে তাদের তুচ্ছ করার কোনো কারণ নেই, বিজ্ঞানের সিঁড়িতে পা রাখার ক্ষেত্রে অনুবাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্য যুগে আরব সভ্যতাতে বিজ্ঞানের চোখ-ধাঁধানো বিকাশের সূচনা হয়েছিল গ্রিক ও সংস্কৃত থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা অনুবাদের মাধ্যমে।

   পরবর্তীকালে আবার আরবি থেকে লাতিন ভাষায় অনুবাদ ইউরোপের বিজ্ঞানে জোয়ার আনে।  অক্ষয়কুমারের অনুবাদ কিন্তু শুধুমাত্র ভাষান্তর নয়, তাতে যথেষ্ট মৌলিক চিন্তাভাবনার ছাপ আছে। বাংলাতে বিজ্ঞান রচনার জন্য একই সঙ্গে তাঁকে সৃষ্টি করতে হয়েছিল পরিভাষার। এক কথায় বলতে গেলে বাংলাতে বিজ্ঞান লেখার গদ্যরীতিই তাঁকে গড়ে নিতে হয়েছিল।

  একটি প্রবন্ধে অক্ষয়কুমারের কর্মজীবনের সমস্ত দিকের প্রতি সুবিচার করা অসম্ভব। আগেই বলেছি, বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে অক্ষয়কুমারের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। যখন ভারতীয়রা বিদেশী শাসনের গুণগানে ব্যস্ত সেই সময় তিনি সরাসরি বিদেশী শাসনকে দেশবাসীর দুরবস্থার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। নীলকরদের অত্যাচার ও চিরস্থায়ী ব্যবস্থাতে সৃষ্ট জমিদারদের প্রজাশোষণ সম্পর্কে সমালোচনা করতে তিনি পরাঙ্মুখ ছিলেন না। শেষ বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ জমিদার দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে অক্ষয়কুমারের বিবাদে সরাসরি না এলেও নিশ্চয় তার ছায়া পড়েছিল। ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ রচনা করতে গিয়ে তিনি তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জাতিপ্রথা মানেন নি। পঞ্জিকাতে যে সময়কে অশুভ বলা হত, কুসংস্কার বিরোধী অক্ষয়কুমার সেই সময়কেই যাত্রা শুরুর জন্য বেছে নিতেন। কোনো পুজোর দিনে অন্যরা যখন স্নানের উদ্দেশ্যে গঙ্গার দিকে চলেছে, তখন গঙ্গানদীর পাশে বাড়ি থাকা সত্ত্বেও অক্ষয়কুমার সবাইকে দেখিয়ে পুকুরে চান করতেন। অক্ষয়কুমারের বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরোধিতা, বিধবা বিবাহের প্রতি সমর্থন তাঁকে সেই যুগে সংস্কার আন্দোলনের সামনের সারিতে স্থান করে দেয়। বিবাহিত জীবনে স্বামী ও স্ত্রীর সমানাধিকারের প্রতি তাঁর সমর্থন এক স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে এমনই সমর্থন পেয়েছিল যে অভিভাবকরা স্কুলটাই পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এই ক্ষুদ্র লেখাতে আমরা শুধু অক্ষয়কুমারের বেকন অনুরাগের প্রতিই দৃষ্টি রাখব।

  অক্ষয়কুমারকে আকর্ষণ করেছিল বিজ্ঞান, তা পড়তে গিয়ে তাঁর পরিচয় হয় বেকনের অভিজ্ঞতাবাদের সঙ্গে। অভিজ্ঞতাবাদই সেই যুগে সবচেয়ে আধুনিক ও সার্থক বিজ্ঞানদর্শন। প্রথম জীবনে স্কটল্যান্ডের চিন্তাবিদ জর্জ কুম্বের মতের দ্বারা অক্ষয়কুমার প্রথম দিকে বিশেষ প্রভাবিত ছিলেন, তাঁর ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ হল কুম্বের ‘Constitution of Man in Relation to External Objects’ বইটির ভাবানুবাদ। ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ প্রকাশের পরে পরেই তিনি তা পড়েছিলেন। হয়তো অক্ষয়কুমারই আমাদের দেশে প্রথম ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের বৈপ্লবিক তাৎপর্য বুঝতে পেরেছিলেন। ডারউইন ছিলেন স্বঘোষিত ভাবেই বেকনের অনুগামী। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও তার থেকে সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ আধুনিক পাঠককেও চমকে দেয়।  ডারউইনের মত প্রচারে জীববিদ টমাস হাক্সলির অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। অর্থনীতিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল বেকনের আরোহী যুক্তিবাদকে আরও শাণিত করেছিলেন। আইজ্যাক নিউটনের চিন্তাধারার উপর বেকনের প্রভাব স্পষ্ট। নিউটনের একটি বিখ্যাত উক্তি, “Hypothesis non fingo”, আমি কোনো রকম পূর্বানুমান করি না। আগে থেকে কোনো ধারণা না করে পরীক্ষার মাধ্যমে যা পাওয়া যায়, তাই মেনে নেওয়ার এই চিন্তা বেকন দর্শনেরই অনুরূপ। রামমোহন যে বিখ্যাত চিঠিতে সুস্পষ্টভাবে বেকনের দর্শনকেই ব্রিটেন তথা ইউরোপের উন্নতির কারণ হিসাবে বর্ণনা করেছেন, তা অক্ষয়কুমার তাঁর বইতে উদ্ধৃত করেছিলেন। নিজের বাড়িতে রামমোহন, নিউটন, ডারউইন, টমাস হাক্সলি  ও জন স্টুয়ার্ট মিলের ছবি টানিয়ে অক্ষয়কুমার তাকে দেবালয় আখ্যা দিয়েছিলেন। লক্ষণীয় যে এই পাঁচজনই বেকনের দর্শনের অনুসারী। বেকনই হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর আরাধ্য। অনেকের মতে জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি হয়ে পড়েছিলেন অজ্ঞেয়বাদী, তিনি মনে করতেন ঈশ্বর থাকা বা না থাকার কোনো প্রমাণ নেই, যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যাবে না।

  অক্ষয়কুমারের পূর্বোক্ত প্রার্থনা-ইকুয়েশন একসময় কলকাতায় ঝড় তুলেছিল।বেকনীয় অভিজ্ঞতাবাদের ছাপ এখানেও স্পষ্ট। আধুনিক যুগের দৃষ্টিতে এই যুক্তির মধ্যে যে ফাঁকি ধরা পড়বে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু উনিশ শতকের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে এই যুক্তিবিন্যাস কলকাতার শিক্ষিত মহলে আলোড়ন তুলেছিল। অক্ষয়কুমার কিন্তু তাতে খুশি হননি, বলেছিলেন, “বিশুদ্ধবুদ্ধি বিজ্ঞানবিৎ লোকের পক্ষে যাহা অতি বোধ-সুলভ, তাহা এদেশীয় লোকদের নূতন বোধ হইল এটি বড় দুঃখের বিষয়।” অর্থাৎ বিজ্ঞান দর্শনের প্রাথমিক পাঠই ভারতবর্ষে প্রসারিত হয়নি।

  দেবেন্দ্রনাথের স্থাপিত তত্ত্ববোধিনী সভার সঙ্গে অব্রাহ্মরাও যুক্ত হয়েছিলেন, বিদ্যাসাগরের নাম তাঁদের মধ্যে স্মরণীয়। অক্ষয়কুমার কিন্তু ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, দেবেন্দ্রনাথ সহ প্রথম একুশ জন ব্রাহ্মের মধ্যে তিনিও একজন। সাধারণে চলিত হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতাতে তিনি আগেই বিশ্বাস হারিয়েছিলেন, কারণ বিশ্বইতিহাস পাঠ তাঁকে দেখিয়েছিল যে গ্রিক বা রোমান সভ্যতার যুগে ইউরোপের প্রচলিত ধর্মের দেবদেবীদের স্থান রয়েছে শুধু বইয়ের পাতায়। ব্রাহ্মধর্মের একেশ্বরবাদ তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল।
      
  ব্রাহ্মধর্মের দর্শন নির্ধারণে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। হিন্দুধর্মের বিশ্বাস বেদ অপৌরুষেয় অর্থাৎ মানুষের সৃষ্টি নয়, ঈশ্বরপ্রণীত; তাই তা অভ্রান্ত। প্রথম প্রথম দেবেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য  ব্রাহ্মরাও তাই বিশ্বাস করতেন। অক্ষয়কুমার বেদ ও বেদান্তের অভ্রান্ততা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। ধর্মগ্রন্থ যে যুক্তিনিরপেক্ষ বিশ্বাসের কথা বলে, তাঁর বেকনীয় দর্শনের সঙ্গে তা একেবারেই মেলে না। তাঁর যুক্তির যথার্থতা মেনে দেবেন্দ্রনাথ বেদবেদান্তের অভ্রান্ততার ধারণা পরিত্যাগ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সাধে কি আর তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘বেকন পড়িয়া করে বেদের সিদ্ধান্ত’? অনেক পরে ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইতে অক্ষয়কুমার লিখেছেন, ‘বেদের যে অংশ যে ব্যক্তির কৃত স্পষ্টই লিখিত আছে, এবং তন্মধ্যে নানা স্থানে ও নানা কালে বিদ্যমান লোকসমূহের ভক্তি শ্রদ্ধা, রাগ দ্বেষ, কাম ক্রোধ, বিপদ আপদ, যুদ্ধ বিবাদ, ব্যসন বাণিজ্য ইত্যাদি অশেষ প্রকার ব্যাপারের বিবিধ বৃত্তান্ত বিনিবেশিত রহিয়াছে, তথাপি জৈমিনি মহাশয়ের মত-প্রভাবে তাহা অপৌরুষেয়, ... এইরূপ অঙ্গীকার করিতে হইবে।’
       
  অক্ষয়কুমার কালক্রমে বুঝেছিলেন যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ধর্মের সত্যাসত্য নির্ণয় বাঙালি ভদ্রলোকের কাছে খুব গ্রহণযোগ্য হবে না। নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে তা আরও পরিষ্কার হয়। ভবানীপুর  ব্রাহ্মসমাজের এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘ভাস্কর ও আর্য্যভট্ট এবং নিউটন্‌ ও লাপ্লাস্‌ যে কিছু যথার্থ বিষয় উদ্‌ভাবন করিয়াছেন, তাহাও আমাদের শাস্ত্র। গৌতম ও কণাদ এবং বেকন ও কোন্ত্‌ যে-কোন প্রকৃত তত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন, তাহাও আমাদের শাস্ত্র।‘ লাপ্লাস ও কোঁত ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না, খোদ সম্পাদকের বক্তৃতাটি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে ছাপার সময় সেই দুটি নাম তাঁর অজ্ঞাতসারেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।এই রকম নানান প্রভেদের জন্য অক্ষয়কুমারকে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয়েছিল।

  আধুনিক মনে প্রশ্ন জাগে, ধর্মের সত্যতা বিচারে বৈজ্ঞানিক যুক্তির প্রয়োগ কি সম্ভব? অক্ষয়কুমারের অবস্থান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। বেদবেদান্তের অভ্রান্ততা বিষয়ে তাঁর মত আগেই আলোচনা করেছি। এও দেখেছি যে প্রার্থনার সাহায্যে কোনো বাস্তব ফল পাওয়া যায় বলে তিনি বিশ্বাস করতেন না। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার পাতাতে তিনি যে বিজ্ঞানের প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেছিলেন, তার মূল লক্ষ্য ছিল প্রকৃতির নিয়ম জানা। প্রকৃতি নিয়ম মেনে চলে, এবং সেই নিয়ম একজন নিয়মস্রষ্টা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ, অক্ষয়কুমারের এই অবস্থানকে বলা যায় ডীইস্‌ম। জর্জ কুম্বও ছিলেন ডীইস্ট।  ডীইস্টরা ধর্মগ্রন্থের আপ্তবাক্যে বিশ্বাস করেন না, তাঁরা যুক্তি ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জগৎস্রষ্টা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চান। তাই অক্ষয়কুমারের শাস্ত্রকারদের মধ্যে আর্যভট্ট, নিউটন, লাপ্লাসদের স্থান পাওয়া মোটেই আকস্মিক নয়। যুক্তি ও পর্যবেক্ষণ – বেকনীয়  দর্শনের এই দুই মূল স্তম্ভের সঙ্গে ডীইস্‌মের উপর উপর মিল খুঁজে পেয়েছিলেন অক্ষয়কুমার। কিন্তু সম্ভবত তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

  এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে হয় একটি বিখ্যাত উক্তি, ‘ডীইস্ট হল সেই যে নাস্তিক হয়ে ওঠার আগেই মারা গেছে।’ অক্ষয়কুমার নাস্তিক না হলেও সম্ভবত অজ্ঞেয়বাদী হওয়া পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। ডারউইনের আগে বিশ্বাসীরা ঈশ্বরের সমর্থনে যে যুক্তি দেখাতেন, তাকে বলা যায় Intelligent design-এর যুক্তি। সেই অনুসারে প্রতিটি জীব তার পরিবেশের সঙ্গে এমন ভাবে খাপ খেয়ে যায় যে কোনো বুদ্ধিমান স্রষ্টা ছাড়া তা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে ডীইস্‌মের মিল খুব স্পষ্ট। অক্ষয়কুমারও লিখেছেন, ‘জীবের শরীর অতি আশ্চর্য্য শিল্প-কার্য্য। তাহার প্রত্যেক অঙ্গ পরাৎপর পরম শিল্পকরের নিরুপম নৈপুণ্য-পক্ষে নিরন্তর সাক্ষ্যদান করিতেছে।’  ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব সেই যুক্তিকে নস্যাৎ করে দেয়। বিবর্তনতত্ত্বের পাঠ অক্ষয়কুমারকেও নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করেছিল। অক্ষয়কুমার আগে লিখেছিলেন, ‘যে পক্ষী যেরূপ দ্রব্য আহার করে জগদীশ্বর তাহার চঞ্চু তদুপযোগী করিয়া দিয়াছেন।‘ ফিঞ্চ পাখির ঠোঁট সম্পর্কে ডারউইনের বিখ্যাত আলোচনা পড়ে অক্ষয়কুমার নিশ্চয় বুঝেছিলেন যে তাঁর যুক্তি ঘোড়ার আগে গাড়িকে জুড়ছে, প্রকৃতপক্ষে পাখির খাদ্যাভ্যাসই তার চঞ্চুর গঠন নির্ধারণ করেছে। সুগভীর ঈশ্বরবিশ্বাসী ডারউইন তাঁর নিজের তত্ত্বের যুক্তি মেনে অজ্ঞেয়বাদের পথ ধরেছিলেন। অক্ষয়কুমার শেষ জীবনে নিজেকে আস্তিক বেকনের সঙ্গে সঙ্গে নাস্তিক অগুস্ত কোঁতেরও অনুগামী বলে ঘোষণা করেছিলেন। তবে এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে শেষ বয়সে অক্ষয়কুমারর অজ্ঞেয়বাদী হয়ে গিয়েছিলেন, সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সবাই একমত নন। অক্ষয়কুমার নিজে সে বিষয়ে তাঁর জীবনীকার মহেন্দ্রনাথ রায়ের প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেননি।  

  অক্ষয়কুমারের অক্ষয় কীর্তি ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’। এই বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়াও সীমিত পরিসরের মধ্যে সম্ভব নয়। এটি তাঁর পুরোপুরি মৌলিক রচনা। ভারতের দুই খণ্ডে বিভক্ত বইয়ের দুটি দীর্ঘ উপক্রমণিকা আছে, যেখানে তিনি বেকনের পদ্ধতির প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন যে ভারতীয় ষড়দর্শনের অনেকাংশই নিরীশ্বরবাদী। কেন আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম ভারতে হল না তিনি আলোচনা করেছেন। দীর্ঘ আলোচনা না করে বেকনের নামোল্লেখ আছে এমন কয়েকটি অংশ উদ্ধৃত করি।

  সাংখ্য দর্শন আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘সাঙ্খ্য-শাস্ত্রের কোন কোন অংশে সমধিক বুদ্ধির প্রাখর্য্য প্রদর্শিত হইয়াছে তাহার সন্দেহ নাই। কিন্তু এ অংশটি নিতান্ত মনঃকম্পিত এখন একথা বলা বাহুল্য। যে সময়ে, ভূমণ্ডলে বিজ্ঞান-রাজ্যের পথ-প্রদর্শক বেকন্‌ ও কোন্তের জন্ম হয় নাই, সে সময়ে আর অধিক প্রত্যাশা করাই বা কেন?’ অর্থাৎ তিনি পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা ছাড়া শুধুমাত্র চিন্তার মাধ্যমে সত্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনাকে অস্বীকার করছেন।

     কণাদ প্রবর্তিত বৈশেষিক দর্শনে পরমাণুর কথা আছে। সে সম্পর্কে সমধিক শ্রদ্ধা সত্ত্বেও তাঁর আক্ষেপ, ‘... সূত্রপাতেই অবশেষ হইল। অঙ্কুর রোপিত হইল, কিন্তু বর্ধিত, পুষ্পিত ও ফলিত হইল না। উহা সংস্কৃত, পরিবর্দ্ধিত ও বহুলীকৃত করিয়া ফল-পুষ্প-শোভায় সুশোভিত করা ভারতভূমির ভাগ্যে ঘটিল না। কালক্রমে সে সৌভাগ্য বেকন্‌, কোন্ত্‌ ও হম্বোল্‌টের জন্মভূমিতে গিয়া প্রকাশিত ও প্রাদুর্ভূত হইয়া উঠিল। তথাপি আমাদের সুশ্রুত, চরক, আর্য্যভট্টাদির পদ-কমলে বার বার নমস্কার!’

     পরে তিনি লিখেছেন, "... দার্শনিক গ্রন্থকারের অনেকেই সতেজ বুদ্ধির সুপুষ্ট বীজ লইয়া জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। যদি তত্ত্বানুসন্ধানের প্রকৃত পথাবলম্বন পূর্ব্বক বিশুদ্ধ বিজ্ঞান-মার্গে বিচরণ করিতে পারিতেন, তবে বহুকাল পূর্বে ভারত-ভূমিও ইয়ুরোপ-ভূমির ন্যায় এ অংশে ভূ-স্বর্গ-পদে অধিরূঢ় হইতেন তাহার সন্দেহ নাই। তাঁহারা বিশ্বের যথার্থ প্রকৃতি ও সেই প্রকৃতি-সিদ্ধ নিয়মাবলী নির্দ্ধারণ পূর্ব্বক কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য-নিরূপণের নিশ্চিত উপায় চেষ্টা না করিয়া কেবল আপনাদের  অনুধ্যান-বলে দুই একটি প্রকৃত মতের সহিত অনেকগুলি মনঃকল্পিত মত উদ্ভাবন করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের একটি পথ প্রদর্শকের অভাব ছিল। একটি বেকন্‌ – একটি বেকন্‌ – একটি বেকন্‌ তাঁহাদের আবশ্যক হইয়াছিল।"  স্পষ্টতই অক্ষয়কুমার অভিমত প্রকাশ করছেন যে প্রকৃত বিজ্ঞান দর্শনের অভাবেই ভারতে বিজ্ঞানের বিকাশ হতে পারেনি।

  অপ্রাসঙ্গিক হলেও অক্ষয়কুমারের একটি উদ্ধৃতি তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। বেকনের প্রয়োজনের কথা বলে তিনি লিখছেন যে সুসজ্জিত সৈন্যদলও দক্ষ সেনাপতির অভাবে ব্যর্থ হয়। ‘একটি রণজিৎ - একটি বোনাপার্ত্‌ – একটি ওয়াশিংটন্‌ আবশ্যক।’ যে তিনজন সেনাপতির নাম করেছেন, একজনও ইংরেজ ছিলেন না; নেপোলিয়ন ও ওয়াশিংটন তো ব্রিটেনের বিরুদ্ধেই লড়াই করেছেন। 

  প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের মধ্যে নিরীশ্বরবাদের প্রভাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন অক্ষয় কুমার। তিনি কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন যে ঈশ্বরকে অস্বীকার করলেও বেদের অভ্রান্ততাকে বিষয়ে অধিকাংশ দর্শন একমত। বেদের অভ্রান্ততা বিষয়ে তাঁর মত আমরা আগে দেখেছি। নিরীশ্বরবাদী সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক কপিল সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘চিরকাল হিন্দু-সমাজে বেদের কি অতুল প্রভাব ও দুর্জ্জয় পরাক্রমই চলিয়া আসিয়াছে। কপিল ঈশ্বরের  অস্তিত্ব অক্লেশে অস্বীকার করিলেন, কিন্তু বেদের মহিমা অগ্রাহ্য করিতে পারিলেন না। তিনিও বেদার্থ প্রামাণিক বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছেন।’ পরবর্তীকালে টীকাকাররা বৈশেষিক দর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সাক্ষ্য খোঁজার চেষ্টা করেছেন, সে বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘কণাদ ঋষির সেইরূপ বিশ্বাস থাকিলে, সূত্রের মধ্যে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ সুস্পষ্ট না লিখিয়া তাহার অন্তর্গত শব্দ-বিশেষের অভ্যন্তর-গুহায় তাহা প্রচ্ছন্ন রাখা কি কোনরূপে সম্ভব হয়?’ সবশেষে তাঁর সিদ্ধান্ত, "প্রথমে কিছু ছিল না, কেবল একমাত্র অদ্বিতীয় পরমেশ্বরই বিদ্যমান ছিলেন, তিনিই পশ্চাৎ সমুদয় জগৎ সৃজন করেন, যাঁহারা কেবল ইহাকেই আস্তিকতাবাদ বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন, তাঁহাদের মতে প্রায় সমুদয় ষড়্‌দর্শনকে নাস্তিকতা প্রতিপাদক বলিয়া উল্লেখ করিতে হয়। "

  বেকনের দর্শন বিষয়ে পরবর্তীকালে নানা সমালোচনা হয়েছে, তার অধিকাংশই অবশ্য অক্ষয়কুমারের অনেক পরে। সেই সমালোচনা ঠিক না ভুল তা নিয়েও বিতর্ক আছে। এই লেখাতে তার মধ্যে যাওয়ার অবকাশ নেই। বিদ্যাসাগর জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশনের কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্তদর্শন, সে সম্বন্ধে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই। তবে ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে। সংস্কৃতে যখন এইগুলি পড়াতেই হবে তখন তার প্রতিষেধক হিসেবে ছাত্রদের ভাল ভাল ইংরেজি দর্শনশাস্ত্রের বই পড়ানো দরকার।’ (অনুবাদ সূত্র, বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ) এর বেশি লেখার তিনি প্রয়োজন বোধ করেন নি। অক্ষয়কুমার কোথায় ভারতীয় দর্শন কানাগলিতে ঢুকে পড়েছে বা উদ্দেশ্যহীন তর্কে সময় নষ্ট করেছে তার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এবং এই কাজে তাঁর সহায় হয়েছেন বেকন।

  আমাদের দেশে আধুনিক বিজ্ঞানদর্শনের প্রয়োজনীয়তা প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন অক্ষয়কুমার, তাঁকেই আমরা ভুলতে বসেছিলাম। আশার কথা দ্বিশতবর্ষে অক্ষয়কুমারকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।  

  তাঁকে বাঙালি খুব মনে রাখেনি। তাঁর মৃত্যু নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নিরুচ্চার থাকেন। অথচ  বলা হত --- "Akshaykumar is Indianising European Science." অক্ষয়কুমার দত্তর সুযোগ্য পৌত্র সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত 'হোমশিখা ' কাব্যগ্রন্থটি পিতামহকে উৎসর্গ করেন। তিনি এই বলে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন--

" হে আদর্শ জ্ঞানযোগী ! 
হে জিজ্ঞাসু তব জিজ্ঞাসায় , 
উদ্বোধিত চিত্ত মোর ; 
গরুড় সে জ্ঞান পিপাসায় ।"


তথ্যঋণ : 
1. অক্ষয়কুমার দত্ত : আঁধার রাতে একলা পথিক- আশীষ লাহিড়ী(2019), দ্বিতীয় সংস্করণ, দেজ পাবলিশিং
2. সেকালের কৃতী বাঙালি-- মন্মথনাথ ঘোষ(2020)
3. সাহিত্য সাধক চরিতমালা (প্রথম খণ্ড)- বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ(2016)
4. History of the Brahmo Samaj-- Shivnath Sastri(1993)
5. মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী
6. বাংলা গদ্যের পদাঙ্ক-- সম্পাদনা: প্রমথনাথ বিশী ও বিজিতকুমার দত্ত(1426)
7. উনিশ শতকের বাংলা সংবাদ ও সাময়িকপত্র- স্বপন বসু(2018)
8. রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, কামারের এক ঘা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ইন্সটিটিউট
9. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান.
10. ইন্টারনেট ও অন্যান্য। 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

 আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments

  1. বালির গর্ব অক্ষয় কুমার দত্ত সম্পর্কে অজানা অনেক তথ্য সাবলীল ভাষায় জানানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete