জ্বলদর্চি

যা খুশি ওরা বলে বলুক/ মিলি ঘোষ



 যা খুশি ওরা বলে বলুক

 মিলি ঘোষ

মাঠের শেষে বটগাছতলার বেদীতে ক'দিন ধরে এক সাধুবাবাকে দেখা যাচ্ছে। সকালবেলার তির্যক রোদ বেদীর ভাঙা অংশকে এমনভাবে আলোকিত করে, দেখে মনে হয় প্রস্তর যুগের কত অজানা কাহিনী ওই ফাটলগুলো দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। সাধুবাবা অবশ্য বসার জন্য তুলনামূলক ভালো জায়গাই বেছে নিয়েছেন। গ্রামের লোক প্রথমে ভেবেছিল সাধুবাবা মৌনী। বিকেলের দিকে মা-বউরা যখন একছড়া কলা বা গাছের চারটে পেয়ারা নিয়ে এসে সাধুবাবার পাশটায় সাবধানে রাখে, তিনি একবারের জন্যও চোখ খোলেন না। ভক্তরা তাঁকে স্পর্শ না করে মাটিতেই উবু হয়ে প্রণাম করে যায়। প্রায় এক মাস পর সাধুবাবা চোখ মেলে তাকালেন। সামনে যারা জোড় হাত করে দাঁড়িয়েছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে  বললেন, "আজ আমার মৌনব্রত সম্পূর্ণ হলো।"
  গ্রামের মহিলাদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখে হাত তুলে তাদের থামতে বললেন।
জীবনের বহু ছোট বড় না পাওয়া উজাড় করে দিতেই তো এখানে ছুটে আসা। নিজের স্বামীকে যা বলতে পারে না, তাই তারা সাধুবাবার কাছে প্রকাশ করতে চায়।
সাধুবাবা বললেন, "আমি সব শুনব। একে একে বলবে। বাকিরা মাঠের ওই ধারে গিয়ে বসে থাকো। একের কথা যেন অন্যের কানে না যায়।"

গ্রামেরই এক বউ মালতী একদিন বলেই ফেলল মেয়ে তপতীকে, "তোকে একটা কথা বলছি। মনটা বড় খারাপ। আজ একমাস ধরে আমি না, একটাই স্বপ্ন দেখছি, প্রায় প্রতি রাতেই।"
একই স্বপ্ন শুনে নড়েচড়ে বসে তপতী। জানতে চায়, "কী স্বপ্ন বলো তো?"
  "কেউ যেন না জানতে পারে।"
  "না, মা। বলব না আমি।"
তপতী ভয়ার্ত চোখে চারপাশটা দেখে নিয়ে বলল, "মুখে রুমাল বাঁধা একটা লোক একটা বাচ্চাকে গলা টিপে মারে। তারপর ব্যাগে ভরে অনেক রাতে কোথায় চলে যায়।"
🍂
ad

তপতী আঁতকে উঠে বলে, "আমিও তো।"
মালতী মেয়েকে বলে, "তুই কী দেখিস? বল।"
  "হাতে ব্যাগ নিয়ে মুখে রুমাল বাঁধা একটা লোক জঙ্গলে ঢোকে। ব্যাগ থেকে কাপড়ে জড়ানো একটা বাচ্চাকে বের করে ফেলে রেখে চলে যায়। মাঝেমাঝেই দেখি, জানো তো!" 
ঘরের মধ্যে গ্রীষ্মের নির্জন দুপুরের স্তব্ধতা। ভাবনাও দুজনের একই খাতে বইছে। এক দুঃস্বপ্নের প্রথম অংশ দেখে মা, বাকি অংশ মেয়ে! কী করে সম্ভব! সাধুবাবার মুখ মনে পড়ে দু'জনেরই। কিন্তু, বলা যে বারণ! মালতী ভাবে, সাধুবাবা বলেছিলেন জীবনে যত কঠিন স্বপ্ন দেখবে, বাস্তব তত সহজ হয়ে যাবে। তবে কি তিনি তপতীকেও....! আর কিছু ভাবতে চাইল না মালতী। মাথার মধ্যেটা যেন শ্যাওলা ধরা পুকুর। 
তপতী হঠাৎ নীরবতা ভেঙে জানতে চাইল, "আচ্ছা মা, তুমি স্বপ্নে যা দেখো, সাধুবাবা কি তোমাকে সেরকম কোনও ঘটনা বলেছিলেন? ভাবতে বলেছিলেন সারাদিন? ঘুমানোর আগেও শুধু ওটাই ভাবার কথা বলেছেন?"
মালতীর চোখ বিস্ফারিত, কন্ঠনালী রুদ্ধ। কোনরকমে ঘাড় নেড়ে শুধু হ্যাঁ বলল।
তপতী বলল, "বুঝতে পেরেছি। চলো মা, আজ বিকেলে বটগাছতলায় একবার যাই। তুমি কিছু বলতে যেও না। যা বলার আমি বলব।"

তপতী সাধুবাবার পাশে নিজেদের গাছের কিছু জামরুল আর পেয়ারা রেখে প্রণাম করল। মালতী মাঠের অন্য দিকে। সাধুবাবার মুখে স্মিত হাসি। 
কোনরকম ভূমিকা না করেই তপতী শুরু করল, "বাবা, আপনি আমাকে যে ঘটনাটা ভাবতে বলেছিলেন, সেটাই আমি প্রায়ই স্বপ্নে দেখি। আপনি কি এর আগের ঘটনাটা মাকেও ভাবতে বলেছিলেন?"
নিমেষের মধ্যে সাধুবাবার মুখের গড়ন বদলে গেল। কঠিন মুখমণ্ডলে রক্তবর্ণ চক্ষু কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে সে তিনিই জানেন।
  "মা বলেছে সে কথা?" প্রশ্ন নয়। আগ্নেয়গিরির লাভা বিচ্ছুরণ।
  "মা'র শরীর দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ঠিক মত খায়-দায় না। না পেরে বলে ফেলেছে।"
  "আর তুই?"
  "আমিও মা'র কথা শুনে ভয় পেয়ে বলে দিয়েছি।"
  "প্রথম প্রথম ওরকম হয়। ক'দিন পরেই ঠিক হয়ে যেত। জীবন তখন স্বর্গ।  এত করে বারণ করলাম! শুনলি না তো! এবার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে সংসারে। প্রাণহানীও ঘটতে পারে।" যেন আকাশ থেকে দৈববাণী নেমে এল।
  "প্রাণহানী! তাহলে?" 
  "উপায় আছে। তবে খরচাও আছে। মা'কে ডাক, বলছি।"
মালতী এসে প্রণাম করতেই সাধুবাবা বললেন, "যা ক্ষতি করার করে ফেলেছ। এর থেকে মুক্তি পাবার একটাই পথ খোলা আছে।"
সাধুবাবার কথা মতো দিনক্ষণ দেখে বটগাছতলাতেই যজ্ঞের আয়োজন হলো। মা মেয়ে দু'জনকে দুটো পাথর ধারণ করতে দেওয়া হলো। আর প্রতিদিন দুপুরের খাবারটা যেন মালতীর বাড়ি থেকে আসে, বলে দেওয়া হলো।
সাধুবাবা ওদের আশ্বস্ত করে বললেন, "পুরোনো যা বলেছি সেগুলো ভুলে যাও। ওতে আর কাজ হবে না। এখন যা বললাম সেগুলো করো, ঠিক হয়ে যাবে সব।"

স্বভাবগত কারণেই মানুষকে যা বারণ করা হয়, মানুষ সেটাই করে। কোনও কিছুই আর চাপা নেই। সব বাড়িতেই আতঙ্কের স্বপ্ন। তবে একই গল্প নয়। কোথাও অশরীরীর উপস্থিতি। কোথাও বা প্রবল ঝড়ে বাড়ি-ঘর তছনছ হয়ে যাবার ভয়। তারপর আপনজনের কাছে বলে ফেলা এবং ভয় পেয়ে সাধুবাবার কাছেই ছুটে যাওয়া। শেষমেষ সাধুবাবার নিদান। 
আজকাল সাধুবাবার চেহারায় জৌলুস এসেছে। মুখ-চোখে চাকচিক্যের বাহার। রাতেও আরামের নিদ্রা। গ্রামেরই কে একজন এসে তোষক বালিশের ব্যবস্থা করে গেছে। কিছুদিন আগেও পাখির ডাকে চোখ মেলতেন সাধুবাবা। ভোরের আকাশে সোনালী রেখা উঁকি দেবার আগেই পুকুরে ডুব দিয়ে আসতেন। আজকাল সকালের রোদ দায়িত্ব নিয়ে তাঁর ঘুম ভাঙায়। ভোরের ব্যাখ্যাহীন সৌন্দর্যের মধ্যে বটগাছের পাশ দিয়ে গ্রামের যে মানুষগুলো কাজে যায়, তারা নীরবেই পার হয়। কে না জানে, ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, গোলযোগ সইতে পারেন না!
ক'দিন ধরে গ্রামেরই কিছু ছেলেকে রাতের দিকে মাঠে জড়ো হতে দেখা যাচ্ছে। সাধুবাবা তখন ধ্যানে বসেন। ধ্যান ভঙ্গ হলো তাঁর, সচকিত হলেন। তারপর একদিন বটগাছতলা ফাঁকা। সাধুবাবা নেই, তাঁর ঝোলা নেই।  বিছানা বালিশ এমনভাবে পড়ে রইল, যেন ঘাটে বসে আছি আনমনা।
গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে, সাধুবাবা গেছেন সাগরসঙ্গমে। একটু সুখের আশায় গ্রামের সহজ সরল বোকা মানুষগুলো ভেবে দেখেনি, একটা বিষয় নিয়ে সারাদিন ভাবলে ঘুমের মধ্যে অবচেতন স্তরে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। তারা সবাই বুক চাপরাল, হাহাকার করল.... সে চলে গেল, বলে গেল না!  আবার একথাও শোনা গেল, সাধুবাবার বাড়ি নাকি কলকাতায়। সেই বাড়ি থেকে নাকি কোটি কোটি টাকা পাওয়া গেছে! গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সে যাক গে, লোকে তো কত কী বলে! লোকের কথায় কান দিতে আছে?
               

Post a Comment

0 Comments