জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-৩২/শুভদীপ বসু


আবৃত্তির পাঠশালা-৩২

শুভদীপ বসু

বিষয়-বাংলার বিশিষ্ট আবৃত্তিকার(সপ্তম পর্ব)
বাসুদেব নন্দী,মেধা বন্দোপাধ্যায় কাকলি রায়,অপরাজিতা মল্লিক


বাসুদেব নন্দী: সততা, পরিশ্রম, নিষ্ঠা, শুদ্ধতা- এই চারটি মন্ত্রকে জীবনবেদ করে আবৃত্তিকেই যিনি জীবন-যাপনে বাঁচার রসদ করেছেন তিনি বাসুদেব নন্দী। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে আবৃত্তি তার প্রতি সময়ের সাধনা। বাংলা মিডিয়ার একটি চ্যানেলে কিছুদিন কাজ করার পর ২০১৪ সাল থেকে শুধুমাত্র আবৃত্তি কেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন শ্রী নন্দী। পিতা স্বর্গীয় গনেশ চন্দ্র নন্দী, মাতা গীতা নন্দী। তিন ভাই ও দুই বোনের সংসারে তিনি ছিলেন ছোট। শিল্পী সাখোওয়াত খানের কাছে ইনি আবৃত্তিচর্চার পাঠ নেন। শ্রীমতী অনুশিলা বসুর অনুপ্রেরণায় শ্রী নন্দীর 'প্রাণের ঠাকুর' নামে একটি আবৃত্তির সিডি প্রকাশিত করেছিলেন যা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। 

  শিল্পী রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটকে স্নাতকোত্তর করেন। শ্রী নন্দীর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান 'সমকাল আবৃত্তি পরিবার' এর বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় দুশো। বিরাটি ও হাবরাতে এর শাখা রয়েছে। কলাভৃৎ প্রতিষ্ঠানেও আবৃত্তির প্রশিক্ষক শ্রী নন্দী।২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এর তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ ও কবিতা একাডেমির আয়োজনে কবিতা উৎসবে শ্রী বাসুদেব নন্দীকে নীলাদ্রি শেখর বসু স্মারক সম্মানে ভূষিত করা হয়। আবৃত্তি করে যে আর্থিক সংস্থান করা যায়, আবৃত্তিও যে ক্যারিয়ার হতে পারে তা শ্রী বাসুদেব নন্দী শিখিয়ে দিয়েছেন।

 মেধা বন্দোপাধ্যায়: বর্তমান সময়ের অন্যতমা দৃঢ়চেতা আবৃত্তিশিল্পী মেধা বন্দোপাধ্যায়ের জন্ম বাঁকুড়া জেলাতে। পিতা স্বাহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা শিপ্রা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিন বোন বাবা-মা এর সংসারে সাংস্কৃতিক আবহাওয়া ছিল ছোটবেলা থেকেই। গান নয়, বাবা কবিতাবলেই ঘুম পাড়াতেন। মা ছাত্রী বয়সে ছিলেন নাট্যকর্মী। সিস্টার নিবেদিতা গার্লস স্কুল থেকে স্কটিশ চার্চ কলেজ ও তারপরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পেয়ে বর্তমানে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাংলার শিক্ষিকা মেধা।প্রথমে বাবার কাছে ও পরে শ্রী মানবেন্দ্র পাখিরার কাছে মেধা প্রথম আবৃত্তির পাঠ নেন। পরবর্তী সময়ে শ্রী পার্থ মুখোপাধ্যায় এর সারথিতে দীর্ঘসময় আবৃত্তি চর্চা করেন শিল্পী। ওনার 'যদি কেউ মেঘ লিখে যায়' 'বোধন', 'তোমায় আমায় মিলে' ইত্যাদি এ্যালবাম গুলি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে ছিল। রবি ঠাকুর এর কবিতা শিল্পী কে পথ দেখায়। 

  বর্তমান সময়ের কবি অচিন্ত্য সুরাল, চন্দন নাথ, অনির্বাণ ঘোষ, আর্য তীরের বহু কবিতা তার কন্ঠে জনপ্রিয় হয়েছে। আঞ্চলিক কবিতায় শিল্পী সিদ্ধহস্ত। অনেক গুলির মধ্যে আলাদা করে দেবব্রত সিংহের তেজ কবিতাটির কথা বলতেই হয় যা বহু মানুষ শুনেছেন। তারা টিভিতে 'আজ সকালের আমন্ত্রণে' ছাড়াও কলকাতা দূরদর্শনের বহু অনুষ্ঠানে পরিচিত মুখ মেধা। বর্তমানে ওনার নিজস্ব আবৃত্তির শিক্ষার প্রতিষ্ঠান 'মেধা মঞ্জরি'তে আবৃত্তি শিক্ষা নিচ্ছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের বহু মানুষ। ২০২০সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ ও কবিতা একাডেমির আয়োজনে কবিতা উৎসবে শ্রীমতী মেধা বন্দোপাধ্যায়কে 'নীলাদ্রি শেখর বসু স্মারক সম্মানে' ভূষিত করা হয়। বাংলা ভাষার শিক্ষিকা ও জনপ্রিয় আবৃত্তিশিল্পী মেধা বন্দ্যোপাধ্যায়  সবসময়ই মাটির কাছাকাছি থাকেন। রবি ঠাকুরের কথাতেই বলেন 'সেটুকু তোর অনেক আছে /যেটুকু তোর আছে খাঁটি/তার চেয়ে লোভ করিস যদি/ সকলি তোর হবে মাটি।'


কাকলি রায়-চিত্তরঞ্জনে জন্ম শিল্পী কাকলি রায়ের। বাবা ছিলেন রেল ইঞ্জিন কারখানার কর্মী স্বর্গীয় বিশ্বনাথ মিত্র। মা অসীমা মিত্রের উৎসাহে ও অনুপ্রেরণায় ছোটবেলা থেকে আবৃত্তি, নাচ, গান, নাটক এসবের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি এই সবকিছু নিয়ে ছিল আগ্রহ। ছোটবেলা থেকেই নানা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও পুরস্কার লাভের মধ্য দিয়ে কবিতার প্রতি ভালোবাসা জন্মলাভ করে শিল্পীর। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোসিয়োলজি তে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন কাকলি রায়। 
ভেতরের আদম্য ক্ষিদে বিবাহ পরবর্তী সময়েও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। 

  আবৃত্তি শিক্ষার গুরু হিসেবে ইনি পেয়েছেন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় , জগন্নাথ বসু, কাজল সুর, মলয় পোদ্দার, নরেশ নন্দীর মতো জনপ্রিয় আবৃত্তিকারদের। ২০১৫ সালে মাত্র ৫জন সদস্য নিয়ে তৈরি করেন আবৃত্তিচর্চার প্রতিষ্ঠান'দুর্গাপুর শ্রুতিরঙ্গম', সর্বোতভাবে পাশে পান স্বামী কুন্তল রায় কে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের সদস্য সংখ্যা প্রায় ২০০। দুর্গাপুরে আটটি শাখা প্রতিষ্ঠানের।তারা টিভি, রূপসী বাংলা, Express News সহ বিভিন্ন স্হানীয় চ্যানেলে নিয়মিত ওনার অনুষ্ঠান সকলেই মুগ্ধ করে । ২০১১ সালে আবৃত্তির সিডি প্রকাশ করেন শিল্পী। ২০১৭ সালে দুর্গাপুর মহকুমার ৫০বছর পূর্তিতে আবৃত্তিরত্ন পুরস্কার পেয়েছেন শ্রীমতী কাকলি রায়। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে শিল্পী জানান 'আমি এখনো ব্যক্তিগত নয় সম্মিলিত পরিবেশনায় বেশি আগ্রহ প্রকাশ করি।'

অপরাজিতা মল্লিক: হাওড়া জেলার বাগনান থানার অন্তর্গত চন্দ্রভাগা গ্রামে অপরাজিতা মল্লিক এর জন্ম। মায়ের কাছেই ওনার আবৃত্তি শিক্ষার প্রথম হাতে খড়ি।  ছোটবেলায় বিদ্যালয় এবং গ্রামের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়, অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন সকলের চোখের মনি। বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে কলকাতার যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে ভূগোলে স্নাতক হন শিল্পী। পরবর্তীকালে বিবাহসূত্রে খড়গপুরে আসেন ও প্রশিক্ষক‌ হিসেবে অর্ণব চক্রবর্তী সান্নিধ্য লাভ করেন।

  বর্তমানে শ্রী উৎপল কুন্ডু, সন্মানিয়া বিজয়লক্ষ্মী বর্মনের কাছে আবৃত্তির শিক্ষা নিচ্ছেন ইনি। ২০১৪-১৬ সালে রাজ্য ছাত্র যুব উৎসব এর আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় রাজ্যস্তরে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সকলের নজরে আসেন অপরাজিতা। বর্তমানে রবীন্দ্র সদনে কবি প্রণাম অনুষ্ঠান, বর্ষাবরণ, নজরুল জয়ন্তী, কবিতা উৎসবে ও কলকাতা ও জেলার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে আবৃত্তির অন্যতমা মুখ তিনি। ইটিভি বাংলা, তারা টিভি, এফএমে ওনার আবৃত্তি দর্শকদের আনন্দ দিয়েছে।'ছন্দ কথা' নামে বর্তমানে অপরাজিতা তৈরি করেছেন নিজস্ব আবৃত্তিচর্চার প্রতিষ্ঠান। কবিতা ও আবৃত্তি নিয়ে শিল্পীর আরো নিত্যনতুন ভাবনা অপেক্ষা করছে আগামীতে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments