জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-৩৩/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-৩৩

শুভদীপ বসু


বিষয়-মেদিনীপুর শহরের আবৃত্তি চর্চা(প্রথম পর্ব)

বিচিত্র বৈচিত্রের সংস্কৃতির মেদিনীপুর শহর ঐতিহ্যবাহী ও গুণীজনে সমৃদ্ধ। আবৃত্তির আঙিনা কে যে সমস্ত  শিল্পীরা সমৃদ্ধ করেছে তাদের কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম।

১) শিশিরকুমার ভাদুড়ী (১৮৮৯-১৯৫৯)- বাংলার এই খ্যাতনামা অভিনেতা ও নাট্যাচার্য জন্মেছিলেন এই মেদিনীপুর শহরের ছোট বাজারে, তার মামার বাড়িতে। বাল্যশিক্ষা মেদিনীপুর শহরের টাউন স্কুলে। বহু রবীন্দ্র কবিতা তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল। আবৃত্তি নিয়ে তৎকালীন সময়ে প্রদীপ জ্বালার আগে সলতেটা পাকিয়েছিলেন শিশির ভাদুড়ী, শম্ভু মিত্রের মত  ব্যক্তিত্বরাই।

২) অরুণ মাইতি-জন্ম ১৯২৬। পিতা প্রফুল্ল চন্দ্র মাইতি ছিলেন কলেজের স্কুলের বিশিষ্ট শিক্ষক। অরুণ মাইতি, বাসুদেব দাশগুপ্ত, কৃষ্ণ প্রসাদ দাসের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে 'কৃষ্টি সংসদ'। আবৃত্তির জগতেও ওনার অসামান্য অবদান ছিল। 

৩) প্রনব চক্রবর্তী- দিদিমা নাম দিয়েছিলেন জেমস সেখান থেকেই ছোট-বড় সকলেই ওনাকে জেমুদা বলে। বাবা কেষ্ট চক্রবর্তী ছিলেন ভারত সরকারের কবি ভূষণ উপাধি প্রাপ্ত। সরকারি চাকুরীজীবী প্রনব বাবুর জীবনযাপন অনেকের থেকেই আলাদা ও শিক্ষনীয়। আবৃত্তি,সঞ্চালনা, নাটক, কমেন্ট্রি, লেখালেখি, খেলাধুলা সমস্ত বিষয়ে তিনি সিদ্ধহস্ত। অফুরন্ত প্রাণশক্তি সম্পন্ন এই মানুষটি এখনো স্বমহিমায় উজ্জ্বল।

৪)  শিব সুন্দর বসু-স্বর-আবৃত্তির প্রতিষ্ঠাতা শিব সুন্দর বসুর কথা আমি অন্য অধ্যায়ে বিস্তারিত লিখেছি।

৫) অমিয় পাল ও মালবিকা পাল-অমিয় বাবু ছোটবেলায় ঝাড়গ্রামের নয়াগ্রাম স্কুলে পড়াশোনা করতেন। এই বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক সুশান্ত মাইতি মহাশয় এর কাছে তার আবৃত্তির প্রথম পাঠ। মালবিকা পাল ছোটবেলায় মায়ের কাছে পরবর্তী সময়ে নিত্যানন্দ মণ্ডল অরুণ মাইতি, তপন জ্যোতি বাবুর কাছে নানা সময়ে সমৃদ্ধ হয়েছেন। মেদিনীপুর কলেজে অমিয় বাবু ইংরেজি ও মালবিকা পাল জুলজি নিয়ে পড়তে পড়তে কবিতার পথ ধরে আলাপ হয় দুজনের। এ সময় এনাদের 'স্বাতী' নামে একটি গানের দল ছিল। নব্বইয়ের দশকে বাচিক দম্পতি  গড়ে তুলেছিলেন আবৃত্তি ও শ্রুতি নাটক শেখানোর প্রতিষ্ঠান 'কথামালা'। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের 'সাত টাকা বারো আনা', 'বড়ি', বিমল করের 'বিচিত্র প্রেম' এই বিখ্যাত শ্রুতি নাটক গুলি এনাদের কন্ঠে আজও জনপ্রিয়। শান্তিদেব ঘোষ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এর মত বহু গুণীজনের সান্নিধ্য পেয়েছেন শ্রী অমিয় পাল। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের বলেন- 'বাংলা সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই আবৃত্তি করতে হবে।'

৬) কাজল মাইতি-পূর্ণেন্দু মাইতি পুত্র কাজল মাইতি গণসংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ওনার জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর এ শহর ভুলবে না। আবৃত্তির জগত তার কাছে আরও বহু কিছু আশা করেছিল।

৭) দীপক বসু-মধ্যপ্রদেশের কাটনিতে জন্ম দীপক বসুর বাবা ছিলেন খড়গপুর আই.আই.টি কর্মী। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পড়ার পর কর্মজীবন শুরু করেন মাদ্রাজে। আবৃত্তি ও নাটক শেখানোর অবৈতনিক স্কুল 'আবৃত্তি তীর্থ' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উনি খড়গপুরে। অসংখ্য মঞ্চনাটক শ্রুতি নাটক আবৃত্তিতে এখনও তিনি সমানভাবে সিদ্ধহস্ত।

৮) কৌস্তুভ বন্দ্যোপাধ্যায়-বর্তমানে ঝাড়গ্রাম এর সহকারি বিদ্যালয় পরিদর্শক(মাধ্যমিক) শ্রী বন্দোপাধ্যায় বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় আবৃত্তিশিল্পী। মাতা ভারতী বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গীতশ্রী উপাধি প্রাপ্ত। ভারতী দেবী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ওঙ্কার মিউজিক সার্কেল। এই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে আবৃত্তির প্রশিক্ষক কৌস্তুভ বন্দোপাধ্যায়। শিব সুন্দর বসু, শুভাশীষ বসু, কাজল মাইতির কাছে আবৃত্তির তালিম নিয়েছেন ইনি। ঋক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন ইনি। সর্বভারতীয় সঙ্গীত ও সংস্কৃতি পরিষদ (কলকাতা) পঞ্চম ও সপ্তম বর্ষে স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক পেয়ে সকলের নজরে এসেছিলেন। বর্তমানে ওনার অসংখ্য ছাত্র ছাত্রী। শিল্পীর জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ সকলে।

৯) মোম চক্রবর্তী-শৈশবে পারিবারিক সাংস্কৃতিকমন্ডলে আবৃত্তি চর্চা শুরু‌ করেন। পরবর্তী সময়ে বিশিষ্ট আবৃত্তিকার শ্রদ্ধেয় শ্রী অমিতাভ বাগচীর কাছে আবৃত্তির পাঠ নিয়েছেন।প্রায় ১৫ বছর আগে নিজের আবৃত্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান, আবৃত্তি কলাকেন্দ্রর প্রতিষ্ঠা করেন। দু তিনজন ছাত্র ছাত্রী নিয়ে শুরু হলেও এখন এই সংখ্যা শতাধিক। আবৃত্তিকলা কেন্দ্রের প্রথম বার্ষিক অনুষ্ঠানের আগে সারা জেলা জুড়ে আবৃত্তির প্রতিযোগিতা অভুতপূর্ব সাড়া ফেলেছিলো। মেদিনীপুর কলেজের প্রাঙ্গণ আবৃত্তি উৎসবের চেহারা নিয়েছিলো। মোম চক্রবর্তীর একক ও ওনার পরিচালনায় আবৃত্তির অ্যালবাম 'ভালোবাসার গল্প বল', 'পথ', 'ব্যারিকেড', 'কবিতা আমার' অত্যন্ত জনপ্রিয়।
১০) তন্দ্রিমা ঘোষ-সারাবাংলা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় স্থান অধিকার করে খুব কম বয়সেই সকলের নজরে এসেছিলেন এই শিল্পী। মা গায়ত্রী ঘোষ, শিব সুন্দর বসু ও পরবর্তী সময়ে উৎপল কুন্ডুর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন শিল্পী।১৯৯৭ সালে 'কথায়ও তুলিতে' আবৃত্তি ও অঙ্কন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন।২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা জনপ্রিয় হয়েছিল। কবি হিসেবেও জনপ্রিয় ইনি। ছাত্র-ছাত্রীদের বলেন 'কবিতার বিষয়বস্তু ফুটিয়ে তুলতে পারাই হোল আবৃত্তি।'(ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments