জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-৩৪/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-৩৪
শুভদীপ বসু


বিষয়:মেদিনীপুর শহরের আবৃত্তির ইতিহাস(দ্বিতীয় পর্ব)

১১) পাঞ্চালি চক্রবর্তী- আবৃত্তির শিক্ষাগুরু হিসেবে উনি পেয়েছেন শ্রী শিব সুন্দর বসু কে। সারা বাংলা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বহুবার পুরস্কার অর্জন করে খুব ছোটবেলা থেকেই সকলের নজরে এসেছিলেন। শিক্ষাগুরুর উদ্যোগেই ১৯৯৭সালে পাঞ্চালি চক্রবর্তী তৈরি করেন আবৃত্তির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এসো আবৃত্তি করি। পরে কিছুটা সময় সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকায় প্রতিষ্ঠানটির সাময়িক কাজ বন্ধ থাকলেও ২০১২সাল থেকে পুনরায় আবৃত্তির আঙিনায় নব রূপে প্রকাশ হয় প্রতিষ্ঠানের। নাম-'পাঞ্চালির কাব্যতীর্থ'।

১২) অজন্তা মাইতি- পিতা শ্রী অরুণ কুমার মাইতি ছিলেন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী নাট্যব্যক্তিত্ব, মাতা শ্রীমতি মনিকা মাইতি অলিগঞ্জ ঋষি রাজনারায়ান বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। পড়াশুনার পাশাপাশি পারিবারিক সাংস্কৃতিক জগতে ছোট থেকেই বড় হয়ে ওঠা শিল্পীর।  প্রথমে বাবার কাছে  আবৃত্তি চর্চার সূত্রপাত। বর্তমানে  শ্রী উৎপল কুন্ডু অধীনে আবৃত্তি চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন শিল্পী। পেশায় শিক্ষিকা বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও সংস্কৃতি চর্চার বীজ রোপন করেন। সম্প্রতি ইউটিউবে প্রকাশিত ওনার বেশ কিছু কবিতা জনপ্রিয় হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন- 'কবিতা আমার পৃথিবী দেখার রঙিন চোখ/কবিতা আমার আশার সোনালী স্বপ্ন লোক।'

১৩) সুতনুকা মিত্র মাইতি- বাবা বিশিষ্ট সাহিত্যিক শ্রী নিলয় মিত্রের কাছে আবৃত্তির প্রথম পাঠ পেয়েছেন শিল্পী। পরে দীর্ঘদিন শ্রী শিব সুন্দর বসুর কাছে প্রশিক্ষণ নেন শিল্পী। স্বয়ং পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ এর সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন শিল্পী। শ্রীমতী গৌরী ঘোষ ওনাকে কৃপণ কবিতাটি শিখিয়ে দিয়েছিলেন যা অডিশনে আবৃত্তি করে আকাশবাণীতে জায়গা করে নেন সুতনুকা মিত্র মাইতি। ১৯৯৩ সালে শান্তিনিকেতনের শ্রীনিকেতন থেকে প্রথম আবৃত্তির রেকর্ড প্রকাশ পায়। ১৯৯৪ থেকে আকাশবাণীর যুববাণীর নির্বাচিত শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন শ্রীমতী সুতনুকা মিত্র মাইতি। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র 'স্বর ও ধ্বনি'। ওনার পরিচালনায় 'স্বপ্নের ফেরিওয়ালা' নামে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে একটি সিডি প্রকাশিত হয় যা জনপ্রিয় হয়েছিল। উদ্বোধন করেছিলেন সংগীতশিল্পী শুভেন্দু মাইতি মহাশয়। বর্তমানে স্বর ও ধ্বনির ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় একশো। শিল্পী মনে করেন আবৃত্তির ক্ষেত্রেও পড়াশোনাটা অত্যন্ত জরুরী, একথা তিনি তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে চান।

 ১৪) নমিতা মাঝি- আবৃত্তির শিক্ষাগুরু হিসেবে শিল্পী পেয়েছেন শ্রী পবিত্র সিনহা, শ্রী কাজল মাইতি  ও শ্রী শিব সুন্দর বসুকে। ২০০২ সালে শিল্পী নমিতা মাঝি প্রতিষ্ঠা করেন 'ঋক আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র'। প্রায় পনেরো কুড়ি জন কে নিয়ে এই সংস্থা শুরু হলেও বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় দুশো। শ্রীমতি নমিতা মাঝি নিজে সরস্বতী বিদ্যামন্দির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহ শিক্ষিকা। সংস্থার অনেক ছাত্রছাত্রী ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের শিল্পী বলেন- 'স্মৃতির মাধ্যমে, উদাত্ত কণ্ঠে  আবৃত্তি করতে হবে।'

 ১৫) কেয়া সেন- দাদু সুকুমার সেনগুপ্ত। মা- নন্দরানী ডল সাত বারের বিধায়ক তথা একবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জনশিক্ষা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। বাবা ডহরেশ্বর সেনও রাজনৈতিক কর্মী। শিল্পী কে প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রী বিপ্লব মাঝি সর্বপ্রথম নিয়ে যান রমা কর পাহাড়ির ঋক আবৃত্তি সংস্থায় আবৃত্তি শেখার জন্য। এরপর ১৯৮৫-২০০৫ এই দীর্ঘ সময়ে শ্রী শিব সুন্দর বসুর কাছে আবৃত্তির শিক্ষা নেন শিল্পী কেয়া সেন। শিব সুন্দর বসুর সাথে ক্লাস ইলেভেন থেকেই বিচারকের আসনেও বসেন তিনি। ২০১৩ সাল থেকে শ্রী উৎপল কুন্ডুর কাছে এখনো আবৃত্তি চর্চা করছেন শিল্পী। নিজে একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা হওয়ায় বহু ছাত্র-ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহ দেন। কেয়া সেনের উদাত্ত দরাজ কণ্ঠে মুগ্ধ আবৃত্তিবোদ্ধারা।


১৬) স্বাগতা পান্ডে সেন- খড়গপুর ট্রাফিক হাইস্কুলের শিক্ষিকা  ২০০৯ সালে  আবৃত্তির স্কুল বাচিক প্রতিষ্ঠা করেন। শিল্পী আবৃত্তির শিক্ষাগুরু  হিসেবে পেয়েছেন ঊর্মিমালা বসু ও জগন্নাথ বসুকে। ওনার প্রথম সিডি বাংলাদেশের খুলনা জেলার বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী শরিফ আতিক-উজ- জ্জামান এর গানের সাথে কবিতা "ফিরে আসার হাওয়া"। সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন  শ্রী কল্যাণ সেন বরাট। পরবর্তী সিডি "ভালোবাসার রং"। কবিতা ও আবহসংগীতে  শ্রী শুভ দাশগুপ্ত।পরের সিডি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা নিয়ে"রবির আলোয় "। এছাড়া আছে শিল্পীর নিজের পরিচালনায় মিউজিক ভিডিও এ্যালবাম- "অঙ্গীকার"। "বাচিক " এর  ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কবিতা নিয়ে এবং নিজের কবিতা নিয়ে তৈরি করেন সিডি"বাচিক  আনন্দ উৎসব দুই হাজার কুড়ি "। শ্রী ভবানীপ্রসাদ মজুমদার, দেবব্রত দত্ত , শ্রী অপূর্ব দত্ত, শ্রী দীপ মুখোপাধ্যায়, শ্রী রতনতনু ঘাটী, শ্রী শুভ দাশগুপ্ত এর মতো বিখ্যাত মানুষদের স্নেহ সান্নিধ্যে এসেছেন শিল্পী স্বাগতা পান্ডে সেন। ২০১৭ সালে বাংলা কবিতা র ব্যান্ড "ফিউশন" গড়ে তুলেছেন শুধু মাত্র কবিতা কে ভালোবেসে।

১৭) রত্নাদে ও নরোত্তম দে- খুব ছোটবেলায় শ্রীমতী রত্নাদে বিদ্যালয়ের সীতা দিদিমণি পরে শ্রী বাসুদেব দাশগুপ্ত ও শ্রী কাজল মাইতি কে আবৃত্তি ও নাটকের শিক্ষা গুরু হিসেবে পেয়েছেন। পরে স্বামী নরোত্তম দে,শ্রী মোহিনী মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ও শ্রী দেবাশীষ দন্ডের কাছে আঞ্চলিক কবিতার প্রশিক্ষণ পান। শ্রী নরোত্তম দে শ্রী কাজল মাইতির কাছে আবৃত্তি প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। উদয়ন, থিয়েটার ইউনিক, কৃষ্টি সংসদ, উত্তরণ ইত্যাদি নাট্য সংস্থার সাথে এই বাচিক দম্পতি যুক্ত ছিলেন। মনোজ মিত্র, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এর কর্মশালা এনাদের উৎসাহ দিয়েছে। ২০১৮ সালে আবৃত্তি ও শ্রুতি নাটকের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র 'শ্রুতি ও ছন্দ' প্রতিষ্ঠা করেন এই বাচিক দম্পতি। ভবিষ্যতে শহরে শ্রুতি নাটকের প্রতিযোগিতা করানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

 ১৮) ইন্দ্রাণী দাশগুপ্ত ও অংশুমান দাশগুপ্ত : ইন্দ্রাণী দাশগুপ্ত আবৃত্তির শিক্ষাগুরু হিসেবে পেয়েছেন শিব সুন্দর বসুকে। অধ্যাপক বীতশোক ভট্টাচার্য এর সাথে ওনার আত্মিক যোগাযোগ ছিল। ওনার উৎসতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন শ্রীমতী দাশগুপ্ত। ধানসিঁড়ি পত্রিকায় ওনার লেখা সাড়া ফেলেছিল। আকাশবাণীর প্রাত্যহিকী তে সেরা চিঠি বহুবার হয়েছে শ্রীমতী দাশগুপ্তের কলম। ১৯৯৬ সালে বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদ এর পরীক্ষায় রাজ্যব্যাপী প্রথম হয়েছিলেন উনি। ২০১০ সালে ইন্দ্রাণী দাশগুপ্ত ও তার স্বামী অংশুমান দাশগুপ্ত মিলে প্রতিষ্ঠা করেন সৃজনী আবৃত্তি সংস্থা। শ্রী অংশুমান দাশগুপ্ত সরকারি আধিকারিক। গুরুত্বপূর্ণ পদ সামনেও আবৃত্তির প্রতি নিষ্ঠা উৎসাহ অন্যদের প্রেরণা দেয়। ২০১৪ সালে সৃজনী থেকে প্রকাশিত হয় আবৃত্তির অ্যালবাম 'আমাদের কবিতা' পরিচালনায় ছিলেন ইন্দ্রাণী দাশগুপ্ত।

১৯) চিত্তরঞ্জন দাস: ছোট বেলাতে কীর্তন গান করতেন বাবার সাথে। গ্রামে নাটক ও যাত্রাদলেও অংশগ্রহণ করতেন তিনি। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই পাঠ্যপুস্তকের কবিতা গুলো  আত্বস্থ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলতেন। শিক্ষক শিক্ষিকারা বেশ প্রশংসা করতেন। আবৃত্তির শিক্ষাগুরু হিসেবে পেয়েছেন প্রথম জীবনে শিব সুন্দর বসুকে।  পরবর্তী কালে গুরু হিসেবে পেয়েছেন শ্রদ্ধেয়া ব্রততী বন্দোপাধ্যায়, শ্রী কাজল সুর, শ্রী নরেশ নন্দী, শ্রী মলয় পোদ্দার কে। ২০০৩ সালে নিজের গ্রাম গুড়গুড়িপাল এ প্রতিষ্ঠা করলেন আবৃত্তি ও শ্রুতি নাটক চর্চার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র 'কাব্য ও কলা'। ২০০৭ সাল থেকে মেদিনীপুর শহরেও এই প্রতিষ্ঠান শাখা খুলেছেন তিনি। 'আলেখ্যায়তন' প্রতিষ্ঠানেও দীর্ঘদিন আবৃত্তির প্রশিক্ষক ছিলেন শ্রী দাস। মেদিনীপুর শহরে শ্রুতি নাটক উৎসব সর্বপ্রথম সূচনা করেন চিত্তরঞ্জন দাস। ২০১৯ সালে কাব্য ও কলার বাৎসরিক অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধেয়া ব্রততী বন্দোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন এই শিল্পী। কবি শুভ দাশগুপ্তের সাথে ওনার আবৃত্তির সিডি 'মাটির গহন হতে' জনপ্রিয়তা পায়। শ্রী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্রী রজতাভ গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রীমতী রত্না মিত্র, শ্রদ্ধেয়া বিজয় লক্ষ্মী বর্মণ সহ বেশ কিছু সুহৃদয় মানুষের সান্নিধ্য লাভও করেছেন শিল্পী। মেদিনীপুর শহর ও জেলা ছাড়িয়ে পশ্চিম বঙ্গ তথা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আবৃত্তির চর্চার প্রসারই ওনার লক্ষ।

 ২০) অনিন্দিতা শাসমল: খড়্গপুরের অনতিদূরে জফলা গ্রামের সুন্দর প্রকৃতির কোলে বড় হয়ে উঠেছেন এই বাচিকশিল্পী, লেখিকা এবং সংগঠক। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনী নিচু মঞ্জরী উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ‍্যালয়ের  জীববিজ্ঞানের শিক্ষিকা, বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মশালার প্রশিক্ষন ও সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত। শিল্পী রবীন্দ্রস্মৃতি সমিতির আজীবন সদস্য। ছোটোবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত ,জীবনানন্দের কবিতা পড়ে, কবিতার প্রতি ভালোবাসা এবং মা- বাবার কাছেই আবৃত্তির প্রাথমিক শিক্ষা ও সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা। শ্রদ্ধেয় বাচিকশিল্পী জগন্নাথ বসু ও ঊর্মিমালা বসুর কাছে অল্প কিছুদিনের জন‍্য আবৃত্তি শিক্ষা।গত বারো বছর ধরে কবি আরণ‍্যক বসু তথা বাচিকশিল্পী পরিচয় বসুর কাছে আবৃত্তিশিল্পের বিভিন্ন দিক, কবিতার নির্মিতি ও ছন্দের পাঠ নিয়ে চলেছেন।আবৃত্তির পাশাপাশি বেশ কিছু পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা ও গদ‍্য লিখছেন। 'মনে থাকবে' পত্রিকার মুখ্য সঞ্চালক তিনি। কবিতাকে ভালোবেসেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কবিতাযাপনের মধ‍্যে দিয়েই ভালো থাকতে চান, সুস্থ সুন্দর সমাজ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে।
তিনি নিজেই  লিখেছেন--
"আমি কবিতা ভালোবাসি
পাগলের মতো ভালোবাসি
কবিতার সঙ্গেই আমার দিনযাপন
কবিতার সঙ্গেই আমার প্রেম
জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক।"


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments