জ্বলদর্চি

হাত বাড়ালেই বন্ধু?/মুক্তি দাশ

হাত বাড়ালেই বন্ধু?
মুক্তি দাশ


বাল্যবয়সে পাঠ্যপুস্তকে সেই ‘দুই বন্ধু ও ভালুকের গল্প’ আমার মতন যাদের পড়তে হয়েছে, আমি বিশ্বাস করি না, পরবর্তীকালে বন্ধু বা বন্ধুত্ব সম্পর্কে তাদের মনে খুব একটা স্বচ্ছ ও অনাবিল ধারণা গড়ে উঠতে পেরেছে। ছোটবেলায় সেই নীতিবাক্যমূলক গল্পটি আমাদের অনেককেই পড়তে হয়। হয়েছে। সেই যে, দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু ঘোর জঙ্গলের মধ্যে কোথায় যেন যাচ্ছিল। এমনসময় উল্টোদিক থেকে আসছিল এক ভালুক। প্রথম বন্ধুটি গাছে ওঠায় ওস্তাদ। বিদ্যেটি এই আপৎকালে তার কাজে লেগে গেল। সে তরতর করে গাছে উঠে মগডালে গিয়ে বসে থাকল। ভালুক তো আর গাছে উঠতে পারে না! কিন্তু দ্বিতীয় বন্ধুটি পড়ল মহা ফাঁপরে। সে গাছে-ফাছে উঠতে পারে না। ছুটে যে কোথাও পালিয়ে যাবে, সে গুড়েও বালি! ঘন বন-জঙ্গলের পথে সে প্রয়োজন মতো দ্রুত ছুটতেও পারবে না। তাছাড়া ভালুকের সংগে পাল্লা দিয়ে ছোটা, বিশেষত গহন অরণ্যের পথে…অসম্ভব! দ্বিতীয়বন্ধুর অনেক কাকুতি-মিনতি সত্ত্বেও প্রথমবন্ধু তাকে গাছে ওঠার ব্যাপারে সাহায্য করল না। তার নিজেরই তখন ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ অবস্থা। এইরকম পরিস্থিতিতে, জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে একটা কথা  বিদ্যুৎঝলকের মতন দ্বিতীয়বন্ধুর মনে পড়ে গেল। কোথাও যেন সে শুনেছিল, ভালুক মরামানুষ খায় না। অতএব সে মড়ার মতন মাটিতে তৎক্ষণাৎ শুয়ে পড়ল। এবং ভালুক এসে যথারীতি তার সর্বাঙ্গ শুঁকে তাকে মৃত ভেবে বনের মধ্যে একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল। এবার মৃতের ভূমিকায় অভিনয়কারী বন্ধু ভূমিশয্যা ছেড়ে গাছের মগডালে নিরাপদে বসে থাকা বন্ধুকে একটি মোক্ষম নীতি বাক্য শুনিয়ে বন্ধুত্বে চিরদিনের মতন ইতি টেনে দিল।

এই গল্প বন্ধুত্বের নিকৃষ্টতম পরাকাষ্ঠা হিসেবে যতই শিশুমনে একটা চিরস্থায়ী দাগ টেনে দিক না কেন, বন্ধু নির্বাচনের ব্যাপারে সেই অল্পবয়েস থেকেই যে আমাদের অত্যন্ত সজাগ ও সতর্ক করে দিয়েছিল- এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।

নীতি, আদর্শ, শখ-আহ্লাদ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রভৃতি ব্যাপারে সমমনোভাবাপন্ন দু’জন ব্যক্তি যখন নিজেদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদের সমান ভাগীদার হতে সক্ষম হয়, তখনই তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে বলে আপাতভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কালক্রমে এই বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। বয়সজনিত ব্যবধান এখানে কোনো বাধাই নয়। অসমবয়সী দু’জন ব্যক্তির মধ্যেও স্বচ্ছন্দে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে। আবার লিঙ্গগত কোনো ব্যবধানও বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে অন্তরায় নয়। নারী-পুরুষের মধ্যেও অক্লেশে বন্ধত্ব স্থাপিত হতে পারে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এইধরণের বন্ধুত্ব রিপুতাড়িত হয়ে অন্যদিকে মোড় নিয়ে নেয়। বন্ধুত্ব তখন রূপান্তরিত হয় ‘প্রেম’-এ। যার পরিণতি বিবাহে, অথবা বিচ্ছেদে। কিন্তু বন্ধুত্ব এমনই জিনিস যার রূপান্তরগত পরিণতি থাকতে নেই। সুতরাং আমরা কেবল সমলিঙ্গী বন্ধুত্বের কথাই আলোচনা করব। অর্থাৎ পুরুষের সংগে পুরুষের অথবা নারীর সংগে নারীর বন্ধুত্বের প্রসংগই এই নিবন্ধে স্থান পাবে। নারী ও পুরুষের বন্ধুত্ব যেমন জটিল, তেমনই বিপজ্জনক। সে পথ না মাড়ানোই ভাল!

একেবারে প্রগৈতিহাসিক যুগে মানুষে-মানুষে পারস্পরিক বন্ধুত্ব স্থাপন হয়েছিল বা হতো বলে আমার তো মনে হয় না। কারণ সে যুগে মানুষ ছিল সমাজ-বিচ্ছিন্ন। যারা তখনও পর্যন্ত দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করার মতন সমাজই গড়ে নিতে পারেনি, তারা বন্ধুত্ব গড়বে কী করে? প্রস্তরযুগে যদিও মানুষ দলবদ্ধ হয়ে বাস করতে শিখেছে, কিন্তু তখনও বন্ধুত্ব কী বস্তু তা তাদের কাছে অজ্ঞাত। বন্ধুত্ব স্থাপনের মতন পরিণত মানসিকতা তখনও তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছিল শুধু দলের প্রতি কৃতজ্ঞতা, আনুগত্য এবং দায়িত্ববোধ। এবং তা উদ্দেশ্যভিত্তিক। কারণ তারা বুঝেছিল, বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে তাদের দলবদ্ধভাবে বাস করতেই হবে। তাই তারা বাইরের শত্রুকে প্রতিহত করতে অথবা আহার্য-শিকারে গিয়ে তাদের পছন্দমতো জন্তুটিকে বধ করতে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ত। একে কি বন্ধুত্ব বলব? দলগত বন্ধুত্ব?

একটা কথা এখানে মনে রাখা দরকার। দুই বন্ধুর মধ্যে মনের মিল যতই থাক, বিশ্বস্ততাই বন্ধুত্বের প্রধান শর্ত। পরস্পরের বিশ্বাসভাজন হতে না পারলে বন্ধুত্বই বৃথা। কারণ সে বন্ধুত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয় না। হতে পারে না। বন্ধুত্ব স্থাপন করতে হলে নিজেকেও তার যোগ্য করে তুলতে হবে। এবং সেই যোগ্যতা দিয়ে বন্ধুত্ব অর্জন করতে হয়। ইংরেজি তে একটি প্রবাদ আছে : “Friendship cannot be purchased, rented or borrowed. It must be earned.’ সুতরাং অর্জিত বন্ধত্বই প্রকৃত বন্ধুত্ব। একজন মানুষের যোগ্যতা যতখানি তার বন্ধুত্ব অর্জনের ক্ষমতাও ঠিক ততখানিই। তার বেশিও নয়, কমও নয়।

আমাদের বাংলাভাষায় ‘বন্ধু’র বহু প্রতিশব্দ রয়েছে। সখা, মিতে বা মিতা, সখী, সই, সাঙাৎ, দোসর, গঙ্গাজল- আরো কত কি! তবে এগুলো কেমন যেন একটু সেকেলে-সেকেলে। তার চেয়ে ‘বন্ধু’ শব্দটাই যেন এখনকার দিনে বেশি জুৎসই। আর ‘সাঙাৎ’ এবং ‘দোসর’ শব্দদুটি তো এখন হীন ও তাচ্ছিল্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন একজন চোরের দোসরকে চোরের বন্ধু বলার থেকে চোরের সাঙাৎ বলতেই আমরা অভ্যস্ত।

বন্ধুদের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ মানসিক আবেদন-নির্ভর। এটি দেশ ও সমাজ দ্বারা আরোপিত কোনো সম্পর্ক নয়। সুতরাং বন্ধুত্ব-স্থাপনের ক্ষেত্রে কোনোরকম সামাজিক অনুষ্ঠানও অপরিহার্য নয়। তবু আগেকার দিনে- এই হয়তো ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে বা বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে রীতিমতন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে ‘সই’ বা ‘গঙ্গাজল’ বা ‘মিতা’ পাতানোর রেওয়াজ ছিল। এখন অবশ্য ওসব আদিখ্যেতা নেই, কবে উঠে গেছে।
যাইহোক, এখন কথা হচ্ছে, প্রকৃত বন্ধুনির্বাচনের সঠিক মাপকাঠি কী? যার সংগে মনের মিল হল, সে-ই যে প্রকৃত বন্ধু- এরকম না-ও হতে পারে। আজ যার সাথে মনের মিল হল, কাল তার সংগে মনের অমিল হতে কতক্ষণ? আসলে বন্ধুত্ব যত পুরনো হয় ততই তা ক্রমে গভীর হতে থাকে এবং বন্ধুর প্রকৃত রূপটিও ততই প্রকটিত হতে ধাকে। বন্ধুত্বের মধ্যে স্বার্থ বা উদ্দেশ্যসিদ্ধির কোনো স্থান নেই। কোনোরকম সংকীর্ণতাও বন্ধুত্বের মধ্যে থাকবে না। তবেই তো বন্ধুত্ব! বন্ধু যদি বন্ধুর আপদ-বিপদ, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সমান ভাগীদার না হতে পারে, তাহলে সে কিসের বন্ধু? প্রকৃত বন্ধুর সান্নিধ্যে মন হয় প্রশস্ত, উদার। বন্ধুর কাছেই তো শুধু মনের সবচেয়ে গোপনতম কথাটিও অনায়াসে বলে ফেলা যায়। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উজাড় করে দেওয়া যায়। যা পরিবারে সর্বাপেক্ষা নিকটজনের কাছেও বলা যায় না, সেই কথাটিও অক্লেশে ব্যক্ত করা যায় বন্ধুর কাছে। তবে যদি সে প্রকৃত বন্ধু হয়। এই প্রকৃত বন্ধু নির্ণয় প্রসংগে একটি অতিদীর্ঘ ইংরেজি বাক্য- আবার বলছি, একটিই মাত্র বাক্য- উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না-

“A real friend is a friend who will never take advantage of your leaning, who will get down on his knees beside you when you are down, and forget that he did so when you are on your feet again, and who has tear on his cheek when you suffer and a twinkle in his eyes when the sun shines on you again, who has a pain in his tone when you are in distress and melody in his voice when your heart is gay, who admires you for your strong points but loves you in spite of your weak ones, who is proud of you when fortune favours you but not ashamed of you when you fail, who contribute to your success without claiming any share in it, who can feel and show satisfaction when you please him but never resentment when you disappoint him, who will tell you the truth even when it hurts and to whom you can tell the truth without his taking offence, who is not ashamed to ask of you a favour, but wii never impose on you for the favour that is done, who will not hesitate to do you a favour even at the risk of being imposed upon, who can extend a helping hand and lighten your load without expecting any other reward than having had the privilege of so doing, who gives you all he can whenever he can, without ever keeping a record of what he had given, who says the best about you when everybody else is saying the worst.”

অতএব কেবল সমমন্যতাই নয়, পরস্পরের মধ্যে উপরোক্ত গুণাবলীর সমন্বয়-সাধন হলেই প্রকৃত বন্ধুর দেখা মিললেও মিলতে পারে। 

রামায়ণ-মহাভারতের যুগে সার্থক বন্ধুত্বের নিদর্শন দুর্লভ নয়। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের অকৃত্রিম সখ্য সর্বজনবিদিত। শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতের নেপথ্য-নায়ক। এবং শ্রেষ্ঠ রাজনীতিজ্ঞ ও কূতনীতিবিদ। নেপথ্যে থেকেই তিনি সমগ্র কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ পান্ডবদের পক্ষে সুচারুভাবে পরিচালনা করে গেছেন। সে কেবল অর্জুন তাঁর প্রাণের সখা বলেই। তিনি না থাকলে মহাভারত অন্যভাবে লেখা হত। নিছক ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত বৃহৎ এক রাজপরিবারকে তিনি রাজনীতির মোড়কে সরাসরি নামিয়ে এনেছেন কুরুক্ষেত্রের বিশাল প্রান্তরে, রণভূমিতে। এবং পঞ্চপান্ডবের জয়কে অনিবার্য করে তিনি করে গেছেন অসত্যের বিনাশ ও সেইসংগে সত্যের প্রতিষ্ঠা। আর পঞ্চপান্ডবের সংগে তাঁর একমাত্র সম্পর্ক-সূত্র ধনুর্ধর অর্জুনের সংগে নির্ভেজাল বন্ধুত্ব। 

আবার সেই শ্রীকৃষ্ণ যখন দ্বারকার রাজা, তখন সুদামার সংগে তাঁর অসাধারণ বন্ধুত্ব রীতিমতন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। সুদামা তাঁর বাল্যবন্ধু। কিন্তু কতদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। শ্রীকৃষ্ণ আজ দ্বারকাধিপতি। প্রভূত ঐশ্বর্য ও ধনসম্পদের অধিকারী। অপরদিকে সুদামা দারিদ্র্যপীড়িত, অনাহারক্লিষ্ট। সবই ভাগ্যের পরিহাস। স্ত্রী ও সাত-সাতটি সন্তানসন্ততি নিয়ে দারিদ্র্য-জর্জরিত বড় কষ্টের সংসার তাঁর। স্ত্রী ললিতার পরণের কাপড়ের ব্যবস্থা করা দূরে থাক, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের সংস্থান করতেও তিনি অসমর্থ। তবু সুদামা তাঁর আদর্শে অটল। কারো কাছে তিনি হাত পাতবেন না। তাতে যদি তাঁর স্ত্রী-পুত্রকন্যারা অনাহারে মৃত্যুবরণ করে, তাও তিনি মেনে নেবেন। তবু কারো দয়া বা করুণার দান তিনি গ্রহণ করবেন না। স্ত্রী ললিতা তাঁকে বহুবার অনুরোধ করেছেন তাঁদের বন্ধুরাজা শ্রীকৃষ্ণের কাছে গিয়ে অভাব-অভিযোগের কথা জানাতে। শ্রীকৃষ্ণ রাজা হলেও গরীব বাল্যবন্ধুকে তিনি বিমুখ করবেন না বলেই তাঁর বিশ্বাস। তবু সুদামা অনড়। কিছুতেই তিনি তাঁর দারিদ্র্যকে বন্ধুর কাছে নগ্নভাবে প্রকাশ করবেন না। কখনোই না।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর। দেবতাদের বেলায়ও বুঝি এর ব্যতিক্রম নেই। একদিন অবস্থা এমন চরমে উঠল যে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর শিশু পুত্রকন্যাদের করুণ কান্না বাপ হয়ে সহ্য করতে পারলেন না সুদামা। শিশুদের জোর গলায় কাঁদবার শক্তিটুকুও যেন আর অবশিষ্ট নেই। এই দৃশ্য আদর্শপরায়ণ সুদামার অন্তঃস্থলে এমনভাবে নাড়া দিল যে, সুদামা মুহূর্তে সবকিছু বিসর্জন দিয়ে হয়ে গেলেন এক দায়িত্বশীল কর্তব্যপরায়ণ পিতা। পত্নী ললিতার প্রস্তাব শিরোধার্য করে শ্রীকৃষ্ণের রাজদরবারে যেতে সম্মত হলেন অনন্যোপায় সুদামা। বেশ যত্ন করে সুদামার কাপড়ের খুঁটে বন্ধু শ্রীকৃষ্ণের জন্যে দু’মুঠো খুদ বেঁধে দিলেন ললিতা। এছাড়া বাড়িতে আর কিছুই নেই যে! এতদিন পর বন্ধুর কাছে যাচ্ছেন সুদামা, খালিহাতে যাওয়া যায়?

প্রথম বিস্ময়ের ঘোরটুকু কাটতেই যা অপেক্ষা। রাজসিংহাসন থেকে নেমে শ্রীকৃষ্ণ ছুটে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রবল উচ্ছ্বাসে জড়িয়ে ধরলেন বন্ধু সুদামাকে। তারপর যাবতীয় রাজকার্য ফেলে রেখে উষ্ণ অভ্যর্থনায় সুদামাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন অন্দরমহলে। রাজকীয় ব্যবস্থা। লোভনীয় খাবার-দাবার। দুই বন্ধুতে মিলে একসংগে খেতে খেতে পারস্পরিক কুশলাদি বিনিময়ের সংগে সংগে কত কথাবার্তাই যে হল! এতদিন পর সুদামার মতো বাল্যবন্ধুকে কাছে পেয়ে শ্রীকৃষ্ণ আর ছাড়তেই চান না! এমনই বন্ধু-বাৎসল্য!

তারপর একসময় সুদামার বিদায় নেবার পালা। শ্রীকৃষ্ণ বন্ধুকে বিদায় জানাতে গিয়ে হঠাৎ বলে বসলেন, ‘বন্ধু, এতকাল পর আমার বাড়ি এলে, আমার জন্যে কি কিছুই আনো নি?’

একেবারে মরমে মরে গেলেন সুদামা। প্রথমত, শ্রীকৃষ্ণ যতই তাঁর প্রাণের বন্ধু হোন- তিনি তো রাজাধিরাজ, সর্বেশ্বর। তাঁকে দু’মুঠো খুদ দিতে সুদামার বড় কুন্ঠা হচ্ছিল। আর দ্বিতীয়ত, শ্রীকৃষ্ণের আপ্যায়নের আতিশয্যে সুদামার মনে একধরণের অপরাধবোধ ও হীনমন্যতা মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। আসলে শ্রীকৃষ্ণের কাছে তো তিনি এসেছেন একটা উদ্দেশ্যসিদ্ধির অভিসন্ধি নিয়ে। সাহায্যপ্রার্থী হয়ে- বন্ধুকৃত্য করতে নয়। শ্রীকৃষ্ণ যদি তাঁর বন্ধুর আগমনের প্রকৃত উদ্দেশ্যটা বুঝতে পেরে যান, তাহলে কি তাঁর উচ্ছ্বাসের জোয়ারে একটু হলেও ভাঁটা পড়বে না? এইসব মানসিক টানাপোড়েনে বিপর্যস্ত হয়ে তিনি শ্রীকৃষ্ণের জন্যে নিয়ে আসা দু’মুঠো খুদের কথা ভুলেও গিয়ে থাকতে পারেন।

যাইহোক, কাপড়ের খুঁট খুলে সুদামা শ্রীকৃষ্ণের হাতে তুলে দিলেন দু’মুঠো খুদ। আর অবাক হয়ে দেখলেন, পরম পরিতৃপ্তির সংগে সেই খুদ চিবোচ্ছেন দ্বারকেশ্বর রাজাধিরাজ শ্রীকৃষ্ণ।

বাড়ি ফেরার পথে সুদামার হঠাৎ মনে হল, এই যাঃ! আসল কথাটাই তো বলা হল না শ্রীকৃষ্ণকে! সংগে সংগে চোখের সামনে ভেসে উঠল ছেলেমেয়েদের ক্ষুধাকাতর করুণ মুখচ্ছবি। শীর্ণকায়া স্ত্রী ললিতার সতৃষ্ণ চাহনি। কী করে তিনি শূন্যহাতে বাড়ি ফিরবেন?

কিন্তু বাড়ি তাঁকে ফিরতেই হল। এবং অবাক বিস্ময়ে দেখতে হল, তাঁদের সেই কুঁড়েঘরটি আর নেই। সে জায়গায় বিশাল দালান-বাড়ি। তাঁর স্ত্রীকে তো চেনাই যাচ্ছে না। বহু মূল্যবান অলংকার ও শাড়িতে সুসজ্জিতা হয়ে হৃষ্টমনে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছেন ললিতা। ছেলেমেয়েদের গায়েও মূল্যবান জরি বসানো জমকালো পোশাক। তারা এখন চর্বচোষ্য খাচ্ছে। সুদামার আচমকাই মনে হল, তিনি না হয় শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর উদ্দেশ্যের কথা বলতে পারেননি বা বলেননি বা বলতে ভুলে গেছেন, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণও তো কই তাঁর আগমনের উদ্দেশ্যের কথা সুদামার কাছে জানতে চাননি। অবশ্য কেনই বা জানতে চাইবেন? শ্রীকৃষ্ণ তো অন্তর্যামী।

কৃষ্ণ-সুদামার প্রবাদ-প্রতিম বন্ধুত্ব এতখানি মহিমোজ্জ্বল যে, তা কিয়ৎ পরিমাণে হলেও মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ-অর্জুনের বন্ধুত্বকে ম্লান করে দিতে পেরেছে। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ-অর্জুনের বন্ধুত্বের পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে আর একটি বন্ধুত্বের উজ্জ্বলতাও মাঝে মাঝে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। তা হল- দুর্যোধন ও কর্ণের বন্ধুত্ব। দুর্যোধন ও সূর্যপুত্র কর্ণের বন্ধুত্ব এমনই প্রগাঢ় যে, এখানে রাজা ও রাজকর্মচারীর বৈষম্যমূলক ব্যবধান সহজেই ঘুচে গেছে। দুর্যোধনের রাজদরবারে কর্ণের অবাধ গতি। এমনকি, অন্দরমহলেও। কর্ণ এবং দুর্যোধন যেন একাত্মা। 

অবসর সময়ে পাশা খেলা তখানকার দিনে অত্যন্ত প্রিয় রাজকীয় বিনোদন। দুর্যোধন ও কর্ণ অবসর সময়ে পাশা খেলেই একঘেয়েমি দূর করতেন। দুর্যোধন-জায়া ভানুমতীও অক্ষক্রীড়ায় পটিয়সী। প্রতিদিন রাতে দুর্যোধন ও ভানুমতীর শয়নকক্ষের সংলগ্ন একটা ঘরে বসত পাশা খেলার আসর। বাইরের লোকের সেখানে প্রবেশ নিষেধ। দুর্যোধন, কর্ণ আর ভানুমতী অধিক রাত্রি পর্যন্ত পাশা খেলায় মগ্ন থাকতেন। প্রথমে দুর্যোধন ও কর্ণের মধ্যে খেলা চলত। তারপর সেই খেলায় যে জয়লাভ করবে, তার সংগে খেলতে হবে ভানুমতীকে। এইভাবে অধিক রাত অবধি চলত খেলা।

একদিন কর্ণ ও দুর্যোধনের মধ্যে পাশা খেলায় দুর্যোধন পরাস্ত হলেন। এবার অবধারিতভাবে শুরু হল কর্ণের সংগে ভানুমতীর অক্ষক্রীড়া। দুর্যোধন কিছুসময় বন্ধু ও পত্নীর খেলা বসে বসে উপভোগ করলেন। তারপর একসময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পার্শ্ববর্তী শয়নকক্ষে নিদ্রাভিলাষে উঠে গেলেন।

এদিকে কর্ণ ও দুর্যোধন-জায়া ভানুমতীর মধ্যে পাশা খেলা ক্রমে জমে উঠতে লাগল। সেইসংগে রাতও বাড়তে লাগল। ভানুমতী দান দিতে একটু বেশি সময় নিচ্ছেন। তিনি তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্না। অত সহজে তিনি তাঁর স্বামীর মতন কর্ণের কাছে হার মেনে নেবেন না। তাই বেশ ভেবেচিন্তে দান দিতে হচ্ছে তাঁকে। কিন্তু বন্ধুপত্নীর এই অহেতুক বিলম্ব কর্ণকে অধীর করে তুলছে। রাত পোহাতেও আর খুব বেশি দেরি নেই। কর্ণ তাই বন্ধুপত্নী ভানুমতীকে মাঝে মাঝে তাড়াও দিচ্ছেন তাড়াতাড়ি দান দেবার জন্যে। কারণ, কর্ণ চাইছেন অচিরে খেলার সমাপ্তি ঘটাতে। তিনিও পরিশ্রান্ত এবং তন্দ্রাহত। তাছাড়া সূর্যোদয়ের পূর্বেই তাঁকে শয্যাত্যাগ করতে হয়। তারপর তিনি যথারীতি স্নান করেন। এবং সেই সংগে সূর্যস্তব। সব জেনেশুনেও ভানুমতী কেমন অবিচল বসে আছেন! এক একটা দান দিতে প্রয়োজনাতিরিক্ত সময় নিচ্ছেন। 

আর পারলেন না কর্ণ। মানসিক অস্থিরতায় বিভ্রান্ত হয়ে তিনি ভানুমতীর হাত ধরে সজোরে নাড়া দিয়ে বললেন, ‘কী হল? দান দিন! বড্ড বেশি সময় নিচ্ছেন আপনি!’

আর ঠিক সেই মুহূর্তে শয়নকক্ষ-সংলগ্ন দরজার ফ্রেমে যেন হঠাৎ উদয় হলেন দুর্যোধন। তিনি স্বচক্ষে দেখলেন, রাজমহিষী ভানুমতীর হাত ধরে কর্ণ ঝাঁকানি দিচ্ছেন। এতক্ষণ তিনি পাশের শয়নকক্ষে ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎ তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। এবং বুঝতে পারেন, তাঁর পাশে ভানুমতীর শয্যা এখনও শূন্য। তাহলে কি এখনও খেলা চলছে? এত রাত অবধি? কৌতূহলী দুর্যোধন শয্যাত্যাগ করে পুনরায় পাশের খেলার ঘরে ঢুকতে গিয়েই চাক্ষুষ করলেন সেই অনভিপ্রেত দৃশ্য।

ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন কর্ণ। আত্মগ্লানিতে ভরা তাঁর মন। তবু তিনি দুর্যোধনের সামনে গিয়ে অপরাধীর ভঙ্গীতে বললেন, ‘আমাকে তুমি রাজ-বিধান অনুযায়ী দন্ড দান কর বন্ধু। আমার শিরশ্ছেদ করে রাজধর্ম পালন কর।’ 

দুর্যোধন বললেন, ‘তুমি আমার পত্নীর অঙ্গস্পর্শ করেছ- এই অপরাধে?’

কর্ণ বললেন, ‘ভানুমতী তোমার পত্নীই শুধু নন বন্ধু। তিনি রাজমহিষী। আর আমি কিনা…’

স্মিতহাস্যে দুর্যোধন বললেন, ‘তাতে কিছু এসে যায় না বন্ধু। তুমি রাজমহিষীর দেহস্পর্শ করেছ ঠিকই, কিন্তু কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে নয়। অতএব মিছেই তুমি নিজেকে ধিক্কৃত করছ। দেহের আবার শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা বলে কিছু আছে নাকি? দেহ তো নশ্বর! মনের পবিত্রতাই হল আসল শুদ্ধতা। কারণ মন বা আত্মা অবিনশ্বর। অসৎ বা অশুদ্ধ মন নিয়ে তো আর তুমি ভানুমতীকে স্পর্শ করনি। তা্হলে তা অধর্ম হত। আর সেই অধর্মের ছায়া পড়ত তোমার চোখেমুখে।’

দুর্যোধনের সান্ত্বনাবাক্যে কিছুটা আশ্বস্ত ও গ্লানিমুক্ত হলেন কর্ণ। এবং পুরোপুরি গ্লানিমুক্ত হলেন তখন, যখন ভানুমতী নিজেই বললেন, ‘ভুলে যেও না কর্ণ, তুমি কেবল রাজা দুর্যোধনের নও- আমারও বন্ধু।’

স্বীকার করতেই হবে, দুর্যোধন ও কর্ণের বন্ধুত্ব খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে কোনোরকমে বেঁচে গিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে গেল। দুর্যোধনের উদারতা, যুক্তিবাদিতা ও সহিষ্ণুতা কর্ণের সংগে তাঁর বন্ধুত্বকে প্রায় অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল। এখনকার দিনে এরকম হলে কী হত বলা যায় না। আমাদের যুগের দুর্যোধনরা অত যুক্তি-ধৈর্যের ধার ধারেন না। ঘটনাকে তলিয়ে দেখার অভ্যাসও তাঁদের নেই। সুতরাং তাঁরা যদি দেখেন, গভীররাতে তাঁরই বাড়িতে বসে তাঁরই স্ত্রীর হাত ধরে টানাটানি করছে তাঁর বন্ধু- তাহলে এযুগের দুর্যোধনরা তৎক্ষণাৎ কর্ণদের ওপর স্টেনগান চালিয়ে স্রেফ লাশ বানিয়ে দেবেন। কর্ণকে আর ‘আমার শিরশ্ছেদ কর বন্ধু’ বলার সুযোগটুকুও দেবেন না। অবশ্য এ-যুগে কর্ণের মতো আদর্শনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত বন্ধু পাওয়াও দুষ্কর। সেদিকটাও ভেবে দেখতে হবে। শেষকালে দুর্যোধনের মতো বেশি উদারতা ও সহিষ্ণুতা দেখাতে গিয়ে দেখা যাবে, এ-যুগের কণর্রা দুর্যোধনকে বোকা বানিয়ে ভানুমতীকে নিয়ে ভেগে পড়েছে। সুতরাং যা হচ্ছে হোক। যে যুগের যা!

তবে এটা প্রমাণিত সত্য যে, দুই পুরুষবন্ধুর মধ্যে একজন নারীর যে-কোনো ধরণের উপস্থিতি তাদের বন্ধুত্বকে চিরতরে বিনষ্ট করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। প্রেমের এই ত্রিকোণ সমস্যা কত সফল বন্ধুত্বকে অঙ্কুরে বিনাশ করে ফেলেছে, কে তার হিসেব রাখে! এইধরণের ঘটনা অবলম্বন করে একসময় বহু গল্প-উপন্যাসও রচিত হয়ে্ছে। এবং সমৃদ্ধ হয়েছে সাহিত্য। এবং সেইসব দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পর্যুদস্ত মানসিকতার বিশ্লেষণ-সমৃদ্ধ ত্রিকোণ প্রেমের রসালো কাহিনীগুলি এককালে যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও লাভ করেছিল। যেমন, রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ বা শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’। অথবা সাম্প্রতিককালের ঔপন্যাসিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘সূর্যসাক্ষী’। এছাড়া খ্যাত-অখ্যাত বহু লেখকের লেখার উপজীব্য হিসেবে এসেছে ত্রিকোণ প্রেমের মুখরোচক কাহিনী। সিনেমা-থিয়েটারেও এই ধরণের কাহিনী নিয়ে ছবি ও নাটক বছরের পর বছর সগৌরবে চলেছে। বন্ধুত্ব ও ত্রিকোণ প্রেমের সমস্যা নিয়ে রূপালী পর্দায় সর্বাপেক্ষা সফল ও সার্থক চলচ্চিত্রায়ন, আমার মতে, রাজকাপুরের ‘সঙ্গম’। তবে মনে রাখতে হবে, ত্রিকোণ প্রেম যেমন দুটি পুরুষ ও একটি নারীর ক্ষেত্রে ঘটতে পারে, তেমনি দুটি নারী ও একটি পুরুষের ক্ষেত্রেও ঘটা সম্ভব।

এবার রামায়ণের কথায় আসা যাক। রামায়ণে সার্থক বা আদর্শ বন্ধুত্ব সম্পর্কে শুধু একটি কথাই বলা যেতে পারে যে, তা তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। আস্থাজনক তো নয়ই। রামায়ণের প্রধান চরিত্র রাম যতই মহাপুরুষ হোন না কেন, আদর্শ হিন্দু হিসেবে তিনি একেবারে অপাঙক্তেয়। কারণ, রামায়ণের ঘটনাপ্রবাহে যত চরিত্র এসেছে তাদের মধ্যে রামের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে কাউকেই চিহ্নিত করা যাবে না। রাম নিজেও কারোও বন্ধু হিসেবে সার্থক হতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।

বনবাসকালে গুহকের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব স্বার্থজড়িত। একথা সবারই জানা। আবার বানররাজ সুগ্রীবের সাথে তাঁর যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, তা-ও স্বার্থকেন্দ্রিকতার ঊর্ধে নয়। তিনি ভালভাবেই জানতেন, সুগ্রীবের সাথে বন্ধুত্ব না পাতালে বানরসেনার সাহায্য পাওয়া যাবে না। আর একথা কে না জানে যে, বানরসেনার সাহায্য ব্যতিরেকে বিশাল সমুদ্রে সেতুরচনা করে লঙ্কায় গিয়ে সীতা উদ্ধার কদাচ সম্ভব হত না। কার্যসিদ্ধির জন্যেই এ বন্ধুত্ব- একথা একেবারে জলের মতো পরিস্কার। এরকম বন্ধুত্ব কতখানি প্রগাঢ় তা জানি না, তবে এর না আছে মহিমা, না আছে কোনোও গরিমা। আগেই তো বলা হয়েছে, উদ্দেশ্যভিত্তিক বন্ধুত্ব অত্যন্ত নিকৃষ্টমানের। রামের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।

পরিশেষে একটাই কথা, বন্ধুত্ব এমন কিছু সহজলভ্য নয় যে, হাত বাড়ালেই বন্ধু এসে ধরা দেবে। প্রকৃত বন্ধু-নির্বাচনটাই বড় কথা। নির্বাচন করার মতন ক্ষমতা বা যোগ্যতাও থাকা চাই অবশ্য। যোগ্য বন্ধু পেতে হলে নিজেকেও সেইমতো উপযুক্ত করে তুলতে হবেই। নচেৎ কিছু স্বার্থান্বেষী মতলববাজ বন্ধু দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকার চেয়ে নির্বান্ধব জীবন কাটানো ঢের ভাল!

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments