জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৫৩/ শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৫৩
শ্যামল জানা

সাররিয়েলিজম্-এর স্বর্ণযুগ

১৯২৮ সালে আন্দ্রে ব্রেতোঁ শুধুমাত্র চিত্রশিল্পের জন্য আংশিক ম্যানিফেস্টো— ‘সাররিয়েলিজম্ অ্যান্ড পেন্টিং’ প্রকাশ করার পর অফিসিয়ালি সাররিয়েলিস্ট পেন্টারদের চিহ্নিতকরণ(Identification)করা হল৷ তার পরে পরেই ১৯৩০ সাল থেকে, বলা যায় সারা বছর ধরেই লাগাতার, সাররিয়েলিস্ট পেন্টিংকে ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা হয়েছিল৷ লন্ডনে তৈরি হল ‘ব্রিটিশ সাররিয়েলিস্ট গ্রুপ’৷ এই গ্রুপ ব্রেতোঁ-র ভাবনা অনুযায়ী ১৯৩৬ সালে ১১ জুন থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত বেশ বড় আকারে আয়োজন করল ‘লন্ডন ইন্টারন্যাশানাল সাররিয়েলিস্ট এগজিবিশন’৷ প্রচণ্ড সফল হল এই প্রদর্শনী বা উদ্যোগ৷ সেই সময়ে মানুষের মনে সাংঘাতিক দাগ কেটেছিল এই প্রদর্শনী৷ শুধু তাইই নয়, অন্তর্জাতিক প্রদর্শনী(International exhibitions)কী রকম হওয়া উচিত, তার মডেল হিসেবে বিবেচিত হল এই প্রদর্শনী৷

ইতিমধ্যে ‘ইংলিশ সাররিয়েলিস্ট গ্রুপ’ নামে আরও একটি দল গড়ে উঠল বার্মিংহাম-এ৷ এরা কিন্তু ‘লন্ডন সাররিয়েলিস্ট’-গ্রুপের বিরোধীপক্ষ হিসেবে নিজেদের স্বতন্ত্র রাখল, এবং ফরাসি সাররিয়েলিস্টদের পক্ষে থাকল এবং তাদেরই অগ্রাধিকার দিল৷ যদিও এই বিরোধিতা বেশিদিন থাকেনি৷ এক দশকের মধ্যেই এদের মিলন ঘটেছিল৷

এই সাররিয়েলিস্ট আন্দোলনে সালভাদোর দালি ও রেনে ম্যাগরিত্তে— এই দুজনের ছবি সবচেয়ে বেশি, বলা যায়, ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল৷ সাররিয়েলিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে সালভাদোর দালি যুক্ত হয়েছিলেন ১৯২৯ সালে৷ এই অংশগ্রহণের পর থেকেই, তাঁর যে ভিসুয়াল স্টাইল, তা অতি দ্রুত প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছিল বছর পাঁচেকের মধ্যেই(১৯৩০-১৯৩৫)৷

সাররিয়েলিজম্ এমনই এক আন্দোলন, যার মধ্যে শিল্পের প্রায় সব মাধ্যমই যুক্ত হয়েছিল, এবং ওই প্রতিটি মাধ্যমই আবার তার নিজস্ব ভাষা বা পদ্ধতি তৈরি করেছিল৷ সাররিয়েলিজম্ দৃশ্যশিল্প-মাধ্যম হিসেবে যে পদ্ধতিটি মূলত তৈরি করেছিল, সেটি হচ্ছে— মনস্তাত্ত্বিক সত্যকে উদ্ঘাটন করা৷ অর্থাৎ, সাধারণ অর্থ বহন করে, এ রকম সাদামাট বিষয় বা উদ্দেশ্যকে নগ্ন করে, তার ভেতর থেকে, মাটি খুঁড়ে বের করে আনার মতো, দৃশ্যকে বের করে আনতে হবে৷ যে দৃশ্য, সাধারণভাবে যে সব প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বা প্রতিষ্ঠান আছে, সেই গতানুগতিকতাকে অবশ্যই অতিক্রম করবে৷

  ১৯৩১ সালটি এ কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ, এই বছরে বিভিন্ন সাররিয়েলিস্টিক পেন্টাররা এমন কিছু পেন্টিং-এর জন্ম দিয়েছিলেন, যেগুলির রচনাশৈলীর বিবর্তন(Stylistic evolution)সন্ধিক্ষণ(Turning points)হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই ‘রেনে ম্যাগরিত্তে’-র ছবি ‘ভয়েস অফ স্পেস’ ছবিটির কথা চলে আসবে(ছবি-১)৷ 


নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এর অভিনবত্ব! স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে— ছবির ধারণাটি সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক৷ অনুভব থেকে সৃষ্ট৷ দেখলে আরও স্পষ্ট হবে বিষয়টি৷ তিনটি বিশালাকার গোলক৷ যেন তিনটি বিশাল গোল ঘন্টা, সুতো বা দড়ি ছাড়াই শূন্যে ঝুলে আছে৷ যেন ওদের থেকে যে শব্দ বেরোবে, সেটি প্রকৃতির এই বিশাল ফাঁকা শূন্যতার কণ্ঠস্বর! ওই একই বছরে শিল্পী ‘ইভেস ট্যাঙ্গে’ একটি বিশুদ্ধ সাররিয়েল ছবি আঁকলেন— ‘প্রোমোন্টোরি প্যালেস’৷ আমরা যদি এর বাংলা মানে করি, তাহলে বলতে হবে— শিলাখণ্ডে তৈরি যে সৈকতের অংশ সরু হয়ে সমুদ্রে এসে পড়েছে, তার ওপরে গড়া প্রাসাদ৷ এক কথায় শিলা-অন্তরীক্ষে প্রাসাদ(ছবি-২)৷

 নামটি শোনার পর সাধারণত আমরা মানসিকভাবে কঠিন কিছু ভেবে নেব যেহেতু অন্তরীক্ষটি শিলা দ্বারা গঠিত৷ কিন্তু শিল্পী ঠিক উল্টোটা করলেন৷ তিনি ছবিতে এর গঠন এমনভাবে করলেন, যেন অত্যন্ত কঠিন কিছুকে অন্য কোনো শক্তির সাহায্যে নরম করা হয়েছে৷ লোহাকে গনগনে আগুনে পোড়ালে যেমন গলে গিয়ে মাখা ময়দার মতো নরম হয়ে যায়, ঠিক সে রকম৷ যদিও শক্ত বস্তুকে গলিয়ে নরম করে ছবিতে ব্যবহার করা, শিল্পী সালভাদোর দালি-র ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে৷ বিশেষ করে তাঁর ‘পারসিসটেন্স অফ মেমরি’ ছবিটি এক্ষেত্রে সবচেয় প্রযোজ্য(এই লেখার শুরুতে যে ছবিটি আছে)৷যেন ঘড়িগুলি গলে নরম হয়ে ঝুলে পড়েছে৷ আর অদ্ভুতভাবে ‘প্রোমোন্টোরি প্যালেস’ ও ‘পারসিসটেন্স অফ মেমরি’— এই দুটি ছবিই একই বছরে আঁকা, ১৯৩১ সালে৷ তবুও ইতিহাসে ‘প্রোমোন্টোরি প্যালেস’-কেই সাররিয়েলিজম্-এর সূত্রপাতের ক্ষেত্রে আগে রাখা হয়৷

এই রকম কয়েকজন শিল্পীদের পরিক্রমার পর সাররিয়েলিজম্ ছবির বৈশিষ্ট কী হবে, তা নির্দিষ্ট করা হল৷ বলা হল, তিনিটি বিষয়ের সমাহার থাকতে হবে৷ এক- ছবি হবে ফোটোগ্রাফিক ডিটেইল-এর সাহায্যে আঁকা৷ দুই- ফোটোগ্রাফিক ডিটেইল হলেও তার সঙ্গে হুবহু বাস্তবের মিল থাকবে না, গঠন হিসেবে হবে বিমূর্ত৷ তিন- কারণ, বাস্তবের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিকতা যুক্ত হচ্ছে বলে৷ বিশেষ করে অবচেতন মন এর কারিগর৷ স্বপ্নের মধ্যে এই অবচেতন মন আমাদের চেতন অবস্থায় বাস্তবে দেখা দৃশ্যগুলিকে জগাখিচুড়ি করে দেয়৷ পরম্পরাহীনভাবে দৃশ্যগুলি এ ওর ঘাড়ে চেপে যায়৷ এই দৃশ্যের চরিত্র ওই দৃশ্যের সাথে পাল্টাপাল্টি হয়ে যায়, বা জাক্সটাপজিশন হয়ে যায়৷ ফলে, শেষ পর্যন্ত ফলাফল হয় বিমূর্ত৷ এক কথায় আমরা বলতে পারি— Photographic depiction + Abstraction + Psychological.৷ সবটা মিলিয়ে প্রথম অবস্থাতে অধিকাংশ মানুষের বোধগম্যতায় বিষয়টি কুলালো না! তাঁদের মনে হল যেন উন্মত্ততার রূপ৷ আবার, মেনেও নিল আধুনিক যুগের শিল্প হিসেবে৷ আত্মার অত্যন্ত গভীরে পৌঁছাতে গেলে যে একাধিক অনুভূতির মিলিত শক্তি লাগে, তা তাঁদের বোঝানো গেল৷ এই যে একটা ছবিতেই এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয় ঘটে, এবং ঘটায় একজনমাত্র শিল্পী৷ এ প্রসঙ্গে একটি পপুলার স্লোগান এখানে উল্লেখযোগ্য— to be "made whole with one's individuality".৷

আমরা আগে আলোচনা করেছি La Révolution surréaliste-এর কথা৷ তারই উত্তরাধিকার হিসেবে ১৯৩০ ও ১৯৩৩ সালের মাঝখানে প্যারিস-এ সাররিয়েলিস্ট গ্রুপ ফ্রেঞ্চ ভাষায় Le Surréalisme au service de la révolution নামে একটি পিরিওডিক্যাল বার করল৷



১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮-এর মধ্যে সাররিয়েলিস্ট গ্রুপের সাথে যুক্ত হলেন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীরা৷ উল্ফগ্যাঙ পালেন, গর্ডন অনস্লো ফোর্ড, এবং রোবের্তো মাট্টা৷ উল্ফগ্যাঙ পালেন সাররিয়েলিস্ট আর্ট-এ ফুমেজ(Fumage)নামে একটি নতুন টেকনিক যুক্ত করেছিলেন৷ যেখানে তিনি ক্যানভাস পেন্টিং-এর তলায় জ্বলন্ত মোমবাতি বা কেরোসিনের কুপি ধরতেন৷ তার থেকে যে কালিযুক্ত ধোঁয়া বেরত, সেই কালি পেন্টিং-এ নতুন মাত্রা যোগ করত৷ গর্ডন অনস্লো ফোর্ড-ও আর একটি কুলেজ(Coulage)নামে একটি অটোমেটিক টেকনিক আবিষ্কার করেছিলেন৷ এটি অনেকটা খেলার মতো৷ অনেকটা অটোম্যাটিজম্-এর মতো৷ যেখানে, আঁকার সময়ে অতি সতর্কভাবে সচেতনতার প্রভাবকে বাদ রাখা হত৷ ওখানে শুধুমাত্র অবচেতন মনকেই একমাত্র প্রাধান্য দেওয়া হত ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা হিসাবে৷
বেশ কিছুদিন পর, ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক এবং পেশাদারিত্বের যে চাপ বা উত্তেজনা ইত্যাদির কারণে সাররিয়েলিস্ট গ্রুপ ভাগ হয়ে গেল৷ তবুও রেনে ম্যাগরিত্তে এবং সালভাদোর দালি নতুন উদ্যমে চালিয়ে যেতে থাকলেন৷ শিল্পে নানা ভিলুয়াল প্রোগ্রাম করে সাররিয়েলিজমকে সঠিক বর্ণনার সাহায্যে তুলে ধরতে থাকলেন৷ এই প্রোগ্রাম, পেন্টিং-এর এক্তিয়ার ছাড়িয়ে, ফোটোগ্রাফ পর্যন্ত বিস্তৃত হল৷ উদাহরণ হিসেবে শিল্পী ম্যান রে-র ফোটোগ্রাফের বই ‘সেল্ফ-পোর্টেট’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য(ছবি-৩)৷ যার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রবার্ট রৌশ্চেনবার্গ কোলাজ বক্সেস নামে একটা সিরিজ(ছবি-৪) করেছিলেন৷                      (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. ৫২ এবং ৫৩ পর্ব একযোগে পড়তে হল। নানা অসুবিধার মধ্যে কাটছে।
    কিন্তু এই লেখাটির ভিতরে প্রবেশ
    করতে হলে শুধু সময় নয়, একটা
    গভীর টান থাকা দরকার। উন্মুখ হয়ে থাকতে হয় এর রসাস্বাদনের
    আগ্রহ নিয়ে। অসাধারণ এগোচ্ছে।
    যে কঠিন কাজে ব্রতী হয়ে আছ,
    তার সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করি।
    শুভেচ্ছা থাকল।

    ReplyDelete