জ্বলদর্চি

করোনাকালের অর্থ ও নীতি/সন্দীপ দত্ত

করোনাকালের অর্থ ও নীতি
সন্দীপ দত্ত


লকডাউন দীর্ঘমেয়াদি হলেই কি সংক্রমণ রোধ করা যায়? প্রশ্নটা তোলার সময় এসে গেছে। এসে গেছে, কারণ করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা আর মৃতের সংখ্যার হিসেব ভারতকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিশ্বের প্রথম দশটি দেশের মধ্যে। যা লজ্জার। যা আতঙ্কের।

     আবার করোনাকে শিখন্ডী করে অর্থনীতির কোমর ভেঙে দেওয়াটাও খুব বেশি বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এই কঠিন সময়ে কঠিন কোনও পদক্ষেপ,যা আপামর সমস্ত দেশবাসীকে সুস্থ থাকার রসদ জোগাতে পারে,তা নেওয়াটাও ভীষণভাবে জরুরি। লকডাউন নামক এই গৃহবন্দি প্রক্রিয়াটির বয়স যখন অনেকগুলো মাসের ধারেকাছে গিয়ে দাঁড়ায়,তখন প্রক্রিয়াটির সঙ্গে ঘর করবার মানসিকতা দেশবাসীর হয়ে গিয়েছে,এটা ধরেই নেওয়া হয়। তাই লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধিতে খুব বেশি আপত্তি থাকবার কথাও নয়। এ যেন অনেকটা জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে সহবাস করবার অভ্যেসের মতোন। হাতে যখন অস্ত্র আছে,সুতরাং কুমিরকে ভয় কী?

     কিন্তু 'অস্ত্র' নামক অর্থ কি দেশের সবার হাতেই থাকে? যাদের থাকে না,তাদের অবস্থাটা কীরকম হয়? আনাড়িভাবে সাঁতার কাটতে কাটতে তারা কতদিন 'কুমির' নামক অভাবের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারবে?

     অতিমারির কবলে এ দেশ আগেও পড়েছে। একের পর এক বিশাল দানবের মতো হাঁ করে দাঁড়িয়েছে মন্বন্তর। দুর্ভিক্ষের ঝড়ে উড়ে গিয়েছে মানুষের পুষ্টি। লীন হয়ে গেছে কত শত প্রাণ। দেশের অর্থনীতির সেদিনও কোমর ভেঙে গিয়েছিল। কঠিন সে সময় থেকে তবুও কি এতটুকু  শিক্ষা নিতে পেরেছে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ? পারেনি। পারলে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অন্য খাতে বইত।

     মানুষের যখন অস্থি সংকট হয়,তাকে সার্পোট দেওয়ার জন্য যেমন লাঠির দরকার,আজ দেশের অর্থনীতির অস্তিত্ব সংকটের সময় সে লাঠির প্রয়োজন পড়বে না কেন?

     লকডাউনের প্রভাব ধনকুবেরদের ওপর কতখানি পড়ে? 'অভাব' শব্দটার সাথে ওরা আদৌ কি পরিচিত? হিসেব করা হয়নি। ও হিসেব নাকি করতে নেই। হিসেব করতে হয় শুধু কোন্ কোন্ এলাকা আরও নতুন করে গন্ডিবদ্ধ হল। হিসেব করতে হয় রাজনীতিকে মানবতার মুখোশ পরিয়ে ত্রাণ নিয়ে কোথায় কারা কতখানি এগিয়ে যাচ্ছে। রঙিন দলের দাদাদের কাছে এখন ওটাই তো শেষ তুরুপের তাস। যে দেখাতে পারবে,জয় তারই। যেন অঘোষিত ভোট হয়ে যাচ্ছে এখানে ওখানে।

     বিশেষজ্ঞদের মতে,লকডাউন কখনই দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে না। হলে তা অযৌক্তিক। লকডাউন হতে পারে বারো থেকে চোদ্দ দিনের। এই চোদ্দ দিনের মধ্যেই সংক্রামিত এলাকাগুলোকে চিহ্নিতকরণ করে উপযুক্তভাবে তার ব্যবস্থা নিতে হয়। লকডাউন বাড়লে দেশের অর্থনীতির শক্তি কমে যায়। এভাবে চললেদ্রুত শক্তিক্ষয়ের ফলে উল্টে যাবে অতিমারির পরিসংখ্যান। করোনার চেয়ে ঢের বেশি মৃত্যু  বাড়বে অনাহারে,কাজ হারানোর অবসাদে আর হতাশায়। ইতিমধ্যে যা শুরু হয়ে গেছে। গত দেড় বছরে ভারতে বেকারত্বের হার বেড়েছে অনেক। মিডিয়া তো রাজনৈতিক দলদের হাতের পুতুল। সঠিক পরিসংখ্যান মানুষের কাছে তাই অধরা।

     গরিবদের ঋণ দেওয়ার মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই। কী দরকার চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ বাড়িয়ে তাদের অতি সাধারণ জীবনগুলোকে নতুন এক বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়ার? বরং নগদ টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক তাদের। ভোটের রাজনীতিতে যদি ধনী গরিবের প্রেরিত ভোটের ভেদ না থাকে,জীবনের দামের হিসেব করতে গিয়ে গরিবেরা দিনের পর দিন দারিদ্র‍্য সীমার নিচের দিকে নেমে যাবে কেন?

     বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী ২০০০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চিনে বিনিয়োগের হার বেড়েছিল ৪২ শতাংশের মতো। অর্থাৎ প্রায় কুড়ি বছরে  ১০ শতাংশের মতো। সেখানে আমাদের দেশে বেড়েছে ২৬ থেকে ২৯,মাত্র ৩ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক আয়বৃদ্ধি গত দশ বছরে ভারতীয় আয়ের চেয়ে খুব বেশি নয়। পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু আয় বর্তমানে অনেক রাজ্যের চেয়েই কম। পশ্চিমবঙ্গের একটা সমস্যা,এখানকার বেশি শিক্ষিত, বেশি মেধাবী,বেশি দক্ষ ছেলেমেয়েদের এখানে না থাকা। আজকাল মুম্বই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, পুণেতে গেলে সহজেই চাকরি পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে চাকরি কোথায়?

      উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা বাদে বাকি বিশ্বের প্রায় পুরোটাই করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। আবার দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনের প্রহর গুনছে মানুষ। আবার হাজার হাজার মানুষের কাজ হারাবার হিড়িক শুরু হবে। আবার অবসাদে আত্মহত্যার পরিসংখ্যান লুকোবে মিডিয়া। আর ধনকুবেররা তাদের সম্পদ বাড়িয়েই যাবে। খেয়াল রাখতে হবে,এমন হলে সবটাই হবে প্রহসন। সবটাই বিত্তপ্রভেদকে আরও স্পষ্ট করবার এক বিশেষ কৌশল হয়ে থাকবে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments