এই যে আলোর আকুলতা
আবীর ভট্টাচার্য
(পঞ্চম অধ্যায়)
দিনের প্রতিটি ক্ষণেরই এক অতুলনীয় বৈভবসুখ থাকে। সকালটি যদি হয় অরুন-আলোর, সন্ধ্যাটি বৈরাগীর। সারাদিনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ দায়ভার কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে, পাখিডানায় ভর করে সন্ধ্যা নামে তুলসীতলায়, মাটির প্রদীপের আলোছায়ায়; গোধুলির বিষন্নতায়,এক বীতশোক অনুভবে।
সারাদিনের হুটোপাটির পরে, গাড়ি যখন জাহের থান পেরিয়ে বনবাংলোয় পৌঁছলো, সন্ধ্যা এভাবেই নামছিলো মন্দ-মন্হরে। এক ছোট্ট টিলার ওপরে, গাছগাছালি ঘেরা, যেন স্বপ্নে-দেখা ব্রিটিশ আমলের কোন এক কাঁচঘেরা গোল বাংলো বাড়িতে রাত্রিবাস, সন্ধ্যে নামে এখানে অবিচ্ছিন্ন ঝিঁঝিঁ আর চাকদোয়েলের ঘরে ফেরার শীষে।
নাগরিক জীবন থেকে বহুদূরে; স্বাভাবিক ভাবেই বিদ্যুৎ নেই, যদিও জেনারেটরের ব্যবস্থা আছে, তাও রাত্রি সাতটার পরে জঙ্গলের শান্তিভঙ্গের জন্য চালাবার হুকুম নেই। তাতে অবশ্য এই নাগরিক দলের কোন সমস্যা নেই, প্রথমতঃ সন্ধ্যার পর থেকে জঙ্গলে এসময় বেশ মনোরম আবহাওয়া ; আর তাঁরা তো চান অনাঘ্রাতা প্রকৃতির রূপখানি প্রাণভরে আত্মস্হ করতে! তাই দেরী না করে, কেয়ারটেকারকে রাতের খাওয়ার ও সন্ধ্যেয় চা-স্ন্যাক্সের কথা বলে যে যার ঘরে ফ্রেস হতে গেলেন।
এদিকে বাইরে তখন শালবনের মাথায় উঁকি দিচ্ছে তরুণ চাঁদের আলো, পুর্নিমা বেশ কয়েকদিন পরে; তবু মেঘভারহীন শারদরাতের তারাভরা আকাশে জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্রমন্ডলী, নীচের বুনোঝোপের নয়নতারাদলও যেন পাপড়ি মেলেছে ,অনাগত জোছনা প্রতীক্ষায়। বাংলোর বাইরের লনে বেতের ডেকচেয়ারগুলি বার করে সবাই একে একে এসে বসলেন। চা এলো, সঙ্গে মুচমুচে ঝালঝাল পকৌড়া। রাতের জন্য মোরগ পাওয়া গেছে,সে খবরও এলো; সঙ্গে ভাত না রুটি জিজ্ঞেস করতে এলো একটি দোহারা চেহারার শ্যামলা আদিবাসী তরুণী,নাম বললো ফুলমতিয়া, সঙ্গে এক শক্তপোক্ত তরুণ,সে করলে নামিয়ে নমস্কার জানিয়ে বললো, তার নাম সুরজ। বাংলোয় সে বাগান দেখে,আর কেউ এলে সে আর ফুলমতিয়া রান্না করতে আসে।
হাস্যময়ী ফুলমতিয়ার দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে অরূপ বলে উঠলেন, -'দন্তরুচিকৌমুদী'....
সবাই হেসে উঠলো,মেয়েটিও হাসলো,সরল সুন্দর হাসি,হয়তো না বুঝেই। কালো টোল পড়া গালে, সুন্দর সাদা দাঁতগুলিতে সে হাসি যেন ঘনমেঘে বিদ্যুৎ চন্দ্রপ্রভার ছটা ছড়িয়ে গেল। দোলা এগিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে বললেন,
-রান্না পরে হবে, তোমাদের ঐ জাহেরথানের গল্প বলো না গো!'
মেয়েটির সঙ্গী-পুরুষটি বলে ওঠলো,
-ফুলমতিয়া তো আপনাদের ভাষা জানেনা, আমি বরং বলছি, ও রান্নাটা সেরে ফেলুক,বাড়ি ফিরতে হবে আমাদের।
মেয়েটি হাসিমুখে ঘাড় নেড়ে চলে গেল, সুস্বাদু পকৌড়া আর চায়ে চুমুক দিতে দিতে নাগরিক মানুষজন শুনতে লাগলেন, প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য সেই প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের সাধনা, কখনও দেবতার অনুসঙ্গে, কখনও ভৈরব-ভৈরবীর গল্প বলে, কখনও বা অপদেবতার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে; ভয়,ভক্তি,ভালোবাসায় অরণ্যবাসী মানুষ প্রকৃতির গাছ-পাথর-নদীজলে দেবত্ব আরোপ করেছে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্যাগানিজ্ম্ আজও তথাকথিত সভ্যতার প্রান্তিক মানুষের আপন সুরক্ষা ও প্রকৃতির রক্ষায় ব্যবহার করা হয়।
ছেলেটির গল্পে জাহেরথানের সঙ্গে উঠে এলো-
পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খন্ডের সীমায় অবস্হিত কানাইসর পাহাড়ের গল্পও ; ভুমিতল থেকে তার উচ্চতা প্রায় সাতশো ফুট,গাড়রাসিনির থেকে দুরত্ব মাত্র দশ কিলোমিটার। এই কানাইসর পাহাড় নাকি আদিবাসীদের দেবতাপাহাড়,আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবার এখানে মোরগবলি দিয়ে পুজো হয়, পাহাড় চূড়ায় এখনও রয়ে গেছে প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, তবে আজ সেখানে ওঠার পথ বন্ধ। শহুরে মানুষেরা ভাবলেন, হয়তো বন্যজন্তুর ভয়, হয়তো খাড়াপাহাড়ের অগম্যতা, তবে ঐ এলাকায় জনশ্রুতি, পাহাড়-পূজা শেষে আর সেই বছরের মতো কখনোই পূজাবেদী দর্শনের অনুমতি নেই ব্রতীর; একমনে ফিরে আসতে হয়, কিন্তু কোন একজন(পাহান) বলি দেওয়ার পরে ভুলে ওখানেই খড়্গ ফেলে চলে আসায়, আবার তা আনতে যান, পাহাড় দেবতা তখন নাকি বাঘেদের সাথে বলির মাংস খাচ্ছিলেন, তিনি প্রাইভেসি নষ্ট হওয়ায় বেদম রাগান্বিত হয়ে খড়্গ ছুঁড়ে মারেন,চিরদিনের জন্য ফিরে যেতে বলেন,আর কখনও ফিরে এলে মৃত্যুর নিদান দেন।
সেই থেকে পূজা হয় পুর্বদিকে, পাহাড়ে ওঠার মধ্যবর্তী স্হানে, সেখানেও একটা প্রায় দেড়শো ফুট লম্বা, আশিফুট চওড়া একখন্ড বিরাট পাথর আশ্চর্যজনকভাবে ঢালু পাহাড়ে নাকি আটকে আছে, তারমধ্যে একটি গর্ত আছে, এলাকাবাসীর বিশ্বাস, পূজা শেষে ঐ গর্তের ওপরে ফুল দিয়ে ব্রতী অপেক্ষা করেন,ফুল তাঁর হাতে ফিরে আসা অবধি; মনস্কামনা পূর্ণ হবে তবে।
গল্প শুনতে শুনতে এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন সবাই, বুঝতেও পারেননি রাত গভীর হতে চলেছে; টনক নড়লো ফুলমতিয়ার ডাকে,
-রান্না শেষ,ও এবার ফিরে যাবে গ্রামে,ডাকতে এসেছে সঙ্গীকে।
এদিকে শালবনের পাতায় পাতায় আধোজোছনা আলো কোন এক মায়াচন্দ্রালোকে পৌঁছে দিয়েছে সবাইকে, দূর থেকে ভেসে আসছে মাদলের বোল। নাম না জানা কোন এক বুনো ফুলের তীব্র সুগন্ধে, বনচরা রাতজাগা পাখির মন্দ্রডাকে, কেমন যেন এক অতীন্দ্রিয় পরিবেশ; হঠাৎ অরূপ প্রস্তাব দিয়ে বসলেন,
-তোমাদের গ্রাম কতদূর গো?মাদল কি ওখানেই বাজছে?
-হ্যঁ গো বাবু।
-নিয়ে যাবে আমাদের?
ওদের সম্মতিসূচক হাসিই বলে দিচ্ছিলো,এমন প্রস্তাবের সঙ্গে ওদের পরিচিতি আছে, এখানে যাঁরা আসেন রাত্রিবাস করতে,তাঁরা অনেকেই যান ওদের গ্রামে,নাচ দেখতে।ওরাই নিয়ে যায়,ফিরিয়েও দিয়ে যায়। এনারাও সেভাবেই যাবেন কথা হোল, বাংলোর কেয়ারটেকারের কাছে পাঁচব্যাটারীর বড়ো টর্চ নিয়ে, প্রায় আধাঘণ্টা গহন বনমধ্যে হেঁটে নাগরিকদল পৌঁছলেন গ্রামের প্রান্তে, একধারে জড়ো করে রাখা কাঠকুটো জ্বালিয়ে তার চারিধারে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে ধামসা-মাদলসহ নারীপুরুষের নাচ, ফুলমতিয়ার আহ্বানে মেয়েরা যোগ দিলেন তায়, যদিও মধ্যবয়সিনীদের সাধ্য হলো না বেশীক্ষন সেই তুমুলছন্দে পা মেলানোর,একটু পরেই ঘেমে,হাঁপিয়ে রণে ভঙ্গ দিলেন। ছেলেদের ইচ্ছে ছিলো স্হানীয় 'হাঁড়িয়া'-য় সামান্য চুমুক দেওয়ার, কিন্তু মধ্যবয়সী পুরুষেরা অত্যন্ত পত্নীনিষ্ঠ, যে যার গিন্নীর রোষায়িত চক্ষু কল্পনা করে সে সুখে বিরত থাকলেন। খানিক বাদে ফিরে এলেন; মনে জমে রইলো একখানা জন্মপারের স্বপ্নযাত্রার মতো ক্ষণিক সুখের মুহূর্তধন; কখনও কোনদিন; অন্য কোনো জন্মে ওনারাও কি এমনই নাচ নেচেছিলেন প্রিয়সঙ্গে, দিনান্তের ক্লান্তি বিমোচনে?
হয়তো,হয়তো…
ফেরার পথে সুরজের সাথে এসেছিলো ওর আরও দুই বন্ধু, বহু অনুরোধ সত্ত্বেও কোন টাকাপয়সা দিতে পারলেন না তাঁরা,তাদের কাছে অতিথি নারায়ন।
ফিরে এসে বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না কারো, চুপচাপ খাওয়া দাওয়া সেরে যে যার ঘরে ঢুকে গেলেন।
অরণির খুব ইচ্ছে ছিলো, এই বারান্দায় বসে,পূর্ণ চাঁদের আলোয় অরূন্ধতীর গলায় একখানা গান শুনবেন, রবীন্দ্রনাথের গান; ওনার পছন্দমতোই। কিন্তু বিকেলের ঘটনার আকস্মিকতা, সন্ধ্যেয় সুরজের গল্প,তারও পরে, গ্রামে ঘুরতে যাওয়ায় আর হয়ে উঠলো না।
কতো কিছুই তো এই জীবনে পাওয়া হয়না; আবার কতো কিছু পাওয়া হয়, প্রত্যাশা ছাড়াই। এসব ভাবতে ভাবতেই বিছানায়, উত্তম শয্যা, পাশেই দেওয়াল জোড়া কাঁচের জানালা দিয়ে গড়িয়ে আসা মায়াবী চন্দ্রালোকে, ঝিঁঝিঁর একটানা সুরলহরীতে যেন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতারের সুরে বাজে কেদার। ইমনের সহজিয়া ধ্যানমগ্নতা পেরিয়ে, ছাতিমের স্মৃতি-মেদুর গন্ধে সে কেদারের মগ্ন-সুর বাজে ৷ প্রাণস্পর্শী সেই সুরে ভেসে যায় চরাচর; মানব-জীবন-চক্র-সম সুর লহরী, আরোহণে-অবরোহণে, সপ্তসুরের গ্রহণে-বর্জনে, আপনছন্দে খেলা করে।
রাত্রি ক্রমে গভীরতর রাত্রির দিকে এগিয়ে যায়, বনাঞ্চলের দীর্ঘ শালবল্লরীর কান্ডে ঢেউ তোলে বহুদূর থেকে ধেয়ে আসে শারদবাতাস; দূর থেকে যেন ভেসে আসে অমোঘ দেবব্রত কন্ঠে, মিশ্র কেদারে “সে কে বাঁশি বাজিয়েছিল কবে প্রথম সুরে তালে, প্রাণেরে ডাক দিয়েছিল সুদূর আঁধার আদিকালে” শুনতে শুনতে ঘুমের অতলে ডুবে যায় মন; আগামী প্রত্যূষের আকাঙ্খায়….
চিত্র- লেখিকা
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
1 Comments
খুব সুন্দর এগোচ্ছে
ReplyDelete