নাস্তিকের ধর্মাধর্ম ---- পর্ব-১৯
সন্দীপ কাঞ্জিলাল
ধর্ম ও মানুষ
আমরা দেখেছি যে প্রাণীজগতের প্রায় অকল্পনীয় সুদীর্ঘ বিবর্তনের পরে ত্রিশ-চল্লিশ হাজার বছর আগে যখন মানুষ প্রথম মানুষে পরিণত হল, তখন তার কোন ধর্মবোধ ছিল না। তার পরেও দীর্ঘকাল ধরে জন্ম-মৃত্যু, প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর শুভ অশুভ রূপ, অন্য মানুষের সঙ্গে শত্রু মিত্র সম্পর্ক, এবং পশুদের সঙ্গে লড়াই প্রভৃতি জাগতিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, এবং যোনিপূজো, আত্মা ও পরলোক কল্পনা, টোটেম প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে যে আদিম ধর্মভাবের জন্ম হয়েছিলো, তাকে আধুনিক অর্থে ধর্ম বলা যায় না। পশুপালন এবং কৃষি সভ্যতার উদ্ভবের পরে, আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে, মিথলজি বা কাল্পনিক অতিকথার ভিত্তিতে মিশরে এবং ব্যাবিলনে প্রাচীন ধর্ম গড়ে ওঠে। কিন্তু ধর্মগ্রন্থকে ভিত্তি করে পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম গড়ে উঠেছে আরো অনেক পরে।
আর বর্তমান কালে ব্যক্তিমানুষের জীবনে এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের গভীর প্রভাবের অন্যতম প্রধান কারণ বংশগতির সঙ্গে জন্মগত ধর্ম লাভ এবং সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ ধর্মের বিস্তার ও স্থিতিশীলতা। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে ধর্ম প্রায় সব ক্ষেত্রেই জন্মলব্ধ হলেও তার শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মত মানুষের জীবন থেকে অবিচ্ছেদ্য নয়। মানুষ ইচ্ছা করলে পরিবার ও সমাজের ধর্মের বাঁধন অস্বীকার করে ধর্মকে বর্জন করতে পারে। যেমন প্রাচীন কাল থেকেই অল্প কিছু মানুষ করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের যে সে ইচ্ছা প্রবল হয় না, এমনকি মোটেই হয় না, তার কারণ নিশ্চয়ই এই যে তাদের জাগতিক জীবনে ধর্মের প্রভাব সম্পূর্ণ নেতিবাচক নয়। অন্তত তারা নিজেরা তা মনে করে না। অর্থাৎ মানুষের বিবর্তনের বর্তমান পরিচয় পর্যায়ে সে তার বাস্তব জীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এ প্রয়োজন মানুষ কেন অনুভব করে তাই আমাদের এখানে প্রথম বিবেচ্য বিষয়।
যে জাগতিক পরিবেশ মানুষকে জাদুভিত্তিক আদিম মন্ত্র তন্ত্রের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তাতে ছিল নিরাপত্তার অভাব। অন্য মানুষের সঙ্গে শত্রু-মিত্র সম্পর্ক থেকে জানতে পেরেছিল যে মানুষকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে বা আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা যায়। আবার স্তব-স্তুতি করে, উপহার দিয়ে, তাকে মিত্র করা যায়। তাই সে মানুষ শত্রুর পুতুল (কুশপুত্তলিকা) বানিয়ে তাতে অস্ত্র ফুটিয়ে কিংবা আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে বলতো, তুই মরে যা, তুই মরে যা। অথবা তাঁকে তুষ্ট করার জন্য স্তুতি এবং ভোগ্যদ্রব্য দান করতো।
তেমনি ভাবে পশু শিকার কিংবা পশুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে সে গুহার দেওয়ালে অস্ত্রবিদ্ধ পশুর স্থুল ছবি এঁকে মন্ত্র বলতো, তুই মরে যা, তুই মরে যা। অথবা সাপ, বাঘ, সিংহ প্রভৃতি হিংস্র পশুকে পুজো দিয়ে মন্ত্র বলতো, তুই আমাকে মারিস না, আমি তোর স্তুতি করছি, এতসব খাবার তোকে দিচ্ছি। চোরকে ধরতে না পেরে ইচ্ছাপূরণের জাদুমন্ত্র বলতো, তুই থেমে যা, তুই থেমে যা। ইপ্সিত স্ত্রীলোক বা পুরুষকে বশীভূত করবার নানা তুকতাক মন্ত্র-তন্ত্র করতো। এ ভাবেই আদিম মানব সমাজে মারণ-স্তম্ভন-উচাটন-বশীকরণ প্রভৃতি ধর্মজাদুর ক্রিয়াকলাপ প্রচলিত হয়। বিভিন্ন বেদে, বিশেষত অথর্ববেদে যার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত আছে। অদৃশ্য শত্রুর বাণে মানুষকে আহত-নিহত হতে দেখবার অভিজ্ঞতা থেকে কারো অসুখ করলেও আদিম মানুষ কল্পনা করত যে কোন গুপ্ত শত্রু বাণ মেরেছে, আর এ ভাবেই ওঝা গুনিন ডাকা এবং ডাইনি নিধন আরম্ভ হয়। বলা বাহুল্য, এসব ধর্মজাদুর প্রচলন বর্তমান কালেও দেখা যায়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অথবা চাকুরীক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বীকে মারণযজ্ঞে বিনাশের চেষ্টা, অথবা অসুখ-বিসুখে ওঝা-গুনিন ডাকা, কিংবা বাণ-মারা ডাইনির নিধন তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে আজও বহুল প্রচলিত।
এরপরে সূর্য, চন্দ্র, বাতাস, ঝড়, বৃষ্টি, নদী, পাহাড় প্রভৃতি শক্তিশালী (উপকার কিংবা অপকার সাধনে সক্ষম) প্রাকৃতিক বস্তুগুলোকে মানুষ যখন যজ্ঞে ঘোড়া-মোষ-মদ্য প্রভৃতি আহুতি দিয়ে স্তুতি (মন্ত্র) করতে আরম্ভ করলো, তখন থেকেই প্রচলিত হলো নিয়মিত জাদুভিত্তিক ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের পরম্পরা। আর এই যজ্ঞ-ব্রত-পুজো-উপাসনা প্রভৃতি নিয়মিত ক্রিয়াকলাপের মধ্যে নির্মিত হলো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ভিত্তি। ধীশক্তি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনুন্নত প্রাচীন মানুষ প্রাকৃতিক বস্তু বা শক্তিগুলোকে প্রাণহীন, নিরাকার এবং নৈর্ব্যক্তিক বলে ভাবতে পারত না। সে তাদের মানুষের প্রকৃতিসম্পন্ন সজীব সত্তা বলেই জ্ঞান করতো। যারা ইচ্ছেমতো মানুষের উপকার কিংবা অপকার করবার ক্ষমতা রাখে। আর সে ক্ষমতা এত বেশি যে তা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাদের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক মানুষ সে ভাবেই কল্পনা করত, যে ভাবে তার অভিজ্ঞতায় মানব সমাজে গড়ে উঠেছিল দেনা-পাওনার সম্পর্ক।
ক্ষমতাবান মানুষকে যেমন ভোগ্যদ্রব্য উপহার দিয়ে এবং স্তবস্তুতি করে কার্যসিদ্ধি করা যায়, তেমনি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন দেবদেবী রুপী প্রাকৃতিক বস্তুগুলোকে যাগযজ্ঞ-পূজোপার্বণ এর মাধ্যমে নানা রকম খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য ভোগ্যদ্রব্য উপহার দিয়ে কল্পনায় তাদের দিয়ে প্রাচীন মানুষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির চেষ্টা করতো। বৃষ্টির জন্য, ভালো ফসলের জন্য, অনেক গবাদি পশুর জন্য, অনেক পুত্র লাভের জন্য, দীর্ঘ আয়ুর জন্য, সুস্বাস্থ্যের জন্য, বিপুল ধনৈশ্বর্যের জন্য, দেবদেবীদের পুজো-প্রার্থনায় তুষ্ট করে তাদের কাছ থেকে সেসব আদায়ের চেষ্টা করতো। তেমনি ভাবে খরা, বন্যা, ভূমিকম্প, রোগ, মহামারী, বন্য জন্তুর আক্রমণ, শত্রুর দ্বারা অনিষ্ট সাধন প্রভৃতি জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর প্রভাবগুলো থেকে মুক্ত হবার জন্যও মানুষ একই ভাবে কল্পিত দেবদেবীদের কাছে প্রার্থনা করতো।
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
0 Comments