জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম ---পর্ব-২২/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম --পর্ব-২২

সন্দীপ কাঞ্জিলাল


ধর্ম ও মানুষ

যেসব দেশে দারিদ্র, বেকারি ও অশিক্ষা প্রবল, সেখানে ধর্মের প্রকোপও বেশি। কিন্তু পৃথিবীর কোনো দেশেই আজ পর্যন্ত এমন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি যেখানে মানুষের অনিরাপত্তা বোধ সম্পূর্ণ দূর হতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যখন এই সামাজিক অনিরাপত্তা থেকে মুক্তি খোঁজে, তখন সে মাতাপিতার কাছে বাল্যকালের সুরক্ষা পায় না। কারণ তখন মাতাপিতা হয় মৃত, অথবা বৃদ্ধ এবং অশক্ত। কিন্তু মাতা-পিতার দেওয়া বাল্যকালের সুরক্ষার স্মৃতি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মগ্নচৈতন্যে বাসা বেঁধে থাকে। তাই সে জাগতিক পিতা-মাতার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন দেবদেবী, অথবা সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরের সুরক্ষা কামনায়, তাদের মাতাপিতা রূপে কল্পনা করে, এবং সেভাবেই তাদের ডাকে, স্তুতি করে, তাদের কাছে প্রার্থনা করে। এ প্রার্থনায় হাজারো অনিরাপত্তা থেকে সুরক্ষার আকুতির সঙ্গে থাকে হাজারো ইচ্ছাপূরণের বাসনা। এ বিষয়ে প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমাণ্ড ফ্রয়েড তার বিভিন্ন গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। অনেক সময় আবার কোনো গুরুতর বিপদ বা গভীর সমস্যা নিয়ে নিবিড় চিন্তার মধ্যে হঠাৎ মনে হয় বুঝি আমার ভেতর থেকে কিংবা বাইরে থেকে কোন দৈববাণী হলো, যেখানে রয়েছে আমার সমস্যার উত্তর এবং কর্তব্যের নির্দেশ।

 অনেক মনোবিজ্ঞানী এ ধরনের দৈববাণী বা প্রত্যাদেশকে ব্যাখ্যা করেছেন শৈশবে মাতাপিতার আদেশ উপদেশের মগ্নস্মৃতির আত্মপ্রকাশ রূপে, যা ব্রেনের মেমোরি সেল বা স্মৃতি কোষগুলোর মধ্যে সুপ্ত থাকে এবং সংকটের সময়ে সেখান থেকে জেগে উঠে মানুষের কাল্পনিক ইচ্ছাপূরণ করে। এরকম বিভিন্ন ধরনের ইচ্ছাপূরণ জীবনের অনিরাপত্তা বোধ এবং সংকট অনুভূতিরই ফলশ্রুতি। ধর্মবিশ্বাসের মূলে অনিরাপত্তা বোধের ভূমিকা থেকে অনিবার্যভাবেই এই সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে প্রাকৃতিক পরিবেশজনিত অনিরাপত্তা দূর হবার পরে সেভাবেই যদি জাগতিক পরিবেশ থেকে উৎপন্ন অনিরাপত্তা বোধকেও দূর করা যায়, তবে মানুষের ধর্মবিশ্বাসের প্রয়োজনও অনেকখানি কমে যাবে। অর্থাৎ মানুষের সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির যদি কোন দিন এমন রূপান্তর সাধন করা যায়, যার ফলে সামাজিক অনিরাপত্তার কারণগুলো দূর হয়ে যাবে, তবে সে অনুপাতে ধর্মের পায়ের তলা থেকেও মাটি সরে যাবে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের সমাজ যদি একদিন সাম্য, স্বাধীনতা ও মৈত্রীর ত্রয়ী আদর্শের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, ব্যক্তিমানুষের কোন মৌলিক জাগতিক অভাব না থাকে, উচ্চশিক্ষা এবং বিজ্ঞানসাধনা সর্বজনীন হয়, কায়িক শ্রম আর মেধাশ্রমের মধ্যে পার্থক্য ঘুচে যায়, সংস্কৃতি চর্চার জন্য সব মানুষের যথেষ্ট সমান সময় ও সুযোগ থাকে, তবে সে অনাগত সত্যযুগে বর্তমানে প্রচলিত শাস্ত্রভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রয়োজনও ফুরিয়ে যাবে। মৃত্যু অবধারিত এবং মানব জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি জেনে মানুষ সেদিন পরলোকে নিজ আত্মার সুরক্ষায় যত্নবান না হয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কালে নিজের এবং সব মানুষের জীবনকে সুরক্ষিত ও সৌন্দর্যময় করে তুলতেই বেশি আগ্রহী হবে। 

কিন্তু একথা মনে করলে ভুল হবে যে অনিরাপত্তা বোধের নেতিবাচক কারণই ধর্মের একমাত্র উৎস। মানুষ মহাবিশ্বকে বুঝতে চায়। মহাবিশ্বের পটে নিজ ক্ষুদ্র অস্তিত্বের স্থানাংক নির্ণয় করতে চায়। পৃথিবীতে শুভ-অশুভের ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়ায়। মানুষে-মানুষে সম্পর্কের নৈতিক ভিত্তির অনুসন্ধান করে। এসব জিজ্ঞাসা এবং তার সহজ উত্তরের অভাবও ধর্মবিশ্বাসের একটি বড় কারণ। অজানার বিরহ, মহাবিশ্ব এবং মানুষের বর্তমানও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে  সত্য জ্ঞানের অনিশ্চয়তা, নিজ ধীশক্তির সীমাবদ্ধতা, এবং নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে পীড়িত করে। পৃথিবীতে খুব অল্পসংখ্যক মানুষই সে আধ্যাত্মিক বেদনা সানন্দে সইতে পারে। মহাবিশ্ব ও মানব জীবন সম্বন্ধে কঠিন প্রশ্নগুলোর যে সহজ উত্তর ধর্ম মানুষকে দেয়, তাতে বিশ্বাস করে অধিকাংশ ব্যক্তিমানুষ অন্তরে স্বস্তি পায়। এভাবে তাদের পক্ষে চিন্তার সংকট এবং অস্তিত্ব বিরহ সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। ধীশক্তির পরিসীমার মধ্য থেকে ধর্মের সুড়ঙ্গ পথে পালিয়ে গিয়ে মানুষ মহাবিশ্ব সম্বন্ধে নিজ অজ্ঞনতার সংকট থেকে মুক্তি খোঁজে। 
অবশ্য মহাবিশ্ব সম্বন্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন বা চিন্তা পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের আদিপর্বে ছিল না।

 কারণ মানুষের চেতনা তার জাগতিক অভিজ্ঞতার বিবর্তনের মধ্য দিয়েই বিকশিত হয়। আদিম মানুষ পূর্ণ চৈতন্য নিয়ে আবির্ভূত হয়নি। সে নিজেও যেমন জীবজগতের বিবর্তন থেকে উদ্ভূত, তার চৈতন্যও তেমনি তার জাগতিক পরিবেশে ক্রমশ বিবর্তিত। নৃবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে একমত যে কৃষিযুগের আগে পর্যন্ত মানুষ মহাবিশ্ব সম্বন্ধে ভাবেতে শেখেনি। কৃষির উপর নৈসর্গিক শক্তিগুলোর প্রভাব লক্ষ্য করেই মানুষ প্রথম মহাবিশ্বের সঙ্গে পৃথিবী এবং মানুষের সম্পর্ক বিষয়ে সচেতন হয়েছে। কিন্তু তখনও নৈসর্গিক বস্তুগুলো সম্বন্ধে, এবং পৃথিবী সম্বন্ধে মানুষের কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। মধ্যযুগ পর্যন্তও এসব বিষয়ে এমন কি শিক্ষিত মানুষেরাও চূড়ান্ত ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করত। সাধারণ মানুষের তো কথাই নেই। ইউরোপের বৌদ্ধিক নবজাগরণের পর থেকে বিজ্ঞানের অগ্রগতির মাধ্যমেই এসব ভ্রান্ত ধারণা ক্রমশ দূর হচ্ছে। আর প্রথম কৃষিযুগের প্রাচীন মানুষের মহাবিশ্ব সম্বন্ধে সচেতনতা যে অত্যন্ত সীমিত এবং প্রায় সম্পূর্ণই কল্পনাশ্রয়ী ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই কল্পনাশ্রয়ী, অবিকশিত মহাবিশ্বচেতনা ছিল প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের অন্যতম কারণ। তখন মানুষ স্রষ্টা নিয়ন্তা পিতা ঈশ্বর এবং দেবদেবী ও দেবদূতদের মাধ্যমে তার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কল্পনা করত। আর মিথ কিংবা কাল্পনিক অতিকথার মধ্যে ছবি রচনা করতো তার আধফোটা মহাবিশ্বচেতনা। 

অধুনা জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতির মধ্যেও ঈশ্বর দেবদেবী দেবদূতের সে প্রাচীন কল্পনাগুলো মানুষের মগ্নচৈতন্যে বেঁচে আছে। হাজার হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় প্রাচীন ধর্মীয় কল্পচরিত্রগুলোর ভাবমূর্তি মানুষের সত্তার গভীরে বাসা বাঁধে। সেগুলোর ক্ষয় হতে বহুকাল কেটে যায়। এ বিষয়ে প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী কার্ল ইয়ং গভীর বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে প্রাচীনকাল থেকে সাংস্কৃতিক পরম্পরার মধ্য দিয়ে সমষ্টিগত মানব জীবনের অচেতন গভীরে কতগুলো নির্দিষ্ট কাল্পনিক ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে, এবং সেগুলো অজান্তে মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে প্রভাবিত করে। এ কারণেই ধর্মপ্রাণ মানুষ অনেক সময়ে নিজ ধর্মের ঈশ্বর বা দেবতাকে নিজের পরিচিতি রূপে দেখতে পান বলে মনে করেন। খ্রিষ্টান যীশুকে, মেরীকে, বা কোন খ্রিস্টধর্মীয় সন্তের কল্পকায়া দেখেন। হিন্দু দেখেন কালী, শিব, বিষ্ণু, কৃষ্ণ, রাম বা হনুমানের আবির্ভাব। এক ধর্মের মানুষ কখনো অপর ধর্মের মানুষের দেবতা বা দেবদূতকে দেখেন না। কারণ কোন ছবিই বাস্তব নয়। বহু পুরাতন ধর্মীয় সাংস্কৃতিক পরম্পরার মাধ্যমে ব্রেনের মেমোরি সেলগুলোতে সঞ্চিত এবং মগ্নহচৈতন্যে রক্ষিত কল্পকয়াগুলো গভীর ইচ্ছাপূরণের আগ্রহে কল্পমূর্তিতে অলীক দর্শনের অনুভূতি দেয় মাত্র। এ ভাবেই প্রাচীন আধফোটা মহাবিশ্বচেতনার ফসল মানুষ আজও ধর্মের পৃথিবীতে কুড়িয়ে চলেছে।

Post a Comment

0 Comments